[চৌচির পৃথিবীলেবু।]
বৃষকায় লোকটা তার দিকে এগিয়ে এলো। কৃশকায় মাধবী থরথর করে কেঁপে উঠল ভয়ে। চিৎকার দিল; যেন তার চিৎকার শুনে যে বজ্রের পাত হচ্ছিল সে ফিরে যাবে আবার মেঘের পেটে। পিছিয়ে গেল; যেন পিছিয়ে গেলেই মুক্তি; যেন পিছিয়ে গেলেই যা থেকে মুক্তি চাইছে তা এগিয়ে যেতে পারবে না; যেন বিপদ থেকে পিছিয়ে গেলেই বিপদ থেকে মুক্তি হবে যেন বিপদের পা নেই। কিন্তু বিপদের পা হাত দাঁত নখ সবই আছে।
দুহাতে চোখ ঢেকে নিলো, যেন চোখ ঢেকে নিলে সমস্তকিছু নাই হয়ে যাবে। যেমনভাবে ভাবে উটপাখি আর ধরা সহজ হয়ে যায় আরো বেশি তাকে।
তার চিৎকারে আকাশের পড়ন্ত বাজ ফিরে গেল মেঘের গর্ভে, পৃথিবীর কোথাও পাহাড় ধ্বসে পড়তে যাচ্ছিলো পাহাড় ধ্বসা বাদ দিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো, তার চিৎকারে প্রাকৃতিক অনেক ধ্বংসাত্মক ব্যাপার থেকে গেল, হংসাত্মক নৃত্য থেমে গেল কিন্তু বৃষাঙ্গ ফিরে গেল না, থামল না।
কৃশাঙ্গের দিকে এগিয়ে আসছে বৃষাঙ্গ। স্কুলে পড়েছিলো পৃথিবী কমলালেবুর মতো। তার চিৎকারে অজস্র কমলালেবু ফেটে চৌচির হয়ে গেল। এ ভূগোল সুগোল নয়; ঈষৎ কমলাবৎ চ্যাপ্টা; বইয়ের ভেতর পৃথিবীর সাথে আকারের মিল দেখাতে কমলার যে ছবি দেওয়া ছিল সে ছবির কমলা ফেটে গেল আর কমলার পাশে থাকা আঁকা পৃথিবী হো হো করে হাসছে। পৃথিবীর নির্মম দাঁত বের করা হাসি দেখে কাঁদছে মাধবী। তার কান্নাতে ভেসে গেল জগতের সব পাহাড়-পর্বত, সমতল, নিম্নতল। লোকটার লোমশ জিহ্বা ঠোঁট তাকে চুষে নিচ্ছে। পৃথিবীলেবুর রস তার কষা বেয়ে তরল আগুনের মতো বয়ে যাচ্ছে পৃথিবীকে পুড়িয়েই। পৃথিবীলেবু ছটফট করে। কমলালেবু ছটফট করে। মথ্যমান মাধবী ব্যথায় কুঁকড়ে যায়।
তার শরীরের কেন্দ্রে যেন লোহার খন্তা ঢুকে গেছে। অজস্র তরমুজ ফেটে যাচ্ছে, তরমুজ খেতে মত্ত হস্তীর এলোপাতাড়ি চলনে, চলার দলনে ফাটছে তরমুজ। তরমুজের লাল লাল রক্তে রসে ভেসে যাচ্ছে সমগ্র খেত।
রক্ত। লোকটা বুনো ষাঁড়ের মতো। মাধবীর মরণ যন্ত্রণা। লোকটার বৃষতা নির্মম। মাধবীর পেটে ক্ষুধা। লোকটা বুনো ষাঁড়; এফোঁড়-ওফোঁড় করে। দুদিন তেমন কিছু খায়নি। লোকটা বুনো ষাঁড়; ফোঁস-ফোঁস করতে থাকে। মাধবীর চোখে জল। লোকটা বুনো ষাঁড়; ফোঁড়াফোঁড়ি করে নির্দয়ভাবে। তখন থেকে মাধবীর মুখভর্তি থুথু থইথই করছে; থইথই থুথু ফেলার জায়গা নেই। লোকটা বুনো ষাঁড়; তার লালা মেখে দিচ্ছে মাধবীর মুখে। মাত্র দুদিন আগে তার বাবা মারা গেছে। লোকটা বুনো ষাঁড়। মাধবী দেখছে তার বাবার কাটা পা এগিয়ে আসছে। লোকটা বুনো ষাঁড়। মাধবী দেখছে প্রৌঢ়ার রেখে যাওয়া থালাতে সাদা সাদা ভাত সাদা সাদা পোকার মতো কিলবিল করছে। লোকটা বুনো ষাঁড়। মাধবী। বুনো ষাঁড়। মাধবী। ষাঁড়। ষাঁড়, ষাঁড়, ষাঁড়। মাধবী নিসাড়। ষাঁড়। মাধবী। মত্ত হস্তি। মাধবী। তরমুজ। পৃথিবীলেবু। কমলালেবু। মাধবী। তার কোনো অস্তিত্ব নেই, শুধু ষাঁড়ের অস্তিত্ব, ষাঁড়ের গুতোগুতি, ষাঁড়ময় জগৎ; শুধুই বৃষ, বৃষতা, বৃষাঙ্গ।
দূর কোথা থেকে ভেসে আসছে তার মায়ের হাতের চুড়ির ঝনঝন, শুনতে পাচ্ছে রমজান ডাক্তারের হো হো হাসি।
এত হাসি হাসে কেন মানুষ?
লোকটা হাসে। হাসি শুনতে তার ভালো লাগে না, হাসি দেখতে ভালো লাগে না। মানুষ যদি গভীরভাবে একটু ভেবে দেখে তবে কোনো হাসি হাসাই মানুষের পক্ষে সম্ভব না।
মাধবী জ্ঞান অজ্ঞানের ঘোলাজলে ঘূর্ণিজলে তলাতে থাকে। শিশুকালের সেই কুকুর তার সামনে আসে। কুকুর জিব বের করে হাঁপায়। কুকুরের জীভ দিয়ে জল ঝরে।
সে বলেছিল, বাবা দেখ— ‘কুকুর কেমন জিহ্বা দিয়ে কাঁদছে। কুকুর কি জিহ্বা দিয়ে কাঁদে গো বাবা?’
কুকুর বিস্ময় নিয়ে তাকায় শিশু মাধবীর দিকে।
শ্রীদাম হাসতে হাসতে বলে— ‘কুকুরের ঘর্মগ্রন্থি নেই গো মা তাই দেহের তাপ ঝরাতে জিহ্বা দিয়ে জল ঝরায়।’
কুকুরের ঘর্মগ্রন্থি নেই। মানুষের আছে। মানুষের ধর্মগ্রন্থি নেই, মর্মগ্রন্থি নেই। লোকটার গা থেকে ঘাম ঝরছে, ঘামের সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে মাধবী।
লোকটা হাসতে হাসতে বলল— ‘চমৎকার তোমার চিৎকার’।
লোকটার কথা মাধবীর কানে ঢুকল না। সে তার চিৎকারের প্রশংসা শুনতে পেল না।
[মৃৎপিণ্ডবেদী। হৃদপিণ্ডবেদী।]
মাধবী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। প্রৌঢ়া ঘরে ঢুকে তাকে নগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। মাধবীর উর থেকে ঊরু পর্যন্ত শরীরে অনেক ছোটো ছোটো ক্ষত।
প্রৌঢ়া লোকটাকে ডেকে পাঠায়— ‘এ কী হাল করেছ তুমি এর, একে তো আরো কয়েকদিন কাজ করাতে পারব না। শরীরখান তো দেখছি ছিঁড়ে দিয়েছ। খ্যাপা কুকুরের মতো কামড়েকুমড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছ। শুকনা শুঁটকি মেয়েটার দুএকখান হাড়ও ভেঙে ফেলেছ কি না কে জানে।’
লোকটা বীরের মতো বুক ফুলিয়ে নিঃশব্দে মিটমিট করে হাসে।
মহিলা বলে— ‘হাসলে হবে না, আরো বেশি টাকা তোমাকে দিতে হবে।’ লোকটা বলে— ‘এমনিতেই তোমাকে কম টাকা দিইনি। টাটকা মাল বলেই তো এত টাকা দিয়েছি। আর কেন টাকা চাও?’
মহিলা নাছোড়— ‘দেখ, বেশি বকিও না নইলে আর কোনোদিন এখানে তোমাকে ঢুকতেও দেব না। বনমানুষের মতো মৌজ করবে আর টাকা দেবে না, তা হবে না বাপু।’
লোকটা আরো কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে যায়। মহিলা মনে মনে হাসে।
মনে মনে হাসা হাসির দুএক ফোঁটা তার মুখ দিয়ে চুয়ে পড়ে— মাগিটাকে দিয়ে বেশকিছু কামাই করা যাবে।
মহিলা মাধবীর চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরায়।
মাধবীর জ্ঞান ফিরলে বলে— ‘ওরে চিনির পুতুল আমার! নে আর নাটক করিস নে। কোনো কায়দা করেই ফায়দা হবে না। তোকে কিনতে একগাদা টাকা চলে গেছে।’
আবার বলে— ‘চিনির পুতুল হয়ে থাকলে চলবে না বুঝলে খুকি। এখন তোকে যোনির পুতুল হতে হবে, ননীর পুতুল হতে হবে, নুনুর পুতুল হতে হবে।’
মহিলার খাবারের থালার দিকে চোখ যায়— ‘কই গিলিসনি এখনো? কোনো লাভ নেই। নে গিলে নে।’
বলে সে খেলো কী খেলো না তার ভ্রক্ষেপ না করেই বেরিয়ে গেল। মহিলা জানে, মানুষ স্বাধীন নয়। সে ক্ষুধার হাতে বন্দী। ক্ষুধা মানুষকে খেতে বাধ্য করে। শত্রুকে ঘৃণা করে কিন্তু শত্রুর সাথে সন্ধি করেই বেঁচে থাকে মানুষ। আসলে মানুষ নিজের ঘৃণার সাথেই সন্ধি করে নিতে বাধ্য হয়।
যদিও মহিলা বলেছিলো, মাধবীকে আর কারো কাছে দুতিনদিন তুলে দেবে না তবু বিকেল হতেই আরো একজন লোক এসে ঢুকল মাধবীর ঘরে। সম্ভাব্য অত্যাচারের ভয়ে সে চোখ বন্ধ করে সংকুচিত হয়ে বিছানার এককোনে চলে গেল। বিছানার ওপর কেউ লুকাতে পারে না। কেউ আসলে কোথাও-ই লুকাতে পারে না। এই লোকটিও এসে তার ক্ষতবিক্ষত শরীরের ওপর চড়াও হলো।
এ লোকটা চলে গেল, এল আরো একজন। তারপর আরো একজন। মাধবীর শরীর আর তার শরীর হয়ে নেই। তার শরীর এখন অন্য কারো; পুরো পৃথিবীর পুরুষের। তার শরীরের মালিক এখন সে নয়; পুরো পৃথিবীর পুরুষ। তার শরীর এখন মাংস বাজারের মাংস। ছুরি ফলায় মাংস ফালাফালা হচ্ছে, মাংস রান্না হচ্ছে, মাংস রান্নার সুগন্ধ ছুটছে দূরে দূরে। লোকজন ছুটে আসছে মাংস ভোজন করতে।
মাধবীর দেহের অনুভূতি যেন চলে গেছে। শরীর যেন নেই। তার ওঠার ক্ষমতা নেই, বলবত্তা নেই।
হে ভগবান, তুমি কি পৃথিবী এ কারণে সৃজন করেছ?
হে ভগবান, তুমি আমাকে তাহলে এই কারণে সৃষ্টি করেছ?
না কি ভগবান টগবান সব ভুয়া কথা।
এতদিন যে ঠাকুরসেবা করেছি তা কি এসকল ঘটার জন্য?
ঠাকুরের পায়ে কুকুরের মতো পড়ে ধুলো মেখেছি কি এ বেশ্যাজীবন পাবার জন্য?
সব দেবতা ভুয়া। অপদেবতাই শুধু সত্য। সব দেবতা দাঁড়িয়ে থাকে মন্দিরে মৃৎপিণ্ডের বেদির ওপর মৃত হয়ে; সব অপদেবতা দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের হৃৎপিণ্ডের ওপর জীবন্ত হয়ে; তারাই মানুষের হৃদয় চালায়।
তো ঠিক আছে ভগবান সব নামগান সব শাম গান থামালাম জীবন থেকে। এখন কামগান হোক শুধু।
তো ঠিক আছে ভগবান, এই যে আমার যোনি উন্মুক্ত করে রেখে দিলাম পুরো জগতের জন্য, সকল মানুষ আসুক, সকল দেবতা আসুক, তুমিও এসো ভগবান। এসে ফেড়ে ফেল। সে দুপা দুপাশে ফাঁক করে পড়ে রইলো। সে পড়ে রইলো, সে তার যোনি সঁপে দিয়েছে জগতের মহাজগতের সকল ইঁদুর বিড়াল সুর অসুর মানুষ সবার জন্য।
[বেশ্যাবেশ্মে প্রথম দিন কেটে গেল।]
মাধবীর পেটে দারুণ ক্ষুধা। তার শরীরের প্রতি পেশী আর প্রতিপেশীর কণায় কণায় দারুণ ব্যথা। ব্যথার দারুণ্য তাকে মুষড়ে রাখে। তার মন আছে না তাকে ছেড়ে চলে গেছে বুঝতে পারছে না।
সে ভাত খাবার জন্য ধীরে ধীরে প্লেটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। এক হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আরেক হাত সেই হাতকে ভাতের থালা না ধরার জন্য টেনে ধরেছে। সে বুঝতে পারল তার ভেতর তাকে এখনো ছেড়ে যায়নি। এক হাতে তার দেহ সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে হাতকে ভাতের থালার দিকে নিয়ে যাচ্ছে আর একহাতে তার মন সমস্ত শক্তি দিয়ে ঐ হাতকে টেনে ধরে আছে। মনের হাত আর দেহের হাতের পাঞ্জা চলছে। পাঞ্জার কোনো হাতই কোনো দিকে টলাতে পারছে না কোনো হাতকে। স্থির হয়ে আছে মধ্যবিন্দুতে।
সে ভাবে, আত্মহত্যা ভালো, আত্মসম্মানহত্যা খারাপ। আত্মহত্যাতে মানুষ পুরো মরে; পুরো মরণ ভালো। আত্মসম্মানহত্যাতে মানুষ অর্ধেক মরে; অর্ধেক মরার মতো লাঞ্ছণাময় আর কিছু নেই, ভয়ংকর কিছু নেই। এসব ভেবে ভেবে, ভাত চাওয়া হাতের বিপক্ষে আঁত বাঁচাতে চাওয়া হাতের দিকের শক্তির বাড়াতে চায়। দুহাতের দুরকম দাবির শক্তি বহুক্ষণ মধ্যবিন্দুতে স্থির থাকে।
আস্তে আস্তে মনের হাত নিস্তেজ হয়ে এলো। মধ্যবিন্দু থেকে বধ্যবিন্দুতে পড়ে গেল মনের হাত। ভাত চাওয়া হাত জিতে গেল আঁত চাওয়া হাতের ওপর। ভাত চাওয়া জয়ী হাতের ওপর উঠে এলো ভাত-শিরোপা। সাদা সাদা ভাত। থোকা থোকা পোকার মতো ভাত।
এসব পোকা কি পেটের ভিতর গিয়ে কিলবিল করবে না?
ভাত মাখতে গিয়ে তার মনে পড়ে সেদিন ঝোঁপে বুনো মুরগি ধরার কথা।
আচ্ছা, বুনো মুরগিটা অত স্থির ছিল কেন?
ওটা কি আসল মুরগি ছিল না?
কত সহজেই ধরা দিয়েছিল, কোনো শব্দ করেনি, ছটরপটর করেনি, ঝটরপটর করেনি।
আচ্ছা তার বাবার কেটে ফেলা পা-টার কী হয়েছিল?
ঐ ডাক্তার পা-টা কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল?
না কি কোনো মাংসের দোকানে বিক্রি করে দিয়েছিল?
মানুষের মাংসের নাম মহামাংস।
মানুষের মাংসের স্বাদ কেমন?
জীব তো জীব খেয়েই বেঁচে থাকে।
তাহলে মানুষ মানুষকে খেলে ক্ষতি কোথায়?
বেশ্যাবেশ্মে মাধবীর প্রথমদিন কেটে গেল।
আরতি
[শেষ নিঃশ্বাসে সময়ও আক্কেলগুড়ুম হতে পারে মানুষের।]
আরো অনেক অনেক মানুষ খুন হলো, দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর গায়ে ছবি হয়ে উঠল; আরো কত কুকুর-শেয়াল সাপ-নেউল বাস ট্রাকের নিচে পড়ে সামান্যতম শব্দ করার সময় পেল না মরে গেল। কত মানুষ মরে গেল গরল গিলে বা ফাঁসিতে ঝুলে।
আরতি বেঁচে আছে। রমজান ডাক্তারের বাড়ি থেকে বিতাড়িত হবার পর, বিবাড়িত হবার পর, আরো কয়েকমাস ধরে সে বেঁচে আছে। যদিও সে আর একটুও বাঁচতে চায় না। কিন্তু সে মরতে পারছে না, তার কাছে মৃত্যু আসছে না। প্রচুর জল আছে ডুবে যেতে পারছে না। প্রচুর আগুন আছে পুড়ে যেতে পারছে না। প্রচুর দড়ি আর গাছের ডাল আছে ঝুলে যেতে পারছে না। প্রচুর ছোরা-ছুরি জগতে, কোনো একটা এসে তাকে ফালা ফালা করে দিচ্ছে না।
দিনের বেলা সে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। কখনো খেতে পায় কখনো পায় না। সারাদিন হারাদিন হলে রাতের বেলা পরিষদের পুরাতন বিল্ডিংয়ে এসে বিছানা পাতে। শুয়ে থাকে। কেউ না কেউ আসে মদনদেবের আজ্ঞা নিয়ে। আরতির কান্না বেরোয়। নিরুপায় হয়ে সে পোশাক আলগা করতে দেয়। বিরক্ত হয়ে বা নিজেকে লাঞ্ছিত করার জন্য কখনো নিজেই খুলে দেয় শাড়ির প্যাঁচ। নিজেই দ্রৌপদী, নিজেই দুঃশাসন।
লোকালয়ের নারীরা তাকে একেবারেই দেখতে পারে না। আগে তো কুলত্যাগি বলে গণ্য ছিল এখন নাম জুটেছে বেশ্যামাগী... কুচনিমাগি...। তার জন্য কোনো পুরুষ ঠিক নেই, সবাই তার কাছে যায়।
আরতির পাগলি পাগলি অবস্থা। সে আর লোকালয়ের দিকে যায় না। বাজারেই ঘুরে বেড়ায়। ঘুরে বেড়ায় বড়ো রাস্তার ধারে বা নদীর কোলে কোলে। ঘুরে বেড়ায় আলোকে ফাঁকি দিতে চেয়ে অন্ধকারে, অন্ধকারকে ফাঁকি দিতে চেয়ে আলোতে।
আজকে ভোর তখনও ভালো করে হয়নি। সে শুয়েই আছে। এমন সময়ে গুটিগুটি পায়ে একটা বারো চৌদ্দ বছরের ছেলেকে আসতে দেখে। আরতি অবাক এমন ভোরে একটা ছেলেকে আসতে দেখে।
আহা মাধবী যদি ছেলে হতো তবে কি তার আজ এ অবস্থা হতো?
যেভাবেই হোক মাধবী কি তাকে উদ্ধার করে নিত না?
দুজনেই দুজনের কাছে উদ্ধৃত হতে পারত না?
এভাবে পথেঘাটে কি তাকে বেড়িয়ে বেড়াতে হতো?
ভাবে, পথ সকলের সাথে এক আচরণ করে না। মেয়েমানুষকে পথ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, পুরুষমানুষ পথকেই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
ছেলেটা এসে তার সামনে দাঁড়াল। আরতি শোয়া থেকে উঠে বসল। ছেলেটিকে মাথা চুমে আদর করতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু হাঁটুর বয়সী ছেলেটির কথা শুনে সে থ হয়ে গেল। আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল।
সে ভেবেছিল, তার জীবনে আক্কেলগুড়ুম হবার আর কিছু নেই; আক্কেলগুড়ুমের অবস্থা তার শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু শেষ হয়নি। শেষ নিঃশ্বাসের সময়ও আক্কেলগুড়ুম হতে পারে মানুষের।
বাচ্চাটি আরতির আক্কেলের ওপর হুড়মুড় করে পচা জল ঢুকিয়ে দিল। আরতি হাতচাপা দিল দুকানে। বাচ্চাটা কথা কয়টা বলে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন সে একটা চকলেট চেয়েছে মাত্র। আরতি আহত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে; এ গোডিম বাচ্চা এখনই কীভাবে শিখে গেছে নারীপুরুষের এসব সম্পর্ক সম্পর্কে।
তার শরীরে কি পুরুষ তৈরি হয়েছে?
আরতির বিস্মিতি কাটে না।
বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে সে বলে— ‘না বাবা এমন পচা কথা বলতে হয় না। তোমার আল্লাহ পাপ দিবে। তুমি তো ভালো ছেলে।’
ছেলেটা বলে— ‘আমি ভালো ছেলে কিন্তু...অনেকেই তো তোমার কাছে...আমি শুনেছি...বাবাও নাকি...মা ঝগড়া করছিল বাবার সাথে। আমি রাতে আসতে ভয় পায় বলেই তো খুব সকালে উঠে এলাম, মা বাবা এখনো ওঠেনি। আমাকে না করছ কেন?’
আরতি হতভম্ব হয়ে যায়। তার কানে যেন গরম সিসা ঢুকছে। সে পারে না যে এখনই প্রাণত্যাগ করে।
আরতি তাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে প্রায় দৌড়ে বাজার চলে আসে। সে হাঁপায়। সে একটা দোকানের চালার নিচে বসে কাঁদে। বাচ্চাটির কথা তার কানে যেন আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে। তার চোখের সামনের বাতাসের গায়ে বাচ্চাটির চেহারা কে যেন আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে। বাচ্চাটার কথাগুলো তার কানের ভেতর পোকার মতো হেঁটে বেড়াচ্ছে। খড়ি কানে ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথাপোকাগুলোকে বের করে দিতে চায়। সে তার চোখের ভেতর ছাই ঢুকিয়ে ঘষে ঘষে বাচ্চাটার চেহারা তুলে ফেলতে চায় যেমনভাবে হাঁড়ি পাতিলের গা থেকে কালিঝুলি ঘষে ধুয়ে ফেলেছে আজীবন।