X
মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
৩০ বৈশাখ ১৪৩২
পথে নেমে পথ খোঁজা

‘জাগ্রত বাংলাদেশ’ ও আহমদ ছফা : এক ক্ষ্যাপা বাউলের প্রাণ ।। পর্ব—সাত

মঞ্জু সরকার
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৩৮আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৪৩

প্রথম পরিচয় ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মারক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ, অভিজ্ঞতা ও চিন্তা নিয়ে আহমদ ছফার লেখা নিবন্ধের এ বইটি মুক্তধারা প্রকাশ করেছিল ১৯৭১ সালেই, কলকাতা থেকে। পরে বাংলাদেশেও সংস্করণ হয়েছে। আমি গ্রন্থকেন্দ্রের বিক্রয় বিভাগে বসে বইটি পড়ি তেয়াত্তর কি চুয়াত্তর সালের দিকে। বইয়ের নামের সঙ্গে লেখকের জীবন ও কর্ম এতটাই মিল খুঁজে পাই যে, একে অপরের পরিপূরক যেন। ওই সময়ে জাসদের মুখপত্র ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’-এ নিয়মিত কলম লিখতেন। সেই কলাম পড়েও বেশ ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম প্রতিবাদী এই লেখকের।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান, এর কার্যক্রমে সরকারি আশীর্বাদধন্য বা আশীর্বাদ প্রত্যাশী লেখক-বুদ্ধিজীবীদের নিয়মিত দেখতাম। কিন্তু আহমদ ছফাকে বক্তা হিসেবে দেখিনি কোনো অনুষ্ঠানে। একজন ব্যতক্রমী ও প্রতিবাদী লেখক হিসেবে গণ্য করা হতো তাকে। আর এটাও তার প্রতি আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা বাড়ার অন্যতম কারণ।

টিয়া পাখি কাঁধে আহমদ ছফা মনে পড়ে, নগরীর ফুটপাতে আহমদ ছফাকে প্রথম দেখে একজন বাউল দেখার কৌতূহল ও আকর্ষণবোধ জেগেছিল। দীর্ঘ একহারা চেহারা, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, হাতে লম্বা একটা বাঁশের বাঁশি। আমার মুগ্ধ দৃষ্টি একাগ্র দেখে আমাকেও ঠারে ঠারে দেখেছেন। আগ বাড়িয়ে আলাপ পরিচয় করার সাহস হয়নি। শুনেছি ঘাড়ে পোষা পাখি নিয়েও চলাফেরা করতেন তিনি।

স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী তারুণ্যের একটি বড় অংশকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছিল তারা। গণকণ্ঠ নামের দৈনিক পত্রিকাটি মুখপত্র ছিল তাদের। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতার অসম্পূর্ণতা ও মুজিবের শাসনের বাস্তবতায় আহমদ ছফাও সন্তুষ্ট ছিলেন না বলাই বাহুল্য। গণকণ্ঠ পত্রিকায় তাঁর সাহসী ও প্রতিবাদী কলামগুলি ছিল তার প্রমাণ। মনে পড়ে, একটি লেখায় সরকারি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, দালাল বুদ্ধিজীবী ও বাংলা একাডেমিরও তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. মাজহারুল ইসলাম ‘অঙ্গনে কুকুর’ এল নামে তার প্রতিবাদও ছেপেছিলেন।

গ্রন্থকেন্দ্রে চাকরি করে সহজে বুঝতে পারতাম, সরকারি মদদপুষ্ট দেশের প্রতিষ্ঠিত লেখক-বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই আহমদ ছফার আক্রমণের ভয়ে তটস্থ থাকতেন। এড়িয়ে চলতে চাইতেন তাকে। অন্যদিকে আহমদ ছফার আক্রমণাত্মক সাহসী চরিত্র এবং প্রতিবাদী চেতনায় শানিত লেখাগুলি তার ওপরে আগ্রহ ও ভক্তি বাড়িয়ে তুলেছিল আমার। সেই সময়ে হাতের নাগালে তার যত বই পেয়েছি, পড়েছি। উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথী’, ‘ওঙ্কার’, কাব্যগ্রন্থ- ‘প্রবীণ বটবৃক্ষের কাছে প্রার্থনা’, ছাত্রাবস্থায় লেখা সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসও বাদ দিইনি। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতাভিত্তিক উপন্যাস ‘অলাতচক্র’, ‘গাভীবৃত্তান্ত’, ‘পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ’, গ্যয়েটের অনুবাদগ্রন্থ ‘ফাউস্ট’ এবং ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ ও ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এর বিভিন্ন প্রবন্ধ পড়েছি। একজন উপন্যাসিক কি কবি হিসেবে আহমদ ছফা আমার কাছে প্রিয় ও বড় লেখক হয়ে ওঠেননি সত্য, কিন্তু তার লেখায়, বিশেষ করে প্রবন্ধ-নিবন্ধে যে নানামুখি চিন্তার ব্যাপ্তি এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে তার ব্যতিক্রমী ও প্রতিবাদী অবস্থান সর্বদাই আকৃষ্ট করেছে আমাকে, শ্রদ্ধাশীল রেখেছে তাঁর প্রতি।

ছোট চাকরি ও টানাপড়েনের সংসারের শিকলে বাঁধা পড়ার পরও অন্তরে জ্বালিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সেই অবিনাশী প্রাণশক্তিকে। দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হলেও, বিভিন্ন বাম ও বিপ্লবী দলের কিছু নেতাকর্মীর সঙ্গে আলাপ ও বন্ধুত্ব হয়েছিল। জাসদেও ছিল বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব। তাদের কাছে আহমদ ছফার গল্প এমনভাবে শুনতাম, যেন ছফা ভাই তাদের একান্তই নিজস্ব লোক। তখনও ছফা ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়নি শুনে জাসদ সমর্থক এক বন্ধু আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছফা ভাই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে থাকতেন।

প্রথম পরিচয়ের দিনে ছফা ভাই সারা রাত জেগে বেটোফেন শোনার প্রতিক্রিয়ায় আচ্ছন্ন থাকার কথা বলেন। আমার বাড়ি রংপুরে শুনে উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহ দেখালেন। ভাওয়াইয়া গান বলতে বললেন আমাকে। কিন্তু ছফা ভাইয়ের মতো সাহস ও আবেগ পাব কোথায়? আমার অক্ষমতা দেখে নিজেও স্বরচিত গান ও কবিতা শুনিয়ে দেন আমাদের। ছফা ভাইয়ের বেসুরো হারমোনিয়াম-বাদন শুনে হাসি পেলেও, তার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের সরল প্রকাশ তুচ্ছ ভাবতে পারিনি। হলের সামনের একটা জায়গায় নিজ হাতে সবজি চাষ করেছেন। অনেক বড় হয়ে উঠেছে তার বেগুনগাছ। সেগুলি দেখাতেও নিয়ে যান। টলস্টয় জমিদার হয়েও তার দেশের বঞ্চিত কৃষকশ্রেণির জন্য তার দরদ যেমন মিথ্যে ছিল না, তেমনি ছফা ভাইয়েরও কৃষক ও প্রকৃতিপ্রেম একটুও মিথ্যে মনে হয়নি। কাছে থেকে দেখার ও কথাবার্তা শোনার প্রথম সাক্ষাতেই আরো মনে হয়েছিল, শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের কালজয়ী স্রষ্টাদের অসাধারণ কীর্তি যেমন মানুষটার অন্তর আলোড়িত করে, তেমনি তাদের মতো একজন হওয়ার স্বপ্ন-সাধনায় দেশের সাধারণ মানুষ, প্রকৃতি ও লোকজীবনকে পরমাত্মীয়ের মতো প্রশ্রয় দিতে চায়।

আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অবিনাশী আয়োজন’ ১৯৮২-তে প্রকাশিত হয়। অগ্রজ অনেক লেখকের সঙ্গে কপি দিয়েছিলাম প্রিয় ছফা ভাইকেও। ছফা ভাই তখন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ-এ তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ড. মফিজ চৌধুরীর পরিত্যক্ত ব্যবসার অফিসে বসতেন। একটি ছেলেকে চিরকুটসহ গ্রন্থকেন্দ্রে পাঠিয়ে আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন সেই অফিসে। আমার বই পাঠের প্রতিক্রিয়ায় ছফা ভাই তার ভালো লাগার কথা বলে উৎসাহ দিয়েছিলেন। ফাঁকা অফিসটায় কাগজে বড় অক্ষরে ছফা ভাইয়ের নানারকম স্বপ্ন-পরিকল্পনার কথা লেখা ছিল। মুখেও বলছিলেন, ‘সম্ভাবনা’ নামে একটা সাহিত্যপত্রিকা করবেন। সম্ভাবনাময় ও সমমনাদের একটা নিজস্ব প্লাটফরম দরকার। ওই সময়ে তাঁর সদ্য প্রকাশিত শিল্পী এস.এম. সুলতানকে নিয়ে লেখা বইটিও দিয়েছিলেন আমাকে। শিল্পকলার রসস্বাদনে এ বিষয়ে তার বিস্তর পড়াশুনার কথাও বলছিলেন। ছফা ভাইয়ের শিল্পকলা মূল্যায়নবিষয়ক সেই লেখাটি পড়ে মনে হয়েছিল, এই শিল্পীর সঙ্গে আহমদ ছফার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মূলে দুই শিল্পীসত্তায় কিংবা জীবনসাধনায় কোথায় যেন মিলসূত্র রয়েছে। চিত্রশিল্পের সমালোচক না হয়েও শিল্পী সুলতানের অসামান্য প্রতিভার মূল্যায়নে এবং তার সামাজিক স্বীকৃতি আদায়ে আহমদ ছফার ভূমিকা ছিল আন্তরিক, যা শুধু লেখার মধ্যে সীমিত ছিল না।

লেখায় যেমন, তেমনি মুখের কথায় আহমদ ছফা ছিলেন দ্বিধাহীন বেপরোয়া। টগবগে তারুণ্যে ভরপুর। কখনো-বা মনে হতো সদাই খাপখোলা তরবারির মতো ধারালো, পষ্টভাষী। সাহিত্য অঙ্গনের প্রতিষ্ঠিত দিকপালদের প্রতিষ্ঠার দুর্বল ভিত ধসে যেত তার মুখের অগ্নিবাণে। চরিত্রের অন্ধকার দিক দুর্গন্ধ ছড়াত। আমার মতো অনুজ ভক্তদের কাছে ছফা ভাই এসব বলতেন সম্ভবত নিজেদের প্রতিবাদী ও সাহসী চরিত্র গঠন এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে প্রেরণা জোগানোর স্বার্থেই। নিজে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন, অন্যদের মধ্যে স্বপ্ন ও সাহস সঞ্চার করতে পারতেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে কাঙ্ক্ষিত স্রোতধারা সৃষ্টির লক্ষ্যে সংগঠিতভাবে কিছু করার চেষ্টাও ছিল বিরামহীন। শুনেছি লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রধান উদ্যোগী সংগঠক ছিলেন তিনি।

এরশাদ আমলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ে শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন প্রমুখের উদ্যোগে লেখকদের একটি পেশাগত সংগঠন লেখক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দলমত নির্বিশেষে সব লেখকই সেই সংগঠনের সদস্য হয়েছিলেন। গ্রন্থকেন্দ্র ইউনিয়নের অস্থায়ী অফিস হয়েছিল বলে আমাকে হতে হয়েছিল দফতর সম্পাদক। লেখক ইউনিয়নের উদ্যোগে লেখক নামে একটি উন্নত নিউজপ্রিন্ট কাগজও উৎপাদনের ব্যবস্থা হয়েছিল। সেই কাগজও বিলিবণ্টনের দায়িত্ব পালন করতে হতো আমাকে। ছফা ভাই ইউনিয়নের নেতৃত্ব নির্বাচনের সময় সাধারণ সম্পাদক পদে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। বেশ কিছু তরণ লেখকের ভোট পেলেও হেরে গিয়েছিলেন ছফা ভাই। কাউকেই বিনা চ্যালেঞ্জে কোনো কিছু ছেড়ে দিতে সম্মত ছিলেন না তিনি, এমনই লড়াকু স্বভাব ছিল তাঁর। ফয়েজ আহমেদের চীনা-সংযোগ ও উদ্যোগের কারণেই সম্ভবত লেখক ইউনিয়নের বেশ একটা বড় প্রতিনিধিদল চীন ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ছফা ভাই ও তার সমর্থক লেখকরা এমন সুযোগের বাইরে থাকবেন, সেটাই ছিল স্বাভাবিক।

১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে তোপখানা রোডে চট্টগ্রাম সমিতির ভবনে ছফা ভাই তার নিজস্ব প্রেস, পত্রিকা, প্রকাশনা চালু করার স্বপ্ন-পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করেন। নেপথ্যে পৃষ্ঠপোষক, অর্থের যোগানদাতা কে ছিলেন জানি না। ছফা ভাই কোনো চাকরি করেননি, ব্যবসায়ীও ছিলেন না। হঠাৎ অল্প-বিস্তর অর্থের মালিক হওয়ার সুস্থ-স্বাভাবিক কোনো পথ ছিল না বলে ছফা ভাইয়ের প্রেস-পত্রিকার মালিক হওয়াটা মনে সন্দেহ জাগিয়েছিল। তার কথা ও কাজের অসঙ্গতি নিয়েও অনেক সময় সামনাসামনি সমালোচনা করেছি। কিন্তু ‘সম্ভাবনা’ নামে সাহিত্যপত্রিকা অচিরেই সম্ভব হয়ে উঠবে, নিজস্ব একটি প্রকাশনা ও অনেকের দাঁড়াবার যোগ্য একটা প্লাটফরম গড়ে তুলবেন, এসব স্বপ্ন-পরিকল্পনা বড় হয়ে উঠেছিল তার কাছে। ছফা ভাইয়ের অফিসে তখন প্রগতিশীল সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী মোরশেদ শফিউল হাসান, দিলওয়ার হোসেন, রেজা, স্বপন প্রমুখ তরুণদের কাজ করতে দেখেছি।

আহমদ ছফা ও এস এম সুলতান ‘সম্ভাবনা’য় প্রথম উপন্যাস লেখার জন্য আমারও ডাক পড়ল। লেখার অগ্রিম সম্মানী পাঁচশত টাকা দিয়ে দিলওয়ারকে আমার বাসায় পাঠিয়েছিলেন। ছফা ভাইয়ের তাড়া খেয়ে মাসখানেক সময়ের মধ্যে লেখা হয়েছিল উপন্যাস ‘তমস’। ‘সম্ভাবনা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই ছাপা হয়েছিল উপন্যাসটি। একইসঙ্গে অফপ্রিন্টে কপোতাক্ষী প্রকাশনা থেকে বইও হয়েছিল। এভাবে আহমদ ছফা আমার প্রথম উপন্যাসের সম্পাদক ও প্রকাশক হয়েছিলেন। পরবর্তীত কালে তার প্রতিষ্ঠিত ‘উত্তরণ’ পত্রিকা যখন আকরাম হোসেনের সম্পাদনায় ঈদসংখ্যা ম্যাগাজিন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল, ছফা ভাইয়ের প্রেরণাতেই সেই পত্রিকায় ‘হুমকি’ নামে উপন্যাস লিখেছিলাম, পরবর্তী কালে যা ‘প্রতিমা উপাখ্যান’ নামে বই হিসেবে বেরিয়েছে। এভাবে আমার লেখকজীবনের শুরুতে আহমদ ছফা অগ্রজ লেখক ও পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা নিয়েছিলেন।

নিজে কখনো হতাশ বোধ করলে, কোনো বিষয়ে জানার আগ্রহ বা কৌতূহল বোধ করলে আলোচনা করে ছফা ভাইয়ের মতামত জানার জন্য ছুটে যেতাম তার কাছে। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি কতো বিষয়ে তার পড়াশোনার ব্যাপ্তি! তাঁর পর্যবেক্ষণ, চিন্তাশীলতা এবং তাৎক্ষণিক মতামত দানের সক্ষমতা মুগ্ধ করত। নিজে কিছু পছন্দের মানুষ ও শ্রদ্ধেয় চিন্তাবিদদের সঙ্গে মিশতেন। একবার আমাকে নিয়ে গেলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বাসায়। উনবিংশ শতাব্দীর জাগরণ বিষয়ে ছফা ভাই তার স্যারের মতামত জানার জন্য আলোচনা শুরু করলেন। নীরব শ্রোতা হিসেবে দুই পণ্ডিত ব্যক্তির কথাবার্তা শোনা ছাড়া আমার কিছু বলার ছিল না। একইভাবে ছফা ভাইয়ের সঙ্গে থেকে বিভিন্ন সময়ে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতায় যাদের দেখেছি, নীরবে কখনো-বা তাদের আলাপচারিতা শুনেছি, এরকম কিছু বিশিষ্টজনদের মধ্যে শিল্পী এস এম সুলতান, ড. আহমদ শরীফ, ড. মফিজ চৌধুরী, সায়ীদ আতিকুল্লাহ, হোসেন জিল্লুর রহমান, হায়দার আকবর খান রনো, ফরহাদ মাজহার, মেজবাহ কামাল, সলিমুল্লাহ খান, সোহরাব হাসান, ব্রাত্য রাইসু ছাড়াও অনেক বিশিষ্ট প্রবীণ ও নবীন ছিলেন।

ছফা ভাইয়ের নিজস্ব প্রেস ও পত্রিকা কোনোটাই বেশিদিন টিকে থাকেনি। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠানবিরোধী এবং প্রতিবাদী চরিত্রটি বজায় ছিল আমৃত্যু। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা লাভে তৎপর লেখক-বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অনেকটা দ্বান্দ্বিক। এ কারণে বয়সে যারা তার চেয়েও তরুণ ও নবীন লেখক, তাদের সঙ্গে ছফা ভাইয়ের সম্পর্ক ও সখ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। আমি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে চাকরি করার সময়ে যে কয়েকজন প্রিয় মানুষ ও অগ্রজ লেখক প্রায়ই আমার টেবিলে এসেও কিছু সময় আড্ডা দিতেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ছফা ভাইও। কবি কায়সুল হকের অবসর গ্রহণের পর এক সময় আমি গ্রন্থকেন্দ্রের ‘বই’ পত্রিকাটির দায়িত্বে ছিলাম। এ সময় প্রকাশনাজগতের সমস্যা নিয়ে গ্রন্থনীতি বিষয়ে একটা মূল্যবান লেখা ছফা ভাইকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলাম। একবার কলকাতা থেকে আগত এক সুদর্শনা মহিলাকে নিয়ে এসেছিলেন। অধ্যাপিকা, জার্মানিতে থাকতেন (নাম ভুলে গিয়েছি)। আমার দিদি বলে পরিচয় দিয়েছিলেন।

বাংলাবাজারের প্রকাশকদের অনেকেই পছন্দ করতেন আহমদ ছফাকে। জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদর প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের ব্যাপারে তার ভূমিকার কথা অনেকেই জানে। হুমায়ূন ছাড়াও নতুন বহু লেখকের গ্রন্থ প্রকাশের ব্যাপারেও ভূমিকা রেখেছেন তিনি। আমার অফিসে আসলে সৃজনশীল আবেগে কিংবা প্রতিবাদী মেজাজে সোচ্চার হয়ে উঠতেন প্রায়ই। একবার এসে বললেন, ‘মঞ্জু মিয়া চলো, হুমায়ুন আজাদকে পেটাতে হবে।’ কারণ হিসেবে তার লেখার তীব্র সমালোচনা করলেন। জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকেও একবার নাকি বলেছিলেন, ‘হুমায়ূন, সংসার চালাতে আপনার কত টাকা লাগে? বলেন আমি দেব, তবু এসব বাজে আর লিখবেন না।’ লিখে টাকা রোজগারের প্রচেষ্টায় আমিও যখন প্রচুর লেখার চেষ্টা করছি ও তাড়াহুড়ো করে বইয়ের সংখ্যাও বাড়াচ্ছি, সমালোচনা করতেন আমাকেও। ‘মঞ্জু মিয়া, তুমি অন্তত আমাদের মহাশ্বেতা হইতে পারতা! কী লিখছো এসব?’ এমনভাবে নাক কুঁচকাতেন, আর কিছু বলার দরকার হতো না।

আগেই বলেছি, ছফা ভাইয়ের আক্রমণাত্মক প্রতিবাদী মেজাজকে ভয় পেত অনেকেই। এড়িয়ে চলতে চাইত তাঁকে। আমার মনে কখনো-বা সন্দেহ জাগত, ছফা ভাই যত বড় না প্রতিভা, তারচেয়ে কি বেশি ভাব-ভঙ্গি দেখান কি ইচ্ছে করে? কিন্তু এসব সন্দেহ ধুয়েমুছে যেত শিশুর মতো আবেগের অনাবিল প্রকাশ দেখে। আমার কাছে ছফা ভাইয়ের প্রতিবাদী আবেগময় কথাবার্তার মূলে তার সহানুভূতি ও ভালোবাসার দিকটাও স্পষ্ট হয়ে উঠত। প্রতিবাদ কিংবা সহানুভূতির সপ্রাণ আবেগময়তা ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠত তার গভীর চিন্তাশীলতা। ঘরসংসারের বাঁধনমুক্ত নিঃসঙ্গ এক বাউল সাধকের মতো শিল্পী ছফার ভাব-ভঙ্গি এবং গান-কবিতা-উপন্যাস সবার মন ছুঁতে পারে না হয়তো, কিন্তু প্রবন্ধগুলিতে প্রতিফলিত তাঁর মননের ব্যাপ্তি, তাঁর অন্বেষণ ও যুক্তিনিষ্ঠা পাঠককে ভাবায় অবশ্যই। এখানে তার কিছু প্রবন্ধের পাঠের কথা স্মরণ করতে পারি।

‘বাঙালী মুসলমানের মন’ প্রবন্ধটিতে তিনি বাঙালি মানস ও বাঙালি চেতনার স্বরূপ সন্ধানে মধ্যযুগের পুঁথিসাহিত্যের চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলা নামক ভূখণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে নিগৃহীত ও পরাধীন জাতির মানুষ ছিলেন। আপন মুক্তির জন্য বৌদ্ধধর্ম ও পরে ইসলাম ধর্মে আশ্রয় গ্রহণ করেন তারা। অন্যদিকে আদি বাঙালির একটি বড় অংশ আর্য, বর্ণাশ্রিত ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে সনাতন ধর্মে আস্থাশীল থাকার জন্য ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ নামে দুই মহাকাব্যের কল্পিত জগতেও ইতিহাসের সত্য ও প্রেরণা খোঁজেন। এর বিপরীতে মুসলমান বাঙালিরাও মুসলমান ধর্মে দীক্ষা নিয়ে ইসলাম ধর্মের ইতিহাসেও তাদের প্রেরণা ও মুক্তির নায়ক খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ধর্মে আশ্রয় নিয়েও বাঙালির জাতিগত মুক্তি হয়নি, বাঙালি মুসলমান কবি-লেখকদের হাতে রামায়ণ মহাভারতের মতো মহাকাব্য কিংবা অমর কোনো শিল্পকলা সৃষ্টি হয়নি। বাঙালি মুসলমানের মানস পরিক্রমায় বাঙালির হীনম্মন্যতা ও মানুষ হিসেবে অসম্পূর্ণতার দিক ও কারণগুলো আহমদ ছফা তাঁর প্রবন্ধে এমন চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন, তেমনটি আর কোথাও পড়িনি।

জাতি হিসেবে বাঙালির দারিদ্র্য ও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য স্মরণে রেখেই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী,/ রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ বাঙালির নিপীড়িন ও দীর্ঘ দারিদ্র্য-দুর্ভোগের ঐতিহাসিক পথপরিক্রমায় ১৯৭১-এ মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন বাঙালি জাতির মুক্তির একটি শর্তপূরণ করেছে সন্দেহ নেই। এ কারণেই হয়তো বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের নায়ক শেখ মুজিব ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করে জনসভায় আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছিলেন, কবিগুরু তোমার বাণীকে মিথ্যে প্রমাণ করেছে বাঙালি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার পরও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দুর্ভোগ, এবং আপন জাতিগোষ্ঠীর কিছু মানুষের হাতে নির্মমভাবে সপরিবার নিহত হবার ভবিতব্য জানা থাকলে নেতা সেদিন বাঙালির মানুষ হওয়ার গর্ব করতেন কি না জানি না। তবে স্বাধীন হওয়ার পরও বাঙালি জাতির বঞ্চনা ও অসম্পূর্ণতার বাস্তবতা দেশে বিরাজ করেছিল বলে, রাজনীতিতে যেমন বিপ্লব-আন্দোলনের প্রয়াস ছিল, সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও সক্রিয় ছিলেন কিছু কলমযোদ্ধা। লেখক আহমদ ছফা ছিলেন এরকম এক প্রেরণাসঞ্চারী কলমযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন হবার পরও স্বাধীনতার অসম্পূর্ণতা, জাতিগত বৈশিষ্ট্যের ভালো-মন্দ দিক এবং সমাজ, রাজনীতি, ও সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা বিষয় তার লেখার বিষয় হয়ে উঠেছে।

মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন আহমদ ছফা? এ প্রশ্নের জবাব তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্কিতরা নিজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই ভালো বলতে পারেন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে তাঁর ‘মূলত মানুষ’ নিবন্ধটি, যেখানে মানুষ সম্পর্কে নিজের চিন্তা ও ধারণা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন লেখক। যে প্রাণ থেকে উৎসারিত কবিতা, গান, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধে তিনি আপন মুক্তি এবং নিজ দেশকালের লক্ষকোটি মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছিলেন, আমার ধারণা তার সেই প্রাণের পরিচয় ‘মূলত মানুষ’ নিবন্ধেও অনেকটা পাওয়া যাবে। এই প্রবন্ধটিতে নিজের সম্পর্কে তিনি যেটুকু বলেছেন, তাতে একাত্মতাবোধ করবেন হয়তো অনেকেই।

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সাথে আহমদ ছফা ‘ক্লান্তপ্রাণ মানুষের চিন্তাচেতনার যে অংশ নিছক প্রাণধারণের গ্লানির ক্লান্তিকর পৌনঃপুনিকতার মধ্যে নিঃশেষিত হয়ে যায় না, বিদ্যুতের অক্ষরে পরবর্তী প্রজন্মের অন্তরে বিরাজমান থাকে এবং যা মানুষের ইতিহাসকে যুগ থেকে যুগান্তরে প্রবহমান রেখেছে, তাকেই মানুষের ঈশ্বর হিসেবে ভাবতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছি। আমার কাছে ঈশ্বরচিন্তা আর মানুষের অমরতার চিন্তা সমার্থক। কেউ যদি আমাকে আস্তিক বলেন বিনা বাক্যে মেনে নেব। আমি আস্তিক। যদি কেউ বলেন নাস্তিক, আপত্তি করব না। আস্তিক হোন, নাস্তিক হোন, ধর্মে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমি কোনো বিবাদের হেতু দেখতে পাইনে। আমার অভীষ্ঠ বিষয় মানুষ, শুধু মানুষ। মানুষই সমস্ত বিশ্বাস, মূল্যচিন্তা, সমস্ত বিজ্ঞানবুদ্ধির উৎস। সবকিছুই উচ্ছৃত হয়েছে মানুষের ভেতর থেকে। ধর্ম বলুন, বিজ্ঞান বলুন, শিল্প-সাহিত্য-দর্শন যা-ই বলুন না কেন, মানুষের সৃষ্টিক্ষমতাই সবকিছুর জন্ম দিয়েছে। মানুষের মধ্য থেকে যা কিছু বেরিয়ে এসেছে, আপাতদৃষ্টিতে তাদের মধ্যে যত বিরোধই থাকুক না কেন, গহনে ওগুলো সবকিছুর মধ্যে একটি মিলনবিন্দু কোথায় যেন আছে। ...যে পিতা-মাতা আমাকে আপনাকে জন্ম দিয়েছেন, যাঁরা আমাকে-আপনাকে লালনপালন করেছেন, যে সমস্ত মানুষের সুখস্মৃতি আমি-আপনি ধারণ করে থাকি, আমি আপনি যে সমস্ত মানুষকে জানি, যাদের জানি না- শুধু অস্তিত্ব অনুভব করি, আমি-আপনি যখন থাকব না, সেই সময়ে যে সমস্ত মানুষ-মানুষী প্রাণের কলরবে এই পৃথিবীকে ভরিয়ে রাখবে বলে ধরে নিয়েছি, সবকিছু মিলিয়ে অনন্তজীবী এক বিমূর্ত মানুষের স্মৃতি আমার চেতনায় আসন নিতে চায় এবং সেটাকেই আমরা ঈশ্বর মনে করি।’

নিজের সম্পর্কে এরকম আবেগময় স্পষ্ট কথনের পর মানুষের রহস্য ও অজ্ঞেয়তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে আহমদ ছফা শেষ করেছেন তার লেখাটি। যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায়ও নিঃসন্দেহ অগ্রসর শ্রেণির মানুষের উপরেই বর্তায়।

শুনেছি জীবিত অবস্থায় সাহিত্য অঙ্গনে ছফা ভাইয়ের সঙ্গে অনেকেরই সুসম্পর্ক বা ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে সম্পর্কটা নিয়মিত এবং তেমন ঘনিষ্ঠ ছিল না বলেই হয়তো, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল অগ্রজ ও অনুজের, শ্রদ্ধা ও স্নেহের।

আমার শহরতলির আবাসস্থলে টেলিফোন আসার পর ছফা ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হতো। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেও এক সন্ধ্যায় ফোন করেছিলাম তাকে। আমার আবাসভূমি এলাকার পাশের গাঁয়ে এক কবি-পিরের বাড়িতে এসেছিলেন এক অনুষ্ঠানে। সেখানে এসেও আমার বাড়ির খোঁজখবর নিয়েছেন। সেই কবি-পিরের এক ভক্ত আমার বাড়িতে এসে জানিয়েছিলেন সে খবর। ফোনে ছফা ভাইকে সেকথা বললে আমার বাড়িতেও বেড়াতে আসার পুরেনো আশ্বাসটি নতুন করে কার্যকর করার আশ্বাস দিলেন। ছেলেমেয়েদের কুশল জানতে চাইলেন। আমার ইচ্ছে ছিল টেলিফোনেই সেদিন ছফা ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দেওয়ার, কিন্তু তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না জানালেন। ভাবলাম তার পুরনো অসুখ অ্যাজমায় কষ্ট পাচ্ছেন বোধহয়। পরে দীর্ঘ কথা বলব বলে ফোন ছাড়ার আগে ছফা ভাই হঠাৎ খাপছাড়াভাবে বিষণ্ন গলায় বলেন, ‘তোমার ওখান থেকে মেঘ দেখা যায়? আকাশের দিকে তাকাও। মেঘটা কতো সুন্দর।’

ঐ সময়ে জানালা দিয়ে ছফা ভাই সত্যই মেঘ দেখেছিলেন হয়তো-বা। আমিও ঘর থেকে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম। আকাশে তখন রক্তিম ও কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে ছফা ভাইয়ের কথা ভেবেছিলাম অনেকক্ষণ। এই সংযোগের মাত্র কয়েকদিন পরই পেয়েছিলাম তার মৃত্যুসংবাদ। মনে পড়ে, ২০০১ সালের জুন মাসের সকালে ছোট ভাইয়ের কাছে আহমদ ছফার আকস্মিক মৃত্যুর খবরটি শুনে আপন বড়ভাইকে হারানোর মতো শোকে মুহ্যমান ছিলাম দিনমান। তার মৃত্যুকে সহজভাবে নিতে না পারার কারণে স্মৃতিতে বড় বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠেন তিনি। জানি, প্রিয়জনের মৃত্যুতে এ রকম প্রতিক্রিয়াই স্বাভাবিক। ভুলে যেতে হয় এবং ভুলে যেতে বাধ্য হব বলে টাটকা বিয়োগব্যথা মন্থন করে অন্তরে ভাস্বর হয়ে ওঠে মৃতের জীবন-স্মৃতি, যেন কিছুতেই সে প্রাণ থেকে মুছে যাবে না। বাহ্যিক সম্পর্কটি চিরতরে ছিন্ন হয়ে গেল বলে সম্পর্ক থেকে অর্জনগুলো ভার করে তোলে স্মৃতিচেতনা।

লোকসমাজে একটি চলতি প্রবাদ এমন যে, ‘রূপ যায় শ্মশানঘাটে,/ গুণ যায় মানবহাটে’। রূপ ক্ষণস্থায়ী, গুণ অনন্তবিহারী। যত রূপবানই হোক, নিশ্চিহ্ন হয় সে শ্মশানঘাটে কিংবা কবরে। কিন্তু মানবিক গুণ রয়ে যায়, মানুষের অন্তর থেকে অন্তরে প্রবহমান। মৃত্যুর পর পরকাল কি পুনর্জন্মের ধর্মতত্ত্ব বিতর্ক এড়িয়েও বলা যায়, মানবিক গুণের কারণেই নশ্বর মানুষ অমর হয়ে ওঠে। লেখক-শিল্পীরা সবাই এক অর্থে অমরত্বের সাধক। সত্য ও সুন্দরের পূজারি ভাবা হয় তাদের, কল্যাণমুখী মানবিক গুণাবলি ও মানবিক বোধসমূহ খোঁজেন তারা, লালন করেন আপন চৈতন্যে। অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির নির্যাস অপর মানুষ তথা সমাজে সঞ্চারিত করতে চান তার সৃজন-কর্মের ভেতর দিয়ে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সমাজে আহমদ ছফাকে এরকম একজন সত্যের সাধক ও লেখক হিসেবে জেনেছি ব্যক্তিগত পরিচয়ের আগে থেকেই। আর ব্যক্তিগত পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠার পর ছফা ভাইয়ের প্রাণের আগুন আমাকে নানাভাবে আলোকিত ও অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছে নিরন্তর। যে প্রাণশক্তির প্রকাশ তার লেখনিতে, মুখের বচনে ও আচরণেও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ পেয়েছে, এবং এখনও যার স্মৃতি মনকে এমনভাবে নাড়া দেয়, নিঃশংসয়ে বিশ্বাস জাগে, মহত্তম মানবিক বোধ ধারণ করে যে প্রাণ, মৃত্যু নেই তার। প্রাণ থেকে প্রাণে সাড়া জাগিয়েই চলবে সে নিরন্তর। চলবে

প্রথম মানস-সন্তানের জন্মবৃত্তান্ত ।। পর্ব—৬

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নটর ডেম কলেজের আরেক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার
নটর ডেম কলেজের আরেক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার
নৌ পথে ঈদযাত্রা ও পশুবাহী নৌযান নিরাপত্তায় কাজ করছে পুলিশ: অতিরিক্ত আইজিপি
নৌ পথে ঈদযাত্রা ও পশুবাহী নৌযান নিরাপত্তায় কাজ করছে পুলিশ: অতিরিক্ত আইজিপি
থাইল্যান্ডে গেছেন মির্জা ফখরুল
থাইল্যান্ডে গেছেন মির্জা ফখরুল
যুক্তরাজ্যের নতুন অভিবাসন নীতির তীব্র সমালোচনা: নার্স, বিশ্ববিদ্যালয় ও এমপিদের শঙ্কা
যুক্তরাজ্যের নতুন অভিবাসন নীতির তীব্র সমালোচনা: নার্স, বিশ্ববিদ্যালয় ও এমপিদের শঙ্কা
সর্বাধিক পঠিত
পররাষ্ট্র সচিবের অফিসার্স ক্লাবের সদস্য পদ স্থগিত
পররাষ্ট্র সচিবের অফিসার্স ক্লাবের সদস্য পদ স্থগিত
আসন্ন বাজেটে নতুন কী থাকছে
আসন্ন বাজেটে নতুন কী থাকছে
আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতার আত্মসমর্পণ
আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতার আত্মসমর্পণ
রংপুরের হাসপাতাল নেপাল ও ভুটানের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে: প্রধান উপদেষ্টা
রংপুরের হাসপাতাল নেপাল ও ভুটানের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে: প্রধান উপদেষ্টা
পাকিস্তানে ভারত হামলা করলে সহায়তা করবে বালুচ লিবারেশন আর্মি
পাকিস্তানে ভারত হামলা করলে সহায়তা করবে বালুচ লিবারেশন আর্মি