X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যু ও ঘুম

শামীম রফিক
২৩ মার্চ ২০২৩, ২১:২১আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৩, ২১:২১

ঘুম পছন্দ করে না বা ঘুমাতে ভালো লাগে না এমন একজন খুঁজে পাওয়া খুবই দুরূহ। কেউ হয়তো কাজের কারণে কম ঘুমায়, কারো হয়ত ঘুম আসে না অনেক চেষ্টা করে, এমনকি চিকিৎসা করেও আবার কেউ হয়তো সুযোগ পেলেই ঘুমায়। এই তৃতীয় শ্রেণির লোকদের ঘুমানোর সুযোগও বেশি। অনেক মানুষ বেলা দশটায় ঘুম থেকে ওঠে, আবার দুপুর তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত ঘুমায় আবার রাত দুইটা থেকে সকাল দশটা। বাকি সময় ঘুরে-বেড়ায়, গল্প-গুজব করে সময় কাটায়—তাদেরকে আমার সুখি মনে হয়। আসলেই সুখি। কাজের চিন্তা নেই, কোনো দুশ্চিন্তা নেই, কারো পরাধীনতা মানে না, সর্বদা স্বাধীন এবং জীবনটাকে সুখ দেয়, আর মন যা চায়—তাই করে। আমারও খুব ঘুমাতে ইচ্ছে করে, খুব সুখি হতে ইচ্ছে করে। কেন ইচ্ছে করে, আর কেনই বা ইচ্ছে করবে না? যার যা কম থাকে বা থাকে না, তার জন্য আকাঙ্ক্ষা একটু বেশিই থাকে। আমারও হয়তো তাই। আমার অনেক ঘুম, চোখভরা খুব ঘুম, ঘুমাতে খুব ইচ্ছে করে। আমি দাঁড়িয়ে, খেতে খেতে, এমনকি হাঁটতে হাঁটতেও ঘুমাতে পারি। রিকশায় বসে ঘুমাই, মোটরবাইকে বসে ঘুমাই, গাড়িতে তো কথাই নেই। মুখে খাবার নিয়ে কতবার ঘুমিয়েছি তার হিসেব নেই; যদিও জানি এটা খুবই বিপজ্জনক কিন্তু সেটা কি আমি ইচ্ছে করে ঘুমিয়েছি? এত ঘুম নিয়েও কিন্তু আমি ঘুমাতে চাই না। সকাল সাতটায় উঠে রেডি হয়ে অফিসে যাই, রাতে নয়টা থেকে দশটার দিকে ফিরি। তারপর গোসল, খাওয়া এবং রাত তিন বা চারটা পর্যন্ত লেখালেখি বা পড়াশোনা। এমন রুটিনেই চলছে জীবন। তাহলে ঘুমাই কখন? ঘুমাই না। ছুটির দিন সারারাত জেগে থাকি এবং দিনে কিছুটা বেশি সময় ঘুমাই। তাই ঘুমের প্রতি আমার একটা প্রচণ্ড আকর্ষণ আছে। অথচ পরিবারের লোকেরা ভাবে আমি খুব ঘুমাই। কী করে খুব ঘুমাই তার ব্যাখ্যা হয়তো তারাও দিতে পারবেন না।

এই ঘুম জিনিসটা আসলে কী—এটা প্রায়শই মনের কোণে সমস্যার সৃষ্টি করে। এটা কি মৃত্যু নাকি মৃত্যুর মতোই কোনো এক রকমের ফরমেশন বা সাময়িক মৃত্যু? ঘুমের বিষয়ে আমি অনেক কিছু জানতে চাই। ঘুম কি ছোট রকমের মৃত্যু! ঘুমের সময় কোন্ কোন্ অঙ্গ ঘুমায় এবং কোনগুলো ঘুমায় না তা কিছুটা জানি কিন্তু আরো ভালো করে জানার শখ হয়। খালি যে ঘুম নিয়েই প্রশ্ন তা কিন্তু নয়, এমন অনেককিছু নিয়েই কৌতূহল। যেমন : ইলেকট্রোলাইটিং ইম-ব্যালান্স কী, বমি কেন হয়, তখন শরীরে কী ধরনের পরিবর্তন হয় বা কোথায় কী ও কীভাবে বিক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সংঘটিত হয়? আমি মানুষ; তাই আমার শরীরে এইসব বিক্রিয়া কোথায় এবং কেন ঘটে এটা জানার ইচ্ছা আমার হতেই পারে? বিশেষ করে ‘ইলেকট্রোলাইটিং ইমব্যালান্স’ বিষয়টা ইদানীং নতুন করে ভাবাচ্ছে। আমি কয়েকজন ডাক্তারের কাছেও গিয়েছি কিন্তু সুরাহা হয়নি। কেন হয়নি, জানি না।

একবার একটি নামকরা হাসপাতালে গিয়ে বসে থাকা তিনজন ডাক্তারের মধ্যে একজন লেডি ডাক্তারকে বললাম, আপা আমি কি একটি প্রশ্ন করতে পারি?

তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন।

অনুমতি পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মানুষ যে বমি করে তার মেডিক্যাল টার্ম কী, মানে মেডিক্যেলের ভাষায় একে কী বলে? আর বমিই বা কেন হয়?

তিনি প্রথমে আকাশ থেকে পড়লেন, তারপর অনেক ভেবে জবাব দিলেন, ‘বমিটিং’। ‘বমিটিং’ বদ হজম হলে হয়।

সে না হয় বুঝলাম কিন্তু শারীরবৃত্তীয় কী কী পরিবর্তন হয়?

অন্যরা নীরব থাকলো কিছু বললো না।

শুনে আমি হাসবো নাকি কাঁদবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ওনার সাথে তর্ক বা বিতর্ক করার প্রয়োজন বোধ করিনি। তাছাড়া আমি বুঝে গেছি, উনি এ বিষয়ে কতটা বেশি জানেন। জানি না, আমার এই সরলতাকে কী মনে করলেন বা আমাকে কোন লেভেলের ইয়ে-টিয়ে মনে করলেন বুঝতে পারলাম না।

প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আবার বললাম, আচ্ছা আপা, বমি কেন হয় এবং তখন শরীরে কী রকমের পরিবর্তন ঘটে?

এতেও তিনি বিব্রতবোধ করলেন এবং কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন।

আমি বিনীতভাবে আমার খণ্ডিত পরিচয়টুকু বলে চলে আসলাম। উনি দ্বিতীয় প্রশ্নে প্রচণ্ড বিরক্ত। জবাব জানেন না বলে বিরক্ত নাকি আমাকে পাগল ভেবে বিরক্ত তা বুঝতে পারিনি। একজন কথাসাহিত্যিক-ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেও ব্যর্থ হলাম। উনি পরে জানাবেন বলে আমাকে বিদায় করলেন। যাই হোক, এখন আর সে অর্থ খুঁজি না।

মনটা খারাপ। ভালো হাসপাতালের ভালো তিনজন ডাক্তার এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না। আবার বিরক্ত হলেন। এর মানে এই নয় যে, কোনো ডাক্তারই এর জবাব জানেন না। অনেকেই হয়তো জানেন, আবার অনেকে হয়তো জানেন না। এমনটি হতেই পারে। সব প্রফেশনেই এমন আছে বা থাকে। এতে অবাক হবার কিছু নেই। তবে এত কমন বিষয় না জানলে হয়তো তা শোভন হয় না।

তখন আমার প্রশ্ন জাগে : তবে কি আমার সব কিছুই ভুল হতে চলেছে? ঘুমের মানে এবং তার কারণ জানি না। বমির কারণ জানি না। ইলেকট্রোলাইটিং ইমব্যালেন্সের মানে এবং কারণটাও জানতে পারলাম না। আমার আর কিছু জানতে ইচ্ছে করে না। মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়। যদি সেগুলোর কারণও জানতে না পারি। এসব প্রশ্ন আসছে কেন, না আসলেই বা কী হতো? এই অল্প কটা দিনের জন্য পৃথিবীতে এসে এতো সব আগ্রহ বা পরীক্ষার কি দরকার ছিল? ভীষণ উদাসী ছিলাম নাকি হলাম? প্রশ্নটা করলাম কিন্তু জবাব ঠিক করতে পারলাম না।

অফিস, বাসা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সব স্থানে বঞ্চিত হলেও কি ভাবতে হবে সবাই খারাপ আর আমি শুধু দুধে-ধোঁয়া তুলসী পাতা। দোষ তো আমারও আছে বা অনেকের চেয়ে বেশিই আছে। কিন্তু আমি দোষ করতে চাই না, ভুল করতে চাই না। তবে কী হয় বা হলো অথবা হয়েই চলেছে? এই বিষয়গুলো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। নিশোর ফোনে তার ধ্যান ভাঙে।

—হ্যালো, হ্যালো, কী করা হচ্ছে?

—কিছু না।

—মন খারাপ?

—হুম।

—কোথায় থাকা হচ্ছে?

—অফিসে।

—ফ্রি হলে যেনো ফোন দেন।

—আচ্ছা।

—আমি মামার বাসায় এসেছি ওয়ারিতে। দেখা করা যাবে?

—টাইমলি অফিস থেকে বের হতে পারি না। তখন আপনাকে কষ্ট পেতে হয়, আবার নিজেও পাই। ওসব আমার ভালো লাগে না।

—আজকে একটু আগে বের হবার জন্য চেষ্টা করা যাবে?

—মাত্থা খারাপ! নিষ্ঠুর জব।

—আধঘণ্টা পরেই মিশো এসে কল করে আমি অফিসের নিচেই চলে এসেছি।

—কিন্তু এতক্ষণ কী করবেন?

—একটু তাড়াতাড়ি বের হবার চেষ্টা করা হোক।

—নিশো রাতের প্রায় অন্ধকার রাস্তায় কী করবে এতক্ষণ তা ভেবে তেলে কৈ মাছ ভাজার মতো ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করছে বুকের ভেতর। ওদিকে প্রতীক্ষাক্লান্ত নিশো, আমার কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে ভাবছে। প্রতিটামুহূর্ত এভাবে কাটিয়ে প্রায় পাগলের মতো ছুটে এসে নিশোর মান ভাঙাতে ভাঙাতে ক্লান্ত। এমতাবস্থায়, নিশোর কষ্ট হয়েছে একথা সত্যি কিন্তু তাতে তার দোষ কোথায়? এখানেও ভুলের শিকার বা দোষের শিকার হয়ে কুহেলিকায় হারাতে থাকি। সব ভুল শুধু তাকেই পাচ্ছে। দোষও নিতে হচ্ছে।

—তাকে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারে সম্বোধনের ফাঁকে কয়েকবার ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছিল নিশো, সেজন্য ক্ষমা চাচ্ছে।

—এটা কোনো ক্ষমার বিষয় হলো?

—‘তুমি’ সম্বোধনটা যাকে-তাকে তো করা যায় না। এর দায়িত্ব অনেক।

—তো, কী কী দায়িত্ব নিতে হবে?

—সে অনেক গভীর ব্যাপার।

তুমিই-বা বললেন কেন আর ক্ষমাই-বা চাইবেন কেন? তাছাড়া এটা তো চাল-ডাল-আলু-পটলের ফর্দ নয় যে দেখে দেখে কিনে নেবেন। ন্যাচারেলি যা হয় তাই ভালো। ন্যাচারকে কোনোভাবেই আটকানো উচিত নয়। ‘তুমি’ বললেই কি প্রেম হয়ে যায়? তাছাড়া প্রেমে পড়লেই কি তুমি বলতে হবে? তুমি ছাড়া কি প্রেম হয় না? তুমিওয়ালা প্রেমও কি ভেঙে চুর্ণবিচুর্ণ হয় না? তুমি থাকতেও পারো আবার নাও থাকতে পারো। অকারণ অগ্রহণীয় বিষয় নিয়ে বিতর্ক করাও উচিত নয়। প্রেম কি হিসেব করে করা যায় নাকি আপনা-আপনি হয়ে যায়? তবে প্রেম হয়ে যাওয়ার বিষয়, করার বিষয় নয়। নিশোর ৪৯ বছর আর আনিসের ৪৫ বছর। তাতে কী? বন্ধুত্বে বা আন্তরিকতায় বয়স কোনো বিষয় নয়। টেনশনের বিষয়ও নয়। সম্বোধনে মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে। নিশোর ভাবনা হলো : সম্বোধন অনুভবের জন্ম দেয়, অধিকার করে নেয়, সম্পর্কের পরিধি বাড়ায়, দায়িত্বের সীমানা বাড়ায়।

আমি বোঝাই, অনুভব কী খারাপ বা ভুল কিছু, অধিকার মানুষকে বাঁচতে শেখায়, সম্পর্ক তো বাড়ারই বিষয়, দায়িত্ব তো সুখের বার্তাবাহক, জীবন ছোট, তাকে শেকল পড়ানো ঠিক নয়।

তাছাড়া ‘তুমি’ বললে যদি প্রেম হয়ে যায় তো হয়ে যাক। অসম বয়স বলে সমস্যা?

প্রেমে অসম বয়স বলে কিছু নেই।

তবে এতো টেনশন কেন করছেন?

এখন থেকে আমিও আপনাকে তুমি বলব। আমি ওনাকে তুমি বলতে শুরু করলাম। বয়সের পার্থক্য ভাবি না, এখন আমরা দুজন দুজনকে তুমি বলি। এই তুমিকে সাক্ষী করতেই শিল্পকলা একাডেমিকে সম্পৃক্ত করা হলো। আমার মনে হয় নিশোর এত ভাবনা হতো না। হয়েছে, কারণ ওর অনেক ছেলেবন্ধু। পুরুষদের গায়েপড়া প্রশংসা থেকে প্রাপ্ত ফ্লেভার ওকে বিভিন্ন জনের সাথে মিশে বিভিন্ন আইডিওলজিতে দ্বিধান্বিত করে দিয়েছে। বহুজনে সুখ নেই। হৈ-হল্লোড় হয়তো হয়, সুখ হয় না। আপন বা আন্তরিক হয় না। যে বন্ধুত্বে ত্যাগ নেই, প্রতিজ্ঞা বা প্রতীক্ষা নেই, ভালোলাগা নেই, সেটা কোনো বন্ধুত্বই নয়। সংখ্যাতিরিক্ত বন্ধুত্ব কোনো বন্ধুত্ব নয়, সেটা কোনো একটা বয়সে হয়তো গ্রহণীয়, কিন্তু সব বয়সে নয়। কখনো কোথাও গণ্ডিবদ্ধ জীবনের বাইরে সুখের জন্য কোনো সম্পর্কের প্রয়োজন হতে পারে, তবে তা যত সীমিত ও অপ্রকাশ্য হতে পারে, ততই মঙ্গল। সেগুলো আপাত সম্পর্ক মনে হলেও মোটেও তা নয়।

আমার মেয়ে বন্ধু তো দূরের কথা ছেলে বন্ধুও নেই। তাই আমি যা বুঝি, তাই বুঝি। আমার ভাবনাগুলো কমপেয়ারেবল হয় না। মনে হয় ওর ঐটা ভালো তো তার সেইটা ভালো। আসলে সব ভালো তো কোনো একজন মানুষের মধ্যে থাকতে পারে না। তাহলে সে মানুষটা নিজেকেই বানিয়ে নিতে হবে। সেটা মাটি দিয়ে হোক, না হয় কাঠ দিয়ে। তাই আমার কাছে জীবন এতো জটিল বিষয় নয়। জীবন আমার কাছে সহজ গণিত। যদিও ভুলে ভরা আর ভুলে চেপে রেখেছে জীবনটাকে। আমি নিশোকে বলি, ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে মেশো—এটা আপত্তির কোনো বিষয় নয়। তাছাড়া তোমার জীবন তো তোমার স্বাধীনতা আর আইডিওলজিতেই চলবে। কিন্তু তুমি যদি ভেবে দেখো, এত বেশি বন্ধু সুখের চেয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে, তবে সে ভাবনা তুমিই ভেবো। আর বন্ধু মানেই তো প্রেমিক নয়। বন্ধু মানেই জীবনটাকে উপভোগ্য করবার উপকরণও নয়। প্রেম করি বা না করি সেটা পরের কথা। অনেকে আমাকে ভালোবাসতে পারে, আমাকে অনেকের ভালো লাগতেই পারে কিন্তু সবাই আমাকে ভালোবাসার কথা বলতে পারবে কেনো? এতো সস্তা কেনো হবে আমার পারসোনালিটি? আমি এতো সস্তা হবো কেন? জীবনের সব চাওয়া পূরণ হয় না, পূরণ করতেও নেই। আমিই বা সবাইকে বলব কেনো? আমারও তো চলতে ফিরতে অনেককে ভালো লাগতে পারে। তাই বলে আমি কি সবাইকে ভালোবাসার কথা বলতে পারব নাকি পারা উচিত, আমি দশ জনকে দিয়ে কী করবো? ভালোলাগা ও ভালোবাসার জন্য তো আমার একজন প্রয়োজন। সবার কাছ থেকে ভালোবাসার কথা শোনা বা বলা ওয়েট বাড়ায় না বরং কমায়। আড়ালে হাসির পাত্রে পরিণত হতে হয়। জীবনের পার্ট হিসেবে মজা হলো এক রকমের ভাঁড়ামি কিন্তু ব্যক্তিত্বের পার্ট হিসেবে মজা হলো আনন্দ বা পুনরায় ব্যক্তিত্ব। সবাই আমাকে পছন্দ করতে পারে এবং পছন্দের কথা বলতে পারে এটা কিন্তু ভালোবাসার মানদণ্ড হতে পারে না। এখানেই লুকিয়ে থাকে ব্যক্তিত্বনামক আশ্চর্য বিষয়টা। জীবনে এই সংখ্যা যত কম হয়, জীবন তত উন্নত ও আনন্দের। বিশেষ প্রয়োজনে—বন্ধুত্বের প্রয়োজন কখনো কোথাও হতে পারে, হওয়া উচিত। তুলনা করবার স্টেজ তুমি পেরিয়ে এসেছো। এখানে নিশ্চয়ই ভুল বোঝবার কোনো বিষয়-আশয় নেই। তাছাড়া আমি তো তোমার দেখা সেরা হিউম্যান বিংদের একজন হবোই। পদ বা পদবী ছাড়া আর কীভাবে ফেলবে?

নিশো একথা শুনে হাসে এবং বলে, ‘সে বিশ্বাস আমার আছে। এখনই সে বিশ্বাসের সময় হয়নি।’

—আর কত সময় অপেক্ষা করতে হবে?

—জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।

—তবে, সুখটা দেখবো কেমন করে?

সুখ খুব আপেক্ষিক। কে কীভাবে সুখি হবে, সেটা সেই জানে। তোমার সুখ আর অন্য একজনের সুখ কখনো এক হতে পারে না। আসলে কি চুমুর বা কোলাকুলির কোনো স্বাদ আছে? থাকলে তা ঝাল-মিষ্টি নাকি টক? কিন্তু স্বাদ যে আছে সে তো সত্যিই। সে স্বাদ হয়তো তিনটির মিলিত স্বাদের চেয়েও অনেক বেশি। বুঝে নিতে হয়।

প্রেম কখনো কোথাও হয়ে যায়। কেন হলো, কী ভালো লাগলো সেটা সে নিজেও জানে না। কিছু দিয়ে কাউকে খুশি বা সুখি করা যায় না। খুশি বা সুখি যে হয় সে অনেককিছু না পেয়েও হয়। আবার অনেককিছু পেয়েও কেউ সুখি হয় না। একতরফা ত্যাগ সুখের হয় না। ত্যাগ যেমন দুদিকের লাগে, সেটা বোঝার ক্ষমতাও থাকতে হয়। বুদ্ধিমানেরা কখনো অসুখি হয় না। সম্পর্ক খারাপ শুধু নির্বোধদের হয়। অনেক ত্যাগ করেও, অনেককিছু দিয়েও অনেককে সুখি করা যায় না। তারা শুধু পেতে চায়, দিতে চায় না বা জানতেও চায় না। প্রেম হতে হলে তাতে ভালত্ব ফ্যাক্টর নয়, মেধা ফ্যাক্টর নয়, ফ্যামিলি ফ্যাক্টর নয়, অর্থ-বিত্ত ফ্যাক্টর নয়, সৌন্দর্য্য ফ্যাক্টর নয়, গায়ের রঙ শরীরের গন্ধ-উচ্চতা-পছন্দ-কেয়ারিং কিছুই ফ্যাক্টর করে না। প্রেম হয়ে যায়, ভালো লাগা বাড়তেই থাকে। আবার কোথাও সব থাকলেও কিছু থাকে না, প্রেম হয় না, প্রেম টেকে না। মন বড় আজব জিনিস। সারাজীবন শুধু মানুষের টেস্ট নিলে কিন্তু নৌকা ঘাটে ভিড়ালে না, তাহলে কী হলো? অপূর্ণই তো থেকে গেলে। জুজুর ভয়ে জীবনকে অপূর্ণ রাখার কোনো মানে হয় না। ক্ষুদ্র জীবনকে যতটা পূর্ণতা দেয়া যায়, ততই ভালো। আমি তো সব জায়গায় ভুল মানুষ বলে প্রমাণিত। হয়তো এখানেও ভুল মানুষ হিসেবে প্রমাণিত হবো। নিশো শাস্তি তো পরকালে হবেই এবং তা অনন্তকাল ধরে চলবে এমন শুনে ও বিশ্বাস করেই তো এত বড় হয়েছি। অন্যায় করলে শাস্তি পাব, তা ঠিক আছে। তাহলে ইহকালে এতো যন্ত্রণার কী দরকার ছিল? আর ইহকালে যন্ত্রণা দিলে পরকালে না দিলেই হতো।

হিসাবটাকে সহজ বলে যারা এর ব্যাখ্যা দেন, তারাও সঠিকভাবে জানেন না, তিনি কী বলছেন। আচ্ছা, মৃত্যুটা যদি ঘুমের মতোন হতো এবং শাস্তি নামক বীভৎস যন্ত্রণার কথা না থাকতো। তাহলে কত মজাই না হতো। যদি ধর্মগ্রন্থ একটা থাকতো এবং পৃথিবীর সকল মানুষ যদি একই ধর্মের হতো সে যেটাই হোক তাতে কী এমন ক্ষতি হতো? কেন ফাঁক গলিয়ে মুচলেকা ছাড়াই পৃথিবীতে চলে আসলাম না? তাছাড়া মুচলেকা দিয়েই আসার কী এমন প্রয়োজন ছিল? না আসলেই হতো। আসলেই যদি মানুষ না হয়ে ফুল বা পাখি হয়ে আসতাম, তাহলে কত ভালো হতো। পৃথিবীতে আসার আগে আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি আমি মানুষ হয়ে পৃথিবীতে আসতে চাই কিনা। তাহলে হয়তো মানুষ হয়ে আসতে চাইতাম না। ভালোবাসা দিয়েছেন কিন্তু সেটা শর্তহীন নয়, স্থায়ী নয়। তাহলে কিসের মোহে এখানে এলাম? যদি আকাশেই থাকতাম তবে তো ফুলের বাগানে ঘোরাফেরা ছাড়া আর কোনো কাজ থাকতো না। ফুলের মধু খেতাম, ফল খেতাম, হুর-পরিদের সাথে শর্তহীন মাস্তি করতাম। ইনকাম বা ইনকাম ট্যাক্সের কোনো প্রয়োজন হতো না, হাট-বাজারের প্রয়োজন হতো না, ক্যারিয়ার নামক উদ্ভট উটের পেছনে ছুটতে হতো না, সেখানে পদ বা পদবী চোখ লাল করে ভয় দেখাতে আসতো না, ছাটাই নামক অন্ধ ঘোড়াটা তাড়িয়ে বেড়াতো না সারাক্ষণ। নিষ্ঠুর ও অনিশ্চিত সম্পর্কগুলোর পেছনে ব্যয় করতে হতো না এই নশ্বর ও অনিশ্চিত জীবনটাকে। সম্পর্কের মধু তো ফুলেই থাকতো, যৌনতার সুখ তো শর্তহীন হুর-পরিদের দিয়েই পূরণ হতো। মৃত্যু নামক নিষ্ঠুর, বিদঘুটে, ভয়ঙ্কর কষ্টের জন্য প্রতীক্ষা করতে হতো না। অসুখ-বিসুখ বা দুর্ঘটনার যন্ত্রণাও হতো না। জীবন নিয়ে এই রকম এক্সপেরিমেন্ট করার কোনো শখ এখন আর হয় না।    

মানুষ সীমানা দিয়ে বিভক্ত, পদমর্যাদা বা কর্ম দিয়ে বিভক্ত, শারীরিক সক্ষমতা দিয়ে বিভক্ত, অর্থ-সম্পদ দিয়ে বিভক্ত, ভাষা দিয়ে বিভক্ত, শরীরিক গঠন-বর্ণ-রঙ দিয়ে বিভক্ত; রাজনীতি দিয়ে বিভক্ত, সর্বোপরি ধর্ম দিয়ে বিভক্ত। এতো বিভক্ত কে এবং কেন করে দিলো, কী প্রয়োজন ছিল এমন নিষ্ঠুর খেলার? কদিন পর পর ধর্মকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা হয় পৃথিবীর বহু দেশে এবং বহু কারণে। হাজার হাজার মানুষ মারা যায়, সম্পদের ক্ষতি হয়। দাঙ্গা কথাটা বলতে গিয়ে দেশভাগের কথাটা মনে পড়ল। ধর্ম তো বিশ্বাস ও ভক্তির বিষয়। সেখানেও বিভক্তি কেন? ঐসব ভয়াবহতায় যারা না পড়েছেন তারা কী করে বুঝবেন দাঙ্গা মানে কী? এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে দেখা মাত্রই কেটে টুকরো টুকরো করে দেয়, ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং অমানুষিক নির্যাতন করে মারে, তা বিশ্বাস করাও এক অবিশ্বাস্য কাজ। কেন তবে এত বিভক্তি? ধর্ম কি মানুষের জন্য নয়? মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর জন্য তো ধর্ম লাগে না। তবে মানুষে মানুষে এ বিষয়টা নিয়ে হানাহানি কেন? দেশভাগ যে কারণে হলো, তা তো মূলত এই ধর্মের উপর ভিত্তি করেই। কিন্তু সেই ধর্ম কি আমাদেরকে সুখ দিতে পেরেছে? আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে? পারেনি। কিন্তু এই ধর্মের কারণে যাদেরকে এক দেশ ছেড়ে, নিজের প্রিয়তম জন্মভূমি ফেলে চোখের জলে ভিজতে ভিজতে পাড়ি দিতে হয়েছে ভিনদেশে, ধর্ম তাদের কতটুকু সুখ দিতে পেরেছে? তারা প্রিয়তম জন্মভূমির জন্য যেমন কেঁদেছেন, ফেলে যাওয়া গবাদি পশু-পাখি, কুকুর-বেড়াল, সকালের শিস দিয়ে ডেকে ওঠা দোয়েল, ডেকে ওঠা কাক, গভীর রাত্রিতে শেয়ালের কান্না, ঝড়-বৃষ্টি-কুয়াশার জন্য তেমনি কেঁদেছেন। যারা চলে গেছেন তারা যেমন কষ্টে ভেসেছেন, আর যারা থেকে গেছেন তারাও তেমনি কষ্টের সাগরে ভেসেছেন। সেই ত্যাগের বিনিময়ে কারা কী পেয়েছেন? আমরা তো লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, সম্ভ্রমের বিনিমিয়ে ফিরিয়ে এনেছি আমাদের প্রাণের দাবি স্বাধীনতাকে। ধর্ম তো আমাদেরকেই রক্ষা করতে পারেনি। আসলে ধর্ম নয়, ধর্মের সঠিক ব্যবহার না করার জন্য এই পরিণতি ঘটেছিলো এবং ঘটছে। মানবতা ও মানসিকতাই হলো আসল ধর্ম। যার এই দুই গুণাবলী ঠিক আছে সে কখনো ধর্মের অপব্যবহার করে না।

সমস্ত পৃথিবী মিলে এক ধর্ম কি করা যায় না? সব সীমানার খুঁটি তুলে দিয়ে কি এক পৃথিবী করা যায় না? এত বিভক্তি কি এক করা যায় না? সকলে মানুষ, আমাদের জন্ম-মৃত্যু ও বেঁচে থাকার ধরন তো একই রকম; তবে পার্থক্যটুকু তুলে দেয়া যায় না কেন?

এতো কাজ রেখে আমার একটুও ঘুমাতে ইচ্ছে করে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘুমের স্বপ্নে আমাদেরকে ‘পরশ-পাথর’ দিয়েছিলেন। এখন আমি জেগে উঠলেও সেই পাথরের জন্য মন খারাপ লাগে। এখন ঘুমালেও আর আসে না সেই পরশ-পাথর। আমার খুব কষ্ট হয়। শীতের রাতে বা বৃষ্টির রাতে রাস্তায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধার পাশে শিশু নাতনিকে দেখে ওদের জন্য পৃথিবীর হিস্যা বুঝে নিতে ইচ্ছে করে। পরশ-পাথর ছাড়া আমি কি করে সেই সমস্যার সমাধান করব? বাংলাদেশের সাহায্য লাগবে না বেঁচে থাকার যুদ্ধে কিন্তু কোন কোন দেশের সাহায্য লাগে। সেই সব দেশকে যদি ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর সাথে মার্জ করে দেয়া যেতো। পৃথিবীর মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো ‘ক্ষুধা’। ক্ষুধা ছাড়া শত্রু নাই তা নয়। কিন্তু ক্ষুধামুক্ত হলে পৃথিবীর ৭০% সমস্যা কমে যেতো। প্রতিদিন মৃত্যুর মতো ঘুম আমাদেরকে আবার জীবনের কাছে ফিরিয়ে দেয়, যদিও বাধ্য নয়। কিন্তু এই ঘুমই একবার এসে জীবনের সব অংক নাই করে দেয়, মিশিয়ে দেয় শূন্যতায়। ‘শূন্য’ নামক অংঙ্কটা আমাদেরকে শূন্য করে দেয়। তবে কি এই শূন্যতাকে জয় করতে পারলে আমরা মৃত্যুহীন হতে পারব? মৃত্যুহীন হওয়া প্রয়োজন, ঘুমহীন হওয়া প্রয়োজন, ক্ষুধাহীন হওয়া প্রয়োজন। ঘুমের পরশ পাথর, বাস্তবে পেতে চাই। শূন্য জয়ের ফর্মূলা আবিষ্কারকে এক নম্বর গুরুত্ব দেয়া উচিত।

আমি বিড়বিড় করে আরো কী সব বলতে থাকলে, নিশো তার বুকে চেপে ধরে আদর করে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারা একে অপরের আধার ও আধেয় হয়ে ওঠে। তাদের চোখের সামনে এই পৃথিবীটা নতুন করে গড়ে ওঠে। তাদের শর্ত ও স্বপ্নগুলো একাকার হয়ে বিরাট এক আকাশে পরিণত হলে নিশো বুঝতে পারে এই, সেই মানুষ যার জন্য তার এত প্রতীক্ষা আর পথ খোঁজা...ঘুমের মতো মৃত্যু...নাকি মৃত্যুর মতো ঘুম...আমাদের ঘুমাতেই হবে।

 

 

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক