X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১
পথে নেমে পথ খোঁজা

সাহিত্য বনাম সাংবাদিকতা ।। পর্ব—নয়

মঞ্জু সরকার
১৪ অক্টোবর ২০২২, ১১:০৫আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২২, ১১:০৫

সাংবাদিকতা পেশা কি সাহিত্যের শত্রু? এমন প্রশ্নে স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে হ্যাঁ কিংবা না-বাচক জবাব দিয়েছেন বহু কীর্তিমান লেখক ও সাংবাদিক। তবে সাধারণের দৃষ্টিতে উভয়ের পেশার মধ্যে মিলের দিকটা ধরা পড়ে প্রথম। তার বড় কারণ লেখক ও সাংবাদিক- এই দুই পেশাজীবীরই কাজ তো লেখালিখি। মোটা দাগে বলা যায় লিখে সত্য প্রকাশ করতে চান তারা। পাঠকসমাজের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে চান উভয়ে। বামপন্থি সংজ্ঞায় বলা যেতে পারে উভয়ে কলমপেশা মজুর। এখন অবশ্য কলমের বদলে উভয়ের লেখালিখি, সম্পাদনা ও দেখাদেখি কম্পিউটার নেটওয়ার্কে বাঁধা।

সাংবাদিকতা পেশাকে নিজের লেখালিখির জন্য সহায়ক ভেবেছেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মতো বিশ্বখ্যাত নোবেলজয়ী লেখক। আবার সাংবাদিকতার পেশা অবলম্বন করে নিজের শিল্পীসত্তা বা সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বহু লেখক-সাংবাদিক। দুই ভিন্ন পেশাজীবীর কাজের প্রকৃতি ও প্রকাশের মিলের সুযোগ থাকায় আমাদের দেশেও বহু সম্ভাব্য লেখক বা সাহিত্যপ্রতিভা সাংবাদিকতা পেশায় এসেছেন। সাংবাদিকতা পেশার ফাঁকে সৃজনশীল সাহিত্য রচনার প্রয়াস অব্যাহত রেখে কবি-সাহিত্যিক পরিচয়ের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা বাড়িয়েছেন অনেকেই। আবার সাংবাদিকতার কারণে সম্ভাবনাময় সাহিত্যপ্রতিভার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার দৃষ্টান্তও কম নয়। ব্যর্থ কবি-সাহিত্যিকরা বড় সাংবাদিক হয়েছেন। কিন্তু দায়বদ্ধ ও নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিক হয়ে বড় সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম করা বেশ কঠিন। তার কারণ উভয় কাজের বা পেশার মধ্যে আপাত মিল সত্ত্বেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। সাংবাদিকের কাজ একান্তভাবে দৈনন্দিন ঘটমান বিশ্ব নিয়ে, সঠিক তথ্যসংগ্রহ ও পরিবেশন করাই প্রতিদিনের কাজ। তার কাজের লক্ষ্য থাকে একান্তভাবে বর্তমানের তথ্যভুক পাঠকসমাজ। প্রাপ্তি কি অপ্রাপ্তির প্রতিক্রিয়াও ঘটে নগদ। অন্যদিকে সাহিত্যিক তথ্যগত সত্যকে উপলব্ধির জগতে জারিত করে পরিবেশন করে কবিতার ছন্দে, রূপক ও কাহিনির মতো বিভিন্ন রকম আঙ্গিকে। তার উদ্দীষ্ট পাঠক বর্তমানের গণ্ডী পেরিয়ে অনাগত কালেও ব্যাপ্ত হতে পারে। কাজের ধরন ও উদ্দেশ্যর দিক থেকে সাংবাদিক বহিঃবাস্তবমুখি হলে, সাহিত্যিকরা সৃজনপ্রক্রিয়ার কারণে হয়ে পড়েন অন্তমুর্খি।

সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের সংজ্ঞা, মিল-অমিল নির্ধারণ কিংবা কোনো তত্ত্ব নির্মাণ করা আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। নিজেকে জন্মগতভাবে একজন লেখক ভাবার পরও পেশাগতভাবে দেশের দুটি বড় দৈনিক খবরের কাগজে দশ বছরের জন্য সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছিলাম। সাংবাদিকতা পেশার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও কেন এবং কীভাবে সাংবাদিক হওয়ার সুযোগ পেলাম, দশ বছরে দেশের সংবাদপত্র জগৎ, সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতা বনাম সাহিত্যচর্চা বিষয়ে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, স্মৃতিচারণের মাধ্যমে পাঠককে তার খানিকটা অংশভাগী করতে চাই এই ব্যক্তিগত নিবন্ধে।

লেখক হতে চেয়ে সাবালক তথা বয়স আঠারোর কোঠা পার হতে না-হতেই কেরানি পদমর্যাদায় আধা-সরকারি চাকরিকে পেশা অবলম্বন করেছিলাম বাধ্য হয়ে। ঘনিষ্ঠ শুভার্থীরা সেসময়ে বলত, লেখক হওয়ার জন্য অধ্যাপনা পেশাই সবচেয়ে উত্তম। বাংলা সাহিত্যে অধ্যাপক পেশায় বিখ্যাত কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীর দৃষ্টান্তও প্রচুর। কিন্তু আমি তো কলেজে অধ্যয়নকালেই সে সম্ভাবনা চিরতরে রুদ্ধ করে, স্বাধীন দেশে শুধুই লেখক বা কলমযোদ্ধা হওয়ার জন্য ঢাকায় চলে এসেছি। ঢাকায় এসে বছর খানিক কোনো মতে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করতে করতেই দেখেশুনে সাংবাদিকতা পেশাকে লেখকের জন্য আদর্শ ও আকর্ষণীয় পেশা মনে হয়েছিল। এর কারণটা ব্যাখ্যা করি আগে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সরকারি বা বেসরকারি অফিসের চাকুরের তুলনায় সংবাদপত্রে জীবিকাসূত্রে জড়িত সাংবাদিকদের মধ্যে কবি-লেখকের সংখ্যাই বোধহয় ছিল বেশি। `দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় চাকরি করতেন কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আহসান হাবীব, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। আবার `দৈনিক ইত্তেফাক’-এ ছিলেন রাহাত খান ও মহাদেব সাহা। তাছাড়া অন্যান্য পেশায় কর্মরত লেখকরা সাংবাদিক না হলেও, তাদের সাহিত্যিক পরিচিতি ও বাড়তি আয় অনেকটাই সংবাদপত্রনির্ভর। এক সময় কলকাতায় বিখ্যাত কিছু সাহিত্যপত্রিকা, বিশেষ করে `আনন্দবাজার’ ও ‘দেশ’ পত্রিকায় অনেক বিখ্যাত কবি-লেখক জীবিকাসূত্রে জড়িত ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সেরকম স্থায়ী বড় সাহিত্যপত্রিকা গড়ে ওঠেনি। ‘দৈনিক বাংলা’র সাপ্তাহিক বিচিত্রার মতো কিছু পত্রিকা ছিল। এসব পত্রিকায় পেশাসূত্রে জড়িত ছিলেন বেলাল চৌধুরী, ফজল শাহাবুদ্দিন, শাহরিয়ার কবির, রফিক আজাদ, সাযযাদ কাদির, মইনুল আহসান সাবের প্রমুখ কবি-লেখকগণ। তবে ম্যাগাজিনের তুলনায় দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের সংখ্যা অনেকে বেড়েছে। বড় সংবাদপত্রগুলো প্রতি সপ্তাহে সাহিত্যের জন্য কম করেও দুএক পৃষ্ঠা বরাদ্দ রাখে। ঈদে বা বিশেষ দিবসে ম্যাগাজিন আকারেও প্রকাশিত হয় বিশেষ সংখ্যা। সংবাদপত্রের সহিত্যপাতা বা বিশেষ সংখ্যায় গল্প কবিতা আলোচনাসহ ঘনঘন নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত না করে কে এ দেশে বিখ্যাত-কবি লেখক হতে পেরেছেন?

তরুণ বয়সে যখন লেখক হওয়ার শখ ও সংকল্প জোরালো হয়ে ওঠে, তখনও দৈনিক পাকিস্তান, সংবাদ ও পূর্বদেশ প্রভৃতি সংবাদপত্রের সাহিত্যপাতায় লেখা ও নাম দেখে দেশের বহু লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। এসব সংবাদপত্রে নিজের নাম ও লেখা ছাপার ব্যাপারটি যে ওসব সংবাদপত্রে চাকরি করলে আরো সহজ হবে, এমন একটি ধারণা হয়েছিল। তাছাড়া বড় লেখক বা ঔপন্যাসিক হওয়ার জন্য বিশ্ব সম্পর্কে টাটকা ধারণা রাখা প্রয়োজন। সম্ভবত মহান ঔপন্যাসিক টলস্টয় বলেছিলেন কথাটা। বিশ্ব সম্পর্কে টাটকা ধারণা রাখার জন্য সাংবাদিকতার চেয়ে সহায়ক পেশা আর কী হতে পারে?

লেখক হওয়ার জন্য ঢাকায় এসে প্রথমদিকে যখন রাস্তা ও ফুটপাথই ছিল ঠিকানা, লেখক রাহাত খান দৈনিক ইত্তেফাকে চাকরি করেন জেনে একদিন গিয়েছিলাম তার কাছে। চাকরি ও আশ্রয় খোঁজার সেই দুঃসময়ের কথা অন্যত্র লিখেছি। এখনে স্মরণযোগ্য কথাটা হলো, রাহাত খান ইত্তেফাকেও ছোটখাটো একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করেছিলেন আমার জন্য। কিন্তু হয়নি। আমিও সংবাদপত্রের চাকরি পাওয়ার আশা ছেড়ে সেই যে ১৯৭৩-এ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে ঢুকেছিলাম, চাকরি ও সংসারের বাঁধন কেটে মুক্ত-স্বাধীন লেখক হওয়ার সাধনায় কেটে গেছে প্রায় তিনটি দশক। অবশেষে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিটা ছেড়ে স্বাধীন ও সার্বক্ষণিক লেখক হওয়ার চেষ্টা করেছি। বছরখানেকের মধ্যে সংসারের চাহিদা লেখকের স্বাধীনতা ও সংকল্পকে পদে পদে বাধা দিতে শুরু করেছিল। ঠিক সেসময়ে ঘরে বসেই পেলাম নবীন যৌবনের স্বপ্ন পূরণের পথটি।

কবি-সাংবাদিক বন্ধু আতাহার খান একদিন ফোনে জানালেন খবরটা। আমার দেশ নামে একটি নতুন দৈনিক কাগজ বেরুবে। উদ্যোক্তা ও পুঁজি বিনিয়োগকারী এনটিভির মালিক ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের রাজনেতিক সচিব মোসাদ্দেক হোসেন ফালু। ঐ পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে কিছু সাহিত্যিককে নেওয়ার কথা ভাবছে তারা। আমি আগ্রহী কিনা? বিএনপি-রাজনীতির সমর্থক নই। উপরন্তু বিএনপির কট্টর সমর্থক হিসেবে কবি মাহমুদ শফিক গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হয়ে এলে তার সময়ে ছেড়েছিলাম জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিটা। আতাহার জানালেন, পার্টিকাগজ নয়, বড় পুঁজি বিনিয়োগে নিরপেক্ষ এবং পেশাদার সাংবাদিকদের সমন্বয়ে কাগজটা প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্র হবে। শুনে আগ্রহী হলাম। মালিকপক্ষ থেকে পত্রিকার সংগঠক আয়োজক ছিলেন সাংবাদিক রাশেদ-উন-নবী বাবু। আতাহার একদিন নিয়ে গেলেন তার বাসায়। লেখক হিসেবে আমাকে ভালো জানতেন বাবু। বিশিষ্ট সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীর সম্পাদক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। কবীর ভাইও পছন্দ করলেন আমাকে। মাস খানেকের মধ্যে সহাকারী সম্পাদক হিসেবে নিয়োগপত্র পেলাম। আমি ছাড়াও সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দিলেন জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন। নিউজ ও অন্যান্য বিভাগেও যোগ দিলো বিভিন্ন সংবাদপত্রে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একদল তুখোড় সাংবাদিক। কিছু পরে উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে এলেন বিখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ।

সহকারী সম্পাদকদের কাজ ছিল রোজ সম্পাদক বা উপদেষ্টা সম্পাদকের সঙ্গে সম্পাদকীয় মিটিং করা। বিষয় নির্ধারণ করে আলোচনাক্রমে সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয় লেখা। কবীর ভাই ও সামাদ ভাই আমাকে বেশ সহযোগিতা করতেন। সম্পাদকীয় মিটিংয়ে কিংবা অবসরে তাদের দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের গল্প শুনতাম। সহকর্মীদের মধ্যে আতাহার ছাড়াও ছিলেন অভিজ্ঞ সঞ্জীব চৌধুরী ও চন্দন সরকার। আমার দেশ-এর খোলামেলা পরিবেশে সব বিভাগের সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে ভালো লাগত। মূল মালিক ফালু সাহেব নেপথ্যে থাকতেন। কখনোই হস্তক্ষেপ করতেন না সাংবাদিকদের কাজে। তার অগ্রজ শহীদুল্লাহ ভাই ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন। তিনিও বেশ চমৎকার মানুষ ছিলেন।

আমার দেশ-এ বছর পাঁচেক ছিলাম। কাওরান বাজারে পাশেই প্রথম আলো অফিস। সেই পত্রিকায় কর্মরত পরিচিত সাংবাদিকদের সঙ্গেও দেখা ও আড্ডা হতো প্রায়ই। একদিন প্রথম আলোর রিপোর্টার প্রীতিভাজন রাজীব নূর বললেন, মতি ভাইয়ের সঙ্গে আপনার ব্যাপারে আলাপ করেছি। আপনার ব্যাপারে তিনি বেশ আগ্রহ দেখিয়ে একদিন নিয়ে যেতে বলেছেন। তা প্রথম আলোর ব্যাপারে আগ্রহ আমারও কম ছিল না। জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকে কাজ করার সুযোগ পেলে আমার সাংবাদিকতা পেশা গুণেমানে নিশ্চয় সমৃদ্ধ হবে। অতএব রাজীবের সঙ্গে গেলাম একদিন। সেদিনই প্রথম সাক্ষাৎ প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে। তবে পরস্পরের সম্পর্কে ধারণা ছিলা উভয়েরই। মতি ভাই গল্পচ্ছলে দীর্ঘ ইন্টারভিউ নিলেন। জানালেন সবার সঙ্গে আলাপ করে আমাকে নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাবেন। অতঃপর উনি কাদের সঙ্গে কী আলাপ করেছেন ও তাদের মতামত কী ছিল জানি না। প্রথম আলোর আনিসুল হক, সাজ্জাদ শরীফ ছাড়াও অনেকের সঙ্গেই তো চেনাজানা ছিল। সহকারী সম্পাদক ও লেখক মশিউল আলমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তার কাছে প্রথম আলোর অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ও ক্ষমতাবানদের সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত হওয়ার পর বুঝে গিয়েছিলাম, সেখানকার কর্মপরিবেশ ও কর্তাব্যক্তিদের মানিয়ে নেওয়া আমার জন্য বেশ কঠিন হবে। মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুও সেখানে টিকতে পারেননি। অতএব দ্বিতীয়বার যাইনি সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছে। তিনিও ডাকেননি আর আমাকে।

আমার দেশ পত্রিকায় বছর পাঁচেক চাকরি করার পর দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে চাকরির সুযোগ পেলাম সহসা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল ছিল সেটা। দুই ভাইয়ের মালিকানায় পরিচালিত ইত্তেফাকে অগ্রজ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হয়েছেন। আর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিদমনবিরোধী অভিযানের শিকার হয়েছেন। রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে পালিয়ে গেছেন আমেরিকায়। আসামির তালিকায় নাম ওঠায় দেশে ফিরতে পারছেন না। দুই ভাইয়ের স্ত্রীদ্বয় ছিলেন ইত্তেফাক কোম্পানির পরিচালক। ইত্তেফাকের বড় ও ছোট কর্তা দুভাইয়ের অনুপস্থিতিতে দুই ভাবিই হাল ধরেছিলেন ইত্তেফাকের। ইত্তেফাকের সবার কাছে বড় ও ছোটভাবি হিসেবে সম্মানিত ছিলেন তারা।

ছোটভাবি তাসমিমা হোসেন পাক্ষিক অনন্যা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, নারীবাদী সমাজকর্মী হিসেবেও সুনাম আছে। অনন্যা পত্রিকার ঈদসংখ্যায় গল্প-উপন্যাস লিখেছি অনেকবার। সেই সুবাদে আলাপ-পরিচয় ছিল তাসমিমা আপার সঙ্গে। ইত্তেফাকে সহকরী সম্পাদক পদে একজন লোক নেওয়া হবে শুনে আমার নামটি অনন্যার কর্মরত নির্বাহী সম্পাদক মনু আপা প্রস্তাব করেছিলেন তাসমিমা আপার কাছে। টেলিফোন করে ডাকলেন একদিন অফিসে। গেলাম, কথাবার্তা হলো। আমেরিকায় অবস্থানরত সম্পাদক-স্বামীর কাছে আমার বায়োডাটা ফ্যাক্সে পাঠালেন। দুদিনের মধ্যে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেলাম। আমার দেশ-এর চেয়েও উচ্চতর বেতন ও সুযোগ-সুবিধার চাকরিটা এত সহজে হবে ভাবিনি।

আমার দেশ-এর মালিকপক্ষ, সম্পাদক-সহকর্মী কারো সঙ্গেই কোনো বিরোধ ছিল না। ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন পেতাম সেখানে। সাংবাদিক হিসেবে অ্যাক্রিডেটেশন কার্ডও পেয়েছিলাম। যে কার্ড দেখিয়ে বিনা বাধায় সচিবালয় ও সরকারি নানা অফিসে যাওয়া যেত। গুরুত্ব পাওয়া যেত। কিন্তু সাংবাদিক সম্প্রদায়ের সবাই জানত, বলাবলিও করত, সাংবাদিকতার চাকরির দিক থেকে ইত্তেফাক হলো সোনার খনি। বছরে সেখানে ছয়টি বোনাস। ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন। প্রয়োজনের তুলনায় হাউজে সাংবাদিক-কর্মচারীদের সংখ্যা বেশি, অতএব কাজ কম। সার্কুলেশন কমে গেলেও ইত্তেফাকের সাংবাদিকদের মর্যাদাও বেশি। কারণ পাকিস্তান আমল থেকে বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর একান্ত দোসর মানিক মিয়া ও তার সম্পাদিত ইত্তেফাকের গৌরবময় ভূমিকা। স্বাধীনতার পরও টানা কয়েক বছর ছিল দেশের শীর্ষ কাগজ। কাজেই আমি সেখানে অধিক বেতনে চাকরির সুযোগ পাচ্ছি জেনে বাধা দিলো না কেউ। আমার আগেই আমার দেশ-এর সংগঠক ও নির্বাহী সম্পাদক রাশেদ-উন-নবী বাবু ব্যারিস্টার সাহেবের অনুমোদনক্রমে নিউজ এডিটর হিসেবে যোগ দিয়েছেন। আমিও তার অনুগামী হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় মনে মনে হয়তো-বা ঈর্ষান্বিত হলো কেউ কেউ।

ইত্তেফাকে যোগ দিয়ে বুঝলাম, পুরোনো সকল সাংবাদিক-কর্মচারীদের চোখে আমার বড় যোগ্যতা হলো, আমি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মালিক-সম্পাদক মঞ্জু সাহেব তথা ছোটভাবির লোক। সম্পাদক অনুপস্থিত হলেও ছোটভাবিকে কেন্দ্র করে অনুপস্থিত সম্পাদকের সমর্থক সাংবাদিক-কর্মীদের পাল্লাই ভারী মনে হয়। ছোটভাবি প্রশাসনের সবাইকে বলে দিয়েছেন, আমার যেন কোনো অসুবিধা না হয়। অতএব আমার সুবিধার দিকে মনোযোগী ছিল সবাই। সম্পাদকীয় বিভাগে একমাত্র আমি কম্পিউটারে লিখতে অভ্যস্ত, অতএব আমাকে কম্পিউটার দেওয়া হলো। রুমের সামনে নেমপ্লেট দেওয়া হলো। আমার মাধ্যমে ছোটভাবিকে তুষ্ট রাখার প্রয়াস যেন প্রশাসনিক কর্মীদের মধ্যে।

স্বাধীনতার পর বাহাত্তর সালে ঢাকায় এসে আমি ইত্তেফাক অফিস ও সহকারী সম্পাদক রাহাত খান ও আখতার-উল-আলমের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার গল্প স্মৃতিকথায় লিখেছি। সেই ঘটনার তিন যুগ পরে তাদের সহকর্মী হিসেবে কাজ করব, স্বপ্নেও ভাবিনি। আখতার-উল-আলম মাঝখানে চাকরি ছেড়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশের রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। সেই দায়িত্ব শেষে পুনরায় চুক্তিভিত্তিতে ইত্তেফাকে উপদেষ্টা সম্পাদক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। রাহাত খান সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান। সম্পাদক মামলার আসামি ও পলাতক থাকার অজুহাতে প্রিন্টার্স লাইন থেকে তার নাম বাদ যায়। ব্যারিস্টার সাহেবের উদ্যোগ ও সমর্থনে সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি পান রাহাত খান।

ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় কাজ ছিল সাধু ভাষায় সম্পাদকীয় লেখা এবং ছদ্মনামে উপসম্পাদকীয় লেখা। পাকিস্তান আমলে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ইত্তেফাকের জনপ্রিয় ভূমিকায় মানিক মিয়ার মোসাফির ছদ্মনামে রাজনৈতিক মঞ্চের ভূমিকা ছিল মুখ্য। মানিক মিয়ার মৃত্যুর পরেও তাঁর দুই ছেলের পরিচালনায় পুরোনো ঐতিহ্য মেনে পত্রিকার সহকারী সম্পাদকগণ ভীমরুল, লুব্ধক, সন্ধানী, সুহৃদ, সত্যবাক, স্পষ্টভাষী, পথচারী ইত্যকার ছদ্মনামে নিয়মিত উপসম্পাদকীয় লিখে যাচ্ছেন। কিন্তু নিউজ, সম্পাদকীয় কি ফিচার পাতায় বিশেষ কারো কিংবা সকলের সম্মিলিত লেখালিখির কারণেও ইত্তেফাক তার জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান ধরে রাখতে পারছে না কেন? নতুন আবির্ভূত প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদপত্রের কাটতি ও জনপ্রিয়তা বাড়ছিল, অন্যদিকে ইত্তেফাকের সার্কুলেশন কমে আসছিল। উপরন্তু মালিক হিসেবে দুই ভাইয়ের বিরোধ পত্রিকার সাংবাদিক ও কর্মীদের মধ্যে যে দলাদলি ও কায়েমি স্বার্থের জন্ম দিয়েছিল, তা শুধু এবকটি ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্রের যুগোপযোগী ভূমিকা পালনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, ইত্তেফাকে একাধিক খুনের ঘটনাও ঘটেছে শুনেছি। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়, অনেকটা সেরকম ছিল কি এসব খুনখারাপির ঘটনা? ঠিক জানি না।

অফিসে দুই ভাবি নিয়মিত উপস্থিত থেকে ইত্তেফাকের তাবদ কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করলেও, নেপথ্য থেকে কলকাঠি নাড়েন আসল কর্তাদ্বয়। আমি যোগ দেওয়ার সময়েও টের পেয়েছি। আমাকে নিয়োগের জন্য ছোটভাবিকে আমেরিকায় অবস্থানরত সম্পাদকের অনুমোদন নিতে হয়েছিল। অন্যদিকে সরকারি ছুটির দিনেও মাঝে মাঝে ব্যারিস্টার সাহেব উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মিটিং করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতেন। সম্পাদকীয় বিভাগের ব্যাপারে তার মনোযোগ ও আগ্রহ ছিল বেশি। ছাপার আগে প্রতিদিনের সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় অনুমোদন দিতেন। একদিন আমার লেখা এক সম্পাদকীয় পড়ে ফোন করেছিলেন, প্রশংসা করার জন্য নয়, ইত্তেফাকের পলিশি সম্পর্কে দু-চারকথা শুনিয়ে দেওয়ার জন্য। জি স্যার ইয়েস স্যার বলা ছাড়া করার কিছু ছিল না। যোগদানের দু-চার মাস পরে আমাকেও নিয়মিত পোস্ট লেখার আদেশ দিয়েছিলেন। মিতবাক ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেছিলাম।

চার-পাঁচ দশকের পুরোনো কর্মী ও সাংবাদিকদের কাছে ইত্তেফাকের অতীত ও দুই ভাইয়ের উপস্থিতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ইত্তেফাকে সৃষ্ট নানা ঘটনা ও গল্প শুনতাম। দুই ভাবির উপস্থিতে এখন তো সরাসরি সেই দ্বন্দ্বমুখর পরিবেশ নেই। ছোটভাবি ইত্তেফাককে আবার কী করে যুগোপযোগী শীর্ষ জনপ্রিয় পত্রিকা করা যায়, এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে একটি প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা তৈরির দায়িত্ব দিলেন আমাকে। ভাইদের মতো দুই ভাবির মধ্যে দাঁ-কুড়াল সম্পর্ক ছিল না। আমি ছোটভাবির নিয়োগ করা লোক হওয়া সত্ত্বেও আমাকেও বড়ভাবি অপছন্দ করতেন না। ইত্তেফাকের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার তথা সার্বিকভাবে দৈনিকটিকে এক নম্বর করে তোলার ব্যাপারে তাদের তো বটে, ইত্তেফাকের কোনো কর্মচারীরই আপত্তি থাকার কথা নয়। প্রশ্ন হলো কীভাবে সেটা করা সম্ভব?

আমার দেশে-এ মোটে পাঁচ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা। তবে দেশের অভিজ্ঞ ও বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অনেকের সঙ্গে চেনাজানা হয়ে গেছে। অভিজ্ঞদের সঙ্গে ইত্তেফাক বিষয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা, নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাভাবনায় নির্ভর করে ইত্তেফাকের বর্তমান বাস্তবতা, প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে শীর্ষ পত্রিকা করার জন্য করণীয় বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পেশ করলাম ছোটভাবির কাছে। এরকম মতামত হয়তো তিনি আমার মতো একান্ত আস্থাভাজন অনেকের কাছেই সংগ্রহ করেছিলেন। তবে আমার প্রতিবেদনটি নিয়ে অনুপস্থিত সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল, তা বুঝতে পেরেছিলাম আরো বছর দুয়েক পরে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দেশে এবং ইত্তেফাকে স্বপদে ফিরে আসার পর। পরিচয়ের পর থেকে সম্পাদকীয় সভায় আমাকে র‌্যাডিক্যাল সম্বোধন করতেন তিনি। পত্রিকার নানা বিষয়ে আমার মতামত শুনতে চাইতেন। সম্পাদকীয় লেখালিখির অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সাহিত্যসম্পাদকের দায়িত্বও দিয়েছিলেন।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দেশে ফিরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেওয়া মামলা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়ার আগে ইত্তেফাকে নিজের অবস্থান আগের মতো শক্তপোক্ত করেছিলেন অনুজ ভ্রাতা। কেবল সম্পাদক পদটি পুনরুদ্ধার নয়, ইত্তেফাক নিয়ে দুই ভাইয়ের দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্ব-বিরোধের অবসান ঘটাতে ইত্তেফাক কোম্পানির তাবদ সম্পদ ভাগাভাগি হয়ে যায়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ইত্তেফাকের একক মালিক হন। টিকাটুলির ইত্তেফাক ভবন চলে যায় ব্যারিস্টারের দখলে। মঞ্জু সাহেব ইত্তেফাককে নিয়ে আসেন কাওরানবাজারে তার নিজস্ব ভবনে। ইত্তেফাককে নতুন করে নিজের মতো করে চালানো শুরুর আগে অর্থাৎ টিকাটুলির ইত্তেফাক ভবনে থাকতেই অবশ্য ব্যারিস্টার কতৃক নিয়োগকৃত এবং তার সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত কিছু সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকুরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন তিনি। ব্যারিস্টার সাহেবের অতি ঘনিষ্ঠদের আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সমর্থক ইউনিয়ন-ক্যাডার কর্তৃক মারধর করার ঘটনাও ঘটেছে। সম্পাদকের প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয়ে কেউ-বা আগেভাগে চাকরিও ছেড়েছেন। আমার অগ্রজপ্রতিম ঘনিষ্ঠ লেখক রাহাত খানকে সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার সাহেব। মঞ্জু সাহেব অফিসে যোগদানের পর সম্পাদকীয় মিটিংয়ে মুখ বুজে মূল সম্পাদকের তীব্র কটুবাক্য সহ্য করেও টিকে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ইত্তেফাক সম্পূর্ণরূপে নিজের দখলে আসার পর রাহাত খানসহ অনেকেই চাকরিচ্যুত হতে থাকেন।

সব খবরের কাগজেই সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী সম্পাদকগণ দৈনন্দিন লেখালেখির ব্যাপারে বিভাগীয় সহকারীদের নিয়ে মিটিং করে থাকেন। ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদকদের নিয়ে নিয়মিত মিটিংয়ের বৈশিষ্ট্য ছিল ভিন্নরকম। তার কারণ ইত্তেফাক সম্পাদক শুধু তো মালিক নন, তিনি একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান, ছয় বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য, একাধিকবার রাজনৈতিক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন, তদুপরি শিল্প-সম্পত্তির মালিক হিসেবে ধনীক শ্রেণির একজন। শুধু ইত্তেফাক ম্যানেজম্যান্ট-এর নির্বাহী বা সম্পাদক হিসেবে নয়, নিজেকে শাসকশ্রেণির একজন ভাবতেন তিনি। কাজেই কথা বলতে গেলে শুধু সম্পাদকসুলভ দায়িত্বে সীমিত থাকা তাঁর পক্ষে কঠিন। স্বভাবগতভাবেও ছিলেন আড্ডাবাজ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলটায় প্রবাস জীবনের যে একাকিত্ব ও দুর্বিষহ সময় কাটাতে হয়েছে, সেটা আমাদের সঙ্গে দিলখোলা আড্ডা দিয়ে যেন পুষিয়ে নিতে চাইতেন। স্পেশাল চা-নাশতা, কোনোদিন বা চিকেন-বিরিয়ানিও পরিবেশন হতো মিটিংয়ে। সরকারি চাকরিতে থাকার সময় আমলাতন্ত্রে বিদ্যমান ‘ইয়েস স্যার’ মন্ত্রে নতমস্তক তেলমারা লোকজন দেখেছি প্রচুর। ইত্তেফাকের সম্পাদক আহুত মিটিংয়ে উপস্থিত থেকেও তৈলমর্দনে দক্ষ ও সূক্ষ্ম নানারকম তেলতেলে সাংবাদিক দেখতে লাগলাম। সরকারি চাকরিতে ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী যত দেখেছি, সংবাদপত্রে দশ বছর চাকরি করে ঘুষখোর ও ধান্ধাবাজ সাংবাদিক দেখেছি অনেক বেশি।

স্বভাবগতভাবে আমি মিতবাক, মিতবাক ছদ্মনামেই বছর দুয়েক প্রতি সপ্তাহে পোস্ট এডিটরিয়াল লিখেছি। সেসময়ে আবিষ্কার করি অন্যান্য প্রথম শ্রেণির পত্রিকায় যেসব বিখ্যাত সাংবাদিক-কলামিস্ট উপসম্পাদকীয় লেখেন, সেই তুলনায় ইত্তেফাকের ছদ্মনামী সহকারী সম্পাদকের পোস্ট দুর্বল। নতুন চিন্তা-ভাবনার উপস্থিতি, এমনকি অনেকে আর্কাইভস ফাইল দেখে পুরনো পোস্ট কপি করে রুটিন লেখার দায়িত্ব সারেন। ধরা যাক, দ্রব্যমূল্য কিংবা জনস্বার্থবিষয়ক সাধারণ সমস্যা নিয়ে ইত্তেফাকে একই পোস্ট কতোবার যে ঘুরেফিরে ছাপা হয়েছে, দুই-তিন যুগের পুরোনো ফাইল তদন্ত করে দেখলে ফাঁকির সমুদ্র আবিষ্কার হবে। ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয় বলে এই ফাঁকি দেওয়ার সুযোগটা ছিল বেশি। ছোটভাবি আমাকে পত্রিকায় যুগোপযোগী পরিবর্তন আনার প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব দিলে আমি স্বনামে পোস্ট এডিটরিয়াল লেখা এবং বাইরের বিখ্যাত কলামিস্টদের লেখা অধিক হারে ছাপার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। প্রাস্তাবটা দুই ভাবির সমর্থন পেয়েছিল। ব্যারিস্টার সাহেব মৃদু আপত্তি করলেও মেনে নিয়েছিলেন। ছদ্মনামে আমাদের পোস্ট লেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রবীণ সিনিয়র সহকর্মীরা হয়তো অনেকেই অসন্তুষ্ট ছিলেন আমার ওপর। প্রবীণরা একে একে অনেকে চলে যাওয়ার পর একক মালিক-সম্পাদক আমার ওপর অধিক নির্ভর করতে চেয়েছিলেন। র‌্যাডিকেল সম্বোধন করে নানা বিষয়ে মতামত জানতে চাইতেন। সেই সঙ্গে সতর্ক করে বলতেন, ইত্তেফাকে অনেক কায়েমি স্বার্থ ও দুর্নীতিবাজদের জায়গা। পরিবর্তন আনতে হলে ধীরে ধীরে এগুতে হবে। আমাকে তিনি পত্রিকার অন্যান্য বিভাগীয় বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি ততদিনে নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝে গেছি।

ছাপোষা কেরানি থেকে সংবাদপত্রের চাকরিতে ঢুকেছিলাম পারিবারিক যে প্রয়োজন থেকে, সেই প্রয়োজনবোধ ততদিনে লঘু হয়েছে। সন্তান দুটি কোনোমতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। অতএব স্বাধীন ও সার্বক্ষণিক লেখক হওয়ার শেষ চেষ্টা করার এই মোক্ষম সময়। এরকম মানসিক অবস্থানে এসেও চাকরিটা কোনোমতে রক্ষা করার সময়ে একদিন অফিসে গিয়ে হাতে অব্যাহতি পত্র পেলাম। সহকর্মীরা কেউ ভাবেনি, এমনকি আমিও ভাবিনি এভাবে হঠাৎ আমার চাকরি যাবে। সম্পাদককে চিঠি দেখিয়ে বললাম, এটা কী? তিনি বললেন, এটা কিছু না, আমি দিয়েছি, আমি এটা বাতিল করতে পারি। আপনি আগে চিন্তা করে দেখেন এই প্রতিষ্ঠানের জন্য আপনি ফিট কিনা। ভেবেচিন্তে কাল আমাকে জানাবেন।

আমার সিদ্ধান্ত তো আগেই নেওয়া হয়েছিল। আমি আর সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে দ্বিতীয়বার তার অফিসেও যাইনি। বাসাতেও যাইনি কোনো দিন। পাওনা টাকাপয়সার চেকটা আনতে একাউন্টস বিভাগে গিয়েছিলাম শুধু। পাঁচ বছরে চাকরি করার প্রাপ্য সবরকম সুযোগ-সুবিধার অর্থ এক চেকেই পরিশোধ করেছিলেন তিনি।

সাংবাদিকতার চাকরি ত্যাগের পর নিজেও তার বিস্তর প্রমাণ পেয়েছি। অবশ্য হুমায়ূন আহমেদের মতো ব্যতিক্রমী ও অতি বিখ্যাত লেখকদের কথা আলাদা। কিন্তু খ্যাতি বা আয়-উন্নতিবিহীন সার্বক্ষণিক স্বাধীন লেখক স্বজন-শুভার্থীদের কাছেও তুচ্ছ ব্যক্তি হয়ে যান। আমাদের গ্রামের সুরেন কাকা যেমন একবার জানতে চেয়েছিলেন, সম্বাদিকের চাকরি ছেড়ে আমি এখন দলিল লেখকের চাকরি নিয়েছি কি না? কীসের লেখক আমি? শিক্ষিত শুভার্থীরা পড়ার আগে জানতে চান, বই লিখে কেমন রোজগার হয়? সত্যি জবাব দিতে সংকোচ হয় কখনো-বা। তারপরও যে নিজেকে স্বাধীন ও সার্বক্ষণিক লেখকে ভেবে গর্ব বোধ করি, তার কারণ ক্ষমতাসীনদের তাবেদার সুযোগ-সুবিধা শিকারি সাংঘাতিক সাংবাদিকতার চেয়ে গৃহকোণে একা হয়ে স্বাধীনভাবে লেখালিখির কাজটাকে মহৎ ও মর্যাদাপূর্ণ বলে বিশ্বাস করি এবং আনন্দও পাই। ঈষৎ সংক্ষেপিত

হাসান আজিজুল হক : স্মৃতিতে ও প্রভাবে ।। পর্ব—আট

 

 

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আত্মসমর্পণের পর কারাগারে  বিএনপি নেতা হাবিব-দীপক
আত্মসমর্পণের পর কারাগারে  বিএনপি নেতা হাবিব-দীপক
ভোরে বজ্রপাতে ৩ গরুর মৃত্যু
ভোরে বজ্রপাতে ৩ গরুর মৃত্যু
অনুপ্রাণন-এর মোড়ক উন্মোচন, বই আলোচনা ও লেখক সম্মাননা
অনুপ্রাণন-এর মোড়ক উন্মোচন, বই আলোচনা ও লেখক সম্মাননা
উত্তর ইন্দোনেশিয়ায় অগ্ন্যুৎপাত, সরিয়ে নেয়া হয়েছে ১১ হাজার মানুষ
উত্তর ইন্দোনেশিয়ায় অগ্ন্যুৎপাত, সরিয়ে নেয়া হয়েছে ১১ হাজার মানুষ
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
তৃতীয় ধাপে যেসব উপজেলায় ভোট
তৃতীয় ধাপে যেসব উপজেলায় ভোট