X
বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
৩১ বৈশাখ ১৪৩২

তাও তে চিং ।। সাধুবাদ দূর কর, জ্ঞান বাদ দাও

জাহেদ সরওয়ার
০৬ এপ্রিল ২০১৮, ১০:১১আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:৪৪

তাও তে চিং ।। সাধুবাদ দূর কর, জ্ঞান বাদ দাও

তাও তে চিং প্রাচীন চৈনিক দর্শন গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম। ৮১ টা প্যারায় কবিতা আকারে লেখা কিছু দার্শনিক উপদেশমালা নিয়ে এই বই। একে লাউৎস কথিত জীবনবাদও বলা হয়। বইয়ের উপদেশগুলো একজন লাউৎস লিখেছেন? না একাধিক পণ্ডিত লিখেছেন? তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। জগতের বহু ভাষায় অনূদিত এই বই বহু পণ্ডিতের মনোযোগ কেড়েছে। কারণ দ্বন্দ্বের অপরপিঠ, প্যারাডক্স। এটা পড়ার অভিজ্ঞতা একেকজনের একেকরকম হতে পারে। প্রথম পাঠে চার পাঁচটা কবিতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। দ্বিতীয় পাঠে উঠে আসে আরও কয়েকটা। এভাবে প্রতিটি কবিতাকেই ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। প্লাতনের মতো তাও তে চিংয়েও একটা ফর্ম বা স্ট্রাকচার ধরে নিয়ে কথা বলেন। সব নীতিইতো আসলে অ্যান্টি ক্যাপিটালিস্ট— সে অর্থে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে কবিতাগুলো সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে। তবে যে স্ট্রেসলেস জীবনের কথা উক্তিগুলোর ভেতর  দিয়ে বেরিয়ে আসে সেটা বৈপ্লবিক অন্তত এখনকার যুগে। কারণ পৃথিবীর গতি সামনের দিকে পিছনের দিকে নয়। পৃথিবীর অ্যাথিকেল দার্শনিকরা যে স্ট্রাকচার বা ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন— প্রশ্ন হতে পারে তারা কি মানুষের এনাটমি জানতেন? এই এথিকসের ধারণা বা কল্পনা তাদের কীভাবে এসেছিল? মানুষের সেলফিশ জিন সম্পর্কে কি তাদের ধারণা ছিল?

তবে এটাও ভাবনার বিষয় যে মানুষ এথিকসের বোধ যদি হারিয়ে ফেলত— তাহলে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো এই ক্ল্যাসিকটি  কীভাবে এখনো টিকে আছে। সান জু, কনফুসিয়াস ও লাউৎস প্রায় সমসাময়িক। লাউৎস শব্দের অর্থ বয়স্ক জোয়ান আর তাও তে চিং মানে সঠিক পথের নিশানা। এখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলা হয়েছে। সেটা শাসক বা শাসন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন মানুষের আচরণ সম্পর্কেও।

এখনকার জমানা সোজা কথায় পুঁজিতান্ত্রিক জমানা। কারণ ক্রয়-বিক্রয় অযোগ্য কোনো মানুষ বা বস্তুর কোনো দাম নেই এখন দুনিয়ায়। লাউৎস বলবেন, পয়সা আর সম্মানের সাথে আসে দেমাগ/ সাথে করে আনে বহু দোষ। কথাতো মিলে যায়, এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে এই দোষগুলোই যেন ক্যাপিটালিজমের অলঙ্কার।

শাসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, নিজের ভেতর যেই জন্তুর বাস/ তাকে এক ও অদ্বিতীয়ে বেঁধে রাখতে পার?/ নিশ্বাসকে বন্দি করে, নিজেকে নরম কর/ শিশুর মতো হতে পার?/ ... মানুষকে ভালোবেসে, দেশ শাসন করেও/ নিজেকে রাখতে পারো সবার অগোচরে? / এদের বাঁচাও, এরা গড়ে উঠুক/ বাঁচাও কিন্তু অধিকার করতে চেয়ো না/ খেটে চলো কিন্তু নির্ভর করো না/ প্রধান হও কিন্তু প্রভুত্ব করো না/ এই সেই রহস্যময় শক্তি।

কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে আমাদের বলতে হবে জগতে একজন শাসকেরও এই মহত্ব ছিল কিনা বা আছে কিনা সন্দেহ। কারণ শক্তির বা পুঁজির নিজস্ব একটা ধর্ম আছে সেটা আক্রান্ত করে শাসককে। মানুষের স্বভাবই নিজেকে নিজের আয়তনের বাইরে নিয়ে যাওয়া। এই জন্য দুনিয়ায় কোনো অ্যাথিকেল রাষ্ট্র গড়ে উঠেনি। টমাস মোরের ইউতোপিয়া, ভলতেয়ারের অ্যালদোরাদো বা মার্কসের সাম্যবাদী রাষ্ট্র হয়তো সে সব বাস্তব হবে বহুযুগ পরে।

সাতান্ন নাম্বার কবিতায় তিনি বলছেন, বাধা নিষেধ জগতে যতই বাড়বে/ মানুষ হবে ততই গরিব/ মানুষের হাতে ধারালো অস্ত্র যতই জমবে/ দেশে ততই বাড়বে গোলমাল/ মানুষ যত বেশি পটু হবে/ ততই বাড়বে ফন্দিফিকির/ আইনকানুন যতই বাড়বে/ বাড়বে ততই চোর ডাকাত।

কি অব্যর্থ কথা আসলেইতো প্রচুর আইনকানুনের উদ্ভব মানেতো প্রচুর অপরাধ। সে দেশগুলোর তুলনামূলক আলোচনা করলেই বুঝা যায়, সুইডেন প্রভৃতি দেশে নাকি কারাগার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে— অপরাধীর অভাবে অথচ আমাদের দেশে প্রতিদিন বাড়ছে নতুন নতুন আইন। জেলখানাগুলোতে লোকধারণের যেন আর ক্ষমতা নেই। মানুষ বেশ পটু হয়ে উঠছে আর চারদিকে শুধু ফন্দিফিকির লোক ঠকানো।

ছেষট্টি নাম্বার কবিতায় তিনি বলেন, নদী আর সাগর / কি করে হয় শত উপত্যকার রাজা?/ এদের নিচু হবার যোগ্যতা আছে।/ জনসাধারণের প্রধান হতে চাইলে/ নিচু কর তাদের চেয়ে স্বর/ যদি জনসাধারণের সামনে থাকতে চাও/ তবে নিজের শরীর নিয়ে থাকতে হবে সবার পিছনে।

রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কে আরও বেশ কয়েকটি কবিতা আছে। এখানে সবখানেই শাসককে বলা হয়েছে তিনি হবেন প্রজ্ঞার আঁধার তবে কৌশলীও। প্লাতনের আদর্শ রাষ্ট্রের তিনি প্রজ্ঞাবান শাসকদের কথা বলতেন। তাও বলেন, একটা বড় দেশ শাসন কর/ একটা ছোট মাছ ভাজার মত দক্ষতায়/ বেশি তাপ দিলে মাছ পুড়ে ছাই হয়।

তাও তে চিংয়ের দর্শনকে সহজিয়া দর্শনও বলা হয়ে থাকে। আমাদের ভাষার গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক লালনকেও প্যারাডক্সিকাল দার্শনিক বলা যেতে পারে। মহাত্মা লালন সাইয়ের যে সহজ মানুষ তার সঙ্গে লাউৎসের যে সহজ মানুষ তার অনেক মিল রয়েছে। যা আছে তা আছে আবার যা নেই তাও আছে। লালন সাই বলেন বাড়ির পাশে আরশিনগর। সেথায় এক পড়শি বশত করে আমি একদিনও না দেখিলাম তারে। লাউৎস বলেন, সুন্দর আছে বলেই আমরা জানি কুৎসিত কি/ মঙ্গল আছে বলেই চেনা যায় অমঙ্গলকে/ থাকা আর না থাকা দুটো একই। লালনের দিব্যজ্ঞান আর লাউৎসের পরমজ্ঞান যেন হাত ধরাধরি করে চলে। লালনের শুন্যের মাজার আর লাউৎসের ফাঁক। লাউৎস বলেন, ত্রিশটি ডাটা মিলে থাকে চাকার মাঝে/ তবু গাড়ির ব্যবহার ভিতরের ফাঁকটুকুর জন্য/ মাটি দিয়ে আমরা করি পাত্র/ পাত্রের ব্যবহার ভেতরের ফাঁকটুকুর জন্য/ ঘর বানাই দরজা জানলা খোদাই করে/ তবু ঘরের ব্যবহার ভিতরের ফাঁকটুকুর জন্য/ যা আছে তাকে দিয়ে জানি যা নাই তার দাম।

লাউৎসকে বুদ্ধ, লালন, আর মার্কসের অনেক কাছাকাছি মনে হয়। সে সব সমান্তরাল দৃশ্যমানতা নিয়ে হয়তো অনেক গবেষণা হতে পারে। সাধারণের দুর্দশা আর ক্ষুধার প্রতি লাউৎস সহানুভূতিপ্রবণ।  উচ্চহারে কর স্থাপন, সামন্তীয় সম্রাটদের শোষণ আর নিষ্ঠুর আইন কানুনের বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। তিনি যুদ্ধ বিগ্রহের বিরোধিতা করে গেছেন।  বলেছেন সবচেয়ে বড় যুদ্ধ নিজেকে জয় করা। কত পরিচিত মনে হয় তার শ্লোকগুলো আমাদের। তিনি বারবার জনমুখী শাসকের পক্ষে কথা বলেছেন। লাউৎসের ফর্ম ছিল সম্ভবত প্রাগৈতিহাসিক শ্রেণিহীন সমাজ। তিনি তথাকথিত জ্ঞান যা সবসময় ধনিক বা বণিক শ্রেণির পক্ষে গেছে সেসবের সরাসরি বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন, বুদ্ধি আর জ্ঞান দেখা দিলেই আসে মহা শঠতা।/ অরাজকতা দেখা দিলেই আসেন রাজমন্ত্রী। সত্যিইতো তাই, অপরাধ দেখা দিলেই শাস্তি দেয়ার রাষ্ট্র আসে কিন্তু রাষ্ট্রতো অপরাধ দূর করতে পারে না।

তাই তিনি বলেন সাধুতাকে দাও নির্বাসন আর বাদ দাও জ্ঞান। কি ভয়ংকর প্রতিবাদ। এ যেন শেষ আঘাত প্রচলিত জ্ঞানগর্ভ সভ্যতার মুখে চপেটাঘাত। আসলে আজকে জ্ঞান যা বিজ্ঞান যা তাতো ব্যবহৃত হচ্ছে সাধারণের বিরুদ্ধে। জীবন বিধ্বংসী রোগের যন্ত্রপাতি কিনে নেয় পুঁজিপতিরা তাদের হাসপাতালের জন্য তা তো জনসাধারণের কোনো কাজে আসে না। বিজ্ঞানের যে সুন্দর সেখানে তো পৌঁছুতে পারে না সাধারণ মানুষ।  যেন জ্ঞান বিজ্ঞান বেড়ে উঠছে কুৎসিত অমানবিক কর্পোরেট পুঁজির হাত ধরে। তাদের আরও বেশি মুনাফা বাড়িয়ে দেয়ার নিমিত্তে। কার্ল মার্কসওতো এটাই চেয়েছিলেন মানুষ আবারও শ্রেণিহীন হবে। সবার জন্য হবে সবকিছু সব মানুষই হবে প্রাকৃতিক।

সবার জন্য সমান শিক্ষা চিকিৎসা খাদ্য ও বাসস্থান। লালনও তো চেয়েছিলেন সহজ হয়ে নির্ভার হয়ে থাকতে। আজকে আমরা যাকে বলি হিউম্যানিজম বা মনুষ্যত্ব তা আসলে কাদের মনুষ্যত্ব। প্রতিনিয়ত এখনো কত মানুষ মরে অনাহারে। কত মানুষ প্রতিনিয়ত হচ্ছে বাস্তুচ্যুত। উন্নত বিশ্ব কখনো সমস্যার সমাধান করে না মানুষ সব হারালে তারা বিভিন্ন সংগঠনের নামে , কিছু লোক দেখানো ত্রাণ বিতরণ করে। লাউৎস বলেন, মনুষ্যত্ব বর্জন করে বিচার ব্যবস্থা বাদ দাও তবেই মানুষ ফিরে আসবে দয়া আর প্রীতির মাঝে।

লেখক : কবি ও ভাবুক

অলঙ্ককরণ : আল নোমান

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইশরাককে মেয়র পদে শপথ করানোর দাবিতে নগরভবনের সামনে বিক্ষোভ
ইশরাককে মেয়র পদে শপথ করানোর দাবিতে নগরভবনের সামনে বিক্ষোভ
চট্টগ্রামে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস
চট্টগ্রামে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস
ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার ঘটনায় আটক ৩, থামায় মামলা
ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার ঘটনায় আটক ৩, থামায় মামলা
ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে সারা দেশে ছাত্রদলের কর্মসূচি 
ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে সারা দেশে ছাত্রদলের কর্মসূচি 
সর্বাধিক পঠিত
বিমানবন্দরে তিন উপদেষ্টা, জেরার মুখে দায়িত্বরতরা
সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগবিমানবন্দরে তিন উপদেষ্টা, জেরার মুখে দায়িত্বরতরা
হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল ইতিহাসে এটাই প্রথম: প্রধান বিচারপতি
হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল ইতিহাসে এটাই প্রথম: প্রধান বিচারপতি
বাড়লো স্বর্ণের দাম, বুধবার থেকে কার্যকর
বাড়লো স্বর্ণের দাম, বুধবার থেকে কার্যকর
রাতে চিয়া বীজ খেলে এই ৬ উপকার পাবেন
রাতে চিয়া বীজ খেলে এই ৬ উপকার পাবেন
সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব পেমেন্ট সুইচ চালু
সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব পেমেন্ট সুইচ চালু