হস্তিনার রাজপ্রাসাদে পুনরায় আগমন ঘটলো ব্যাসদেবের। তাঁর গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণ (ভগবান কৃষ্ণ ও দ্রুপদকন্যা কৃষ্ণার ন্যায়), জটা ও দাড়ির রং কপিল (তৈর্থিক নিরীশ্বরবাদী কপিল মুনির ন্যায় পিঙ্গল), দুটি চোখ অক্ষপাদের ন্যায় সমুজ্জ্বল। গাত্রগন্ধও বনবাসী তাপসের মতো। ওদিকে সত্যবতী অম্বিকা ও অম্বালিকাকে জানিয়ে রেখেছেন, তাঁদের দেবর তাঁদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের নিমিত্ত তাঁদের সঙ্গে রমণ করতে আসবেন। বধূরা সুসজ্জিতা হয়ে প্রাসাদের শয়নকক্ষে অপেক্ষা করবেন। ব্যাসদেব পুনরায় ভাবতে লাগলেন, আদর্শ শাসকের বৈশিষ্ট্যের কথা। শাসক বা রাজা কাম ও ক্রোধকে জয় করবেন। যে রাজা চিত্রাঙ্গদের মতো ক্রোধ জয় করতে পারেন না কিংবা বিচিত্রবীর্যের ন্যায় কামক্রীড়ায় মাতোয়ারা হন, তাঁরা নিতান্তই কৃপার পাত্র। অতিরিক্ত কামের চর্চা ক্ষত্রিয়কে ত্রিবর্গের প্রথম দুই পুরুষার্থ ধর্ম ও অর্থ থেকে ভ্রষ্ট করে—ধর্ম্মায় রাজা ভবতি ন কামকরণায় তু। তবে অতি ধার্মিক রাজা কিংবা অতি নিরীহ শাসক রাজ্যশাসনের উপযুক্ত নন। শুধু করুণাতে রাজ্য রক্ষা হয় না। শাসক ধর্মের প্রতিপালক, যথেচ্ছ ভোগ তিনি করবেন না। রাজধর্ম পালনে দেবত্ব লাভ হয়, রাজধর্ম পালনে অপটু শাসক নরকে যান। জীবজগৎ রাজধর্মে বিধৃত, শাসক সেই রাজধর্মের সেবকমাত্র। যিনি ধর্ম বা রাজধর্ম পালনে সমর্থ নন, তিনি সিংহাসনেরও উপযুক্ত নন। প্রজাদের উন্নতিতে রাজ্যের উন্নয়ন—অথ যেষাং পুনঃ প্রাজ্ঞো রাজা ভবতি ধার্ম্মিকঃ।
এই সব ভাবতে ভাবতে ব্যাসদেব অম্বিকার কথা স্মরণ করলেন। ‘অম্বক’ শব্দের একটি অর্থ হল চক্ষু, যেজন্য ত্রিনয়ন শিবকে ‘ত্র্যম্বক’ বলা হয়। রুদ্র যেমন ধ্বংসের প্রতীক, তেমনি অম্বিকাও ধ্বংসের প্রতীক। আবার ‘অম্বু’ মানে জল, সে জীবনেরও প্রতীক। ব্যাসদেব অম্বিকাকে মানসচক্ষে দেখতে পেলেন। এই নারীই তাঁর ঔরসে জন্ম দেবে সেই অসামান্য পুরুষকে যিনি শতাধিক পুত্রের জনক হবেন।
তে চাপি বৃহতীশ্যামে নীলকুঞ্চিতমূর্দ্ধজে।
রক্রতুঙ্গনখোপেতে পীনশ্রোণিপয়োধরে।।
কন্যারা বৃহতী (সপ্তপর্ণ) পুষ্পের ন্যায় রক্তাভ তপ্তকাঞ্চনবর্ণ, তাঁদের কেশগুচ্ছ ঘনকৃষ্ণ ও কুঞ্চিত, তাঁদের নখগুলি লোহিতবর্ণ ও প্রশস্ত।
সত্যবতী পুত্র ব্যাসকে বললেন, অরাজক রাষ্ট্রে কালাতিপাত করা উচিত হবে না। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন যেন শীঘ্রই মায়ের অভিলাষ পূর্ণ করেন। ব্যাস জানালেন, যদি এক্ষুনি বধূগণের গর্ভে আগামীর শাসকের জন্ম আপনার অভিপ্রেত হয়, তবে কন্যারা আমার দেহের রূপ, গন্ধ প্রভৃতি বিরূপতা সহ্য করার জন্য প্রস্তুত হন। এতে তাঁদের ব্রতপালন করা হবে এবং তাঁরা উৎকৃষ্ট পুত্র অর্থাৎ আগামীর শাসক লাভ করবেন। সুন্দর পোশাক পরে, অলঙ্কারে সেজে শোওয়ার ঘরে তাঁদের অপেক্ষা করতে বলুন।
সত্যবতী অম্বিকার কাছে গেলেন। আজ তাঁর গর্ভে পুত্র অর্থাৎ হস্তিনার শাসক উৎপন্ন করবেন তাঁরই দেবর—এই কথা শুনে অম্বিকা প্রফুল্ল হয়ে সাজসজ্জায় মন দিলেন।
অবশেষে অম্বিকা রাজমাতা সত্যবতীর কথার মর্মোদ্ধার করতে পারলেন। তিনি জানতেন, তাঁর সঙ্গে সংগম করতে আসবেন তাঁর দেবর। চন্দ্রবংশীয় দেবব্রত-ভীষ্ম ছাড়া আর কাউকে তিনি দেবর বলে জানতেন না। তাহলে এই নিকষ কালো জটাজূটধারী ব্যক্তি কে? সূর্যের মতো তেজ তাঁর দুই চোখে, সেই তাপ ও বিরূপতা সহ্য না করতে পেরে অম্বক অর্থাৎ চোখ বন্ধ করে ফেললেন কাশীরাজকন্যা অম্বিকা। এই তবে রাজনৈতিক পরিহাস!
অম্বিকা ভাবতে লাগলেন, রাজ্য এবং রাজা সৃষ্টির পিছনে ঐশ্বরিকতা নয়, রাজনীতিই তবে প্রধান। এই সেই রাজধর্ম যার সঙ্গে অর্থ ও কামের যোগ সুবিদিত। সে সব কিছুকে ঐশ্বরিকতার মোড়কে মুড়ে ফেলার যে কী কারণ তা বুঝে উঠতে পারেন না ক্ষত্রিয়কন্যা। ক্ষত্রিয়ের জীবনে তো মোক্ষ নেই, তাহলে ঈশ্বর আসছেন কোথা থেকে! মোক্ষ থাকলে রাজ্যপাট মাথায় উঠে যাবে!
ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন অম্বিকা। মহর্ষি ব্যাসদেব শৃঙ্গারের কথা ভাবতে পারছেন না। তিনি চিন্তা করছেন অরাজক রাষ্ট্রের কথা। শাসক না থাকলে মানুষ বলবানদের অত্যাচারে যত্রতত্র পালিয়ে বেড়ায় কিংবা লুকিয়ে পড়ে জীবন রক্ষা করে। সেই জন্য ঈশ্বর রাজার সৃষ্টি করেছিলেন।