X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
ধারাবাহিক—এক

ক্লিশিতে শান্ত দিন ।। হেনরি মিলার

ভাষান্তর : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়  
০২ আগস্ট ২০২১, ১৩:৩০আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২১, ১৩:৩৭

[১৯৩০-৩৯ সময়পর্বে প্যারিসে বসবাসকালের অভিজ্ঞতা নিয়ে মিলার এই উপন্যাসিকাটি লেখেন। ওঁর ‘ট্রপিক অফ ক্যান্সার’, ‘ব্ল্যাক স্প্রিং’, ‘ট্রপিক অফ ক্যাপ্রিকর্ন’, ‘দ্য রোজি ক্রুসিফিকশন’—ট্রিলজি, এগুলোর মতোই ‘কোয়ায়েট্‌ ডেইজ ইন ক্লিশি’ও একটি আত্মজৈবনিক আখ্যান। ’৩০-এর দশকের শুরুর দিকের অভিজ্ঞতাই এতে রয়েছে, যে সময়টায় মিলার ‘ব্ল্যাক স্প্রিং’ উপন্যাসটি লিখছিলেন। থাকতেন শহরতলি ক্লিশির একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে বন্ধু আলফ্রেড পার্লেসের সাথে ভাগ করে। লেখক জীবনের এক প্রতিকূল অবস্থার সাথে তখন লড়ছেন মিলার। প্যারিস থেকে নিউ ইয়র্কে ফেরার অল্প কিছুদিন বাদে ১৯৪০-এ লেখেন এই উপন্যাসিকাটি। পরে, ১৯৫৬ সালে বিগ সারে থাকার সময়, যখন তিনি ‘নেক্সাস’-এর ওপর কাজ করছেন, এতে কিছু সংযোজন, পরিমার্জন করেন।
‘কোয়ায়েট্‌ ডেইজ ইন ক্লিশি’ গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ফ্রান্সে, অলিম্পিয়া প্রেস থেকে, ১৯৫৬ সালেই। আমেরিকায় মিলারের ‘ট্রপিক অফ ক্যান্সার’-এর ওপর দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে চলা অশ্লীলতার অভিযোগ তথা আইনি নিষেধাজ্ঞা ১৯৬৪-৬৫ নাগাদ উঠে যাবার পর ওঁর অন্যান্য বইয়ের সাথে এই উপন্যাসিকাটিও আমেরিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। প্রকাশক, গ্রোভ প্রেস।
মিলারের ফোটোগ্রাফার-বন্ধু জর্জ ব্রাসেই ওঁর ‘হেনরি মিলার: দ্য প্যারিস ইয়ার্স’ বইতে জানিয়েছেন যে, মিলারের মতে (‘কোয়ায়েট্‌ ডেইজ ইন ক্লিশি’র) ‘টাইটল ইজ কমপ্লিটলি মিসলিডিং’।       
উল্লেখ থাকে যে, উপন্যাসিকাটির দুটি অংশ। প্রথমাংশ, ‘কোয়ায়েট্‌ ডেইজ ইন ক্লিশি’, দ্বিতীয়াংশ ‘মারা ম্যারিগনান’। যদিও, দুটি অংশই মূল গ্রন্থে দু মলাটের ভেতর রয়েছে এবং তাদের মধ্যে স্থান, কাল ও পাত্রের বহুলাংশে সাদৃশ্য থাকলেও, আখ্যানের ক্রমিক পরিণতির দিক থেকে বা কাহিনির ধারাবাহিক বিন্যাসে অংশ দুটিতে প্রত্যক্ষ বা অনিবার্য কোনও যোগ নেই। আমি এখানে শুধু প্রথমাংশটিরই অনুবাদ করেছি।
অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য বলা, মিলারের ‘কোয়ায়েট্‌ ডেইজ ইন ক্লিশি’ অবলম্বনে সিনেমা তৈরি হয়েছে দু’বার। প্রথমটি একটি ড্যানিশ প্রোডাকশন, ১৯৭০ সালে। দ্বিতীয়টি ছিল ফরাসি নির্মাণ, ১৯৯০ সালে পরিচালক ক্লদ শাব্রল এটা নিয়ে সিনেমা করেন। ১৯৯১ সালে, আমেরিকার সাহিত্যের ওপর ভিত্তি করে এইচবিও চ্যানেল একটি অ্যান্থলজি সিরিজ করেছিল, তাতে এই উপন্যাসের দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ ‘মারা ম্যারিগনান’ অবলম্বনে একটি ৩০ মিনিটের শর্ট ফিল্ম তৈরি হয়, যার নাম ছিল ‘মারা’।  
উপন্যাসিকাটিতে ফ্রান্সের একাধিক রাস্তাঘাট, জায়গা, স্থাপত্য নিদর্শন এবং শিল্প ও সাহিত্য-ব্যক্তিত্বের নাম রয়েছে। বাঙালির জিভে তাদের যথাযথ উচ্চারণ কী হবে বা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক চিরকাল থাকবে। আমি একটা স্বাভাবিক ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেছি। যা হয়তো বিশুদ্ধ ফরাসি উচ্চারণ নয় তবে তার কাছাকাছি, আবার বাঙালির জিভেও বেমানান নয়।
আরেকটি কথা, যে সমস্ত ফরাসি নাম বা শব্দ এই উপন্যাসে তথা এই অনুবাদে রয়েছে, তাদের সম্পর্কে পরিশিষ্টে সামান্য কিছু পরিচিতি উল্লেখের চেষ্টা করেছি। যাতে আগ্রহী পাঠকের কাছে উপন্যাসে জড়িয়ে থাকা পরিমণ্ডলটির আবহ সাবলীল হয়। সেপ্টেম্বর—অক্টোবর, ২০১৬। —অনুবাদক।] 

এ লেখা যখন লিখছি, রাত নেমে এসেছে। লোকজন সব ডিনারে চলল। সারাটাদিন ছিল ধূসর। প্যারিসে যেমন হামেশাই দেখা যায়। চিন্তায় হাওয়া লাগাতে ব্লকগুলোর আশপাশ দিয়ে হাঁটছি। করতে কিছুই পারছি না, শুধু ভাবছি নিউ ইয়র্ক আর প্যারিস এই শহর দুটোর মধ্যে কী ভীষণ তফাত। সেই একই সময়, একইরকম দিন, এমনকী এই ধূসর শব্দটাও, যা এইসব সঙ্গ থেকেই আসে, সেই গ্রিসাইলের সাথে অল্পই সাযুজ্য তার, একজন ফরাসির কানে যা চিন্তা ও অনুভূতির একটা জগৎ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। অনেক আগে, প্যারিসের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, দোকানের জানলায় রাখা জলরঙের কাজগুলো মন দিয়ে দেখতে দেখতে, আমি সেই জিনিসটার একক অনুপস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলাম যাকে পেইন’জ গ্রে[১] বলে। এটা আমি উল্লেখ করলাম কারণ, সবাই-ই জানে প্যারিস সবিশেষভাবে এমন এক শহর যার নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা নেই। উল্লেখ করলাম কারণ, আমেরিকান শিল্পীরা তৈরি করা ফরমায়েসি ধূসরকেই ব্যবহার করে অতিরিক্ত এবং বদ্ধমূলভাবে। ফ্রান্সে এই ধূসরমালা অসীম; এখানে ধূসর তার পরিণাম-লুপ্ত।

ধূসরতার এই বিপুল পৃথিবী নিয়ে ভাবছিলাম যাকে আমি এই প্যারিসেই চিনেছি। কারণ এরকম সময়ে, এমনিই যখন বুলেভার ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম, অধীর আগ্রহে মনে হল ঘরে ফিরে যাই, লিখি, আমার স্বাভাবিক অভ্যেসের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী একটা লেখা। ওখানে আমার সময় ফুরোলে আমি আবার প্রবৃত্তিগতভাবে ঠিক ভিড়ে মিশে যাব। এখানে এই ভিড়, সবরঙের শূন্যতা, সবকিছুর সূক্ষ্ম তারতম্য, সব ভেদ ও স্বাতন্ত্র্য, আমাকে নিয়ে যাবে আমার ভেতরে, ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আমার ঘরে, আমার কল্পনার মধ্যে এক নিরুদ্দিষ্ট জীবনের সেই জটিল ও মিশ্র উপাদানগুলোকে খুঁজতে, যখন সেগুলো সংমিশ্রিত ও আত্তীকৃত হয়ে প্রতিপালিত আর সুসংগত অস্তিত্বের সৃষ্টির দিকে হয়তো কী অনিবার্যভাবে পুনরুৎপাদন করছে কোমল ও স্বাভাবিক ধূসরকে। এরকম একটা দিনে, এরকম সময়ে র‌্যু লাফিত্তের[২] যে কোনও জায়গা থেকে সাক্রে কয়্যেরের[৩] দিকে তাকিয়ে দেখাটাই আমাকে স্বপ্নাবেশে নিয়ে যেতে সক্ষম। এমনকী যখন আমি ক্ষুধার্ত কিংবা ঘুমনোরও কোনও জায়গা নেই তখনও আমার ওপরে এই দৃশ্যটার এরকমই প্রভাব চলত। পকেটে আমার হাজার ডলার থাকলেও আমি জানি এমন কোনও দ্রষ্টব্য নেই যা আমার মধ্যে এরকম স্বপ্নাবেশ জাগাতে পারে।

প্যারিসের ধূসর দিনগুলোয় আমি সাধারণত মঁমার্তের[৪] ক্লিশির দিকে হাঁটি।

ক্লিশি থেকে অবারভিলারের[৫] দিকে একের পর এক কাফে, রেস্তোরাঁ, থিয়েটার, সিনেমাহল, কাপড়ের দোকান আর হোটেল। এটা প্যারিসের ব্রডওয়ে যা ৪২নং আর ৫৩নং রাস্তার মাঝখানের অল্প বিস্তৃতিটার দিকে সংযুক্ত হয়েছে।

ব্রডওয়ে সর্বদাই ছুটছে। মাথা ঘুরিয়ে দেয় আর ঝলমলে। বসার কোনও জায়গা নেই। মঁমার্ত আলস্যপরায়ণ, মন্থরগতি, উদাসীন আর গতানুগতিক, খানিকটা বাজেই আর নোংরা, সম্মোহন করার মতো রূপসী সে নয়, ঝকমকে নয় কিন্তু ধুঁইয়ে ধুঁইয়ে ওঠা আগুনে দেদীপ্যমান।

ব্রডওয়ে রোমাঞ্চকর, এমনকী কখনও জাদুকরী, কিন্তু সেখানে আগুন নেই, তাপ নেই কোনও— সে এক ঝকঝকে আলোকিত অ্যাজবেস্টস্‌, বিজ্ঞাপনের প্রতিভূদের স্বর্গ। মঁমার্ত অতি ব্যবহারে জীর্ণ, নিষ্প্রভ, বেওয়ারিশ, ন্যাংটো লম্পট, ভাড়াটে সেনার মতো শুধু টাকার জন্য কাজ করে, অশ্লীল। যদি এমন কিছু থাকে, যা বিরক্তিকর অথচ আকর্ষণীয়, কিন্তু কপট কুটিলতার সাথে বিরক্তিকর, সেরকম আবাধ্য লম্পট সে। খানকতক বার এখানে রয়েছে যা একচেটিয়াভাবে বেশ্যা, দালাল, ঠগ আর জুয়াড়িতে ভর্তি, ওদের হাজারবার নিরস্ত করলেও শেষ অব্দি তোমায় চুষে নেবে আর দাবি করবে ঠকেছে বলে।    

এই বুলেভারের প্রধান বস্তু হল রাস্তার ধারের হোটেলগুলো, যাদের কদর্যতা এতোটাই বদ আর কুটিল যে সেখানে ঢোকার চিন্তামাত্র তুমি কেঁপে উঠবে, তবু এটা অনিবার্য যে এদের মধ্যে কোনও একটায় কোনও-না-কোনও দিন তুমি একটা রাত অন্তত কাটাবে, হয়তো একটা সপ্তাহ বা একটা মাস। এমনকী হয়তো এই জায়গাটার প্রতি আসক্তই হয়ে পড়বে এটা দেখে যে, একদিন তোমার গোটা জীবনের আদলটাই পালটে গেছে এবং একসময় যাকে তুমি হীন, জঘন্য ভেবেছ এখন তাকেই মোহময়, চমৎকার মনে হচ্ছে। বৃহৎ প্রেক্ষিতে, আমার সন্দেহ, মঁমার্তের এই কপট মোহের কারণ প্রকাশ্য ও বেআইনি যৌনব্যবসা।

সেক্স জিনিসটা রোম্যান্টিক নয় বিশেষত যখন তা বিকিকিনির হাটে এসেছে। কিন্তু ছেয়ে থাকা একটা সুগন্ধ সে তৈরি করতে পারে, একটা ঝাঁজালো অতীত-আর্তি। যা দুর্ধর্ষ আলোকিত গে হোয়াইট ওয়ের[৬] চেয়েও অনেক অনেক বেশি রহস্যময় আর সম্মোহনকারী। প্রকৃতপ্রস্তাবে আবছা, অন্ধকারময় আলোতেই যৌনজীবনের শ্রীবৃদ্ধি; আলো-আঁধারির ছায়াতেই এর ঘর, নিওন আলোর ঝলসানি এখানে নয়।

ক্লিশির এক কোণে কাফে ওয়েপলার, যা দীর্ঘদিন ধরে বহুবার যাওয়া আমার অত্যন্ত প্রিয় এক জায়গা। দিনের পুরোটা সময় সমস্তরকম আবহাওয়ায় তার ভেতরে, বাইরে আমি বসেছি। একটা আস্ত বইয়ের মতো আমি একে জানি। ওয়েটার, ম্যানেজার, ক্যাশিয়ার, বেশ্যা, খদ্দের এমনকী বাথরুমে থাকা অ্যাটেন্ডেন্টদের মুখগুলো আমার স্মৃতিতে এমনভাবে খোদাই করা আছে যেন তারা একটা বইয়ের অলঙ্করণ, যে বই আমি রোজ পড়েছি। মনে পড়ে, সেই প্রথম যখন এসেছিলাম কাফে ওয়েপলারে, আমার স্ত্রীর সাথে, ১৯২৮ সেটা; রোয়াকের ওপরে একটা ছোট্ট টেবিলে মাতাল বেহেড হয়ে এক বেশ্যাকে যখন মরে পড়ে যেতে দেখলাম, আর দেখলাম কেউ তাকে ধরার জন্য ছুটেও গেল না, কীরকম প্রবল ধাক্কা খেয়েছিলাম আমি এটা দেখে, মনে পড়ে। ফরাসিদের এই নির্বিকার ঔদাসীন্য হতবাক আর আতঙ্কিত করে দিয়েছিল আমাকে; এখনও করে, ওদের মধ্যে যেসব ভালো গুণ রয়েছে পরবর্তীকালে সেসব জানার পরেও। ‘এ কিছু না, সামান্য একটা বেশ্যা... একটু মাতাল হয়ে পড়েছিল আর কি’। এখনও আমি এই শব্দগুলো শুনতে পাই। আজও তারা আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়। কিন্তু এটাই প্রকৃত ফরাসিয়ানা, এই মনোভাবটা, আর তুমি যদি এটা মেনে নিতে না শেখো, ফ্রান্সে তোমার অবস্থানটা খুব সুখপ্রদ হবে না।  

ধূসর দিনগুলোয়, যখন বড় কাফেগুলো ছাড়া সর্বত্র ঠান্ডায় জমে গেছে, রাতে ডিনারে যাবার আগে কাফে ওয়েপলারে এক-দু ঘণ্টা কাটাবার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে থাকতাম। কামোদ্দীপনার এমন সুসময় ভাসিয়ে নিয়ে যেত এই জায়গাটাকে, যা উঠে এসেছে এক ঝাঁক বেশ্যার হাত ধরে, যারা জমায়েত করে থাকত ঢোকার মুখটার কাছে। ধীরে ধীরে তারা খদ্দেরদের কাছে নিজেদের বিলি-বণ্টন করে দিলে, জায়গাটা তখন শুধু কামনায় উষ্ণই হয়ে উঠত না, মিষ্টি একটা সুগন্ধের মাধুর্যে ভরে যেত।

আবছা আলোয় সুগন্ধী জোনাকির মতো তারা ডানা ঝাপটাত। যারা খদ্দের খুঁজে নেবার মতো ভাগ্যবান হত না, রাস্তায় পায়চারি করত অলসভাবে, তারপর সাধারণত আবার ফিরে আসত একটু বাদেই, তাদের পুরনো জায়গায়। গর্বে অন্যদের মুখ তখন ঝকঝক করছে, সন্ধের পালা শুরু করতে তারা প্রস্তুত। যে কোণটায় সাধারণত ওরা জড়ো হত সেটা যেন একটা এক্সচেঞ্জ মার্কেট, এই সেক্স মার্কেটেরও ওঠা-নামা আছে অন্য এক্সচেঞ্জ মার্কেটের মতোই। বর্ষার দিনগুলো সাধারণত এখানে ভালো ব্যবসা-পাতির দিন, আমার চোখে তা-ই মনে হয়েছে। প্রবাদ আছে, একটা বর্ষার দিনে তুমি দুটো কাজই করতে পারো যখন বেশ্যারা কখনও তাস পিটিয়ে সময় নষ্ট করে না।

সেই দিনটাও ছিল বর্ষারই দিন, শেষবিকেলের দিক। কাফে ওয়েপলারে এক নবাগতাকে লক্ষ করলাম। আমি বেরিয়েছিলাম কেনাকাটা করতে, আমার হাত ভর্তি হয়ে আছে বই আর কিছু ফোনোগ্রাফ রেকর্ডে। সেদিন নিশ্চয়ই আমেরিকা থেকে একটা অপ্রত্যাশিত অর্থপ্রাপ্তি ঘটেছিল যার ফলে কেনাকাটা যা করেছি তারপরেও কয়েকশো ফ্রাঙ্ক তখনও আমার পকেটে। আমি বসে আছি ওই এক্সচেঞ্জের জায়গাটায়, ক্ষুধাময় এক মহিলামহল পরিবেষ্টিত হয়ে; ক্রমাগত খুঁচিয়ে যাওয়া বেশ্যার দল আর যা কিছু আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে সেসবে আমার কোনও প্রতিবন্ধকতাই হচ্ছিল না, কারণ আমার চোখ তখন একনজরে তাক করে আছে মোহসঞ্চারী ওই নবাগতা সুন্দরীর দিকে, যে অনেকটা তফাতে কাফের দূরবর্তী কোণে বসে আছে। তাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় সুন্দরী এক যুবতি বলেই মনে হল যে তার প্রেমিকের সাথে দেখা করবে বলে এসেছে এবং নির্ধারিত সময়ের অনেকটা আগেই চলে এসেছে। যে মদটা মেয়েটা অর্ডার করেছিল নামমাত্রই ছুঁয়েছে সেটা। তার টেবিলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পুরুষদের দিকে সে পূর্ণ এবং স্থির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, কিন্তু তা থেকে কিছুই বোঝা যায় না— ব্রিটিশ বা আমেরিকান মহিলাদের মতো একজন ফরাসি মহিলা কখনওই তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয় না। নিরুদ্বিগ্ন স্থির চোখে তাকিয়ে সে চারপাশ মাপছে, কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কোনও স্পষ্ট প্রয়াস তাতে নেই। সে ছিল নিঃশব্দ পদসঞ্চারী এবং সম্ভ্রম উদ্রেককারী, আগাগোড়া স্থিতিসাম্যে টান টান আর নিজেকে ধরে রাখা একজন।

সে অপেক্ষা করছিল। আমিও অপেক্ষা করছিলাম। আমি উৎসুক ছিলাম দেখতে যে সে কার অপেক্ষায় বসে আছে।

আধঘণ্টা পর, যে সময়টায় আমি বেশ ক’বার তার চোখাচোখি হলাম এবং ধরে ফেললাম, এ মেয়ে অপেক্ষা করছে যেকোনও কারুর জন্যেই, যে সঙ্গত আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবটা করবে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত মাথা বা হাত নেড়ে ইশারাটুকুই করতে হয় যাতে মেয়েটি তার টেবিল ছেড়ে উঠে আসবে এবং তোমার সাথে যোগ দেবে— যদি সে ঠিক সেই ধরনের মেয়ে হয়। কিন্তু তখনও আমি একেবারে নিশ্চিত হতে পারিনি। আমার চোখে তো সে দেখতে খুবই সুন্দর, সুপুষ্ট, উথলে ওঠা যাকে বলে— মানে বলতে চাইছি যত্নে লালিত আরকি।  

যখন ওয়েটার আরেকবার রাউন্ডে এল আমি মেয়েটিকে দেখিয়ে ওকে জিগ্যেস করলাম যে চেনে কিনা। ওয়েটার যখন বলল ‘না’, আমি বললাম ওকে এখানে আসতে বলো, আমার সাথে জয়েন করুক। আমি মন দিয়ে ওর মুখ লক্ষ করছিলাম যখন ওয়েটার ওকে মেসেজটা দিচ্ছিল। ওর মুখে হাসি এবং আমার দিকে তাকিয়ে অল্প মাথা নাড়ানোটা দেখে আমার যেন একটা রোমাঞ্চ দিয়ে গেল। আমি আশা করেছিলাম যে ও জলদি উঠে পড়বে এবং এদিকে চলে আসবে, কিন্তু তার বদলে বসেই রইল এবং আবার হাসল, এবারে আরও মৃদু, আর সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে একদৃষ্টে স্বপ্নমাখা চোখে তাকিয়ে রইল। মাঝখানে ঢুকে পড়তে আমি একটু সময় দিলাম এবং দেখলাম নড়াচড়ার কোনও লক্ষণই তার নেই, এবারে আমি উঠে দাঁড়ালাম, সোজা হেঁটে গেলাম ওর টেবিলের দিকে। যথেষ্ট আন্তরিকভাবেই সে আমায় স্বাগত জানাল, যেন বাস্তবিকই আমি তার বন্ধু, কিন্তু আমি লক্ষ করলাম ও যেন একটু আচ্ছন্ন হয়ে আছে নেশায়, প্রায় অপ্রস্তুত। আমাকে বসতে দিতে চায় কি চায় না ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না আমি, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি বসে পড়লাম এবং ড্রিঙ্ক অর্ডার করে চট করে ওর সাথে কথা বলতে শুরু করে দিলাম। (চলবে)

পরিশিষ্ট
১. পেইন’জ গ্রে (Payne’s grey) : নীল, লাল, কালো এবং শাদা রঞ্জকে তৈরি একটি কম্পোজিট পিগমেন্ট। বিশেষত জলরঙের ছবিতে ব্যবহার করা হয়। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ শিল্পী উইলিয়াম পেইনের নামানুসারে এই নাম।
২. র‌্যু লাফিত্তে (Rue Laffitte) : প্যারিসের একটি রাস্তা। বর্তমানে এর বিস্তৃতি বুলেভার্দ দে ইতালিয়েনস থেকে র‌্যু নত্‌রদাম দে লরেত্তে অবধি। এই রাস্তাটার একেবারে শুরুর মুখে, অর্থাৎ বুলেভার্দ দে ইতালিয়েনসের জংশন থেকে সাক্রে কয়্যেরকে দেখে মনে হয় নত্‌রদাম গির্জার শৃঙ্গভাগে দাঁড়িয়ে আছে।   
৩. সাক্রে কয়্যের (Sacré Coeur) : ১৯১৪ সালে নির্মিত প্যারিসের রোমান ক্যাথলিক চার্চ। ইংরিজিতে পুরো নাম, ব্যাসিলিকা অফ দ্য সেক্রেড হার্ট অফ প্যারিস। ১৮৭১ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয় এবং ওই বছরই সমাজতান্ত্রিক পারি কম্যিউনের জাতীয় স্মৃতিতে শহরের সবচেয়ে উচ্চবিন্দুতে মঁমার্তের শৃঙ্গভাগে রোমান-বাইজেন্টাইন স্থাপত্যরীতির এই চার্চ। ফরাসি রক্ষণশীলতার নৈতিক ভাষ্যের মূর্ত প্রকাশ বলে একে ধরা হয়। এর গম্বুজের চূড়া থেকে প্রায় গোটা প্যারিস শহরটাকে দেখা যায়। 
৪. মঁমার্ত : ফরাসি উচ্চারণে মঁমার্ত্র (Montmartre)। এটা প্যারিসের অষ্টাদশ প্রশাসনিক শাখার অন্তর্গত এক পাহাড়ি টিলা। এর চূড়াভাগে থাকা শ্বেত-গম্বুজওয়ালা সাক্রে কয়্যের গির্জা আর গোটা এলাকা জুড়ে ছড়ানো নৈশ কাফেগুলির জন্যে অধিক পরিচিত মঁমার্ত। দালি, পিকাসো, ভ্যান গঘ প্রমুখ বহু শিল্পী বিশ শতকের শুরু থেকে এখানে এসেছেন, থেকেছেন দীর্ঘকাল, তাঁদের কাজ করেছেন।
৫. অবারভিলে (Aubervillers) : প্যারিসের উত্তর-পূর্বের শহরতলিতে অবস্থিত একটি ফরাসি কম্যিউন।    
৬. গে হোয়াইট ওয়ে : ১৯০২ সাল থেকে নিউইয়র্কের ব্রডওয়েকে ‘গ্রেট হোয়াইট ওয়ে’ বলা হয়। মিউজিকাল গে হোয়াইট ওয়ে ১৯০৭-এর অক্টোবরে ফিলাডেলফিয়ায় অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ক্যাসিনো থিয়েটারে চালু হলে, ‘গ্রেট হোয়াইট ওয়ে’র বদলে নাট্যশহর ব্রডওয়েকে সাধারণত ‘গে হোয়াইট ওয়ে’ নামেই ডাকা হত এর ডাকনাম হিসেবে। বিশ শতকের পঞ্চাশ এবং ষাটের দশক থেকে ‘গে’ শব্দটি ‘সমকামী’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। আবার ওই সময় থেকেই টেলিভিশনের দর্শক বাড়ার সাথে সাথে আমেরিকার সংস্কৃতির ওপর ব্রডওয়ে মিউজিকালের বিপুল প্রভাব ও জনপ্রিয়তাও কমতে শুরু করে। এখন ‘গে হোয়াইট ওয়ে’ কথাটি কদাচিৎ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, যদি বা হয়, তাহলে ‘গে’ শব্দের সমকামী ব্যবহারকেই এতে উল্লেখ করা হয়।  

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘বিএনপি যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে’
‘বিএনপি যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে’
ফেসবুকে নিজের সমালোচনা দেখে হাসি পায় সাকিবের
ফেসবুকে নিজের সমালোচনা দেখে হাসি পায় সাকিবের
উপজেলা নির্বাচনে পলকের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে হাইকোর্টে রিট
উপজেলা নির্বাচনে পলকের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে হাইকোর্টে রিট
নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না