X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জীবন থেকে উন্মাদে

আরিফুল হাসান
০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০

সেসব উন্মাদনার কথা আমার মনে নেই। যখন আকাশ থেকে ঝরে পড়তো বৃষ্টি ও রোদ এবং জীবন থেকে ঝরে পড়তো দিনরাত্রি। সেসব শীতকালের কথাও আমার মনে নেই। কুয়াশার সাথে ঝরে পড়তে রাজগঞ্জ রাস্তার পাশের টাল দোকান। বেছে বেছে দু-একটা কেনার সামর্থ থাকলে দেহে দেবার পর দেখা গেছে সে সবে ছাড়পোকায় ভরা। তখন রেল স্টেশনে শুয়ে থাকা নির্জন দুপুর একটি কুকুরকে কণ্ঠে ধরে কেনো যে তীর্যক স্বরে ককিয়ে উঠতো, সে সবের ভাষা পরিহাস আজ আর মনে নেই। মনে নেই ফুটপাত, পথভুলো মেঠোপথ, মনে নেই তালপাখার বাতাস। সব ভুলে গেছি আমি, সব ভুলে গেছি, সব সব, একদম সব ভুলে গেছি।

মদের গ্লাসটা বাইরে ছুড়ে মেরে কিছুক্ষণ নিঃশব্দ তাকিয়ে থাকলাম মাছে। কোথাও কোনো দোলা বিকেলের চিহ্নপর্যন্ত নেই। ডুবে গেছে। আলগোছে রেখে গেছে অন্ধকারের কপাট দরজা। আমি তাতে ঠকঠক কড়া নাড়ছি বহুক্ষণজুড়ে কিন্তু চাঁদ তার ঘোমটা তুলছে না। আমি আরও দূরে শূন্যে দৃষ্টি মিলিয়ে দেখলাম, চাঁদটা উঠলো বলে, মেঘের আড়ালটা শাদা হয়ে আসছে। আশান্বিত আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামি। গ্লাসটা কুড়িয়ে আনি। বেসিনের জলে ধুলে তা আবার চকচক করে ওঠে। চ্যাপটা ব্রান্ডির বোতলটা আবারও কাত করি, দেড় পেগ সমান নিয়ে তাতে বরফ ছুড়ে দেই, না, আমি ভুলে থাকতে চাই সব, সব।

সে সব উন্মাদনার দিনে আমার মনে হতো আমি ঘুড়ি। যেনো উড়ছি আকাশে সঙ্গী নেই, বান্ধব নেই, ভাসমান এক পাখি। কোনো ডালে আশ্রয় নেই, আশ্রয় পাবার চেষ্ঠা নেই। কোনো হেমন্তে নেই পার্বণ, কোনো শরতে নেই কাশফুল। তখন কান্দিরপাড় থেকে চকবাজার, কিংবা বাগিচাগাও ঘুরে শাসনগাছা, হাড্ডিখোলা আর হরিজন পল্লী ছিলো ভাসা। সেসব অস্পষ্ট দিনে কেনো আমি নিষিদ্ধ ছিলাম সেসব ভুলে থাকতে চাই, তাই ভুলে গেছি। মনে পড়ে না তখন একটি পুরি খেয়ে, সিঙারা খেয়ে কিংবা লুচি খেয়ে ক্ষুধায় পেটে নিরবে যে পাথর বেঁধেছি, মনে পড়ে না। কেনো আমার মনে পড়ে না।

মদের গ্লাস শূন্য হলে ভালো। আরো মদ ঢালা যায়। টলটল করে যখন স্বর্ণালি সুরা গ্লাসের তলায় ঝরতে থাকে তখন মনে তৃষ্ণা আরো জেগে উঠেছে। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ এসে লাগে নাকে। তখন মদ খাওয়া ছাড়া আর কোনো কথা মনে থাকে না। ওই সময়টাতেই সব কিছু ভুলে যাই। তাই গ্লাসের পর গ্লাস ফাঁকা হতে থাকলে আমার বরং লাভ। আমি আরেকটি সিগারেট ধরাই। পোড়াই মনের আগুন। বৃথা হাঁপরের বাতাস বুকের ভেতর ঘুরে ফিরে চলে আসে। বলে যায় বয়ে যাওয়া বাতাস তখনো অনুকূলে ছিলো এবং এখনো আসে। আমি চমকে উঠি। আবার সরাবের গ্লাসটা ছুড়ে ফেলি বাইরে। কী ভীষণ রোম্যান্টিক সন্ধ্যা! তবু বড় নিঃসঙ্গ লাগে, বড় অদ্ভুত একাকী লাগে। এ নিঃসঙ্গতা আরও জমাট বাঁধলে আপনি আপনি আবার চলে আসে কালো মেঘ, হায় মেঘ, তুমি সোনালি ডানার চিল।

উন্মাদের ঘুমভাঙা স্বপ্ন কেমন ছিলো তা তো একদম মনে নেই, মনে নেই কেনো এই মনে না থাকার অপবাদ নিতে হয়েছিলো। দেখা হয়েছিলো কোন নিশানা নতুন? যার ফলে ভাগ হলো পথ আর আমি হলাম পাগলা গারদ। আমার ভেতর নিজেকে আমি বন্দি করে রাখলাম আর ইচ্ছেকে করে দিলাম অবারিত যেনো সে চলতে পারে যেথা ইচ্ছে তথা, যখন ইচ্ছে তখন। তখন রাত নামার দৃশ্যগুলো ভুলে গেছি। প্রায়ই স্টেশনের কাঁচা রুটির স্বাদ এখন আর মনে নেই। খালা ডাকতাম তাকে। মাঝবয়সী রমণী ছেঁড়া কাগজে পিঠা তুলে দিতেন। ফুয়াতে ফুয়াতে সে পিঠা মুখে পুরে দিয়ে আবার চেয়ে থাকতাম। কিন্তু কী করবো, মুখে তো খিদে, বুকে তো পকেট নাই। দুই গ্লাস পানি খেয়ে আবার সে টাউনহলে আর সাথে একটি ছোট্ট পুটলি, তাতে সেভিং রেজার, একটি গেঞ্জি, দুটো পাজামা, তিনটি হয়তো পাঞ্জাবি। পলিস্টারের গুটি ওঠা শার্ট। হলুদ, হ্যাঁ, হলুদ রং ছিলো সেটির আর ছিলো বিবর্ণ।

বাইরে কাত হয়ে পড়ে আছে সরাবের গ্লাসটি। ম্লান ওঠা আলো চাঁদকে সঙ্গী করে আবছায়ার একটু বেশি দেখা যাচ্ছে, তাতে হয়তো টলমল করছে শেষবিন্দু মদ অথবা টিকে থাকা বরফ কুচি। তার উপর কুয়াশা পড়ছে। নিজের সোয়েটারটা ঠিকঠাক করে আমি এসে বসি চেয়ারে। ফোন দেই মেয়ে অরিত্রিকে। মেয়ে, ও মেয়ে, তুমি কেমন আছো? অরিত্রি ও পাশ থেকে জবাব দেয়, আমি ভালো আছি বাবা, তুমি কী করছো? বসে আছি। ও আচ্ছা, বসে থাকো। মেয়ে! জ্বী বাবা, বলো। মেয়ে, তুমি কী আগামীকাল আসতে পারবে? আগামীকাল? হ্যাঁ, মেয়ে, আগামীকাল। আচ্ছা বাবা, আমি রাতের ফ্লাইটে রওনা হবো। আচ্ছা, রাখছি। আবার জানালার কাছে যাই। চাঁদ উঠেছে আরেকটু বেশি। গ্লাসটা এবার চকচক করছে। আমি আবার নিচে নামতে চাই, তুলে আনতে চাই গ্লাসটি। ব্রান্ডি আরো কোয়ার্টার আছে। চলুক না কিছুক্ষণ। মেয়ে আসলে ওসব খেতে দেয় না। তখন লুকিয়ে চুরিয়ে খাই। খেয়ে ভুলে যাই আমি যে মানুষ, আমার যে অতীত ছিলো।

অতীতে আমি উন্মাদ ছিলাম কিনা সে ধারণা এখন আমার থেকে অতীত। সেসব দিনগুলো মুছে গেছে বাতাস থেকে মুছে যাওয়া শুদ্ধতার মতো। মরে গেছে গোমতি নদীর পারে কাটানো বিকেল, হলুদ হয়ে আসা সকাল দশটার রোদ। খালি পেটে কাজ খুঁজতে যেয়ে নিজেকে শাহান শাহ প্রত্যক্ষ করে আবার ফিরে আসা। আর ফিরে এসে খালি পেটে ঝিমানো রেললাইন। পাথরে টুকরোগুলো ছুড়ে মারতাম একটা আরেকটার উপর আর ছিটকে গিয়ে আমার কাছেই ফিরে আসতো সমস্ত আঘাত। আমি উত্তাপ সহকারে রাতের ফ্লাইওভারের উপর কুড়িয়ে পাওয়া বিরিয়ানির বাকশে উচ্ছিষ্ট খাবার কীভাবে চেটেপুটে খেয়েছি সেসব কিছু এখন নিশ্চয়ই ভুলে গেছি। কারণ আমি ভুলে গেছি সাধারণ বিশ্রামাগারের রাত আরও অনেক পুরনো পাগল কেড়ে নিতো।

গ্লাসটা আবার নিচে থেকে আনি। এই অবারিত ঐশ্বর্যের ভেতর আমি আমার টলটল প্রিয় শব্দ শুনবো না তা কি হয়। এই একা নিঃসঙ্গ জীবনের শেষ প্রান্তে কেনো আমি আবার ঢালবো না মদ, ব্রান্ডির গেলাসে। আমি ঢালছি। টলটল প্রিয় শব্দ আর মনমাতানো ঘ্রাণ আমাকে আবার সবকিছু ভুলিয়ে দিলে আমি তখন ঢালতে থাকি আর পান করতে থাকি। একসময় বোতল ফুরায়। এবার উঠে জানালা দিয়ে বোতলটি ছুড়ে মারি আর তা পাথরে লেগে ঝনঝন করে ভেঙে যায়। ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসি। স্বাভাবিক জীবনের পৃষ্ঠায় আঁকা একটি ছত্রিশ বছরের সংসার, প্রিয়মুখ, আসা-চলে যাওয়া, আরও কত কী জাগতিক দেখি! দেখতে দেখতে চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে। সফল জীবন, সমাজের ধনাঢ্য প্রবীণ, একমাত্র মেয়ে বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করে। সমাজের চোখে আমি তো মহাসুখী। সেই উন্মাদনার দিনরাত্রি ভুলে, হঠাৎ করেই যেনো জেগে উঠেছিলাম। ফিনিক্স ডানায় আবার আঁকলাম ভোর, ভোর হলো, রোদ হলো। ঝকঝকে দুপুরের পরে পড়ন্ত বিকেলের ইচ্ছেপাখির পায়ে শিকল পড়িয়ে আমি এখন একা। কাল মেয়ে আসুক, ওর মায়ের কবর জেয়ারত করতে যাবো।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা