X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা

গৌতম গুহ রায়
১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩১আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩১

১১তম পর্ব

'অতল স্পর্শের ঝড়'

১৯২৩ সালে নেরুদার ‘সান্ধ্য পংক্তিমালা’ প্রকাশিত হয়। তখন নেরুদা একটু একটু করে সমাজ-সভ্যতার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তখনো সামাজিক কাঠামোর মার্ক্সীয় বিশ্লেষণে উপনীত হননি। বন্ধু বৃত্তে বুদ্ধিজীবী থেকে সবহারানো মানুষেরা রয়েছেন, রয়েছেন অপরাধ জগতের মানুষেরাও। কিন্তু তিনি একাকী ও নিঃসঙ্গ, ভালোবাসার অন্বেষায় কাতর। সেই ভালোবাসার অন্বেষার তাড়না থেকে লিখলেন—

“অকস্মাৎ রাত্রির জগৎ যেন খুলে গেল।
শেষ হয়ে আসা একটি হরিদ্রাভ দিন এবং
অন্য একটি দিনের শুরুর মাঝখানে আবিষ্কার করলাম
যেন একটি গোপন গোলাপ।
কিন্তু দক্ষিণের যে অঞ্চল থেকে আমি এসেছি
সেখানে প্রকৃতি তার আধিপত্য প্রকাশ করে
আগুন আর বরফের ঝড়ের মধ্য দিয়ে।
আর এখানে মনে হল নাগরিক রাত্রি যেন জাহাজের খোলে আবদ্ধ,
যার দরজা হঠাৎ খুলে যায়
অন্ধকারের জগতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আলো...” (অনুবাদ: আলী আনোয়ার)

তাঁর পড়া অসমাপ্ত রেখে শামীম রেজা আমাকে পাবলো নেরুদার ‘প্রেমে ও সংগ্রামে’ বইটি দিয়ে গেল আজ। নেরুদা পড়তে পড়তে কোথাও আবার দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। খোলা দরজার ওপাড়ে মেঘান্তারা বর্ষা, ম্লান হয়ে আসা কৈশোরের একদিন। কবিতা সঙ্গে করে প্রেম নিয়ে আসে কিনা জানি না, তবে সবকিছুই অন্যরকম লাগছিল ক্রমশ! ছাপা অক্ষরে আমারই কবিতা দেখার পর কী জানি কী ঘটে গেল!

আমাদের বাড়ির পেছনের বাড়িতে থাকতেন স্কুল শিক্ষক পীযূষ কান্তি ঘোষ ও প্রদীপ ঘোষ, একজন ইংরেজির অন্যজন ভৌত বিজ্ঞানের। তাঁর বোন খুকু মাসি আমার  মায়ের বন্ধুই শুধু ছিলেন না, মা বলতেন আমার শৈশবে তিনিই কোলে-পিঠে করে বড় করেছেন। এরপর সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে সেই খুকু পিসিও একদিন তাঁরাদের আত্মীয় হয়ে গেলেন। সেই খুকুপিসির বড় ভাই পীযূষ মাস্টার তাঁর বাসায় নিজের উদ্যোগে চালু করেছিলেন একটা লাইব্রেরি, ঠাকুমার ঝুলির নীলকমল লালকমল’ থেকে বেছে নেন পাঠাগারের নাম, ‘সোনার কাঠি পাঠাগার’। পাড়ার সবার কাছে তিনি ‘পাঁচুদা’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাসার বাইরের দিকে একচালা একটা ঘরে সেই লাইব্রেরি ছিল আমার গ্রন্থপাঠ তৃষ্ণার লালন কক্ষ। আমার বইয়ের পাঠ তৃষ্ণা সেখানেই মিটতো। তৃষ্ণা ক্রমশ নেশা হয়ে দাঁড়াল। সেখানে আরো কয়েকজন এমন আসতেন, তাঁদের মধ্যে যারা বয়স্ক তাঁরা সন্ধ্যার পর এসে বই পালটে চলে যেতেন। আমরা দু-একজন সেখানেই অনেকটা সময় থাকতাম, বই ঘাটতাম, পড়তাম। এঁদের একজন আমারই মতো বইয়ের নেশা নিয়ে হাজির হত, টুম্পা। ও প্রতিদিন আসতে পারত না, রবিবার লাইব্রেরি খোলা থাকত। টুম্পা সেদিন আসত। টের পাচ্ছিলাম, রবিবারের জন্য আমার ভেতরও একটা প্রতীক্ষা জন্ম নিয়েছে। প্রতি রবিবার সকাল থেকেই মন উসখুস করত। টুম্পাদের বাড়ি ছিল কলোনির ২ নম্বর গলির পুকুর পাড়ে। লাইব্রেরির থেকে তিনটা গলির পর। সেই সময় লাইব্রেরির বাইরে ‘স্কুল বালিকা'-এর সঙ্গে কথা বলাটা অসম্ভব ছিল। পাঁচুদা ইংরেজির শিক্ষক, টিউশন করতেন। রবিবার স্কুল না থাকায় সেদিন ছিল বিকাল থেকে তাঁর টিউশানের সময়। লাইব্রেরির দরজার চাবি আমার কাছে দিয়ে চলে যেতেন। একটা অদ্ভুত দর্শন কেরোসিনের লণ্ঠন ছিল লাইব্রেরিতে, হ্যাচাকের মতোই পাম্প করে তাকে চালু করতে হত। ব্যাঙের ছাতার মতো উপরে ঢাকনা ছিল তার এবং সেটি ঘরের মাঝখানে উপর থেকে একটা লম্বা লোহার আংটায় ঝুলিয়ে দেওয়া হত। বিকাল হয়ে এলেই সেটি ভেতরের বাসা থেকে দিয়ে যাওয়া হত। মাঝে মাঝেই পাম্প দিতে হত, না হলে আলো কমে আসত তাঁর। সেদিনও রবিবার, বসন্তের না, বর্ষার সময়। আমাদের স্কুলের মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্ট ছিল। রবিবারের টানে আমি সেখান থেকে সোজা লাইব্রেরিতে চলে এসেছি, কলোনির রাস্তার জল-কলে পা ধুয়ে এলেও শরীর জুড়ে ঘাম। খেলার গেঞ্জিটা আর পালটে আসার সময় ছিল না, টুম্পা চলে আসবে। যদিও তার সঙ্গে কোনোদিন কথা হয়নি, তবুও তাকানো ও হাসি বিনিময়েই কিছু একটা হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন ঢুকলাম তখন দিনের আলো কমে গিয়েছিল, সেই লণ্ঠনটি ঝুলে গেছে। অর্থাৎ পাঁচুদা লাইব্রেরি খুলে দিয়ে চলে গেছেন।  আমি তখন দেব সাহিত্য কুটিরের টারজান সিরিজ পড়ছিলাম, নির্দিষ্ট আলমারি থেকে এডগার রাই বারোসের ‘রিটার্ন অফ টারজান’ বের করে নিয়ে টেবিলে বসলাম। পেছনের টেবিলে টুম্পা। আমার টারজান বন্য হাতির পিঠে চড়ে পশুদের মাঝে, বন্য না-মানুষদের সঙ্গে কথা বলছে ইশারায়। খেলার গরমে ও ক্লান্তিতে কিনা মনে নেই তবে মন বইয়ে থাকছিল না। মাঝে মাঝে মাথার উপর আলোর দিকে তাকাচ্ছিলাম, আবার কখনো বাইরের দিকে। বাইরে তখন পরিষ্কার কালো আকাশ–বৃষ্টির জলে ধোয়া চকচকে চাঁদ উজ্জ্বল জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দিচ্ছিল। ঘরের ভেতর ধীরে ধীরে লণ্ঠনের আলো কমে আসছিল, লক্ষ করিনি। হঠাৎ প্রায় ঝপ করে অন্ধকার। আমি উঠতে যাব, পেছনে চেয়ার টেবিল সরে যাওয়ার দুমদাম আওয়াজ—একটা নরম হাত শক্ত হয়ে আমার শরীরটাকে ছুঁয়ে দিল। অন্ধকের জ্বলজ্বল করে উঠল বাতাসা বাড়ির জানালা, মানিকদের সেই বিছানাটা, গামছা সরে যাওয়া শায়িত দেহের উঁচু দুই তাল মাংস গোলক। পিঠে চেপে বসছে, ঘষছে। প্রায় ঠান্ডা কয়েকটি আঙুল শরীরে খেলছে। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঘুরে গিয়ে মুখটা সেই মুখে চেপে

ধরেছিলাম। হাতদুটো খেলতে চাইছিল, ফুটবল খেলে আসা শরীরের পুরোনো ঘামের নীচ থেকে দরদর করে নতুন ঘাম আমাকে ভেজাতে লাগল। আমার ঘামে ভেজা দেহের বুকের মাঝখান দিয়ে সেই নতুন ঘামের স্রোত নেমে যাচ্ছিল নিচের দিকে। কোথাও দ্রুত তালে একটা তাপের মিনার জাগলো। কতক্ষণ এভাবে ছিলাম মনে নেই । হঠাৎ একটা আওয়াজে এক ঝটকায় দ্রুত সেই লাইব্রেরি ঘর থেকে ছিটকে বের হয়েছিলাম। অন্ধকারের মধ্যেও কোথাও তীব্র আলো জ্বলছে নিভছে, আশেপাশে কেউ নেই। বাড়ির ভেতরে গিয়ে একটা মোম বাতি নিয়ে এলাম। লণ্ঠনটা ঝুলছে, আলোহীন, আমার সামনে শুধু সেই লন্ঠন। উপরের হুক থেকে খুলে ভেতরে নিয়ে গেলাম। যখন আলো নিয়ে ফিরলাম তখন ঘর ফাঁকা। টুম্পা চলে গেছে। খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে মেঘান্তারা বর্ষার এক অন্যধরনের আলোয় আমি অন্ধকারের রূপ দেখছিলাম। আমার শরীরের অতল স্পর্শের ঝড়।

সেই বৃষ্টিহীন বাদল দিনের পর অনেকদিন টুম্পা আসেনি। আমি প্রতিদিন লাইব্রেরিতে যেতাম, অপেক্ষা করতাম, অপেক্ষার কোনো অন্ত নেই, আমারও হত না। একটা অস্থিরতা জন্ম নিচ্ছিল ওই অপূর্ণ অপেক্ষা থেকে। স্কুল থেকে ফেরার সময় সেই পুকুর পার হয়ে ফিরতাম। টুম্পাদের বাসার সামনে দিয়ে, একা একা। বন্ধুদের এড়িয়ে।  ক্রমশ বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছিলাম, প্রসাদ ইয়ারকি করে বলল— তকে একায় পাইছে। একা হয়ে যাওয়া মানুষ কবিতায় নিবিড় হয়, আমিও। তখন সামনে এক অন্য জগৎ, যেখানে—

“পুরুষ ও নারীরা নাচছে দেখতে পাই
তাদের আঠালো দেহগুলো লেপ্টে আছে
পাথরের গায়ে লেগে থাকা শামুকের মতো
তাদের চকচকে ঘূর্ণমান কালো জুতোগুলো যেন কফিন
তামাকের ঘন ধোঁয়া, কড়া মদ, কোলাহল এবং মদ্যপায়ীদের প্রমত্ত উল্লাস।” (নেরুদা)

একদিন পুকুর পারের রাস্তা দিয়ে ঘুরে আমাদের গলিপথের পেছন দিয়ে ফিরছিলাম। সেই বুড়োর বাগানের ভেতর দিয়ে। দেখি জঙ্গলের মধ্যে একটা চাদর পেতে তাস খেলছে আমার মেজদা, মেজো জ্যাঠার ছেলে এবং আরো চারজন। তাসের পাশে কতগুলো লিফলেট, একটা দশ-বারো ইঞ্চি লম্বা ছুরি। ওই চাদরের নীচে আরও কিছু থাকতে পারে। আমাকে দেখেই একটা গামছা তার উপর বিছিয়ে দিল তারা। মুখগুলো দেখলাম—হীরাদা, প্রাণকৃষ্ণদা, নরেশদাকে চিনলাম। এঁদের নকশাল বলত পাড়ার লোকে। একটা ১২ বছরের ছেলের কাছে এই ‘নকশাল’ শব্দটা তখনো শুধু পরিচয় জ্ঞাপক শব্দই ছিল। আমাদের কলোনির বড়দের কাছে ছিল কিছুটা ভয় কিছুটা শঙ্কার অনেকটা সমর্থনের। তখন পুলিশ, সি আর পি, জিনিসপত্রের আকাশ ছোঁয়া দাম, সর্বত্র ভয় ভয় পরিবেশ। মাঝে মাঝেই স্কুল কলেজ বাজার ঘাট বন্ধ। পরিচিতদের অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত এলাকার জনজীবনে কোথাও একটা শাসক বিরোধীতার জন্ম দিয়েছিল। বারো তেরো বছরের আমার কাছে আমার নিজস্ব একটা দেশ তখন অন্তরে অঙ্কুরিত হচ্ছে। মনের ভেতর ক্ষমতা নয় ক্ষমতার বিরুদ্ধাচারণের দিকেই সমর্থন তৈরি হচ্ছিল। মনে বলছিল ব্যক্তি বাসনার প্রেম থেকে অনেক জরুরি সামাজিক আন্দোলনে,  অসাম্যের বিরুদ্ধে থাকা। একটা লাল টুকটুকে স্বপ্নের ফ্রেম আমাকে ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল। একদিন সন্ধ্যায় আমাদের বাইরের ঘরে দাদার নকশাল বন্ধু প্রাণকৃষ্ণদা গাইছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের গান— “অনেক স্বপ্নেরা সব অরণ্যের সাথে/ ফুল ফুল পাখি নিয়ে শহিদ হয়েছে/ এখানে প্রতিটি দিন বিস্ফোরণে আসে/ তবু পথ খুঁজতে থাকো।” ক্রমশ টুম্পা বা মানিকের দিদিরা ফিকে হয়ে এলো, জ্বলজ্বল করতে লাগল সুনসান হাইওয়ে, বারুদের গন্ধ, রক্তমাখা হাতে অবিনশ্বর লালসালুর ঝান্ডা।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে