X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

চেনা সুরের রাগ-রঙ

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়
০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১০:০০আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১০:০০

চেনা সুরের রাগ-রঙ পর্ব-২১

খাম্বাজ ঠাটের গৌড়মল্লারের কথায় নটমল্লারের কথা মনে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। নটমল্লারের কথায় আমার মনে পড়ে বর্ধমানের কথা। কারণ বিষ্ণুপুরের প্রবাদপ্রতীম ধ্রুপদী গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসবাস ছিল এই বর্ধমান শহরেই। আসলে গোপেশ্বর বাবুর গাওয়া নটমল্লার রাগে সেই হৃদয় ভোলানো গানের সূত্র ধরেই মনে পড়ে ঝাপটের ঢাল, পিচকুরির ঢাল, বনপাস, বর্ধমান হয়ে কলকাতা পর্যন্ত কত না জায়গার নাম। বরষার মেঘ উড়ে চলেছে সব দেখতে দেখতে। একটা কবিতা শুনুন—

‘আসিল বরষাকাল। সকাল সকাল

বালিবর্ণ মেঘে ছায় ঝাপটের ঢাল।

ক্রমশ দক্ষিণমুখী হাওয়ার উড়ানে

ডানার ঝাপটে মেঘ পিচকুরির পানে

ধাইল বনপাস হতে অজয়েরর বাঁকে

সেথায় খড়ের ধাম, কবি এক থাকে।

কুমুদরঞ্জন নাম, বসি অন্যমন

উপরে মেঘের খেলা করে নিরীক্ষণ।

অতঃপর বর্ধমান ঝরোঝরো ধারে

ভাসাইলেন গোপেশ্বর কী নটমল্লারে—

আজও সে গালায় চাকতি বাজে গ্রামোফোনে।

আসিলে বরষাকাল কলকাতার ধারে,

গৌড়মল্লার ছায় ... ‘মোর ভাবনারে ...’’

হ্যাঁ! কবিতার শেষে এসে অবশেষে দেখা পাওয়া গেল গৌড়মল্লারের!

কলকাতায় এবং বলাই বাহুল্য জোড়াসাঁকোয়, ঠাকুরবাড়িতে, যেখানে বেজে উঠেছে সমরেশ রায়ের গাওয়া সেই গ্রামোফোন রেকর্ডটি— ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো/দোলে মন দোলে অকারণ হয়ষে’

এই হলো সেই খাম্বাজ ঠাটের গৌড়মল্লার—আমরা যার খোঁজে বেরিয়ে ছিলাম!

গৌড়মল্লারের খেয়ালের বহু রেকর্ড আছে, কিন্তু আমার প্রথমেই মনে পড়ে মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া রেকর্ডটির কথা, কারণ সেটিই আমার শোনা গৌড়মল্লারের প্রথম খেয়াল—‘শাওন কে ঝুকি আয়ি রে বাদরা’...গানটি সম্ভবত খাম্বাজ ঠাটের গৌড়মল্লারের সবচাইতে পরিচিত খেয়ালের বন্দিশ এবং মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেকর্ডটিও ছিল অবিস্মরণীয়।

আরেকটি অসাধারণ রেকর্ড আছে পণ্ডিত নারায়ণ রাও ব্যাসের গাওয়া—‘বারমা বাহার আয়ি’...এবং এই একই গান শুনেছি অঞ্জনী বাঈ লোলেকরের কণ্ঠে, ইন্দিরা বাঈ খাদিলকরের মধুর কণ্ঠে এবং অতি সম্প্রতি ওস্তাদ সুজাত খাঁর সেতার ও তারই স্বকণ্ঠে যুগলবন্দী। আরো দুটি রেকর্ডের কথা বলব কণ্ঠসংগীতের। একটি পণ্ডিত মল্লিকার্জুন মনসূরের কণ্ঠে এবং অন্যটি কিংবদন্তি শিল্পী কেনারবাঈ কেরকরের কণ্ঠে।

এই রাগ অবলম্বনে যে দুটি গানের কথা মনে পড়ছে, তার মধ্যে একটি গান হিন্দি ছায়াছবির গান। ছায়াছবির নাম ‘বরসাত কি রাত’, দ্বৈত কণ্ঠে গানটি গেয়েছিলেন সুমনকল্যাণপুর এবং কমল বারোট। গানটির বাণী ছিল, ‘গরজত বরসত শাওন আয়োরে’ এবং সুর ‘শাওন কে ঝুকি আয়ি রে বাদরা’ প্রায় হুবহু অনুকৃতি, কিন্তু তবু, এমন গান আর শুনেছি বলে মনে পড়ে না। ‘বরসাত কি রাত’— ছায়াছবিটি তৈরি হয়েছিল ১৯৬০ সালে। তারপর অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু খাম্বাজ ঠাটের গৌড়মল্লারে বাঁধা অমন রাগাশ্রয়ী গান আর শুনলাম না।

অনেক পরে, প্রায় সাম্প্রতিক কালে, ওই একই খেয়ালের অনুসরণে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ রচিত একটি বাংলা গানও স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘শাওন মেঘমায়া ছাইল গগনে’—গানটির শিল্পী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। এই গানটিও শুনুন, মনে রাখুন; তাহলে গৌড়মল্লারকে চিনতে আর কোনো সমস্যা হবে না।...এই তো গেল গৌড়মল্লার বৃত্তান্ত।...

“অতঃপর বর্ধমান ঝরোঝরো ধারে

ভাসাইলেন গোপেশ্বর কী নটমল্লারে

‘রয়েছ হৃদয় মাঝে’, হৃদয়ের কোণে

আজো সে গালার চাকতি বাজে গ্রামোফোনে”

কিন্তু গ্রামোফোন আজ হৃদয়ের কোণেই পড়ে আছে। পুরু হয়ে জমে উঠেছে ধুলো। সে গালার চাকতিও আর পাওয়া যায় না। ৭৮আরপিএম রেকর্ডের দিন তো কবেই চলে গেছে। রেকর্ডিংয়ের কারিগরী এখন অনেক অনেক উন্নত হয়েছে, কিন্তু সে শিল্প কই? সে সংগীত কই? কোথা যে উধাও হলো? কে এ প্রশ্নের উত্তর দেবে?...

কিন্তু একথা এখন বরং থাক। বলছিলাম, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া নটমল্লার রাগে সেই অসাধারণ রেকর্ডটির কথা। ‘তুমি হৃদয় মাঝে রয়েছ’—গানটি শিল্পীর স্বরচিত এবং গানটির সুর একটি প্রাচীন খেয়াল গানের অনুসরণে। এই গানটি এবং মূল গানটিও একতালে, অর্থাৎ বারো মাত্রার তালে নিবদ্ধ। বিষ্ণুপুর ঘরাণায় গানটি গাওয়া হতো এবং তার বাণী ছিল, ‘মোরি নঈ লগন লাগিরে’, যার অনুসরণে রবীন্দ্রনাথের ভাঙাগান— ‘মোর বারে বারে ফিরালে’। নটমল্লারের নিদর্শন এ সবই। এই অবসরে বলে রাখি, ‘মোরি নঈ লগন লাগিরে’—গানটির একটি মাত্র রেকর্ডের কথা জানি, যেটি গেয়েছিলেন, নীহাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রসংগীতটির রেকর্ড আছে চিত্রলেখা চৌধুরীর কণ্ঠে। কিন্তু বিষ্ণুপুরের নটমল্লারের আরেকটি অনবদ্য রেকর্ড আছে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর কণ্ঠে। গানটির বাণী হলো, ‘ছন্দে ছন্দে নাচে নন্দদুলাল’। রচনা, সম্ভবত তুলসী লাহিড়ীর। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা দুটি গান পাচ্ছি, যারা নটমল্লার রূপে চিহ্নিত হয়েছে, প্রথমটি হলো, ‘ফিরে নাহি এলে প্রিয় ফিরে এলো বরষা’ এবং অন্যটি, ‘রুম ঝুম বাদল আজি বরষে’। দুটি গানের কোনোটিই আমি শুনিনি, রেকর্ড আছে কিনা তাও জানা নেই।

নজরুলগীতি দুটির সুর কেমন আমার জানা নেই, তবে বিষ্ণুপুরের নটমল্লারের সঙ্গে উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের নটমল্লারের কিছুটা পার্থক্য আছে। এবার সে প্রসঙ্গে আসি।

তার আগে ‘নট’ শব্দটি প্রসঙ্গে একটু আলোচনা করা যাক। নটবেহাগ, নটকামোদ, নটভৈরব, নটবিলাবন, ছায়ানট, নটমল্লার... এমনি অনেক রাগে ‘নট’ শব্দটি আমরা পাই। একটি রাগ আছে, যার নাম নট, বা ‘শুদ্ধ নট’ও বলা হয়। পণ্ডিত ওঙ্কার নাথ ঠাকুরের একটি রেকর্ড আছে, যা শুনলে নট রাগটির স্বরূপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হবে। এর অন্তর্নিহিত ভাব হলো গভীর ভক্তির, আত্মসমর্পণের ভাব। এর আবহ রাত্রির মেঘমুক্ত আকাশের উজ্জ্ব তারকাখচিত মহাবিশ্বের মতো উন্মুক্ত। কিন্তু তবু মনে হয়, রাগটির গভীরে কোথাও যেন হৃদয় বিদারক এক করুণ রসের অনন্ত উৎস আছে, যা প্রকাশিত হয় ‘পা মা রে’—এই স্বর সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে। মনে করুন, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর গাওয়া সেই অবিস্মরণীয় নজরুলগীতিটি— ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর ফিরে আয় ফিরে আয়’। শোনা যায় পুত্র বিয়োগব্যথায় কাতর বিহ্বল কবি এই গানটি রচনা করেছিলেন। রাগ ছায়ানট এবং গানটির সেই তীব্র বিচ্ছেদ বেদনার সবটাই যেন প্রকাশিত হয়, ওই ‘মোর’ শব্দটির মধ্যে দিয়ে, যা আসলে ‘নট’ রাগেরই স্বাক্ষর। এই স্বাক্ষর খুব স্পষ্টভাবেই নটমল্লারকেও চিনিয়ে দেয়, যা গৌড়মল্লারে নেই। বহু পুরোনো একটি বাংলা গানের কথা বলি। ‘রুমা ঝুমা ঝুম ঝুম ঝুম বাদল ঝরে’ গানটির শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। রাগ নটমল্লারে আধারিত গানটি প্রায় ষাট বছর আগের রেকর্ডিং। অনেক অসাধারণ গানের মতো, বিস্মৃতি প্রবণ বাঙালি, এই গানটির কথাও যথারীতি মনে রাখেনি; কিন্তু সে গান আমি আজও ভুলতে পারিনি। রেকর্ডটি পেলে আপনারাও শুনুন। সেই মেঘমন্ত্রিত কণ্ঠে নটমল্লার শোনার আনন্দ আস্বাদন করুন।

নট রাগের কথা বলেছি। এবার মল্লারের কথাও আবার বলি। গৌড়মল্লার বা নটমল্লারের বিষয়ে কিছু রেকর্ডের কথা মনে পড়ে গেল গৌড়মল্লার বা নটমল্লারের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে। একটি রেকর্ড ১৯১০ সালের, শিল্পী জানকী বাঈ। অতীব সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী এই শিল্পী যে খেয়ালটি গেয়েছিলেন, সেটি ছিল শুদ্ধ মল্লারে। আরেকটি বাংলা গানের সঙ্গে এই খেয়ালটির মিল বিস্ময়কর। অতুল প্রসাদের ‘ডাকে কোয়েলা বারে বারে’, গানটির কথা বলছি। অথচ এই গানটিতে আমরা তো নটমল্লারকেই পাই! অবশ্য গৌড়মল্লারেরও নানা প্রকার আছে এবং তার মধ্যে অন্যতম নটঅঙ্গের গৌড়মল্লার। তাও হতে পারে, বিশেষত অন্তরায় গৌড়মল্লারের প্রকাশই সুস্পষ্ট হয় বেশি।

আরেকটি রেকর্ড। সময়, সম্ভবত বিগত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক। শিল্পী, মেহবুব জান। গানটির বাণী, ‘ঝুম ঝুম বাদরিয়া বরষে’। ‘মল্লার’ নামে চিহ্নিত এই গানটির সুরও অনেকটা নটমল্লারেরই মতো। বিশেষভাবে মনে পড়বে, ‘মোরে বারে ফিরালে’—এই রবীন্দ্রসংগীতটির কথা।

আসলে, মনে হয়, রাগগুলির সীমারেখা শাস্ত্রকাররা যতটা কঠোরভাবে বেঁধে দিতে চান, শিল্পীর স্বাধীনতাকে তাতে আটকে রাখা অসম্ভব। মুক্তির পথ সে খুঁজবেই এবং তাতেই বিপত্তি বাঁধবে। তবে, নিয়ম যেমন আছে, তেমনি অনিয়মও আছে—এটা মনে রাখলেই আর সমস্যা নেই। (চলবে)

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় ৮ সেনা আহত
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় ৮ সেনা আহত
ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র
ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র
এক উপজেলায় ১৩ প্রার্থীর সবাই আ.লীগের
এক উপজেলায় ১৩ প্রার্থীর সবাই আ.লীগের
শিরোপাজয়ী দল কি কোটি টাকা পাবে?
ফিরছে সুপার কাপশিরোপাজয়ী দল কি কোটি টাকা পাবে?
সর্বাধিক পঠিত
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক