X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

যৌনতার ছদ্মবেশে খোঁজা জীবনের মানে

রাজু আলাউদ্দিন
০৪ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০

বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের এমন কয়েকজন কথাসাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে যাদের লেখা আমি আগ্রহের সাথে অনুসরণ করে আসছি অনেকদিন থেকে। হামীম কামরুল হক আমার সেই আগ্রহের কেন্দ্রে অবস্থান করেন। হামীমকে কেবল কথাসাহিত্যের জন্যই নয়, প্রবন্ধের জন্যও তিনি আমার প্রিয় তালিকার একজন প্রাবন্ধিক। হামীমের নানামুখী পড়াশোনা কারোর  কাছেই অজানা নয়। সাহিত্যবিষয়ক পাঠে হামীমের পাণ্ডিত্য আমাকে মুগ্ধ করে। তার কথাসাহিত্যে এই পাঠের নির্যাস, শিল্পকৌশল ও বয়ানের কল্যাণে এমনভাবে মিশে আছে যা গুণানুরাগী পাঠক ঠিকই টের পাবেন। অন্যদিকে,  পাণ্ডিত্যবিমুখ পাঠকও তাতে নিপীড়িত বোধ করেন না কোনোভাবে। অর্থাৎ, হামীম একইসঙ্গে সাধারণ ও মননশীল পাঠক—উভয় পক্ষকেই তুষ্ট রাখার শিল্পকৌশলকে সযত্নে রক্ষার মুনশিয়ানা ধরে রেখেছেন তার উপন্যাস ও গল্পসম্ভারে।

হামীমের এই পর্যন্ত প্রকাশিত ১৮টি গ্রন্থের ৭টিই উপন্যাস। আর এর সাথে দুটি নভেলা যুক্ত করলে সংখ্যাটি দাঁড়াবে ৯-এ। আমি মাস দুয়েক আগে তার সর্বশেষ উপন্যাস যেখানে খুঁজেছ তুমি জীবনের মানে পড়ে শেষ করেছিলাম। তৎক্ষণাতই বইটি নিয়ে লিখতে শুরু করতে গিয়েই অন্যসব উটকো কাজের ঝামেলায় আর শেষ করতে পারিনি। এই উপন্যাসটির একটা বিশেষত্ব এই যে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে যৌন-উপাদানকে ব্যবহার করা। সাহিত্যে যৌন উপাদান ব্যবহার করা প্রসঙ্গে আমাদের হয়তো মনে পরবে পর্ন হয়ে ওঠার আশংকা সম্পর্কে ডি এইচ লরেন্সের সেই সতর্কতা:

‘Pronography is the attempt to insult sex, to do dirt on it.’

লরেন্সের এই উক্তি আমাদের এটাই বলতে চায় যে সেক্স বা যৌনতাকে যদি সঠিকভাবে ব্যবহার না করতে পারি তাহলে সেটা শেষে পর্ন হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু দক্ষ শিল্পীর হাতে যে তা হয় না আমরা হামীমের আগে সৈয়দ শামসুল হকের খেলা রাম খেলে যা উপন্যাসে দেখেছি। কিন্তু হামীম এই উপন্যাসে খেলা রাম খেলে যা-এর চেয়ে আরও বেশি খোলামেলাভাবে যৌনতাকে ব্যবহার করেছেন। এর ফলে পর্ন হয়ে ওঠার ঝুঁকি ছিল আরও বেশি। হামীম যে এই ঝুঁকি সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন সেটা বোঝা যায় এটিকে কেবল সুখপাঠ্য হিসেবে গড়ে তোলার মধ্যে নয়, বরং জীবনার্থের উপায় খোঁজার মধ্যে।

এই গ্রন্থে টিকলি নামের যুবতী প্রধান চরিত্র যে কিনা যৌনতার এক আগ্নেয়গিরি। কারনাইনের সাথে তার সম্পর্ক ও সঙ্গমের বয়ান এসেবে উপন্যাসের কয়েক পৃষ্ঠা পেরুনোর পরপরই:

“টিকলি সকালে গিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত, অনেকটা সময় হলে তার কারনাইনের জন্য বরাদ্দ কক্ষে কাটিয়েছে। দুজনে এক সঙ্গে পড়ালেখা করেছে। শারীরিক-ক্ষুধা বোধ করামাত্র মিলিত হয়েছে। দিনে কতবার যে মিলিত হয়েছে, তার কোনো হিসাব ছিল না। অনেক সময় সারাদিনই সঙ্গম করেছে। কক্ষের এক কোণে একটা পুরোনো দুধের টিন রাখা থাকত, তাতে পেশাব করেছে। আর থাকত শুকনো খাবার, চার-পাঁচ বোতল পানি। সঙ্গম করো, আবার পানি খাও আর পেশাব করো। সারাদিন গায়ে কাপড় তোলা হতো না। এমন দিনও কত গেছে—সঙ্গম করেই কারনাইন বসে যেত পড়ার টেবিলে। টিকলি বিছানায়, গায়ে কোনো কাপড় নেই। আধশোয়া হয়ে এমনিই শুয়ে, বা কোনো পত্রিকা পড়ছে। মিনিট পনের পরে কারনাইন আবার শুরু করে দিল। অথবা কারনাইন পড়তে পড়তে পড়ার অনেক গভীরে চলে গেছে, পরনে একটা শর্টস, হঠাৎ টিকলি পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল। পিঠে ঠেসে ধরে রাখা তার বিশালবিরাট স্তন ও স্তনবৃন্তের স্পর্শে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতপ্রবাহ। টিকলিকে সামনে টেনে এনে চেয়ারে বসে বসেই কাজটা সম্পন্ন করার কত না দিন গেছে। সেই হলে যাওয়া নিষিদ্ধ হয় এক ছাত্রসংগঠনের নেতার শতনারীর ধর্ষণপূর্তির কথা রটে গিয়ে। শুরু হয় ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন।” (পৃষ্ঠা ২২)

প্রায় পর্নপ্রতিম রগরগে বর্ণনা কোন মোহনায় গিয়ে মিলিত হয় সেটা লক্ষ্য করলেই হামীমের উদ্দেশ্যটি পাঠকদের কাছে পরিস্কার হয়ে উঠবে পরের প্যারাটি অনুসরণ করলে:

“ছেলেমেয়েদের এমন স্বর্গীয় মুক্তমেলামেশার ওপর নেমে আসে নিষেধাজ্ঞা। হলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ করে সঙ্গমের সহজ স্থান হারানোর ফলে, অনেক প্রেমিকাকেই মুখমৈথুন শিখে নিতে হয়। সন্ধ্যার অন্ধকারে কেন্দ্রীয় মাঠের ভেতরেই প্যান্টের ফ্লাই খুলে কোলের কাছে মুখ ওঠা নামার নতুন বিদ্যা শিখে নেওয়া ছাড়া তাদের আর গত্যন্তর থাকে না। টিকলিরও থাকেনি। তার সেই অপূর্ব কৌশলের ফল তুমিও ভোগ করলে। যিশু যে-বয়সে ক্রুশবিদ্ধ হন, তুমি সে বয়সে মুখবিদ্ধ হলে, টিকলির সেই অনিন্দ্যকলাকৌশলে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ের দল বহুদিন নিষিদ্ধ। তারা মিশে গিয়েছিল প্রগতিশীলতার ছদ্মবেশে। ফলে তারা নিষিদ্ধ না-থাকা অবস্থায় যা পারেনি, দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ থাকার পর তলে তলে কার্যক্রম চালানোর ভেতরে এই ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনও একটা ফল এবং প্রগতির মূল দিকের একটা যে নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশার ভেতর দিয়ে যে সম্মানবোধ তৈরি হয়, তার বিপরীতে, ক্যাম্পাসে নামিয়ে আনে রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপ। তলে তলে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতিক্রিয়াশীলতা এইভাবে পেছন থেকে ছুরি মারতে পারে প্রগতির বুকে (পেছন থেকেই যদি হয়, তাহলে ‘পিঠে’ হওয়াই কি সঠিক নয়?—আলোচক)।” (পৃষ্ঠা ২২-২৩)

হামীম কামরুল হক হামীম, যৌনতার মুখোশ পড়ে প্রবেশ করেন আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার চোরাগুপ্তা স্রোতে। এমনকি ধর্মের মতো গনগনে স্রোতেও তিনি অবগাহন করেন স্বাচ্ছন্দ্যে। ধর্মের সত্যতা ও প্রাসঙ্গিকতাকে তিনি প্রশ্নের মুখে ফেলে দেন এই অমোঘ এক সন্দেহকে ঘনীভূত করে:

“টিকলি বলে, পৃথিবী গোলাকার, তাহলে পৃথিবীর ওপর কোনটা? ওপর থেকে নাজিল হয় যে বলে, কোনো কিছুই ওপর থেকে নাজিল হয় না। আর পৃথিবীর ইতিহাস কয়েক লক্ষ বছরের। ধর্মের ইতিহাস মাত্র আট হাজার বছরের। এই একটি হিসাবেই তো ধর্ম আর টিকে না।”( পৃ ৫৫)

প্রথমেই বলেছি, যে এই গ্রন্থে হামীম অপূর্ব সাহসিকতায়, সম্ভবত প্রথমবারের মতোই এতটা হিম্মতের সাথে যৌনবিবরণকে আমাদের সংস্কারের বিবর থেকে বের করে এনে চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। আর তাই এই উপন্যাসে মাঝেমধ্যেই পাতার পর পাতা যৌনতা ফুলে ফেঁপে ওঠে মাংশল নিতম্বের মতো, কিংবা পরিপুষ্ট স্তনের মতো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। হামীমের আগে মনে হয় না, বাংলা ভাষায় আর কোনো লেখক এতটা উন্মোচনের সাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু এইসব বিবরণে পাঠক আবিষ্ট হওয়ামাত্র পাঠককে জীবনের নিহিতার্থের দিকে নিয়ে যান হীরোকোজ্জ্বল দার্শনিক উপলব্ধির মাধ্যমে:

“টিকলি বলেছে, এক নারীতে বিশ্বস্ত থাকা আর কৌমার্য বজায় রাখার ভেতরে খুব একটা পার্থক্য নেই।” (পৃ ২৪)

কিংবা

“যেখানে উঞ্চতা নেই, সেখানে সম্পর্কও নেই।” (পৃ ২৪)

এই যৌনতার সূত্রেই হামীম এক সময় ফ্রয়েডিও এক ধারণাকেই এমন এক সৃজনশীল প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেন যাকে কোনোভাবেই উটকো মনে হয় না:

“কবি তোমাকে বলেছিল, কেন মেয়েটির এই ছেলেঘেঁষা স্বভাব? এর কারণ তার যৌনচাহিদা নয়, মানে সেটি প্রধান নয়। প্রধান হলো : পিতৃস্নেহের সন্ধান। সারাজীবন এই ধরনের মেয়েরা পুরুষের কাছে, তাদের না-দেখা পিতা, না-পাওয়া পিতৃস্নেহ খুঁজে বেড়ায়।” (পৃ ১৮)

কিংবা আরও কিছু দূর এগিয়ে হামীম কথকের মুখ দিয়ে আমাদেরকে শেষ পর্যন্ত এমনও শোনাতে চান যেন এই যৌনতা আসলে মূখ্য নয়, মূখ্য হচ্ছে মানুষের অন্তর্লীন পরিচয়টিকে উন্মোচন করা:

“লোকে শুধু শোয়াটাকেই দেখে—এর ভেতর দিয়ে যে মানুষকে জানা যায়, তা কেউ ভাবে না।” (পৃ ৪৮)

উপন্যাসটি বাস্তবসম্মত শর্ত ধরে এগিয়ে গেলেও হামীম এর শেষ পৃষ্ঠায় এসে আমাদেরকে সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেন এর সত্য ও বাস্তবতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশের মাধ্যমে। কেন তাকে এটা করতে হলো? হামীম কি তাহলে আমাদেরকে এতক্ষণ যা বলেছেন তা সত্যি ছিল না, ছিল না বাস্তবসম্মত? মারিও বার্গাস যোসার মতো তিনি আমাদেরকে তাহলে এই কথাই বলতে চাচ্ছেন যে কথাসাহিত্য আসলে Truth of lies? নাকি এই কথাটাকেই ঘুরিয়ে তিনি বলতে চাচ্ছেন lie of truth? হামীম শেষ পৃষ্ঠায় এই দুয়ের কোনোটারই পক্ষ না নিয়ে বরং দুটোকেই গুলিয়ে যা বলেন তা এই:

“বর্ণিত সমস্ত ঘটনাই অবাস্তব, ফলে এসব সত্য কিনা—সে কথা বলার আর কোনো অবকাশও থাকে না, কারণ সত্য ও বাস্তবতা যে এক নয়, সেই কথা কেউ কেউ মানেন, কেউবা সংশয় প্রকাশ করেন, মোদ্দা কথা হলো : বাস্তবে এই সব ঘটনা ঘটবার কোনো স্থানকালপাত্র নেই। কাহিনিতে সে সব সত্য হলেও হতে পারে, কারণ কথাকাহিনিতে সত্য কথা বানিয়ে বানিয়ে বলতে হয়। তাই টিকলি বলে কেউ নেই, আর সৌমিক পারভেজ মুন বলে যদি কেউ থাকে, সে এখন ভূতের মতো কোথাও হয়ত আছে, হয়তবা নেই।” (পৃ ১২৮)

তাহলে আমরা এতক্ষণ যা পড়েছি তা আসলে সত্যও হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে। কিন্তু লেখক আমাদেরকে কোনো দিকেই ঝুঁকে পড়ার পরামর্শ দেন না। ঠিক যেমনভাবে হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামো উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে বাস্তব মনে হলেও আসলে তারা বহু আগেই মরে ভূত হয়ে গিয়েছিল।

হামীমকে অভিনন্দন জানাই আমাদেরকে এমন একটি অনন্যসাধারণ উপন্যাস পাঠের সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

যেখানে খুঁজেছ তুমি জীবনের মানে।। হামীম কামরুল হক।। প্রকাশক : গ্রন্থকুটির।। দাম : ১৭৫ টাকা।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপে কোনও অগ্রগতি হয়নি: ট্রাম্প
পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপে কোনও অগ্রগতি হয়নি: ট্রাম্প
আ.লীগ নেতার বাড়িতে চাঁদাবাজির অভিযোগে পুলিশ সদস্য আটক
আ.লীগ নেতার বাড়িতে চাঁদাবাজির অভিযোগে পুলিশ সদস্য আটক
হিজরি সনের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক গভীর যে কারণে
হিজরি সনের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক গভীর যে কারণে
চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল