X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আরজ আলির প্রত্যাবর্তন

সানাউল্লাহ সাগর
২০ জুন ২০২৩, ০০:০০আপডেট : ২০ জুন ২০২৩, ০০:০০

আরজ আলি হাত তুলে নামাজ শুরু করবে ঠিক এমন সময় তার মনে সন্দেহের উদয় হলো। ওজু আছে কিনা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছে না সে। মুয়াজ্জিনের ইকামত শেষে ইমাম সাহেব নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন। আরজ আলি হাত তুলবে না বের হয়ে আবার ওজু করতে যাবে সে চিন্তা করতে করতে ইমাম সাহেব সুরা পড়া শুরু করে দিয়েছেন। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো ওজু থাক বা না থাক এই সন্দেহ নিয়ে নামাজে দাঁড়াবে না। এখনই মসজিদ থেকে বের হয়ে যাবে। জীবনে অনেক পাপ করেছে; সন্দেহের উপরে নামাজ পড়ে সে পাপের পাল্লা আর ভারি করতে চায় না। মসজিদের পাশেই খাল। শান বাঁধানো ঘাট। সেখানে সবাই ওজু-গোসল করে। দু-রাকাত দেরি হলেও ঘাটলায় গিয়ে আবার ওজু করে এসে নামাজে দাঁড়াবে। ইমাম সাহেবের কাছে শুনেছে এমন সন্দেহ নিয়ে নামাজ হয় না। কিন্তু বিপদ হলো আরজ আলি যখন কাতারে দাঁড়িয়েছিল তখন মসজিদে মানুষ মাত্র সাতজন। তাই বাধ্য হয়ে তাকে প্রথম কাতারে ইমাম সাহেবের পিছনে দাঁড়াতে হয়েছে। এখন একজন-দুজন করে তিন কাতার মুসল্লি হয়ে গেছে। পিছনের কাতারে নামাজরত মুসল্লিদের ঠেলে মসজিদ থেকে বের হওয়াও বিব্রতকর। এই বায়তুল আমান পাঞ্জেগানা মসজিদে অন্যান্য ওয়াক্তে তেমন মুসল্লি হয় না। তবে মাগরিবের ওয়াক্তে কখনো-সখনো চার কাতারও হয়ে যায়। তবে সে ক্ষেত্রে হাটবারের একটা ব্যাপার আছে। বর্ষাকালে করিমগঞ্জ বাজার থেকে দেনাপুর গ্রামে ফেরার এটাই একমাত্র রাস্তা। তাই মাগরিবের ওয়াক্তে ছোট্ট এই পাঞ্জেগানা মসজিদটি মুসল্লিতে ভরে যায়। ইমাম সাহেব সুরা ফাতেহা পড়তে থাকেন। আরজ আলি এখনো হাত তোলেনি। দাঁড়িয়েই আছে। ঠিক তখনই তার মনে হলো মসজিদের বাইরে রাখা বাজারের ব্যাগটা ঠিক আছে তো! গতবছর এই মসজিদেই মাগরিবের নামাজ পড়তে গিয়ে বাজারের ব্যাগ ও বাটার একজোড়া স্যান্ডেল চুরি হয়েছিল তার। ব্যাগের মধ্যে তাজা ইলিশ মাছ ছিল। আরজ আলির ছোটো মেয়ে পপি ইলিশ মাছ খুব পছন্দ করে। প্রায়দিন বাজারে বের হওয়ার আগে বার বার বলে দেয় বড়ো ইলিশ মাছ নিয়ে আসার কথা। তিন বউয়ের সংসারে পপি আরজ আলির একমাত্র সন্তান। বাকি দুই বউয়ের ঘরে কোনো সন্তান আসেনি। সে কারণে প্রতিবেশীদের বুদ্ধি ও নিজের বুদ্ধি মিশিয়ে একে একে সে তিন বিয়ে করেছে। তৃতীয় বিয়ে করার সময় তিন বউ সামলানোর চেয়েও তার মাথায় ছিল, এই বউয়ের ঘরে সন্তান না আসলে সে আরও একটি বিয়ে করতে পারবে। ইসলাম তাকে সে অধিকার দিয়েছে! একটি সন্তানের লিপ্সায় সে টানাটানির সংসারে তিন বউয়ের ভরণ-পোষণের কথা ভুলে যায়। প্রথম বউকে বিয়ে করার পাক্কা বারো বছর পর সে দ্বিতীয় বিয়ে করে। প্রথম বউয়ের অনুমতি সাপেক্ষেই। কিন্তু এক এক করে নয় বছর হওয়ার পরও যখন কোনো সন্তানের মুখ দেখা হয় না, তখন আরজ আলির নিজের প্রতিও এক ধরনের সন্দেহ তৈরি হয়। কিন্তু সেটা কারো কাছে প্রকাশ করে না সে। পুরুষ বলে কথা! নিজেকে একবার বউদের কাছে অসহায় করে তুললে বউরা তাকে আর ভয় পাবে না। তার চেয়ে সমানে দুই বউকেই ওঝা-ফকির দেখাতে থাকে। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায় না। তখন দুই বউ মিলে তাকে তৃতীয় বিয়ে করার কথা বলে। আরজ আলি চুপ করে থাকে। যেন তার কোনো আগ্রহ নেই। কেবল দুই বউয়ের অনুরোধে সে বিয়ে করবে এমন ভাবে হ্যাঁ বলে। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি হয়ে গেছে। দুই বউয়ের শরীরও তাকে আর তেমন টানে না। নতুন একটা শরীরের কথা চিন্তা করে তার চোখ চিকচিক করে। মনে মনে খুব খুশি হয়। কিন্তু সে আনন্দ কিছুতেই প্রকাশ পেতে দেয় না আরজ আলি। বরং সন্তান না পাওয়ার বেদনাকেই মুখ্য করে সাতচল্লিশ বছর বয়সে তৃতীয় বিয়ে করে।

নতুন বউ সুরাইয়া বিবির বয়স পঁচিশের কাছাকাছি। আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু স্বামীর কাছে অপছন্দনীয় হওয়ায় তালাকপ্রাপ্ত। মুখখানা দেখতে তেমন মায়াময় না হলেও শরীর একদম পরিপাটি। দেখলে কে বলবে এই মেয়ে ছয় বছর সংসার করেছে। আগের ঘরে তার দুই সন্তানও আছে। বিয়ের পর এই কালো হীরের প্রতি দরদ বেড়ে যায় আরজ আলির। সে বিষয়টি আগের দুই বউ মরিয়ম আর মারফুন নেছা ভালো করেই টের পায়। কিন্তু ধান সেদ্ধ করা, টেঁকিতে ধান ভানা, গরুর ঘাস, খড় দিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে শরীর ভাটির দিকে চলে যাওয়া মরিয়ম খুব বেশি আক্ষেপ করে না। কিন্তু দ্বিতীয় বউ তার তুলনায় নিজেকে এখনও কিছুটা তরতাজা মনে করে। সে কারণে প্রকাশ না করলেও গোপনে গোপনে তার মনে অভিমান, ক্ষোভ জমে। মাঝেমধ্যে বড় বউয়ের কাছে অভিযোগ করে। বড় বউ তাকে বোঝায়, ‘দ্যাখ, পুরুষ মানুষ। নতুন একটা শরীর পাইছে কিছু দিন ডুবে থাকবেই। তারপর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। আমরা তাকে কোনো সন্তান দিতে পারিনি। পারলে তো আর বিয়া করতো না।’

এই কথায় তেমন সান্ত্বনা পায় না মারফুন নেছার মন। সে মা কিংবা বড় বোনের মতো মরিয়মের কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কাল নাগিনীর মতো ফণা তুলে ফোঁস করে ওঠার কথা তার। কিন্তু সে তা করে না কিংবা করতে পারে না। বরং ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কারণ সে জানে বিষহীন সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে কোনো লাভ নেই। নিজের সন্তানকে আদর করার মতো করে বড় বউ মারফুন নেছার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সান্ত্বনা দেওয়ার সময় বড় বউ মরিয়মের ডান পাশে ঝুলে থাকা পাকা চুল বেয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে আসা নোনা পানি মারফুন নেছার পিঠে পড়ে। মাথা উঁচু করে সে তাকে দেখে। দুই জোড়া করুণ, কাতর চোখের চোখাচোখি হয়। মেজো বউ বড় বউয়ের চোখে নিজের কষ্টের প্রতিচ্ছবি দেখে। দেখে সে যাকে ছাতা ভাবছে সেও একই কষ্টে কাঁদছে। তারা এরকম কেঁদে কেঁদে আড়ালে-আবডালে আবার চোখ মুছে ফেলে। নিজেরাই একে অপরকে সান্ত্বনা দেয়। তবুও আরজ আলিকে কিছু বুঝতে দেয় না। সংসারের কাজে লেগে যায়। রাতে অনাগত সন্তানের মুখ দেখার লোভে হাসি হাসি মুখ করে ঘুমিয়ে যেতো। পরদিন আবার ফজরের আজানের পরপরই উঠে ঘরকন্যার কাজে লেগে যেতো।

বছর যায় সুরাইয়া বিবির পেট ভারি হয় না। সবার অপেক্ষার পাল্লা ভারি হতে থাকে। তৃতীয় বিয়ের উসকানি দেয়া মরিয়ম ও মারফুন নেছাও নিজেদের প্রতি বিরক্ত হয়। আর আরজ আলি নিজের প্রতি সন্দেহ বাড়তে থাকে। কিন্তু এই সন্দেহের কথা কাউকে বলে না সে। ষাটের কাছাকাছি না গিয়েও অধিক শারীরিক পরিশ্রমে সত্তর বছরের বুড়োর মতো লক্কর-ঝক্কর হয়ে গেছে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারে। যতটা লোভ করে তৃতীয় শরীরের জন্য আরজ আলির মন চুকচুক করে উঠেছিল বিয়ের পর বুঝতে পেরেছে জোয়ান বলদের সাথে বুড়া গাভি দিয়ে হাল চাষ করলে চাষও হবে না দুধও পাওয়া যাবে না। এরকম করে পাঁচ বছর পার হয়ে যায়। আরজ আলি ও তার আগের দুই বউ সন্তানের আশা ছেড়ে দেয়। মনে মনে ঠিক করে নতুন বিয়ের উসকানি তারা আর দিবে না। আরজ আলিও শরীরে আর তেমন জোর পায় না। সে কারণে চতুর্থ বিয়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে আসে। পরিবারের সকলেই মনে মনে একরকম সন্তানহীন জীবন মেনে নেয়। কিন্তু সুরাইয়া? ষষ্ঠ বছরে সুরাইয়া বিবি নিজের মধ্যে নতুন অস্তিত্বের টের পায়। এই খবরে মরিয়ম ও মারফুন নেছারা খুশি হয়। আর আরজ আলি খুশি হয় সবার চেয়ে বেশি। এতো বছর পর হলেও নিজের পৌরুষত্ব ফলানোর গৌরবে তার পা মাটিতে পড়ে না। আগের দুই বউকে আলাদা আলাদাভাবে ধন্যবাদ দেয়ার পাশাপাশি বকা দিতেও ছাড়ে না সে। তাদের শারীরিক অক্ষমতার কারণেই যে এতো বছর তার পৌরুষত্ব প্রকাশ পায়নি সে বিষয়ে বিশদ বক্তৃতা দিতেও ছাড়ে না আরজ আলি। আর পাড়ার দোকানে প্রতিবেশীদের খোঁচায় সে আর লজ্জা পায় না। মনে মনে অপেক্ষা করে সন্তান জন্ম নেয়ার। মনে মনে ভাবে পাড়ার দোকানে তার পৌরুষত্ব নিয়ে যারা সন্দেহ প্রকাশ করে তাদের এবার উচিত জবাব দেবে।

মনে মনে সবাই ছেলে আশা করলেও সুরাইয়া বিবি একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়। কোনো অঘটন ছাড়াই জন্ম নেয় পপি। আরজ আলি বাংলা সিনেমায় আসা নতুন নায়িকার নামে মেয়ের নাম রাখে। মনে মনে ঠিক করে বাজারের সাদাকালো টিভিতে নায়িকা পপির মুখ আর দেখবে না! তার ঘরে জন্ম নেয়া রঙিন পপিকে দেখবে। সাথে সাথে এটাও ঠিক করে বিদ্যুৎ ছাড়া গ্রামে বিদ্যুৎ এলে যে করেই হোক একটা রঙিন টিভি কিনবে সে। পপির বয়স বাড়তে থাকে।

হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা খালি ঘর থেকে আরজ আলি চাচাতো ভাইয়ের ছেলেকে বের হতে দেখে। তার মনে সন্দেহ তৈরি হয়। নিজের অজান্তেই আবার সেসব ফুঁ দিয়ে উড়িয়েও দেয় আরজ আলি। কিন্তু একদিন সদ্য কৈশোর পেড়োনো চাচাতো ভাইয়ের ছেলে আকবরের সাথে সুরাইয়া বিবিকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলে আরজ আলি। তারপর থেকে বছরের পর বছর তার মধ্যে নিজের অক্ষমতায় সন্দেহের মেঘ আরও ঘনীভূত হয়। একসময় সে একটি সিদ্ধান্তের কাছাকাছি চলেও আসে। সবকিছু তার কাছে আয়নার মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। সে ছাড়া সুরাইয়া বিবির এই কীর্তি যেহেতু কেউ জানে না সে কারণে এই কথা অন্যদের জানিয়ে নিজের পুরুষত্ব হারানোর মতো বোকামি করে না আরজ আলি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঘৃণা-অপমান আর অবহেলায় পেট ফুলে উঠলেও নিজের পৌরুষত্বও কথা ভেবে নিজের বউ সুরাইয়া বিবি আর ভাইয়ের ছেলে আকবরকে কোনো গাল মন্দ করে না। যেন কিছুই হয়নি এরকমভাবেই চলতে থাকে সবকিছু। আরজ আলিও নিজেকে স্বাভাবিক রাখে। পপিকে আদর করে। পপি চার বছর পেড়িয়ে পাঁচে পড়েছে। এখন আরজ আলিও ভালো করেই বাবা ডাকতে পারে। আরজ আলি হাসে। অথবা ভেতরে ভেতরে কান্না করে। কিন্তু চোরকে যে দেখেছে সে কিছু না বললেও চোরের ভয় কিছুতেই কাটে না। সে তার চুরির ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেও সাক্ষীকে কোনো ক্রমেই ভুলে যায় না।

আরজ আলি ওজু নিয়ে সন্দেহের কথা ভুলে যায়। তার বাজারের ব্যাগ ও রাডা কোম্পানির স্যান্ডেলের কথা মাথায় ঘোরে। এই রাডা কোম্পানির স্যান্ডেল সে বাটা মনে করেই কিনেছে। কিন্তু বাড়িতে নিয়ে এসে যখন মেয়েকে দেখালো তখন ক্লাস ওয়ানে পড়া মেয়ে বানান করে বাটার জায়গায় রাডা আবিষ্কার করে। প্রথমে মেয়ের বিদ্যায় বিশ্বাস করতে পারেনি আরজ আলি। সে পাশের ঘরে ক্লাস সিক্সে পড়া ভাইয়ের ছেলেকে দেখালে সে পপির আবিষ্কারকে সমর্থন করে। তখন মনে মনে কতোগুলো গ্রাম্য গালি দেয় আরজ আলি। যদিও সে গালি বাটা কিংবা রাডার কারো কাছে পৌঁছে না। আকাশের দিকে থুতু ফেলার মতন নিজের কাছেই ফিরে আসে। সাথে সাথে নিজেকেও কিছু গালি দেয় পড়ালেখা না শেখার জন্য। আরজ আলির চিন্তা বেশি দীর্ঘায়িত হতে পারে না। ইমাম সাহেব রুকুতে যাওয়ার জন্য যখন আল্লাহু আকবর বলে তখন তার আবার ওজুর কথা মনে পড়ে। তখন সে আর দেরি করে না। একরকম জনসভায় মানুষের পায়ের নিচে পড়তে পড়তে বেঁচে যাওয়া মানুষের মতন হুড়মুড় করেই মসজিদ থেকে বের হয়ে আসে। বাইরে এসে বাজারের ব্যাগ খুঁজে পায় না। তবে এবার স্যান্ডেল চুরি হয়নি। রাডার দুই সেলাই খাওয়া স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে আরজ আলি। তারপর বাজার চুরি যাওয়ার রাগে আল্লাকে গালি দিতে দিতে ওজু না করতে গিয়ে বাড়ির পথ ধরে। কয়েকবার বিড়বিড় করে সিদ্ধান্তও নেয় না সে আর কখনো এই মসজিদে নামাজ পড়বে না।

আরজ আলি বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে। সূর্য ডুবে গেলেও এখনো তার সব আলো আড়াল না হওয়ায় ঠিকঠাক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ গাছগুলোকে দেখা যাচ্ছে। আরজ আলির নামাজ চলতি অবস্থায় এমনভাবে দৌড়ে বের হয়ে যাওয়ায় মুসল্লিরা কী পরিমাণ রেগে যেতে পারে সেটা ভেবে কিছুটা চিন্তিত হয় সে। পরমুহূর্তেই আবার ভাবে তার তো নিজের কোনো দোষ নেই। ওজু না থাকলে কেমনে নামাজ পড়বে! ওজু ছাড়া নামাজ পড়ার মতো সাহস তার নেই। বিড়ি খায়। মিথ্যা কথা বলে ঠিকাছে কিন্তু তাই বলে একটা পাঞ্জেগানা মসজিদে ওজু ছাড়া নামাজ! নাহ এটা সে কোনো ক্রমেই করতে পারতো না। তবে এটাও ভাবে ওভাবে হুড়মুড় করে দৌড়ে না এসে আস্তে আস্তে ভদ্র মানুষের মতো বের হওয়া উচিত ছিল।

ঘণ্টাখানেক আগে একচোট বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাটির সরু রাস্তার প্রায় অংশেই আঠালো কাদা। ঝোলাগুড়ের মতো পায়ে লেগে যায়। পুকুরে অনেকক্ষণ ধরে ধুতে থাকলে পা ছাড়তে চায় না। কচি বয়সে পালিয়ে বিয়ে করা মেয়েদের মতো যে কোনোভাবে পা আটকে থাকতে চায় কাদা। আরজ আলি সামনে এগোতে থাকে। আবছা অন্ধকারে সামনে কাদা দেখতে পেয়ে আরজ আলি হাতের রাডা স্যান্ডেল জোড়া খুলে হাতে নেয়। নয় বছর আগে বানানো রঙচটা বেগুনি পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে সতর্কভাবে সামনে হাঁটতে থাকে। কোনোরকম পা পিছলে গেলেই কোমর ভাঙার আশঙ্কা। উনষাট বছর বয়সে কোমর ভেঙে গেলে আর বিছানা থেকে উঠতে পারবে না সেটা নিজেকে বোঝায়। রাস্তার উপর জমে থাকা অল্প পানি দেখে বেশি সতর্ক হয়। প্রায় গর্তের মধ্যে পা পড়ে কাদার পিচকারি ওঠে জামায়। বাজারের ব্যাগ হারানোর রাগ আর মসজিদ থেকে নামাজ না পড়ে বের হয়ে আসার রাগের সাথে আরও কয়েক ডিগ্রি রাগ যোগ হয়। পাঞ্জাবির পকেট খুঁজে একটা বিড়ি জ্বালায় আরজ আলি। দুই-তিন টান দিতে খকখক করে কাশি শুরু হয় তার। বউ, মেয়ে বলে দিয়েছে বাড়িতে বিড়ি খাওয়া যাবে না। ডাক্তার তিন বছর আগেই নিষেধ করেছে। তারপরও আরজ আলি প্রায় পঞ্চাশ বছরের অভ্যাস ছাড়তে পারে না। বাড়ির বাইরে আসলে দু-একটা বিড়ি খায়। কাশি পাত্তা না দিয়ে বিড়িতে জোরে টান দেয় আরজ আলি। একমাত্র মেয়ে পপির মুখটা সামনে আসে। পপি তার সবকিছুরই ঊর্ধ্বে! হোক সে অন্যের সন্তান কিন্তু সমাজ তো সেটা জানে না। পপির জন্যই সে এখন একটু মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারে। আড়ালে-আবডালে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা আগের মতো খোঁচা দিয়ে কথা বলে না। নিজেও মনে মনে নিজেকে সাহস দেয়। আবার মুহূর্তেই সে সাহস হাওয়া হয়ে যায়।

যত সামনে এগোতে থাকে ততই রাস্তার মুমূর্ষু অবস্থা দৃশ্যমান হতে থাকে। নিরুপায় আরজ আলি বুঝতে পারে দো-কাছা দেয়াটাই তার জন্য ভালো হবে। দো-কাছা দেয়ায় কিছুটা উপকার হয় ঠিক কিন্তু ঢালু জায়গায় বৃষ্টির পানি জমে থাকা স্থানে রাডা স্যান্ডেলসহ পা আটকে যায়। টেনে পা তুলতে চায় আরজ আলি। কিন্তু অল্প শক্তি খরচে কাজ হয় না। কাদায় পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে গেছে। আরো একটু বেশি শক্তি খরচ করে পা টান দেয়। এবার পা উঠে আসে ঠিকই কিন্তু তার প্রিয় রাডা স্যান্ডেল কাদার মধ্যে থেকে যায়। অন্ধকার ঘন হয়ে আসে। আকাশে থেমে থেমে মেঘের গর্জন জানিয়ে দেয় বৃষ্টি মাটি ছোঁয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরজ আলি রাডা স্যান্ডেলের মায়া ছেড়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। তার মনের মধ্যে আগে থেকে বসে থাকা বাজারের ব্যাগ হারানো ব্যথার সাথে প্রিয় স্যান্ডেল হারানো ব্যথাও যোগ হয়। সে নিজের উপর খুব বিরক্ত হয়। মনে মনে আজকে বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য নিজেকে গালি দিতে থাকে। অতি যত্নে তুলে রাখা বাঁ পায়ের জুতাটা রাস্তার পাশের জঙ্গলে ছুড়ে মারে। কিন্তু জুতা ফেলে সামনে তাকিয়ে দেখে একজন মানুষ বাজারের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি তার মতোই পাঞ্জাবি পড়া। আরজ আলি প্রাথমিক অবস্থায় কিছু বুঝতে পারে না। সে ডাক দেয়। ভাবে তারই কোনো প্রতিবেশী হবে। লোকটি সামনের দিকে ফিরে থাকায় সে তার মুখ দেখতে পায় না। আরজ আলি আবার ডাক দেয়। ‘ওই কেডারে। কই থাইকা আইছো?’

সামনের মানুষ থেকে কোনো জবাব আসে না। আরজ আলির মধ্যে ভয় তৈরি হয়। সমানে শরিফ বাড়ির সামনে বাঁশ বাগান। তার সামনে কবরস্থান। তারও মিনিট দশেক হাঁটলে তার বাড়ি। দৌড়ে গেলেও বারো-তেরো মিনিট লাগবে। এই বয়সে এমন কাদা রাস্তায় দৌড়াতে পারবে না আরজ আলি। আকাশে বিজলি চমকায়। সে দেখতে যায় অচেনা লোকটির হাতে তার হারানো ব্যাগ। আরজ আলির মনে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু কোনো উত্তর নেই। সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌড় দেয়ার সাহস করলেও এই অন্ধকারে সেটা বাস্তবায়ন করতে পারে না সে। আরজ আলি ভেতরে ভেতরে ভরকে গেলেও বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। নিজের হারানো ব্যাগ নেয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। হাঁটা শুরু করে। লোকটিও হাঁটতে থাকে। আরজ আলি দাঁড়ায়। লোকটিও দাঁড়িয়ে যায়। যেন তার সাথে অচেনা লোকটির শরীরের গতি বাঁধা আছে। আরজ আলি যত জোরে হাঁটে লোকটি যেন তার চেয়ে আরো জোরে হাঁটে। আরজ আলি যতই চেষ্টা করে দূরত্ব কমে না। শরিফ বাড়ির কবরস্থান পার হয়ে অনেক দূর চলে এসেছে। বাড়ি পৌঁছতে আর হয়ত পাঁচ মিনিট লাগবে। পাঁচ মিনিট সময় খুব বেশি নয়। আরজ আলি নিজেকে শক্ত করে। হাঁটতে থাকে। ধারণা করে লোকটি হয়তো মৃধা বাড়িতে ঢুকবে। কিন্তু যখন মৃধা বাড়ি পার হয়েও লোকটি হাঁটতে থাকে তখন আরজ আলি ভয় আর সামলাতে পারে না। সামনে তার বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়ি নেই। তার বাড়ির পরও আর কোনো বড়ি নেই। প্রায় আধা মাইল ফসলের খেত। আরজ আলি চিৎকার করে। কিন্তু গলা থেকে কোনো শব্দ বের হয় না। এবার আরজ আলি বয়সের অক্ষমতা ভুলে দৌড় দেয়। সামনের মানুষটিও দৌড় দেয়। তারা দৌড়াতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আবার বিজলী চমকায়। দশ পনেরো হাত দূরে লোকটি দাঁড়িয়ে যায়। আরজ আলি এবার লোকটিকে দেখতে পায়। লোকটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখোমুখি। লোকটি কেউ নয় সে নিজে। আরজ আলি নিজের শরীরের দিকে তাকায়। অবিকল সে। তার মতো জামা পরে বাজারের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আবার বিজলি চমকায়, আর তখন আরজ আলি নিজেকে মাঝি বাড়ির কবরস্থানে আবিষ্কার করে। তিন বছর আগে যেখানে তাকে কবর দেয়া হয়েছিল।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে