X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা

গৌতম গুহ রায়
৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

পর্ব-২


প্রাচীনতম স্মৃতির গোপন উষ্ণতা

সেই সময় আমাদের কলোনির কোনো বাড়িতেই অন্য বাড়ির মাঝে কোনো বেড়া ছিল না। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর ওপার থেকে আসা মানুষদের পুনর্বাসন ঘটেছিল এই ‘কলোনি’গুলোয়। সবাই ছিন্নমূল ও বাঙাল, এখানকার পুরোনো বাসিন্দারা বলতো ‘ভাটিয়া’। তাই এই কলোনিগুলোর ভাষা ও সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পেঁচিয়ে ছিল দেশভাগের ফলে ভিটা হারানো মানুষজন, আত্মীয়স্বজনদের স্মৃতি ও কান্না। তাই সীমান্তের কাছে পরাজিত সব হারানো মানুষগুলোর সীমান্তহীন এবাড়ি ওবাড়ি মাঝখান দিয়ে অনায়াসে চলাচল করা যেত। সেই বন্যার পরে বাড়ি ফেরা আমাদের তেমনি এবাড়ি ওবাড়ির মাঝখান দিয়ে। ৪ অক্টোবর, মধ্যরাতে প্রলয় এসেছিল আমার শহরে, তখন আমার বয়স ৪ বছর, ভাই তপন তখন ৫/৬ মাসের সদ্যোজাত। বন্যার পর এই শহরের সব হারানো মানুষদের আকাশজুড়ে খিদা, আর বাতাসে মাঝে মাঝে সাইরেনের শব্দ, এ-ও এক যুদ্ধক্ষেত্র, জীবন যুদ্ধের, ত্রাণের জন্য যুদ্ধের। আমাদের বাসার পেছনে ছিল একটা রুটির ফ্যাক্টরি, নাম ক্যালকাটা বেকারি। তার সামনে দিয়ে আসতে গিয়ে মায়ের পা বন্যার আঠালো পলিমাটির কাঁদার মধ্যে আটকে যায়। দুই কাঁখে দুই সন্তানকে নিয়ে মা হুমড়ি খেয়ে পড়েন সেই জলকাদার মধ্যে। তারপর আবার উঠে দাঁড়ায় আমার মা, আমাদের প্রত্যেকের শরীরজুড়ে ধূসর কালো আঠালো কাদায় মাখামাখি। অস্পষ্ট হয়ে আসা সেই স্মৃতির মধ্যে আজও স্পষ্ট একটা হৃৎস্পন্দন মার চেতনার শেকড়ে, জাগিয়ে রাখে। আমাকে বুকে চেপে ধারে মা ছুটছেন, ঘোলা জল বাড়ছে, মা একদিকে আমাকে জড়িয়ে আঁকড়ে অন্য হাতে জড়িয়ে নিয়েছেন আমার সদ্যোজাত ভাইকে, জল বাড়ছে ক্রমশ।  হাঁটু ডুবে যাওয়া তিস্তার বাঁধ ভাঙা ঘোলা জলের তীব্র বাঁধা ভেঙে মা ছুটছেন। আজ, ষাট বছর পরে সেদিনের চার বছরের শিশুর কানে সেই অভিজ্ঞতার স্পন্দন ছাড়া আর কিছু নেই। সেদিন ছিল কোজাগরীর পূর্ণিমা রাত। সেদিনের শিশু আজ মাতৃহীন স্মৃতির প্রাণশূন্য করতল হাতে রুদ্ধবাক, ক্রমশ রক্তহীন হয়ে যাচ্ছে ওই আঙুলগুলো, যা আঁকড়ে একদিন শিশুটি উঠে দাঁড়িয়েছিল। আজও সেই গরম বুকের ধুকপুক শুনি, আমার জীবনমন্ত্র। মায়ের হৃদয়ের ঐ আদি ধ্বনি আমার প্রাচীনতম স্মৃতির ধ্বনি।

নিশুতি রাতে, মাঝে মাঝেই মগজে ঐ ধ্বনির হানাদারি চলে, চোখ বন্ধ করলে সামনে উড়ে আসে ছেঁড়া ছেঁড়া ছবিগুলো, ঝাপসা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ছুটছেন তিনি, আমার জগতজননী মা। বুকে আঁকড়ে আছেন নিজেরই আত্মজ, নিজের রক্তমাংসে গড়ে তোলা উত্তর প্রজন্ম...। পথ শেষ হয়ে আসছে, জলকাদা ভেঙে তিনি আর ছুটতে পারছেন না, পায়ে পা জড়িয়ে পরে যাচ্ছেন, আবার উঠছেন, ছুটছেন...।

আজ মা-হীন জগতে মা জেগে আছেন ওই ধ্বনিতে। ২০১৫-তে দু-দুবার তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। স্মৃতিগুলো মায়ের এলোমেলো হয়ে যায়, কখনো স্মৃতি হারিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, আবার কখনো অতীত ও বর্তমান নিয়ে সচেতন ও স্নেহ-নিবিড়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও স্মৃতিহারানো মা আমার আতঙ্কে চিৎকার করে উঠতেন। এই সময় কি তার চিন্তার খাঁজে ও ভাঁজে জমা থাকা কষ্টগুলো ভেসে উঠত? টুকরো টুকরো আতঙ্ক, চিরজীবন বহন করা অনিশ্চয়তার কষ্ট, বিশ্বাসহীনতার ছলচাতুরীর ক্ষত, প্রবলের দাপটে অসহায় কান্নার ছটফটানি। জীবনভর দুহাতে বিলিয়ে যেতে চেয়েছেন শুভেচ্ছার শুভ্রতা, দুর্বলের কষ্টে আঁচল খুলে শেষ সম্বলও বিলিয়ে দিতেন হাস্যমুখে, সেই হাসিমুখ কেমন নিষ্পাপ ফুলের মতো শুয়েছিল শেষ যাত্রার সময়। প্রাণহীন সেই দেহ সমস্ত আবেগ, কষ্ট, যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে, আজ ‘আকাশভরা সূর্য তারা’র মাঝে সেই অভিমানিনী, সেই আলকময়ী কি তাকিয়ে দেখছেন তাঁর স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, তাঁর ইচ্ছা, অনিচ্ছাগুলো কীভাবে গায়ে গা লাগিয়ে টিকে আছে বা উবে গেছে! আপোসের এই ঈষৎ স্বর্ণাভ, ধানবর্ণ তাঁরাটি কি সে, যাকে মা বলে ডাকতাম...।

বন্যার পরে যখন বোঝবার বয়স হল তাঁদের কাছে শুনেছি সেই প্লাবনের রাতে ঘোলা স্রোতের উত্তাল জলে সাঁতার কেটে বাবা সারারাত আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের বাড়ির খোঁজ নিয়ে বেড়িয়েছেন। আমার মেজো জ্যাঠা দার্জিলিং থাকতেন, তাঁর অসুস্থ শ্বশুরকে ওই জল ভেঙে জলমগ্ন বাড়ির চাল খুলে কাঁধে করে উদ্ধার করে এনেছিলেন। এক বন্ধুর মাকে দরজা ভেঙে বের করে আনেন ডুবন্ত বাসা থেকে। আমার বাবাকে ঘিরে এমন হাজারো প্রাচীন স্মৃতি, বাবাকে সেখানে খুঁজে পাই। তাঁর জন্য একটা গোপন উষ্ণতা বুকের মধ্যে টের পাই, আজও।


বেঁটেখাটো কালো রঙের জন হেনরির কথা

যেদিন বাবা অন্তিম শ্বাস নিচ্ছেন, সেদিন আমি আমার আজন্মের এই ছায়াবৃক্ষের পতনের দৃশ্য-শব্দ দেখার সাহস পাইনি। আত্মীয়-স্বজনের বাবার এই খবরটা কানে কানে পৌঁছে গেছে ইতিমধ্যে। সকাল থেকেই আত্মীয়-স্বজনেরা আমাদের বাসায় চলে এসেছেন। কেউ একজন বললেন– টান উঠেছে, পারিবারিক ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ছোট কাকু অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে বললেন। অনেকে এই সময় বাইরে যেতে না করলেও তা অস্বীকার করে আমিই অক্সিজেন সিলিন্ডারের খোঁজে বাইরে চলে গেলাম। আসলে আমার মন এই দৃশ্য থেকে পালাতে চাইছিলো। বাইরে বেড়িয়েই মনটা হুহু করে কেঁদে উঠল। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেশি নেই। আমি পথে পথে উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, অনেকক্ষণ এভাবে ঘুরেফিরে হাঁটতে হাঁটতেই যখন বাসায় ফিরলাম তখন বাসা জুড়ে কান্নার আওয়াজ। মা ঘরের চৌকাঠে বসে আছেন, পাশে আমার একমাত্র পিসি, বাবার থেক বয়সে বড়– সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আমাকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাবা, সব শেষ হয়ে গেলো! বাবার মুখে শেষ বার জল দিতে পারলি না!’ এতক্ষণ মায়ের চোখে জল ছিল না, আজ অনেকদিন পরে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখলাম মাকে। মায়ের চোখের জলে ধুয়ে গেলো আমার মনের দলা পাকানো কান্নার কুয়াশা। মার বুকে জমে থাকা কান্নার বরফ তখন গলে গলে নামছে। কান্নারা তো মানুষের বুকের জমাট দুঃখের বরফেরই শীতল জল।

রূপবান পুরুষ ছিলেন না তিনি, আমার বাবা। বেঁটেখাটো কালো রঙের মানুষটা যখন সকালে বেরিয়ে রাতে বাসায় ফিরতেন তখন আমরা দূর থেকেই তার কাশির শব্দে টের পেতাম বাবা ফিরছেন। অজস্র ক্ষতচিহ্ন ছিলো তাঁর শরীর জুড়ে, মনেও কী ছিল না! কিন্তু মনের কোনো ক্ষতকে তিনি কোনোদিন প্রকাশ করেননি। কোনো বাবাই তার সন্তানসন্ততিদের সামনে অন্তরের ক্ষত দেখায় না, আমার বাবাও কোনোদিন তাঁর  আঘাতের অন্তর বা অন্দর কোনোটাই দেখাননি।

ছোটকাকা বা একমাত্র পিসি সময় সুযোগ হলেই আমাকে দেশের বাড়ির গল্প করতেন। তাঁদের বর্ণনায় আমার চোখের সামনে ফুটে উঠতো বিক্রমপুরের মালখানগরের পুকুরের পানা ও মাছের ঝিলিক, দেখতাম ঘাসের ধুলো উড়িয়ে স্কুলের মাঠে দৌড়াচ্ছেন পাণ্ডব রায়ের পাঁচ নাতি। কিন্তু বাবা আমাকে কোনোদিন দেশের বাড়ির গল্প করেননি। বলেননি দেশভাগের সময় কী মর্মান্তিক, অমানুষিক যন্ত্রণা সহ্য করে এখানে সেখানে ঠোক্কর খেতে খেতে চলে এসেছেন সীমান্ত হয়ে যাওয়া অন্য এক দেশে। এই সেই দেশ, আজ যা আমার দেশ বলে চিহ্নিত করা হয়। বাবার ও আমার কি ভিন্ন দেশ?

উত্তর পাই না, শুধু আকাশে চক্কর খাওয়া ধূসর অতীত-রঙের শকুনের চিল্লানো হাসি ও চিৎকার শুনি।

মানুষের অন্তরের ক্ষত খুব বেশি গভীর হলে সে তার প্রকাশ করতে পারে না, আমার মাঝে মাঝে মনে হতো এই ক্ষত যন্ত্রণা বাবা বয়ে চলছেন আহরাত্র, আমরা টের পাই না। অথচ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শারীরিক আঘাতেও শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি তাঁকে। একবার বাম হাতের বুড়ো আঙুলে ফোঁড়া হয়েছিলো, গোটা বাড়ি সেই ব্যথায় টলোমলো। বড় জেঠিমা গরম জলে নুন দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে, তুতের পট্টি দিয়ে সেই ফোঁড়া ফাটানোর পর স্বস্তি। একবার পেন্সিল কাটতে গিয়ে ব্লেডে আমার হাত কেটে গেলো, কয়েক ফোটা রক্ত, বাবার সেই দেখেই কী চিৎকার! কখনই রক্তপাত দেখতে পারতেন না তিনি।

ছোটবেলায় আমার মাঝে মাঝে কাঁটা-ছেঁড়ার দুর্ঘটনা ঘটতো, বেশিরভাগই স্কুল ফেরতা, একবার জামরুল গাছের মগডালে উঠে হাতের নাগালের বাইরের বেশ পরিপক্ব একটা সাদা-গোলাপী জামরুল পাড়তে গিয়ে সেই অশক্ত ডাল ভেঙে সোজা নিম্নমুখী স্খলন, নিচে আনারস গাছের ঝোপের উপর! বুকের অনেকটা সেই তরবারির মতো কাঁটাযুক্ত পাতায় ছুলে গায়ের ছাল উঠে যায়! এপারের ঘটনা আরো মারাত্মক। আমাদের বাসায় ঠাকুরদার লাগানো অনেকগুলো আম জাম কাঁঠালের গাছ ছিল। বাসার দক্ষিণ সীমান্তে এরই একটা আমগাছ ছিল। পোকা হতো খুব সেই আমে, তাই সেই গাছের আমের প্রতি কারো আগ্রহ ছিল না। গ্রীষ্মের এক সকালে দেখি ডালে ডালে পাকা আম ঝুলছে। লোহার একটা ছোট দাঁ নিয়ে গাছে উঠে যেই ডালে কোপ দিয়েছি সেই দাঁ ছিটকে এসে পায়ে লাগে। সেই কাঁটা জায়গা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত, যাকে বলে প্রবল রক্তপাত। আমার থেকেও বাবার যন্ত্রণা বেশি, চিৎকার চেঁচামেচি করে অস্থির। কদিন পরে সেই কাঁটা জায়গায় পুচ জমে টনটনে ব্যথা, ক্ষতের সংক্রমণ। এখনো, দুর্ঘটনার পাঁচ দশক পরেও সেই ক্ষতচিহ্ন আমার পায়ে স্থায়ী দাগ রেখে দিয়েছে। এমন অনেক ঘটনার হার্ডল পার হয়ে আসা আমার সেই কিশোরবেলা, অভিভাবকেরা বলেন যে, অতি চাঞ্চল্যের কারণে এইসব কাঁটা-ছেঁড়া। কোনো সময়েই বাবা সেই কাঁটা-ছেঁড়া দেখতে পারতেন না, আমার শরীরে কাঁটা-ছেঁড়া দেখলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলতেন। সেই মানুষটার বা-পায়ের গোটা চামড়াটা ছিল পোড়া, কুঁচকে থাকা কিছুটা লালাভ কালো চামড়া। তিনি যখন পড়াশোনার জন্য কার্শিয়াং ছিলেন কিছুদিন, সেই সময় হস্টেলে গরম জলের বালতি পড়ে যায় পায়ে। এই চিহ্ন সেই সময়ের ছাত্র পরেশ গুহ রায়ের আজীবনের ক্ষত হয়ে গেছে।  পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ফিরে আসেন বাসায়।

দাদাঠাকুরকে দেখিনি, ঠাকুরমার প্রিয় নাতি ছিলাম আমি। সেই ঠাকুরমা বলতেন, আমার মাও বলতেন– কাজের কারণে আমার বাবা অনেক দূর হেঁটে যাতায়াত করতেন। আমিও দেখেছি কী অসম্ভব পরিশ্রম করার শক্তি ছিল তাঁর। মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতেন, ক্লান্তিহীন সেই হাঁটা। ভাত শিকারের জন্য ডুয়ার্সের মালবাজার, পশ্চিমে ওদলাবাড়ি, পূর্বে চালসা, লাটাগুড়ি, মাইলের পর মাইল হাঁটতে হতো তাঁকে।

নিজের কোনো গাড়ি ছিল না, সাইকেল চালাতে জানতেন না। আমার মাঝে মাঝে বাবাকে তাই জন হেনরি মনে হতো। যান্ত্রিক সুবিধাকে অগ্রাহ্য করে ছুটছেন ভাত শিকারে, একটা কালো চামড়ার খর্বাকায় মানুষ।

সেই মানুষটাকে শেষ জীবনে মাঝে মাঝেই ওই ক্ষত-গ্রস্ত পায়ের ব্যথায় শয্যাশায়ী থাকতে হতো। ব্যথা অসহ্য হলে আমাদের সেখানে হাত বোলাতে বলতেন, আজ অনুভব করি তাঁর ব্যথা কতটা অসহ্য ছিল। জীবন গুটিয়ে নিয়ে অন্তিমকাল ক্রমশ নিকটস্থ। অন্তিম প্রহর যখন তাঁর খুব কাছে চলে এলো তখন শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন।

মধুমেহ রোগের কারণে বহুবিধ কষ্ট তাঁর উপর চেপে বসেছে। কিন্তু সেই পায়ের যন্ত্রণা তাকে বিবশ করে দেয়। সারারাত ব্যথায় গোঙাতেন। ক্রমশ চোখের আলো চলে গেলো। আলোহীন চোখ দিয়ে অনুভব করতেন সবকিছু। হাসপাতালের আতঙ্ক তাঁর চিরদিনের, বলতেন– হাসপাতালে গেলে ওই রক্ত, গজ ব্যান্ডেজ, ফিনাইলের গন্ধেই আমি মারা যাবো, আমার এমন ভয়ানক মৃত্যু দিস না তোরা। তাই বাসাতেই তাঁর চিকিৎসা চলছিলো।

আজীবন বেহিসেবি, অগোছালো ও সংসার উদাসীন বলে যাকে বারে বারে অভিযুক্ত হতে হতো সেই মানুষটার বুকের ভেতর যে সবুজ ছায়ায় মেলে রাখা এক কবিতার খাতা ছিল, একটা ভেজা মশালকে দিনরাত পাথর ঠুকে ঠুকে জ্বালিয়ে রাখার পরিশ্রম ছিল, তার খোঁজ সাদা চোখে পাওয়া দুষ্কর। শৈশব থেকে একটা কথা শুনে এসেছি যে, বাবা রাজনীতি করতে গিয়ে সংসারের দিকে নজরই দেননি, তাই বারোভূতে সব লুটেপুটে খেল। সেই বারোভূতকে আমি খুঁজতে গিয়ে বারে বারে হতাশই হয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই বৈভবের সুখস্পর্শ আসেনি আমাদের, সুখের জন্য কোনো হা-হুতাশ ছিল না তাঁর।

আমার শৈশবের একটা ঘটনার কথা মনে এলে আজও কান্নারা দলা পাকিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরে। নিঃসঙ্গ একাকী রাতে সেই কান্না আজও হানা দেয়। আমাদের যৌথ পরিবার তখন একে একে ভাঙছে। বাবার বড় দাদারা, আমার জ্যাঠারা আগেই আলাদা হয়ে গেছেন। স্কুল শিক্ষক কাকা-কাকিমা ও আমাদের একটাই উনুন ছিল তখনও। একদিন তাও ভাঙল। বাবা সেদিন গোয়ালিয়ারে তাঁর রাজনৈতিক দলের এক সম্মেলনে। সেই রাতটা আজও স্পষ্ট মনে আছে। বাবার ফিরে আসার দিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও দু-দিন অতিক্রান্ত। ঘরে আমি ও আমার চার বছরের ছোট্ট ভাই। দুপুরে উনুন জ্বলেনি, ছোটভাইকে নিয়ে মা কাঁদতে কাঁদতে হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছেন। কাসার বাটিতে গুড়-মুড়ি দিয়ে মা এই রাতটা কষ্ট করে থাকতে বলে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন অনেকক্ষণ। খিদের হানাদারিতে বেসামাল আমি রূপকথার জগতে  নিজেকে হারিয়ে ফেলার চেষ্টা করছি। মনে আছে, অনেক রাত অবধি বারে বারে পড়ে প্রায় মুখস্ত সেই বই, শৈলেশ ঘোষের ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’। নিজেকে সেই কাহিনীর মতো দুর্গম পাহাড়ে দৈত্যের সঙ্গে লড়াইয়ে নিজেকে যুক্ত করেছিলাম। জাদুপাহাড়ে পথ হারিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। খিদের সর্বগ্রাসী দৈত্যের সঙ্গে যে কঠিন লড়াই সেই দিন গোটা রাত মোকাবেলা করতে হয়েছিল। এই দক্ষিণের সঙ্গে লড়াইয়ের স্মৃতি আমাকে আজও তাড়া করে। ভোররাতে বাবা এলেন, বাবাকে সেই অন্ধকারমাখা আলোর আভায় আমি প্রথম কাঁদতে দেখি। রঙিন পাথরের মতো নানা ঘটনা এই জলের মতো স্বচ্ছ ও নির্মল মানুষটার বুকের গভীরে আমি চকচক করে উঠতে দেখছি গোটা জীবন।   

বাবাকে ব্যবসার কাজে ঘন ঘন কলকাতা যেতে হত। একদিন সকালে দেখি বাবা ফিরে এসেছেন, সঙ্গে বছর পনেরোর এক কিশোরী। তারা সাইকেল রিকশা থেকে নামতেই আশপাশে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। পরে জানা গেলো ঘটনাটি কী। নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশনে ট্রেনের কামরা থেকে নামার সময় বাবা লক্ষ্য করেন যে, ওই কামরার মধ্যেই একটা মেয়ে একা একা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। স্বাভাবিকভাবেই বাবা জানতে চাইলেন, কেন সে কাঁদছে? মেয়েটি জানালো যে, এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল করতে পারেনি, বাড়ির লোকজন বকাবকি করায় সে রাগের মাথায় বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। শেয়ালদহ এসে এই ট্রেনের কামরায় উঠে বসেছিল। কিন্তু এখন সে অসহায় অবস্থায় পড়েছে, কাউকে চেনে না কোথায় যাবে জানে না। আতঙ্কিত মেয়েটিকে প্রবোধ দিয়ে বাবা তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছে যাতে খোঁজখবর নিয়ে এই কিশোরীকে তার বাড়ি ফেরত পাঠানো যায়। একাকী একটা কুমারী মেয়েকে স্টেশনে ফেলে আসা তার মন চায়নি বা রেল পুলিশকে জানানোর উপরও তাঁর আস্থা ছিল না। সেই সময় আজকের মতো ঘরে ঘরে টেলিফোন ছিল না, হাতে হাতে মোবাইল তো কল্পনার বাইরে। তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ সহজ ছিল না। মেয়েটি তার বাসার ঠিকানাও খুব পরিষ্কারভাবে বলতে পারছিল না। তবুও চেষ্টা চললো তাকে বাড়ি ফেরত পাঠানোর জন্য। এইটুকু জানা গেছে যে, তার বাড়ি হাবড়ায়, বাবার নাম শ্রীজীব চট্টোপাধ্যায়, স্কুল শিক্ষক, দাদা রূপময়, চিকিৎসক।

বাবার এক বন্ধুর বাড়ি হাবড়ায়, তাঁকে খবর পাঠানো হলো খোঁজখবর নিয়ে মেয়েটির বাড়িতে খবর দেওয়ার জন্য। সাতদিন পরে মেয়েটির বাড়ি থেকে শ্রীজীব বাবু ও মেয়েটির দাদা রূপময় বাবু আমাদের বাসায় চলে এলেন। বাবা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। এরপর বাবার হাত ধরে কেঁদে ফেললেন বর্ষীয়ান শিক্ষকটি।

একটা নিষ্প্রভ আত্মভোলা মানুষ, সারাজীবন ভাত শিকারে ছুটে চলা মানুষটা কখনো গান শুনতেন না, ফুটবল খেলেননি, দাবাও খেলেননি, যাত্রা দেখেছিলেন অনেক, যাত্রার নানা চরিত্রকে সামনে রেখে জীবনের অর্থ খুঁজতেন। বাবার কথাতেই চিনেছিলাম ভক্ত প্রহ্লাদ, নদের নির্মাণ বা শান্তগোপালের পালার কথা, জেনেছিলাম আট ঘণ্টার লড়াইয়ের কথা, লেনিন বা ডিরোজিওকে। নীরব বাতাসের ভেতর গুঞ্জরিত ধ্বনিতে আজও খুঁজে চলি বাবার মৃদুস্বরে কথা বলা। কোনো নিঃসঙ্গ বিকালে তিস্তার পাড়ে বসে জলের গভীরে তাকিয়ে থাকলে নদীর চঞ্চল মাছের মতো ঝলসে ওঠে স্মৃতির আলোগুলো, গভীর থেকে আরও গভীরে দেখি অভয় মন্ত্রের মতো বাবার হাসিমাখা মুখ।

চলবে

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিপু-প্রীতি হত্যা: আ.লীগ নেতাসহ ৩৩ জনের বিচার শুরু
টিপু-প্রীতি হত্যা: আ.লীগ নেতাসহ ৩৩ জনের বিচার শুরু
ঘনঘন শ্যাম্পু ব্যবহারে চুল রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন সমাধান
ঘনঘন শ্যাম্পু ব্যবহারে চুল রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন সমাধান
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ব্যবসায়ীর
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ব্যবসায়ীর
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ