তার গল্প-উপন্যাস প্রকাশিত হবার পর অনেকেই বললো, লেখক জীবনানন্দ কবি জীবনানন্দের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠুক—তা নাকি তিনি চাননি, কেউ বললো, তিনি শুধু কবি হয়েই থাকতে চেয়েছিলেন। আবার এমন কথাও হলো, তিনি নাকি সন্দিহান ছিলেন তার লেখা নিয়ে। অর্থাৎ সেগুলো কিছু হচ্ছে কিনা! আমি আশ্চর্য হয়ে যাই এই ভেবে যে, তার জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে এসব মানুষের কোনো ধারণাই তাহলে ছিল না! আমি বলছি এ শুধু দুর্বল সাহিত্যিকদের আবিষ্কার। নিজের লেখা নিয়ে তোমার দাদা এতোটাই আস্থাশীল ছিলেন যে, নিজেকে তিনি বাংলা সাহিত্যের কোনো কবি লেখকের সাথে তুলনাই করতেন না। নিজের নাম তিনি তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, শেলি, কিটস, এলিয়টের পাশে রাখার স্বপ্ন দেখতেন!
আমি তো মনে করি, তিনি খুব জেনে বুঝেই লিখেছিলেন। বরং অন্যদের প্রতি তার আস্থা ছিল না। তিনি জানতেন ওই সময়ে প্রকাশ করলে তার গল্প-উপন্যাস অবমূল্যায়িত হবে। কবি বুদ্ধদেব বসুর সহযোগিতা এবং পক্ষপাতের পরেও, তার প্রতি সত্যিকারের যে মনোভাব তোমার দাদার ছিল, তাতো তাচ্ছিল্যই। আর সেটা শুধু বুদ্ধদেব বসু নয়, আরও অনেকের প্রতিই ছিল। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কাউকে পাত্তার যোগ্যই মনে করতেন না বোধহয়। করার কথাও না অবশ্য। সে সময় কেই-বা জ্ঞানে বা প্রতিভায় তার সমতুল্য ছিলেন? সবাই, একেবারে সক্কলে হেঁটেছেন চেনা পথে, কোনো না কোনো গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে। এক তোমার দাদাই ছন্নছাড়া। নিজেই তো লিখেছে—"সকল লোকের মাঝে ব’সে/ আমার নিজের মুদ্রাদোষে/ আমি একা হতেছি আলাদা"–যতই বলুক মুদ্রাদোষ, সে তা বদলাবার চেষ্টা কখনোই করেনি, ইচ্ছেও ছিল না। সে জানতো এরকমই সে থাকতে চায়, ভীড়ের মানুষ সে নয়।
আমার ধারণা তোমার দাদা ঠিক জানতো যে সে-ই শ্রেষ্ঠ। একদিন তার সাহিত্য ঠিকই মূল্যায়িত হবে। এবং তাই তো ঘটেছে, যত দিন গেছে ততোই জীবনানন্দ মূল্যায়িত হয়েছেন। তার গদ্য গুণে-মানে-আয়তনে এমনই নাকি ইউনিক, এতটাই সমৃদ্ধ যা একজন লেখকের সারাজীবনের সাধনার ধন। অনেকেই আফসোস করেন, সাহিত্যের একটি সমৃদ্ধ ধারা দীর্ঘসময় ইতিহাসের বাইরে থেকে গেলো বলে। অথচ তোমার দাদা এগুলো বাক্সবন্দি করে রেখে, আরেক রহস্যের জন্ম দিয়ে গেলেন। 'মাল্যবান' যে একটি ভিন্নধারার উপন্যাস, যার অস্তিত্ব কেউ জানতোই না তখন, তা কেবল তোমার দাদার পক্ষেই লেখা সম্ভব ছিল, তা এখন বলা হচ্ছে। আজ এই উপন্যাসের লাইন ধরে ব্যাখ্যা হচ্ছে, নতুন নতুন থিওরি হচ্ছে। আশ্চর্য হই ভেবে, কতো পিছিয়ে ছিল সেই সময়ের সাহিত্যিক, সমালোচকেরা(!), এতো ভুল ব্যাখ্যায় সাজিয়ে ফেলেছিল তার সাহিত্য, তার জীবন। সেই সময়টার কথা ভেবে দুঃখ হয়, বড় ভুল সময়ে এসেছিল তোমার দাদা, বড় আগে চলে এসেছিল এই পৃথিবীতে, তাই সময়টাই হয়ে উঠেছিল বড় ভিলেন।
হ্যাঁ, ‘সময়ের শত্রুতা’ অথবা ‘উজ্জ্বল সময়স্রোতে অবগাহন’ তোমার দাদার লেখা পড়েই আরও ভালো করে জেনেছি। নানাভাবেই তা তার লেখায় এসেছে। আমি তোমার দাদার মতো ইতিহাস সচেতন নই, সমাজ-মানব-মানবী, রাজনীতি-অর্থনীতি, পৃথিবী-মহাপৃথিবীর সাথে যোগ করে সময়ের ব্যাখ্যা করতে পারবো না, তবে এটুকু বুঝি, ওই সময়টি আমাদের অনেককিছুই কেড়ে নিয়েছিল। যুদ্ধ, মন্বন্তর, বৈশ্বিক মন্দার কারণে মনুষ্যত্বের ক্ষয়, একটি শ্রেণীর মানবেতর জীবন, আরেকটি শ্রেণীর আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠা—এরমধ্যেই ভারতব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা। শুভবুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান ঘটলো; সুভাষ বোস, জিন্নাহ কংগ্রেস থেকে বের হয়ে আলাদা আলাদা দল গড়লেন। অন্যদিকে চীন আর রাশিয়ার প্রভাবে নানামুখী কমিউনিস্ট আন্দোলনও দানা বাঁধলো প্রবলভাবে। সাম্যের প্রত্যাশায় অবহেলিত মানুষ জীবনবাজি রাখলো। সাহিত্যিকদের অনেকেই প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলন শুরু করলেন। পুরো ভারত নানা মতে খণ্ডবিখণ্ড, দিশেহারা। তোমার দাদা কখনোই উচ্চকিত মানুষ ছিলেন না। তিনি গভীর চিন্তক, নিজেকে ও কবিতাকে ডামাডোলের অংশীদার করতে চাননি, স্লোগানধর্মী কবিতা লেখেননি। যদিও কবিতায় ইতিহাসের অন্ধকার, সময়ের বাস্তবতা ঠিকই তুলে এনেছিলেন পরোক্ষে, উপমায়। তারপরেও তাকে ব্যঙ্গ করে 'স্বপ্নময়তার কবি' বলে কোণঠাসা করা হয়েছে। প্রগতিপন্থীদের উপেক্ষার শিকার হতে হয়েছে। এমন যে বুদ্ধদেব বসু তিনিও শাসন করতে চাইলেন, পত্রিকায় এমনভাবে সমালোচনা করলেন যে, আমার ননদ, জা আর তাদের বন্ধুদেরকে আলোচনা করতে শুনলাম, সজনীকান্ত যতটা ক্ষতি করেছেন, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন বুদ্ধদেব বসু। তিনি নাকি কবির প্রতি পাঠকের আগ্রহই কমিয়ে দিয়েছেন। এসব নিষ্ঠুরতা কী যথেষ্ট নয় একজন কবিকে নিঃশেষ করতে? যে কবির কিনা জীবন আর কবিতা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে, এমনকি জীবনের চেয়েও কবিতা যার কাছে বড়? তবু সবকিছু ছেড়ে সবাই আমাকেই ভিলেন ঠাওরালো কেন জানো? তোমাদের মতো অবিবেচক মানুষদের জন্য। যারা আমাদের একজনকেও মানুষের কাতারে রাখেনি। কবিকে অতিমানব বানিয়ে দোষ-গুণের ঊর্ধ্বে রেখে পুজো করেছে, আর আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করে খারিজ করে দিয়েছে, ডাইনি বানিয়ে মানুষ হিসেবে আমার আবেগ, ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্যায়ন করেনি।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই দিশেহারা সময়ে, তোমার দাদা একদিন দাঙ্গার মধ্যে হারিয়ে গেল। বাড়ির সবার ভয়ংকর দুশ্চিন্তায় মরবার দশা। দাঙ্গা চলছে বলে ঘর থেকে বের হবার জো নেই। তো অনেক রাতে পুলিশের গাড়ি তাকে পৌঁছে দিয়ে গেল। সবাই বকছে এটা-সেটা বলছে, তোমার দাদা চুপচাপ। জানা গেল পুলিশ তাকে দাঙ্গাকারী সন্দেহ করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। পরে তার এক ছাত্র যে কিনা সেই থানার ওসি, সে ডিউটিতে এসে স্যারকে চিনতে পেরে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে গেছে। তো সবাই প্রশ্ন করতে লাগলো, এরকম অবস্থায় সে কেন বাড়ি থেকে বের হয়েছে, কেন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, পরিস্থিতি খারাপ দেখে কেন সরে পড়লো না, পুলিশকে কেন নিজের পরিচয় দিলো না ইত্যাদি। তোমার দাদা কোনো উত্তরই দেয়নি, কেবলই মুচকি হেসেছে। এরপর এই গল্প পল্লবিত হলো, তোমার দাদার বোকামি, অসচেতনতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের অভাব ইত্যাদিসহ। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, সে আসলে ওই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তেই চেয়েছিল—সত্যটা দেখতে চেয়েছিল, অনুভব করতে চেয়েছিল।
দেশের পরিস্থিতি ক্রমশ আরও খারাপ হচ্ছিল। আমার শ্বশুর মারা গেলেন, শাশুড়ি কলকাতায় ঠাকুরপোর কাছেই বেশি থাকতে লাগলেন, আমার ননদ সুচরিতাও তখন তমলুক চলে গিয়েছে চাকরি নিয়ে। ততদিনে আমাদের দ্বিতীয় সন্তান এসেছে। সংসারে আমার কিছুটা প্রতিপত্তি বেড়েছে, কাজও বেড়েছে অনেক। সর্বানন্দ ভবনে তো অনেক মানুষ থাকতেন তখনও, তারা ছিলেন। এ সময়গুলোতে তুমি কি কলকাতায় ছিলে নাকি শিলং-এ? আমার ঠিক মনে পড়ছে না এখন। দুর্ভিক্ষ শুরু হলো তখন—তেতাল্লিশের মন্বন্তর। তুমি কি দেখেছিলে কলকাতার পথঘাটের সেই দৃশ্য? বরিশালেও সেই ঢেউ লেগেছিল। যুদ্ধের ঢেউ, দুর্ভিক্ষের ঢেউ, দাঙ্গার ঢেউ, স্বাধীনতার ঢেউ। আমি তো স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা মেয়ে, অথচ ততদিনে তোমার দাদা আর তার সুশৃঙ্খল পরিবারে বসবাস করে, আমিও কেমন মিইয়ে গেছি। সবকিছু ছেড়েছুড়ে ঝাঁপ দেয়ার একটা বাসনা মাঝে মাঝে পাগল করে তুললেও, বিশাল পরিবারের বধূ, দুটি সন্তানের কর্তব্যপরায়ণ মা হয়েই দিন কাটাতে থাকি।
সময় আরও উত্তাল হচ্ছিল, দাঙ্গার প্রকোপ বাড়তে লাগলো ভয়ঙ্করভাবে। বরিশাল বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে খুবই সক্রিয় ছিল, শুধু বরিশাল-ইবা বলি কেন, পুরো পূর্ববাংলাই পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে, হিন্দুরা সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে কলকাতাতেই স্থায়ী হচ্ছিলেন, আর যারা থাকতে চাইলেন তাদের বিপদ বাড়ছিল। তোমার দাদা যে কিনা রক্ত সইতে পারে না, সে পথেঘাটে ঘন ঘন রক্তাক্ত লাশ দেখতে লাগলো। ওইসব দিনগুলো যত সাদামাটাভাবে বললাম, বাস্তবে তা ছিল না। সেই আতঙ্ক ভাষায় প্রকাশ করার সামর্থ্য আমার নেই। তোমার তো বরিশালের সাথে তেমন যোগ ছিল না, তাই তুমিও বুঝবে বলে মনে হয় না। মিলুদার জন্য তোমার টান থাকলে খোঁজ রাখতে তার।