X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
পর্ব—এক

কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন

মুহম্মদ মুহসিন
০৯ জুন ২০২২, ১৯:১৩আপডেট : ০৯ জুন ২০২২, ১৯:১৩

শিরোনাম দেখে একটু ভিরমি দশা হতে পারে—‘কুসতুনতুনিয়াটা আবার কোন দুনিয়া’? এ ব্যাপারে গুগল ম্যাপও খুব সাহায্য করবে না। সেখানে কুসতুনতুনিয়া খুঁজলে দেখা যাবে ভারতের উত্তর প্রদেশের রাতাউলের একটি দোকানের ঠিকানা। তবে সার্চটা গুগল ম্যাপে না দিয়ে সরাসরি গুগলে দিলে আসল দুনিয়ার খবরটা পাওয়া যাবে। সেখানে কুসতুনতুনিয়া লিখলেই নিচে এর বিকল্প টাইটেল হিসেবে যে নামটি দেখা যাবে সেটি মোটামুটি আমজনতার পরিচিত দুনিয়ারই মশহুর এক জায়গা—কনস্টান্টিনোপল, অর্থাৎ ইস্তাম্বুল। তবে এলেম কালামে যারা আমার মতো উম্মি না, তারা `মুসনাদে আহমাদ’ গ্রন্থের বরাতে জ্ঞানের গোড়ার অন্যতম গুরু হজরত মুহম্মদ (স.)-এর লফজ থেকেই জানেন সেই বিখ্যাত উক্তি যেখানে মুহম্মদ (স.) বলেছেন—‘অবশ্যই তোমরা কুসতুনতুনিয়া জয় করবে—তো কত না উত্তম ঐ অভিযানের আমির এবং কত না উত্তম ঐ বাহিনী’!

সেই কুসতুনতুনিয়ায়ই আমি এবার কয়েকদিনের জন্য গিয়েছিলাম। তবে হাদিস কোরানের যতই বরাত-রেফারেন্স দেই না কেন, আমার এই যাওয়া আর হাদিসের ঐ ‘আমিরিয়াত’ বা ‘অভিযাত্রা’র মাঝে ‘আগরতলা’র সাথে ‘উগৈরতলা’র যতটুকু সম্পর্ক ততটুকু সম্পর্কও ছিল না। বরং আমার মতো পাপী-তাপীর সম্পর্ক ঘটনাক্রমে হয়ে যেতে পারে কুসতুনতুনিয়ার দুনিয়ায় পাপের দাগী নাম বহনকারী নমরুদের সাথে। নাউজুবিল্লাহ, এমনটা না হোক—এমন মোনাজাত অন্তরে থাকলেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সফরটা যখন এরাদায় এনেছিলাম তখন ঐ খানেখোদা নমরুদের নামটাই দিলের মধ্যে উচ্চারিত হয়ে গিয়েছিল। এর জন অবশ্য দায়ী ছিল আরেক অভিশপ্ত নাম ‘ফেরাউন’।

ফেরাউন ব্যাটাকে নিয়ে আমার স্ত্রী নাসিমা জাহান লুসির একটা দুর্মর আগ্রহ আছে। তাই দুনিয়ায় তার দুটিমাত্র জায়গা দেখারই সাধ—একটা হলো পবিত্রভূমি মক্কা-মদিনা, আরেকটি হলো ফেরাউনের কারণে অভিশপ্ত ভূমি মিশর। মক্কা মদিনার জন্য টাকা জামা দিয়েও কমবখত করোনার জন্য প্রতিবছর খালি পিছিয়ে যাচ্ছি। তাই ২০২১ সালের শেষদিকটায় যখন দেখলাম কমিনার জাত করোনা তার অব্যাহত অভিশাপের যাত্রা থেকে একটু পিছে ফেরার খেয়াল করছে তখনই মনের মধ্যে ইচ্ছারা ইতিউতি মারতে শুরু করল আর বলতে লাগল—‘যা বাছা, বউয়ের সাধটা মেটা, মক্কামদিনা সুবিধামতো যাবি, এবার ফেরাউনের দেশের দুটো ভিসার জন্য একটা দাপাদাপি শুরু কর’। মনের এতদিনের ঘাপটিমারা ইচ্ছারা এভাবে আমাকে কাবু করল এবং আমি ফেরাউনের দেশ মিশরের দুটো ভিসার জন্য পরিচিত কিছু ট্রাভেল এজেন্সির সাথে বাতচিত শুরু করলাম। কিন্তু ধাক্কা খেলাম। ট্রাভেল এজেন্সিরা বলছে—মিশর ভিসার আবেদন নেয়, নিয়ে খালি করোনার ভাবগতিক লক্ষ করে এবং মাসের পর মাসেও পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার নাম করে না। তাদের পরামর্শমতে আমরা বরং তুরস্ক যাওয়ার এরাদা করতে পারি। লুসিকে বললাম—‘দেখ, ব্যাপারটা কিন্তু নেহায়েত মন্দ না, তুমি ফেরাউনের দেশ মিশর আপাতত স্থগিত রেখে, চল বরং নমরুদের দেশ তুরস্কটাই আগে দেখে আসি’। অল্প পীড়াপীড়িতেই লুসি রাজি হয়ে গেল। শুরু হলো আমাদের নমরুদের দেশ তুরস্ক আর মহানবীর হাদিসে বর্ণিত কুসতুনতুনিয়ার দুনিয়ায় যাওয়ার প্রস্তুতি।

প্রস্তুতিটা শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে। আর সেই প্রস্তুতির ফসল হিসেবে আমাদের প্লেন ঢাকা থেকে উড়াল দিলো ২০২২ সালের মার্চের ৩ তারিখ। তাও সরাসরি তুরস্কের দিকে নয়। কোনো অজানা কারিশমায় ঢাকা থেকে দুনিয়ার সকল ফ্লাইটের টিকেটের দাম ঐ সময়টায় এমন বাড় বেড়েছিল যে দেখা গেল ঢাকা থেকে তুরস্ক গেলে ট্যাঁকের যে কয় টাকা গুনতে হয়, তারচেয়ে সিঙ্গাপুর থেকে তুরস্ক গেলে তার অর্ধেক টাকায়ই হয়ে যায়। অথচ ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল যে দূরত্ব তারচেয়ে সিঙ্গাপুর থেকে ইস্তাম্বুলের দূরত্ব প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার বেশি। বাংলাদেশের এই ক্যারিশমার কারণে শেষ পর্যন্ত আমার মতো ঘোড়ারোগাক্রান্ত গরিবদের তখন এদিক-সেদিক ঘুরে বলা যায় লোকাল বাসের মতো স্টেশন পাল্টিয়ে পাল্টিয়ে বিদেশ যাত্রার আয়োজন করতে হয়েছে। সেই আয়োজনে আমাদের জুটেছিল কুয়েত এয়ারওয়েজের দুখানা টিকেট। দাম সরাসরি ইস্তাম্বুলের টিকেটের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। আলহামদুলিল্লাহ বলে সেই টিকেটে আমরা চললাম কুসতুনতুনিয়া তথা ইস্তাম্বুলের দিকে। পথে কুয়েতে আমরা ঘণ্টা দুই যাত্রাবিরতি পাব, তারপরে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ আমাদের পৌঁছার কথা ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্ট।

বিমান খালি দেরিই হয় জানতাম। বিমান যে সময়ের আগেও যায় তা এবার ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে নেমে বুঝলাম। যথাসময়ের প্রায় পৌনে একঘণ্টা আগে আমরা নামলাম ইউরোপের সবচেয়ে ব্যস্ত ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে। পূর্বের ‘ইস্তাম্বুল আতাতুর্ক এয়ারপোর্ট’ নতুন জায়গায় স্থানান্তর করে এবং নামটা থেকে ‘আতাতুর্ক’টুকু বাদ দিয়ে ২০১৯ সালে এই এয়ারপোর্টটি চালু করা হয়েছে। ২০২১ সালের রেকর্ড অনুযায়ী এটি ইউরোপের ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট এবং সারা বিশ্বের ২য় ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট। তেরকোস হ্রদের পাড়ে ১৯০০০ একর জমিজুড়ে এয়ারপোর্টটি নির্মিত হয়েছে। এর প্রধান টারমিনালটির আয়তন প্রায় দেড় বর্গ কিলোমিটার যা এ মুহূর্তে পৃথিবীর বৃহত্তম টার্মিনাল ভবন। পৃথিবীর সেই বৃহত্তম ফ্লাইট টার্মিনাল ভবনে প্রায় দুই কিলোমিটার পায়ে হেঁটে আর ইলেকট্রিক ওয়াকওয়েতে দৌড়ে আমি এবং লুসি দুই গরিব দেশের যাত্রী পৌঁছলাম আমাদের ইমিগ্রেশন কাউন্টার আর লাগেজ ক্লেইম কক্ষে।

লাগেজ ক্লেইম করে একটি ট্রলিতে বহনের জন্য সারি দিয়ে রাখা একটি ট্রলি টানাটানি করে বের করতে গিয়ে দেখি আমি যে একটু উজবুক কিসিমের আছি তা লুসি তো আগে থেকেই জানে, এবার পাশের লোকগুলোও টের পেয়ে যাচ্ছে। ট্রলিগুলো যে একটি অদৃশ্য তালায় আটকে রাখা হয়েছে এবং তালা খোলার জন্য যে কিছু চক্করবক্কর কিউআর কোডের মধ্যদিয়ে টাকা ট্রান্সফার ছাড়া হাতের জোরে টানাটানির কোন অর্থ নেই তা যথেষ্ট উজবুক বলেই আমার বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যাক, শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরে অল্প মানইজ্জত হাতে রেখে ট্রলি ছাড়াই ফিরে আসলাম। এবার বের হওয়ার পালা। সব লোক যেদিকে যাচ্ছে সেদিক আগাতেই কিছুক্ষণে চোখে পড়ল বিশাল অক্ষরের Chikis সাইনবোর্ড যার নিচে একটু ছোট অক্ষরে লেখা Exit। শিখলাম প্রথম তুর্কি শব্দ ‘চিকিস’ মানে ‘প্রস্থান’। প্রস্থানের সেই পথ ধরে প্রস্থান হতে না হতেই চোখে পড়ল আমাদের পনেরো দিনের তুরস্ক ভ্রমণে আমরা দুজন নিজেদেরকে যার ওপরে সোপর্দ করে দিয়ে ‘নো-টেনশন’ মুডে ঘুরব, খাব আর ঘুমাব সেই পরিচিত মুখ—জয়নাল।

জয়নাল আবেদীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সরকার ও রাজনীতি’ বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় গবেষণার মাধ্যমে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক মাহমুদ ছিল আমার শিক্ষকতার জীবনের প্রথম দিকের ছাত্র-কাম-বন্ধু। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাহমুদের ছাত্র ছিল জয়নাল। মাহমুদই ইস্তাম্বুলে অবস্থানরত এই জয়নালের সাথে আমার যোগসূত্র স্থাপন করে দিয়েছে। জয়নাল সামনের সেশনে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির চেষ্টায় রয়েছে। ফলে এই মুহূর্তে তার যথেষ্ট অবসর আছে বিধায় এই নমরুদের দেশে আমাদের ১৫ দিনের পথচলায় সে সার্বক্ষণিক সারথি হতে রাজি হয়েছে। ঘণ্টাখানেক ধরে সে আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল। আমরা বের হতেই মিনিটের মধ্যে বিদেশ বিভূঁয়ে এই আপন চেহারার সন্ধান মেলায় আমরা বলতে গেলে তখন প্রায় আহ্লাদে আটখানা।

এই আহ্লাদ নিয়েই তার কাছে প্রথম আবদার করলাম—‘পানি খেতে হবে’। বিমানে মিল চয়েস করতে গিয়ে চেয়েছিলাম ‘ল্যাম্ব’। সার্ভ করার সময় বিমানবালা বলল—‘নিন, আপনার লাহাম’। সেই ল্যাম্ব-লাহামের পরিপাকে পাকস্থলি যতখানি পানি চাচ্ছিল তা তাদের নাপিতের হোজবাটির মতো দেওয়া প্লাস্টিক-বাটিতে মোটেও ছিল না। তারপরে আবার বিমান থেকে নেমে দেড়-দু কিলোমিটার ধরে টার্মিনালে হাঁটা। ফলে পানির অভাবে শরীর প্রায় কারবালা হয়ে যাচ্ছিল। কারবালায় রুগ্ন জয়নালের জন্য পানি আনতে হোসেন-বাহিনী নেমেছিল যুদ্ধে। আর ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে সেই জয়নালই নামল আমাদের জন্য পানির খোঁজে। আশ্চর্যের বিষয় হলো ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টের এক্সিট ডোর থেকে বের হয়ে যে বিশাল প্যাসেঞ্জার-ফ্লোর ও সহগ অন্যান্য স্থাপনা সেই বিশাল স্থাপনার এদিক-সেদিক প্রায় বিশ মিনিট ধরে খোঁজাখুঁজি করেও জয়নাল এক ফোঁটা পানি আমাদের জন্য কোথাও পেল না। কিনতেও পেল না, কিংবা এয়ারপোর্টের ব্যবস্থাপনায় ড্রিংকিং ওয়াটারের কোনো ফ্রি ট্যাপেও পেল না। মনে হলো এ তো এয়ারপোর্ট নয়, এক সাক্ষাৎ কারবালা। তবে জয়নাল ছাড়ার পাত্র নয়। সে শেষ পর্যন্ত সেই কারবালা থেকেই পানি জোগাড় করে ছাড়ল। নিরাপত্তা চৌকির এক পুলিশের কাছ থেকে তার ব্যক্তিগত মালিকানার আধা লিটারের এক বোতল পানি নিয়ে জয়নাল এসে হাজির হলো। মনে হলো, ভাগ্যিস জয়নাল সাথে ছিল, না হয়, এক অক্ষর বাংলা বা ইংরেজি না-বলা এই দেশে শেষ পর্যন্ত পানির অভাবেই পটল তুলতে হতো কি-না আল্লাহ মালুম।

এবার রওয়ানা নবীজির সেই কুসতুনতুনিয়া আর আমাদের ইস্তাম্বুল শহরের দিকে। টাকা পয়সা এখনো তুর্কিকরণ করা হয়নি। তাই জয়নালের ট্যাঁকই ভরসা। জয়নাল টিকেট কাটল তিনটি। গন্তব্য আকসারাই। বাসে উঠে টার্মিনালের অভ্যন্তরের আলো-ফকফকা অংশ পার হয়ে বুঝতে পারলাম সময়টা আর দিন নেই। পুরোপুরি রাত। আধাশহর-আধাগ্রামের মধ্যদিয়ে চলা বাসের এই রাস্তায় রাতে আর বাইরে কিছু দেখার নেই। এ অবস্থায় এবার ভাবালুতার সাথে চোখ বুজে নিজের ভিতরেই একটু ডুব মারতে চেষ্টা করলাম। ডুব দিয়ে মনের বাড়িতে গিয়ে ভিতরে একটু শিহরন অনুভব করলাম। মনে হলো আমি চলছি সেই দেশের রাস্তায় যেই দেশের গলিতে-ঘুপচিতে আর মাটির পরতে-পরতে মুক্তোর মতো ছড়িয়ে আছে বিশ্ব ইতিহাসের অবিস্মরণীয় সকল ঘটনা ও নিদর্শন। এই সেই দেশ যেখানে গোবেকলি-তেপেতে রয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব বারো হাজার বছর পূর্বের নব্যপ্রস্তর যুগীয় মনুষ্যবসতির বিষ্ময়কর নিদর্শন। গোবেকলি-তেপেতে অবস্থিত খ্রিষ্টপূর্ব দশ হাজার বছর পূর্বের মন্দির এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত মানুষ জাতির আদিমতম উপাসনাস্থল। এ দেশে রয়েছে লৌহযুগের প্রথম দিকের সভ্যতার নিদর্শন ট্রয় নগরী, যার শুরু হয়েছিল মূলত প্রস্তর যুগেই। খুব ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলেও ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে ২১৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণকারী নবী ইব্রাহিম (আঃ) এবং তাঁকে শাস্তি দিতে উদ্যত সম্রাট নমরুদও এই তুরস্কের অধীন উরফা নগরীরই বাসিন্দা ছিলেন। এই তুরস্কে প্রথম সাম্রাজ্য স্থাপিত হয় হিট্টাইটদের হাতে এবং সেই সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্রের নাম ছিল কুসারা যার পত্তন হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৫০ সনে। এই কুসারা থেকেই দুই শতাব্দীর মধ্যে স্থাপিত হয়েছিল বিখ্যাত আনাতোলিয়া সাম্রাজ্য। গ্রিক সভ্যতার বিখ্যাত রাষ্ট্র লিডিয়াও (Lydia) এই তুরস্কেই অবস্থিত ছিল। গ্রিকরা এখানে অনেকগুলো নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল যেমন মিলেতাস (Miletus), এফেসাস (Ephesus) স্মার্না (Smyrna), বাইজান্টিয়াম (Byzantium) ইত্যাদি। তুরস্কের এ রাষ্ট্রগুলো নামে গ্রিক রাষ্ট্র হলেও এগুলো মূলত ছিল তুরস্কের মাটিতেই অবস্থিত। ফলে নগররাষ্ট্র মিলেতাসের অধিবাসী বিখ্যাত দার্শনিক থ্যালিসকে গ্রিক দার্শনিক না বলে বরং তুর্কি দার্শনিক বলাই সমীচীন। একইভাবে অ্যানাক্সিমেন্দার (জন্ম ৬১০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ), অ্যানাক্সিমেনেস (জন্ম খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৫৮৫) এবং ডায়োজিনিস (জন্ম খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৩২৩) গ্রিক দার্শনিক বলে পরিচিত না হয়ে তুর্কি দার্শনিক বলে পরিচিত হওয়াই উচিত ছিল। হোমারের ইলিয়াডের সেই যুদ্ধক্ষেত্র ছিল এই তুরস্কের মাটিতে। তারপর এই সকল গ্রিক নগররাষ্ট্র আবার দখল করে নিয়েছিলেন পারস্য সম্রাটরা খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে। গ্রিক বীর আলেকজান্ডার আবার এগুলো পুনর্দখল করে নিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৪ অব্দে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে তুরস্কের এই গ্রিক রাষ্ট্রগুলোসহ তুরস্কের বিশাল ভূখণ্ড রোমান সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে যায়। তবে রোমান সম্রাটরা এখানে গ্রিক ভাষা ও গ্রিক সংস্কৃতিই আবাদ করে চললো। যিশুর অনুসারীরা দলে দলে বেড়ে গেলে যে শহরে প্রথম ‘খ্রিষ্টান’ শব্দটি উদ্ভূত ও উচ্চারিত হয়েছিল সেটিও তুরস্কেরই শহর এন্টিয়ক।

তুরস্কের বিশাল এলাকাজুড়ে রোমান সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়ে চলল খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে। ইহা ব্যাপক বিস্তার লাভ করলো খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে রোমান সম্রাট প্রথম কনস্টানটইানের হাতে। তিনি ইস্তাম্বুল তথা বায়জান্টিয়ামকে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানীতে রূপান্তর করলেন এবং তাঁর নামানুসারেই এর নাম হলো কনস্টান্টিনোপল, আরব রাজ্যে যার উচ্চারণ ছিল কুসতুনতুনিয়া। কনস্টানটইান নিজে খ্রিষ্টান না হয়েও রাজনৈতিক সুবিধার্থে খ্রিষ্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করলেন। এই রোমান সাম্রাজ্য টিকে থাকল প্রায় পনেরো শত বছর, তবে পুরো তুরস্কজুড়ে নয়। ১০৩৭ থেকে ১১৯৪ পর্যন্ত তুরস্কের একটা বড় অংশ ছিল সুন্নি মুসলিম সেলজুক সুলতানদের অধীন। এরপর ত্রয়োদশ শতকে ইরতুগরুল গাজী এবং তাঁর ছেলে ওসমানের হাত ধরে তুরস্কের মাটিতে পত্তন শুরু হলো বিখ্যাত ওসমানীয় বা আটোম্যান সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্য ১৪৫৩ সালে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় কনস্টানটাইনকে পরাজিত করে শুধু তুরস্ক নয় বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপ ও আফ্রিকার অনেকখানিজুড়ে বিস্তৃত হলো। ওসমানীয় শাসনামলই তুরস্কের সবচেয়ে গৌরবের অতীত। ইহার ব্যাপ্তি ছিল ত্রয়োদশ শতক থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ২৯ অক্টোবর ১৯২৩ পর্যন্ত। এর পরের ইতিহাস সকলের জানা। কামাল আতাতুর্কের হাত ধরে জন্ম নিল আধুনিক তুরস্ক। চলবে

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!