X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১
হারুকি মুরাকামি

আমার চরিত্রগুলোর উৎস কোথায় ।। পর্ব-১

অনুবাদ : সাজিদ উল হক আবির
২৭ নভেম্বর ২০২২, ১৭:১৩আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০২২, ১৭:১১

আমি তাদের খুঁজে বের করি না, তারাই আমাকে খুঁজে নেয়

আমাকে প্রায়ই এই প্রশ্ন করা হয় যে, আমার উপন্যাসের চরিত্রগুলো বাস্তব মানুষজনের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত কিনা। সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে, উত্তর হচ্ছে- না। আমি অনেক উপন্যাস লিখেছি এ পর্যন্ত, তারমধ্যে কেবল দুই কি তিনবার আমি একদম শুরু থেকেই বাস্তব জীবনে পরিচিত কোনো ব্যক্তির ওপর ভিত্তি করে চরিত্র নির্মাণ করেছি (তাও পার্শ্বচরিত্র)। সে ক্ষেত্রে আমি বরাবর কিছুটা ভয়ে ভয়ে থাকতাম, যে, হয়তো আমার পাঠক ধরে ফেলবে- অমুক বা তমুক চরিত্রটি কোনো সত্যিকারের মানুষের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত; বিশেষ করে, যার ওপর ভিত্তি করে চরিত্রটি নির্মিত, সে নিজেই যদি পাঠের পর বিষয়টা ধরে ফেলে। সৌভাগ্যের বিষয় হল, কেউ কখনও এরকম অভিযোগ এখন পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে তোলেনি, এমনকি একবারের জন্যেও না। কারণ হয়তো এই যে, যদি আমি বাস্তবের রক্তমাংসের কোনো মানুষের ওপর ভিত্তি করে আমার উপন্যাসের কোনো একটি চরিত্রকে দাঁড় করিয়েও থাকি, তবে আমি এতো সতর্কভাবে এবং যত্নের সাথে ঐসব চরিত্রকে নির্মাণ এবং পুনর্নির্মাণ করেছি যে দিনশেষে পাঠকের পক্ষে আর আমার চরিত্রের প্রাথমিক উৎস ব্যক্তিটিকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। সে ব্যক্তি নিজেও মনে হয় না বুঝতে পেরেছেন।

কিন্তু যে ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটেছে, তা হল- আমার একদম কল্পিত কোনো চরিত্রকে মানুষজন প্রায়ই বাস্তবজীবন থেকে প্রাণিত বলে দাবী করেছেন। কখনও তো এমনও হয়েছে যে আমার পাঠক কসম খেয়ে দাবী করেছেন- অমুক চরিত্রটি যে তিনি নিজে, এতে তার কোনো সন্দেহ নেই। সমারসেট মমের ক্ষেত্রে একবার এরকমটা ঘটেছিল। জীবনে সামনাসামনি দেখাও হয়নি, এমনকি নামও শুনেননি কখনও- এমন এক সরকারী কর্মকর্তা তার নামে মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন। মম তার সাহিত্যকর্মে এক চরিত্রের পরকীয়া সম্পর্কের চিত্রাঙ্কন করেছিলেন, আর উক্ত সরকারী কর্মকর্তা দাবী করেছিলেন যে চরিত্রটি তার ওপর নির্মিত, এবং তাকে সামাজিকভাবে হেয় করার জন্যেই মম তৈরি করেছেন।

বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমার উপন্যাসের চরিত্রগুলো গল্পের ধারাবাহিক প্রবাহের ফলশ্রুতিতে, বা প্রয়োজনেই এসে হাজির হয়। আমি প্রায় কখনোই আগে থেকে এমন সিদ্ধান্ত নিই না যে- অমুক ধরনের একটা চরিত্রকে আমার গল্পে বা উপন্যাসে আমি ঢোকাবো। আমি যখন লিখি, তখন সেই লেখার তৈরিকৃত সারবত্তাসুলভ কঙ্কালের ওপর রক্তমাংস জড়ানোর প্রয়োজনে নানারকম চরিত্রেরা এসে জড়ো হয়। আমি তখন এগিয়ে এসে তাদের নানা খুঁটিনাটি বিবরণ যুক্ত করে করে তৈরি করি একেকটা চরিত্র। চুম্বক যেভাবে লোহাকে আকর্ষণ করে, এটা অনেকটা সেই উপায়ই। এভাবেই আমার চরিত্রগুলো সামগ্রিকভাবে গড়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পর কখনও কখনও আমার মনে হয় যে অমুক চরিত্রটি অনেকটা বাস্তবের তমুকের মতো হয়ে গেছে, কিন্তু এটা একটা 'অটোম্যাটিক প্রসেস' বা স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া, কোন পূর্বনির্ধারিত কার্যপ্রণালী নয়। আমার মস্তিষ্কে জমা হওয়া বিবিধ স্মৃতি আর তথ্যের ভান্ডার থেকে আমি অবচেতন মনে টেনে হাতড়ে নানারকম খুঁটিনাটি বের করে এনে সুঁইয়ের ফোঁড়ে তাদের একত্র করি।

এই প্রক্রিয়ার আমার একটা নিজস্ব নামকরণ আছে- 'অটোম্যাটিক ডোয়ার্ফস' , বা স্বতঃস্ফূর্ত বামনের দল। আমি সারাজীবন ম্যানুয়েল গিয়ারের গাড়ি চালিয়ে এসেছি। জীবনে প্রথমবারের মতো যখন অটোম্যাটিক গিয়ারের গাড়ি চালাতে বসলাম, আমার মনে হল যেন গাড়ির গিয়ারবক্সের ভেতরে একদল ছোট ছোট পুতুল সাইজের মানুষ আছে, তারা নিজেরাই ভেতরে ভেতরে গাড়ির গিয়ার বদলায়। আমার ভেতরে এই ভয়ও তখন করতো যে, হয়তো এই বামন সাইজের মানুষগুলো একদিন অনুধাবন করবে যে তারা তাদের জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে অন্য মানুষের হয়ে দাসত্ব করতে করতেই, তারপর তারা ধর্মঘট ঘোষণা করে বসবে এবং ভরা রাস্তায় হুট করে আমার গাড়ি অচল হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে।

আপনাদের হাস্যকর লাগতে পারে, তবুও আমি আন্দাজ করি- আমার অবচেতন মনে এমন কিছু স্বতঃস্ফূর্ত বামন বসবাস করে। তারা তাদের সব রাগ-জেদ নিজের ভেতরে চেপে রেখেই ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছে আমার কথাসাহিত্যের চরিত্র নির্মাণে। আমার দায়িত্ব হল অবচেতন থেকে ওদের তৈরি করা সে সমস্ত চরিত্র স্রেফ কপি করে লেখার খাতায় এনে বসিয়ে দেয়া। সাধারণত আমি যে প্রক্রিয়ায় উপন্যাস লিখি, তা খুব একটা গোছানো, ঝটপট পরিবেশন উপযোগী নয়। প্রথম পাণ্ডুলিপিটা লিখে শেষ করবার পর আমার তার ওপর আরও বেশ কয়েকবার কাজ করা লাগে, ওটার কাঠামোয় পরিবর্তন আনা লাগে। এই সম্পাদনা এবং পুনর্লিখনের প্রক্রিয়া আরও সচেতন এবং যৌক্তিক হয়। কিন্তু প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতির প্রক্রিয়াটা বরাবরই অবচেতন এবং স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর নির্ভরশীল। ওখানে নিজে থেকে ভেবে চিন্তে কিছু বসানো বা বের করবার মতো অবস্থা থাকে না আমার জন্য। এটাই লেখক হিসেবে আমার কর্মপন্থা। আমি যদি এর ব্যতিক্রম কোনো পন্থা অবলম্বন করি তবে আমার চরিত্রগুলো তাদের স্বাভাবিকতা হারিয়ে মৃত চরিত্রে পরিণত হবে। ঠিক এই কারণেই আমি যেকোনো উপন্যাসের সূচনার সময়ের নির্মাণপ্রক্রিয়া পুরোপুরি ছেড়ে দিই সেই স্বতঃস্ফূর্ত বামনদের হাতে।

তবুও, উপন্যাস লিখতে গেলে যেমন অনেক উপন্যাস পড়া থাকা লাগে, একইভাবে চরিত্র নির্মাণের সময় সেসমস্ত চরিত্রের ব্যাপারে অনেক খুঁটিনাটি জ্ঞান থাকা লাগে লেখকের। "জ্ঞান থাকা লাগে" বলতে অবশ্য আমি এটা বোঝাতে চাইছি না যে চরিত্রগুলির প্রত্যেকটাকে আপনার খুব গভীরভাবে বুঝতে হবে। যা আপনার করা লাগবে, সেটা হচ্ছে- মানুষের পোশাক পরিচ্ছদ, তাদের হেঁটে বেড়ানো, কাজকর্ম করা, কথাবার্তা বলার ভঙ্গি, তাদের বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলী আপনাকে জানতে হবে। আপনাকে যত অধিকসম্ভব মানুষজনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে, এবং এই প্রক্রিয়াটি সচেতন হলে চলবে না। যাদের আপনি পছন্দ করেন, যাদের আপনি খুব একটা পছন্দ করেন না, এমনকি যাদের আপনি অপছন্দ করেন- তাদেরও আপনার পর্যবেক্ষণ করা লাগবে। আমার বক্তব্য হল- যদি আপনি আপনার উপন্যাসে কেবল আপনার পছন্দের চরিত্র দিয়ে ভরে রাখেন, যদি আপনার লেখার সব চরিত্রই সহজবোধ্য হয়, তাহলে আপনার উপন্যাস ধীরে ধীরে তার ব্যাপ্তি হারাবে। সবরকমের চরিত্র থাকা লাগবে আপনার লেখায়, তারা নানারকম বিচিত্রমুখী কাজকর্ম করবে, আর এই বিপরীতমুখীনতার সংঘর্ষের মাধ্যমেই আপনার গল্প সামনে আগাবে। কাজেই, লেখক হতে চাইলে ব্যক্তিজীবনে আপনি যদি কাউকে অপছন্দ করেন, তবে তার ওপর থেকে স্রেফ আপনার নজর হটিয়ে রাখলেই হবে না, আপনার নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে- "ওকে, বা ওদের আমি ঠিক কি কি কারণে অপছন্দ করি?" এবং, "যে কাজগুলির জন্য আমি মানুষটি বা মানুষগুলোকে অপছন্দ করি, সে কাজগুলিকেই বা কেনো অপছন্দ করি?"

অনেক অনেক দিন আগে- যখন আমার বয়স হয়তো ত্রিশের মাঝামাঝি ছিল- তখন কেউ একজন আমাকে বলেছিল "আপনার উপন্যাসে কখনও কোনো খারাপ চরিত্রের উপস্থিতি দেখা যায় না।" (পরে আমি জেনেছিলাম, কার্ট ভনেগাটের লেখালিখির ব্যাপারেও মৃত্যুর আগে তার বাবা সে একই কথা বলেছিলেন) আমি তার বক্তব্যটা ধরতে পেরেছিলাম। তারপর থেকেই আমি প্রায় সচেতনভাবে আমার লেখায় নেতিবাচক চরিত্র ঢোকানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু ততদিনে আমি আরও সচেতন হয়ে উঠেছি বড় পরিসরে বর্ণনাভিত্তিক রচনা তৈরি করবার বদলে, নিজের সৃজনশীল লেখালিখির খুব ব্যক্তিগত একটা জগত নির্মাণে- যাতে সবকিছুর মাঝে একধরনের সাযুজ্য থাকবে। বাইরের পৃথিবীর নির্মমতা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমার নিজস্ব এক কাল্পনিক জগতের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, যা কাজ করবে আমার রক্ষাকবচ হিসেবে।

যা হোক, সময় যত কেটেছে, এবং মানুষ হিসেবে ও লেখক হিসেবে আমি যতটা পরিণত হয়েছি (যেমনটা লোকে বলে আর কি), ততোই আমি নেতিবাচক চরিত্র প্রবেশ করিয়েছি আমার লেখাপত্রে; এমন সব চরিত্র নিয়ে কাজ করেছি, যারা সাজানো-গোছানো পৃথিবীর সুর-লয়-তান সব কেটে দেয়। উপন্যাসে আমি যে কল্পনার জগত নির্মাণের চেষ্টা করেছি- তার আকৃতি এবং কার্যক্রমের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ আসার পর আমার পরবর্তী প্রকল্প ছিল তাদের ব্যাপ্তি, গভীরতা, এবং গতিশীলতা বৃদ্ধি। তার জন্য আমার চরিত্রগুলিতে আরও বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে হয়েছে, তাদের কর্মের পরিসরের ব্যাপ্তি বাড়ানো লেগেছে আরও অনেক। আমি এর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছিলাম গভীরভাবে।

ততদিনে জীবনে অনেক কিছুর অভিজ্ঞতা নেয়া হয়ে গেছে আমার। ৩০ বছর বয়সে আমি পেশাদার লেখকদের খাতায় নাম লেখাই, তাও জনসম্মুখে, এবং আমি পছন্দ করি আর না করি আমাকে প্রচুর পরিমাণ চাপ কাঁধে নিতে হয়। মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবার আগ্রহ আমার চরিত্রগতভাবেই নেই, তবুও সময়ে সময়ে দেখা গেলো আমার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে সে আসনে গিয়ে বসা লেগেছে। এমন কাজও ক্ষেত্রবিশেষে করা লেগেছে যাতে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না, অথবা খুব কষ্ট পেয়েছি যখন আমার ঘনিষ্ঠ কেউ আমার বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান করেছে। কখনও কখনও মানুষ আমার প্রশংসা করতে গিয়ে এমন সব কথা বলে ফেলত যা তারা নিজেরাও আদৌ বিশ্বাস করতো না, আবার কেউ কেউ আমার বিবেচনায় কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। আরও এক শ্রেণীর লোক আমার সম্পর্কে অর্ধ-সত্য ছড়িয়ে বেড়ানোর কাজে লিপ্ত ছিল। এছাড়াও আমার এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েও যাওয়া লেগেছে, যাদের কোনোভাবেই সাধারণ বলা চলে না।

প্রতিবার আমি অত্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেছি এই সমস্ত লোক দেখতে কেমন, তারা কীভাবে কথা বলে বা আচরণ করে। যদি আমাকে এ সমস্ত কষ্টকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতেই হয়, আমি হিসেব কষে বের করেছিলাম, তবে এর মধ্যেই আমার লাভজনক কিছু বের করে আনতে হবে (প্রতিদানস্বরূপ, যেমনটা সবাই বলে)। স্বাভাবিকভাবেই এসব অভিজ্ঞতা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে বিষণ্ণতার শিকারে পরিণত করেছে, কিন্তু এখন আমার মনে হয়- ঔপন্যাসিক হিসেবে আমার প্রস্তুতিতেও তারা বড় ভূমিকা রেখেছে। আমার জীবনে যে আনন্দদায়ক, উপভোগ্য অভিজ্ঞতার সংখ্যাও কম তা নয়, তবে যে কোনো কারণেই হোক, কষ্টের অভিজ্ঞতাগুলো, যেগুলো আমি ভুলে যেতে চাই, সেগুলোই মনে গেঁথে থাকে। হয়তো এ জন্যে যে, কষ্টের অভিজ্ঞতা থেকেই আমাদের শেখার থাকে বেশি।

যখনি আমি আমার পছন্দনীয় উপন্যাসগুলোর কথা স্মরণ করি, আমার মনে পড়ে যে তাদের প্রত্যেকটাতেই মনমাতানো সব পার্শ্বচরিত্র ছিল। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে দস্তয়েভস্কির 'ডেমন' উপন্যাসটার কথা। উপন্যাসটা বেশ বড়, তবে একদম শেষ পর্যন্ত মনোযোগ ধরে রাখে। একের পর এক রঙিন, উদ্ভট পার্শ্বচরিত্রের উপস্থিতি আমাকে বিস্মিত করে, এই ধরনের চরিত্র কেনো? দস্তয়েভস্কির মস্তিষ্কের দেরাজ নিশ্চয়ই কাজ করবার জন্য হরেক রকমের চরিত্রে বোঝাই ছিল।

নাতসুমে সোসেকির উপন্যাসগুলোও আকর্ষণীয় সব চরিত্রে ভরপুর। এমনকি যে সমস্ত চরিত্র অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যেও উপস্থিত হয়, তাদের উপস্থাপনও খুবই স্পষ্ট এবং আলাদা। তাদের কারো উচ্চারিত একটি বাক্য, অথবা কোনো অঙ্গভঙ্গি বা কাজ খুব বিস্ময়করভাবে গেঁথে থাকে আমার মাথায়। সোসেকির উপন্যাসের যে জিনিসটা আমাকে সত্যই মুগ্ধ করে, সেটা হল- তিনি স্রেফ বানানোর জন্যই একটা চরিত্র বানান না, বরং তাদের জন্ম হয় লেখকের স্পষ্ট সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতে যে উপন্যাসের ঐ জায়গাটিতে তিনি নির্দিষ্টভাবে ঐ চরিত্রটির উপস্থিতি কামনা করেন। এ হচ্ছে সেই ধরনের উপন্যাসের উদাহরণ, যা মস্তিষ্কের কাটা-ছেঁড়ায় জন্ম নেয় না বরং অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতার স্ফুরণ থেকে যাদের জন্ম। সোসাকি তার প্রতিটি বাক্যে নিজের সেরাটা ঢেলে দেন এবং ফলশ্রুতিতে পাঠক সে লেখা পড়তে গিয়ে একধরনের শান্তি অনুভব করে।

উপন্যাস লেখার যে ব্যাপারটি আমি সবচে বেশি উপভোগ করি তা হল- আমি যা ইচ্ছা তাতেই পরিণত হতে পারি। আমি উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলাম উত্তম পুরুষে। বকু নামের এক পুরুষ ছিল আমার সে উপন্যাসের প্রবক্তা। এভাবে আমি উত্তম পুরুষেই পরবর্তী ২০ বছর টানা লিখি। ক্ষেত্রবিশেষে ফাঁকে ফাঁকে অবশ্য নামপুরুষে গল্পটল্প লিখতাম। খুব স্বাভাবিকভাবেই, উপন্যাসের এই "আই" বা "আমি" হারুকি মুরাকামি, তথা আমি নিজে নই। (যেভাবে কিনা ফিলিপ মারলো-রেমন্ড চ্যান্ডলার না), এবং প্রতি উপন্যাসেই সেই উত্তমপুরুষে থাকা ব্যাটামানুষ প্রবক্তার চেহারা বদলায়। যদিও আমি উত্তমপুরুষে নিয়মিত লিখতে থাকার ফলে বাস্তবের আমি আর উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের মধ্যবর্তী ব্যবধান ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে, আমার জন্যও, আমার পাঠকের জন্যও।

প্রথম দিকে এটা কোনো সমস্যা ছিল না, কারণ কাল্পনিক এক উত্তম পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি (অর্থাৎ 'আমি') থেকে একটি উপন্যাসের পৃথিবী সৃষ্টি এবং বর্ধিত করে তোলা- এটাই ছিল আমার মূল লক্ষ্য। কিন্তু দিন যত গেছে, আমি অনুভব করেছি যে আমার গল্প বলার অন্যান্য আরও কৌশল খুঁজে বের করা লাগবে। বিশেষ করে আমার উপন্যাসগুলো যখন আকার আকৃতির কলেবরে বৃদ্ধি পেতে লাগলো, তখন কেবল উত্তমপুরুষ গল্প বলে চলার প্রক্রিয়াটা অনেক ক্ষেত্রেই আমাকে নির্দিষ্ট এক গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলতো। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত "হার্ড-বয়েলড ওয়ান্ডারল্যান্ড অ্যান্ড দা এন্ড অফ দা ওয়ার্ল্ড" এ আমি দুটি ভিন্নভিন্ন উত্তম পুরুষের কণ্ঠস্বর ব্যবহার করি (সর্বনামগুলো ব্যবহার করেছিলাম বকু, এবং কিছুটা কেতাদুরস্ত চরিত্র ওয়াতাশি নামের চরিত্র দুইয়ের জন্য, পারস্পারিক অধ্যায়ে), যেটা ছিল উত্তম পুরুষে গল্প বয়নের কারিগরি সীমাবদ্ধতাকে ভাঙার এক ব্যক্তিগত প্রয়াস।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যুক্তরাষ্ট্র বড় শক্তি, তাদের পরোয়া করতে হয়: শ্রম প্রতিমন্ত্রী
যুক্তরাষ্ট্র বড় শক্তি, তাদের পরোয়া করতে হয়: শ্রম প্রতিমন্ত্রী
ব্যাংক ডাকাতি রোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে
ব্যাংক ডাকাতি রোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে
রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরালো হয়েছে ঢাকা ও দোহার মধ্যে
কাতারের আমিরের সফররাজনৈতিক সম্পর্ক জোরালো হয়েছে ঢাকা ও দোহার মধ্যে
পুড়ছে সড়ক, তবু অবিরাম কাজ তাদের
পুড়ছে সড়ক, তবু অবিরাম কাজ তাদের
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট