X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
বেন ওকরির গল্প

জাদুর তৃতীয় সূত্র

অনুবাদ: সা‌জিদ উল হক আবির
০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:০৫আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:১০

রাতটা সে তুষার নিয়ে কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন আকৃতির শক্ত তুষার বল তৈরি করার পরে জমা করে রাখে ফ্রিজারে, যাতে বরফের বলগুলো গলে না যায়।

দীর্ঘদিন ধরে সে চাইছিলো এমন কিছু তৈরি করবে, যা হবে সাধারণ এবং প্রাকৃতিক, যেন দেখে মনে হয় না যে, তার তৈরি জিনিস খুব গভীর এক পরিকল্পনার ফসল। আর তা নিশ্চিত করার জন্য তার প্রয়োজন ছিলো গভীরতম অভিনিবেশ এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের দক্ষতা।

অতীতে সে নানারকম পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছে। সে ধুলোবালি বিক্রি করেছে। এমনকী পত্রিকা ফেরি করে বিক্রি করেছে, তবে বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। সে পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা মাত্র ১০১ কপি ছাপিয়ে বিক্রি করেছে। পত্রিকার সংবাদগুলো হতো মারমার কাটকাট এবং পিলে চমকে দেওয়ার মতো, কিন্তু পাঠকের বিশ্বাস জয় করে নেওয়ার মতো। যেমন পত্রিকায় হয়তো সে দাবী করতো যে, আজকাল মানুষজন হুটহাট উধাও হয়ে যাচ্ছে, আর মানব সমাজে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করা ভিনগ্রহের প্রাণীর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। তার প্রকাশিত সংবাদপত্রের খবরাখবর পাঠকের মাঝে বাস্তবতাকে সন্দেহ করার প্রবণতা তৈরি করতো, অথবা যে সমাজ বাস্তবতায় তারা বসবাস করে—সেটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতো। যেমন পত্রিকার বিজ্ঞাপনে বলা হতো যে, শহরের কোথাও বিশাল মূল্য ছাড়ে ধুলোবালি ও আবর্জনা বিক্রি হচ্ছে এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে লাইন ধরে কিনছে সেসব জিনিস। অথবা কোনো একবার দেখা গেল যে, তার পত্রিকায় ৫৫ বছর বয়সী এক বুড়ো মাছির পুরনো ও বহুল ঘষামাজাওয়ালা ফটোগ্রাফ ছাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ছবিটা দেখে মনে হয় কিছুটা পরিচিত, আবার তা কিছুটা অস্বস্তিরও উদ্রেক করে। যেন তা উইলিয়াম ব্লেকের আঁকা ছবি এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফি পত্রিকায় ছাপা হওয়া বাস্তবমুখী ফোটোগ্রাফের এক আজব মিশেল। কিন্তু প্রতিবার এরকম লম্বা চওড়া পরিকল্পিত কর্মসূচি নিয়ে এগুতে গেলেই সে টের পেতো, পরিকল্পনার এতো বিস্তৃতি এবং খুঁটিনাটির দিকে খেয়াল রাখার ব্যাপারটা তার অভীষ্ট শিল্পকর্মের সহজাত স্বাভাবিকভাব নষ্ট করে ফেলে।

কাজেই সে বারোক শিল্পকলার মতো চটকদার শিল্প তৈরির চিন্তাভাবনা ছেড়ে দেয়। সে শিশুসুলভ কিছু করতে চেয়েছে। ফলে তার চিন্তাভাবনা করা লাগে শৈশব নিয়ে, এমনকী নাগরিক জীবনের জাঁতাকলের প্রেষণে ছিনতাই হয়ে যাওয়া শৈশবের গুরুত্বপূর্ণ সব অনুষঙ্গ নিয়ে। তার স্বপ্ন ছিল বিস্ময়ের ফেরিওয়ালা হবার। কিন্তু সে চাইত সেসব বিস্ময় এত সহজ এবং সাধারণ হবে যে, তাদের স্বাভাবিকতার সঙ্গে বিস্ময় উৎপাদনের গুণকে একে অপরের থেকে আলাদা করা যাবে না। দুনিয়ার একদম সহজ ও সাধারণ জিনিসের একটা লম্বা তালিকা সে তৈরি করেছিল। আবর্জনা বিক্রি ছিল সেই পরিকল্পনারই একটা অংশ। কিন্তু আবর্জনার সমস্যা হলো, এটা ব্যক্তিগতভাবে খুব চমকপ্রদ কিছু না। এছাড়াও সে কাজ করেছে ভাঙা কাঠের টুকরা, বোতল, মানুষের চুল নিয়ে। কাজ করেছে মানুষের শরীর এবং ত্বকের আঙ্গিক নিয়ে। নিজের গায়ের রং তুলে এনে ছাপ মেরেছে কাগজের ওপর। সে তার পুরো শরীরটাকেই শিল্পকর্ম বানানোর চেষ্টা করেছে। বাস্কেটবল এবং খেলোয়াড়দের উচ্চতা নিয়ে শিল্প তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে। শহুরে রাস্তার ধুলোবালি দিয়ে নানা আর্টফর্ম তৈরি করেছে। শহুরে আবর্জনা দিয়ে শৈল্পিকভাবে সর্বোচ্চ যা কিছু করা যায়, সে তার সবই করে ফেলেছে।

এবারে তার লক্ষ্য ছিল এমন কিছু করার, যা হবে একদম সরল। কিন্তু যতই সে শিল্পকর্মের সরলতার দিকে কেউ গভীর অভিনিবেশ নিয়ে তাকাবে, ততই তা অস্পষ্ট এবং জটিল হয়ে উঠবে—যে পর্যন্ত না কাজটা তার শিল্পী জীবনের অব্যক্ত সমস্ত বয়ান ও বক্তব্যকে স্পষ্ট করে তোলে। শিল্প নির্মাণের এরকম একটা স্বচ্ছ ও প্রাকৃতিক উপকরণ সে কোথায় পাবে? এমন এক বস্তু, যা মানুষের চিন্তাকে ঘাই দিতে থাকবে ক্রমাগত, আবার একই সঙ্গে মানুষের চিন্তার সীমাকে অতিক্রমও করে যাবে। আবার সে শিল্পকর্মকে ঘিরে এমন এক প্রদর্শনী অনুষ্ঠান আয়োজন করা লাগবে, যা কেউ কখনো পুনরাবৃত্তি করতে পারবে না। যা সংঘটিত হবে একবারই এবং তারপর তা মিলিয়ে যাবে চিরতরে। ঘটনাটি আদৌ ঘটেছিল কি ঘটেনি—তা নিয়ে মানুষের জল্পনাকল্পনা চলতে থাকবে। সে এমন একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চাইছিল—যাতে যে কেউই প্রবেশ করতে পারবে, তবে মূল ঘটনা, যাকে কেন্দ্র করে সে অনুষ্ঠানের আয়োজন, তা উপলব্ধি করতে পারবে অল্প কিছু মানুষ। কাজেই একটা সহজ ও সাধারণ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে অনেকগুলো সম্ভাব্যতাকে স্পর্শ করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।

বেশ কয়েক বছর ধরে সে শহরের এমন সব জায়গায় চলাফেরা করেছে, যেখানে মানুষ সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিসপত্র বিক্রি করে। রাস্তায় খুঁজলেই সহজে পাওয়া যায়, এমন জিনিসপত্রের বাজারে সে প্রায়ই ঘুরে বেড়াত। কারণ ততদিনে সে এটা উপলব্ধি করেছিল, তার শহরে প্রতিদিন যে পাহাড় পরিমাণ আবর্জনা উৎপাদিত হয়, তার মধ্যেই শিল্প নির্মাণের সব গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল খুঁজে বের করা সম্ভব। এ সমস্ত সহজে পাওয়া জিনিস ছিল নির্মাণসামগ্রী এবং নির্মাণ সহযোগীর সহায়তায় নির্মিত দামি শিল্পকর্মের চেয়েও মূল্যবান। খোঁজাখুঁজির শুরুর দিনগুলোতে নগরবাসীরা যে সমস্ত জিনিস অকেজো বিবেচনায় ছুড়ে ফেলে দেয় আবর্জনার বাক্সে, তা দেখে সে বিস্মিত হয়। একদম ঠিকঠাক কাজ করে এমন কম্পিউটার এবং টিভি সেট, রেডিও, মাইক্রোওভেনও সে দেখেছিল ফেলে দেয়া জিনিসের স্তূপে। ওই স্তূপের মাঝেই সে ধুলো ঝেড়ে তুলে এনেছে বিখ্যাত শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত চিত্রকর্ম এবং পোস্টার, শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর ব্রশিউর, আইনি সংস্থার কাগজপত্র, এমনকী নানান মূল্যবান বইসহ ১৯২২ সালে প্রকাশিত এক আস্ত এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা। উদ্ধার করেছে পুরনো মূল্যবান গ্রামোফোন প্লেয়ারের রেকর্ড এবং লেখক চেষ্টার হাইমসের অসম্পূর্ণ গল্প সংকলন। খুঁজে পেয়েছে মানচিত্র, দিনলিপি এবং ট্যাপড্যান্সের জুতো; সান্ধ্যকালীন পোশাক, মাথার টুপি, এমনকী মেয়েদের পেন্টির সাথে পায়ের লম্বা মোজাকে শক্ত করে ধরে রাখার নতুন বেল্ট বা সাসপেন্ডার। ময়লার স্তূপে পচে গন্ধ ছড়ানো সবজি, ভাঙা ডিমের খোসা, দইয়ের হাড়ি এবং আরো ল্যাদল্যাদে, তেলতেলে জিনিসের মাঝে সে খুঁজে পেয়েছে এসব। প্রায় প্রত্নতাত্ত্বিকের অভিনিবেশে সে মাটির তল থেকে খুঁড়ে বের করে এনেছে অভিবাসীদের বসবাসের অধিকার না দিয়ে পাশ করা আইনের সরকারি নথি। দুচোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে সে ময়লার স্তূপ থেকে খুঁজে বের করেছে প্রাইভেট গোয়েন্দার নোটখাতা অথবা প্রেম মরে যাওয়ার পর ছুড়ে ফেলে দেয়া প্রেমপত্র।

এভাবে ক্রমশ সে শহুরে আবর্জনা বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলো। আবর্জনার ডিপো থেকে এসব কুড়িয়ে আনা বস্তু জমা করবার জন্য বাড়ির বাইরে সে একটা আলাদা গুদামঘর তৈরি করেছিল। মাঝেমাঝে সন্ধ্যেবেলা তাকে দেখা যেত শপিং করবার বড় একটা ঝুড়ি ভর্তিকরে নানারকম কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসপত্র ঠেলতে ঠেলতে ঘুরে বেড়াতে। কেউ ভাবতো, সে আসলেই একজন ময়লা কুড়ুনি। আবার কেউ মনে করতো যে সে ঐসব পাগলদের একজন যারা সারারাত ধরে শহরজুড়ে ঘুরে বেড়ায় এবং ঝুড়ি ভর্তি করে ময়লা টোকায়।

এমন করে লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতেই সে একদিন খুঁজে পেয়েছিলো ঐ সাদামাটা বাজার, যেখানে মানুষজন একদম আজগুবি এবং তারা কিম্ভূতকিমাকার সব জিনিসপত্র নিয়ে এসে বিক্রি করে। একদম প্রথম দিনই তার পরিচয় হয়েছিলো টিংটিঙে পাতলা এক ফোকলা দাঁতের বিক্রেতার সঙ্গে, যে বসে বসে বিক্রি করছিলো নকল দাঁতের পাটি। ঝুরঝুরে এক টেবিলের ওপর সে সারি সারি দাঁতের পাটি সাজিয়ে রেখেছিল। ওখানে ছিলো বাচ্চা এবং নারীদের দাঁত আর পুরো একটা সারি জুড়ে কুকুর এবং ঘোড়ার দাঁত। তার পাশেই আরেকজন বসে বিক্রি করছিল চোখের রকমারি সামগ্রী। তার সামনে সাজিয়ে রাখা ছিলো এক চোখ ঢাকবার মতো গ্লাস, তারের তৈরি অদ্ভুত চশমা, এমনকী কাঁচ দিয়ে বানানো নকল চোখ। কিছু চোখ বড়, কিছু চোখ ছোট এবং প্রায় সবগুলো চোখই নীল। তার থেকে অল্প দূরে এক লোক বিক্রি করছিল দক্ষিণ আমেরিকার কিম্ভূতকিমাকার আম এবং বিশাল, ফোলাফাঁপা অ্যাভোকাডো। তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে এক ফেরিওয়ালা বিক্রি করছিল দৈত্যাকৃতির জামাকাপড়। তার পাশেই কেউ একজন বিক্রি করছিলো বাচ্চাদের জুতো।

সে এগিয়ে গেল তাদের দিকে। কাঁচের তৈরি একটা নকল চোখ কিনে নিয়ে সে গল্প জুড়ে দিলো নকল দাঁত বিক্রেতার সঙ্গে।

“নাম কি তোমার ভাই?”

“জোয়ি।”

“কতদিন আছো এখানে?”

“এই তো, আজকের দিনটাই।”

“না না, মানে বলছি এ জায়গায় কতদিন ধরে ব্যবসা করছো?”

“ওহ, মাস দুয়েক।”

“বিক্রিবাট্টা ভালোই?”

“চলে যাচ্ছে।”

“আমি কিছু জিনিস বিক্রি করতে চাই এখানে, তোমাদের এই বাজারে।”

“তাই? কী জিনিস?”

“আবর্জনা।”

“আবর্জনা, সত্যি সত্যি আবর্জনা?”

“সত্যি সত্যি আবর্জনা।”

“এই নাথান, এদিকে এসো, এই লোকটা নাকি আবর্জনা বিক্রি করে।”

নাথান এলো। সে বাচ্চাদের জুতো বিক্রি করছিলো। 

“তুমি আবর্জনা বিক্রি করো?”

“হ্যাঁ। তুমি বাচ্চাদের জুতো খুঁজে পাও কোথায়?”

“ময়লার বিনে। আর তুমি আবর্জনা জোগাড় করো কোথা থেকে?”

“কোথায় আর, রাস্তায়।”

“বেশ বেশ। আবর্জনা জোগাড় করতে চুরি ডাকাতি করার প্রয়োজন পড়ে না, তাই না?”

“তাই।”

“ঠিক আছে, এসো তুমি। আমাদের পাশে বসে বিক্রি কর তোমার মালামাল।” নকল দাঁত বিক্রেতা জোয়ি বলল।

“আসব?”

“এসো, এক সপ্তাহ পর পর প্রতি রবিবার। নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বসে যাবে। যে যার মতো ব্যবসা করব। তুমি তোমার ধান্দা করবে, আর আমরা আমাদের ধান্দা করব। এই তো।”

“ব্যস এই?”

“এই তো নিয়ম।”

“ভাই, তোমাদের নিয়ম সত্যি জোশ। আমি আসছি তাহলে।”

“অপেক্ষা করব তোমার আবর্জনা দেখার জন্য।”

তারপর টানা তিনমাস, এক সপ্তাহ পর পর প্রতি রবিবার গিয়ে লোকটা হাজিরা দিতে থাকল বাজারে। বেচা বিক্রি প্রায় কিছুই করতো না। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্রেফ ঐ কিম্ভূতকিমাকার মালামালের বেসাতি নিয়ে বসা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করা। তার পরনে থাকত একটা ময়লা কোট, গলায় বিশেষ ধরনের টাই, পায়ে একজোড়া দোমড়ানো-মোচড়ানো পুরনো জুতো। তাকে দেখে মনে হতো অর্ধেক যাযাবর ভিখিরি, বাকি অর্ধেক জ্যাজ সঙ্গীতশল্পী। অন্য সব বিক্রেতা আন্দাজ অনুপাতে আবিস্কার করতো তাকে। এভাবে ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো ঐ ব্যবসায়ীদের রুঢ় রসিকতায়, জীবনযাপন পদ্ধতিতে। আর তারাও অভ্যস্ত হয়ে উঠলো তার পরিশীলিত আলাপে, চাতুর্যপূর্ণ রসিকতায়।

“এই, তুমি ময়লা বিক্রি শুরু করবে কবে?” নকল দাঁতের বিক্রেতা জিজ্ঞেস করলো তাকে।

“আবহাওয়া একটু সদয় হোক।”

“তুষারঝড় ধেয়ে আসছে, শীঘ্রই। তোমার উচিৎ এখনই ময়লা কুড়াতে বেরিয়ে পড়া। নইলে পরে আর কিছু খুঁজে পাবে না। জানোই তো, তুষারঝড় একবার শুরু হয়ে গেলে পুরো শহর কীভাবে তুষারের নিচে চাপা পড়ে।”

“ময়লাওয়ালা নিশ্চয়ই সঠিক ধরনের আবর্জনার অপেক্ষায় আছে, তাই না?” বাচ্চাদের জুতো বিক্রেতা বলে। “নিশ্চয়ই কাজটা খুব কঠিন।”

সব বিক্রেতা একযোগে হেসে ওঠে। তার ঠোঁটের কোণে দেখা যায় এক চিলতে বিদ্রূপ মেশানো হাসি।

“সঠিক প্রজাতির আবর্জনা খুঁজে বের করা পৃথিবীর অন্যতম কঠিন কাজ। এমনকী স্বর্ণ খুঁজে বের করার চেয়েও কাজটা জটিল।”

“আসলে কতোটা কঠিন তোমার এ কাজ?”

“সঠিক আবর্জনা খুঁজে পেতে হলে দেখবার মতো সঠিক চোখ লাগে। আর সেই চোখ সবার থাকে না।”

“অবশ্যই, অবশ্যই,” বাচ্চাদের জুতো বিক্রেতা বলে ওঠে। তার সম্মতিজ্ঞাপনের ভঙ্গিতে সবাই একসঙ্গে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে।

পরবর্তী বাজার বসবার ঠিক দুদিন আগে পুরো শহরকে তুষারের ভারী চাদর আদ্যোপান্ত মুড়িয়ে নেয়। শহরের মাঠঘাট, পথপ্রান্তর, উঁচু দালান, বাড়ি, গাড়ি, ল্যাম্পপোস্ট—সবই তলিয়ে যায় বরফের নীচে। বাসায় বসে সে দেখল সেই তুষারপাত। তারপর বাইরে বেরিয়ে পড়ল হাঁটতে। হাঁটতে হাঁটতে আবিস্কার করলো, তার পরিচিত শহর তুষারশুভ্র জাদুমন্ত্রের কবলে জড়িয়ে পড়েছে আষ্টে-পিষ্টে। বরফের রং কালো হলে কেমন হতো? সে ভাবলো। তাহলে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটনা হতো। তখন তুষারপাত দেখে মনে হতো আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো রাত্রি ঝরে পড়ছে। ঘরবাড়ি, গাছপালা, রাস্তা, রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি—সবকিছু ছেয়ে যেত কালো রঙে। এমন পরিস্থিতিতে সবাই গান গেয়ে অশুভ বড়দিন উদযাপন করতো। জমে থাকা তুষার দিয়ে অশুভ বরফমানব তৈরি করতো। পুরো ব্যাপারটা জন্ম দিতো নতুন এক পৌরাণিক বাস্তবতার। এ সমস্ত ভাবনাচিন্তা মাথার ভেতর নাড়াচাড়া করতে করতে সে হেঁটে বেড়ায় রাস্তা ধরে। সড়কের পাশে হাঁটার রাস্তা বরফের চাদরের নিচে ঢাকা পড়েছিলো। এভাবে মুড়িয়ে রাখার মাধ্যমেই শীত আমাদের উষ্ণ রাখে। অদূরে এক মাঠে শিশুরা একে অপরকে বরফের তৈরি বল ছুড়ে মারছিল। হাতের মুঠোর সমান এক বরফের বল ওদের নিশানা ছুটে গিয়ে আঘাত করলো তার বুকে। এ ঘটনায় বাচ্চারা ভয় পেয়ে ছুটে পালাল যে যেদিকে পারে। হাসতে হাসতে ছুটতে থাকা বাচ্চাগুলোর কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছিলো পেছন থেকে। হয়তো ওরা ধরে নিয়েছিল যে, সে তাড়া করছে তাদের। সে বরং ঝুঁকে পড়ে তুলে নিলো বরফের ভাঙ্গা বলটা, ওটাকে ঠিকঠাক করে আগের আকৃতিতে ফিরিয়ে এনে সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে এলো। তখনো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল নতুন চিন্তা।বিস্মৃতিময় বরফে পৃথিবী মুড়ে ফেলা।

বাসায় ফিরে সে দু-জায়গায় ফোন করলো। যারা ওপাশ থেকে তার ফোন ধরলো, তারা ফোনে তার দিকনির্দেশনা শুনে মোটামুটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। প্রথমজনকে সে বললো ক্যামেরা সঙ্গে করে একটা নির্দিষ্ট দিনে এক নির্দিষ্ট জায়গায় এসে হাজির হতে।

“এমনভাবে এসে আমার সঙ্গে আলাপ শুরু করবে না, যাতে করে মনে হয় তুমি আমাকে আগে থেকে চেনো। ভিড়ের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব মিশে থেকে স্রেফ ছবি তুলবে। আর দোহাই লাগে, দয়া করে ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলোর ফটোগ্রাফারদের মতো আচরণ করবে না। ভাব ধরবে যে রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলে, এমন সময় হঠাৎ করেই ঘটনাটা চোখে পড়েছে, আর ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে তুমি ছবি তোলা শুরু করেছ।”

“এটাই কাজ?” প্রশ্ন এলো অপর পাশ থেকে।

“এটাই।”

“মূল ব্যাপারটা কী?”

“এতো বিস্তারিত মনে হয় না তোমার জানার প্রয়োজন আছে। একদম কিছুই না জানলে আরো ভালো। ওখানে শুধু সময় মতো উপস্থিত থাকবে, ব্যস।”

অপরজনকে সে ফোনে বললো:

“ঐ দিন হাতে সময় হবে তোমার?”

“তা হবে, তবে ঘটনা কী?”

“তেমন কিছু না, স্রেফ চলে আসবে। ভাব দেখাবে যেন আমাকে আদৌ চেনো না। হয়তো কিছু কিনবে। তারপর আশেপাশে আরো কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে চলে যাবে।”

“নতুন কোনো জাদু দেখাচ্ছ নাকি?”

“ঐরকমই।”

“এসব উল্টোপাল্টা কাজ করতে করতে একদিন বড় ধরনের বিপদে পড়বে।”

“জীবনে কোনো বিপদ না থাকলে বেঁচে থাকায় স্বাদ থাকে?”

তারা দুজনেই হেসে উঠলো। তারপর সে ফোন নামিয়ে রাখলো এবং উঠে গিয়ে বসলো জানালার পাশে। চেয়ে চেয়ে দেখলো আকাশ থেকে তুষার ঝরে পড়ার দৃশ্য। ঝরে পড়া তুষারদের মধ্য থেকে সে একটা বরফ কণাকে আলাদা করে সেটার পতন্মুখ বা নিচে ঝরে পড়ার রাস্তা আবিষ্কারের চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ। ঝরে পড়া বরফের স্তূপগুলোর কোনো কোনোটা ধারণ করেছিলো ষ্টেশনারি গাড়ির আকৃতি, কোনো কোনোটা রাস্তার ওপর পড়েছিলো দৈত্যাকার টুপির মতো। এই যে বরফ, যা শুয়ে আছে রাস্তার ওপর সমস্ত বৈপরীত্যকে নিজের মধ্যে ধারণ করে, এটা আসলে কী? যা কিছুর আঙ্গিক ধারণ করেছে সে, তার মধ্যে সে আসলে এটা, না ওটা? কোনটা? তার রং সাদা কেন? আকাশের ভুলে? তিমি মাছের মতো সাদা রং বরফের। একরত্তি তুষারকণার দাম কতো হওয়া উচিৎ? যদি প্রকৃতি নিজের উদ্যোগে বরফ বিক্রি করা আরম্ভ করতো, পুরো শহর বরফাচ্ছাদিত করে ফেলতে কতো খরচ হতো? ঐ যে গির্জার উঁচু-চূড়াটা, ওটাকে বরফে মুড়ে দূর থেকে দেখতে একটা বিয়ের গাউনের মতো করে তুলতে, অথবা স্ট্যাচু অফ লিবার্টির মাথাটাকে একটা সাদা গাউনে পরিণত করতে কতো টাকা গোনা লাগতো? যদি এক গ্রাম স্বর্ণ আর এক গ্রাম বরফ একই মূল্যে বিক্রি হতো, তবে? সস্তা, বিনে পয়সার বরফের যুগ চলে গেছে—বলত সবাই। বরফ নিয়ে কোনো স্মৃতিই নেই, এমন কেউ কী আছে? দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এক জিনিস এটা। একদম নিঃশব্দে পুরো শহরকে দখল করে নেয়। শিশুদের তৈরি সে বরফ মানবের কথা হচ্ছে না—যা গলে নিঃশেষ হওয়ার আগে কুৎসিত, কদাকার হয়ে যায়। গির্জার চূড়ায় কিংবা ঝুলন্ত তারের শরীরের থোকা থোকা বরফও নয়। বরং এ তুষার সেই তুষার—দীর্ঘ এক রাতের শেষে, সকালবেলা, নিজের বাড়ির সদর দরজা খুলে এক পা বাইরে রাখা মাত্রই চারপাশে উপস্থিতি মানুষের চিত্তকে উৎফুল্ল করে তোলে। যে তুষারপাত আমাদের চারপাশের পরিচিত জগতকে এক নিষ্পাপ শিশুর আকাঙ্খিত স্বর্গে পরিণত করে।

এমন কোনো জিনিসের দাম ঠিক করা যায় না। যে বস্তু আকাশের একটা টুকরো, তার কি দাম হয়? একবার গলে মিশে গেলে তা উধাও হয়ে গেল চিরদিনের জন্য, যেন স্মৃতির মতোই ক্ষণস্থায়ী, সৌন্দর্যের মতোই ভঙ্গুর, নিজের মাঝামাঝি চেহারা ত্যাগ করে ফিরে গেল মৌলিক অবস্থায়। শিল্প হিসেবেও সে অমূল্য। আর্ট গ্যালারিতে অথবা জাদুঘরে শিল্পকর্ম হিসেবে তাকে প্রদর্শন করাটা কোনো অর্থের দ্যোতনা তৈরি করে না। এভাবেই শিল্পকর্ম তৈরি হয় আর শিল্পকর্মের অর্থমূল্য নির্ধারণের যে সামগ্রিক ভন্ডামি—তার মুখোশ উন্মোচন করে। এক বিন্দু তুষার, এক রেণু শীতকাল, এক টুকরো ক্ষণস্থায়ীত্ব। একটা অণুর মাঝে বিদ্যমান পৃথিবীর সমস্ত জটিলতা—অর্থ, বাণিজ্য, শ্রেণী, জাত, নকশা, আধ্যাত্মিকতা, ভঙ্গুরতা, নমনীয়তা, শৈশব, প্রকৃতি, বিস্ময়—সবকিছু। পুরোপুরি বরফ নয়, আবার পুরোপুরি পানিও নয়। আংশিক বাতাস, আংশিক স্বপ্ন। ভাব-জগতের বস্তু। কালো মানুষের সন্তানদের উপরেও নির্বিচারে বিলি করে নিজের সৌন্দর্য। সংজ্ঞাতীত এক সুখ, যার নিচে চাপা পড়ে যায় মানবতার নির্মমতার সমস্ত ইতিহাস। তুষারপাত সমস্ত বিচ্ছিন্ন মানুষের আত্মাদের এক করে। এই বিচ্ছিনতাবাদী প্রজাতন্ত্রের সম্ভবত একমাত্র গণতান্ত্রিক বস্তু সে। জীবন, মুক্তি, পরিপূর্ণতা—সব মিলিয়ে, এই তো তুষার।

সে জানালার পাশ থেকে সরে আসে।

“আমি আমার পরবর্তী পরিকল্পনা খুঁজে পেয়েছি,” শোবার ঘরে এসে সে তার স্ত্রীকে বললো।

“তাই? কী সেটা?”

“ব্যাপারটা ঘটবে, অথচ কেউ দেখতে পাবে না। ঘটনাটার সংবাদ ছড়িয়ে পড়বে জনশ্রুতি হিসেবে। অল্পস্বল্প প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে এখানে-ওখানে। কোনো আর্টগ্যালারীর মালিক, কিউরেটর, অথবা জাদুঘরের পরিচালক ঘটনাটির ধারে কাছেও উপস্থিত থাকবে না। থাকবে কেবল শিশু, পথচারী, গরীব মানুষজন, একদম সাধারণ জনগোষ্ঠী—যারা শিল্পকর্ম ঘুরে ফিরে দেখেও না, পাত্তাও দেয় না। এটা হবে দেশের সবচে গণতান্ত্রিক একটা প্রদর্শনী। একটা সেতুর নিচে প্রদর্শনীটা হবে, যেখানে মাদক ব্যবসায়ী, আবর্জনা কুড়ানো লোকজন ঘুরে ফিরে বেড়ায়। সব কিছু ঘটবে তাদের চোখের সামনেই, কিন্তু তারা উপলব্ধি করবে না যে, তারা সেটা দেখছে। কারণ পুরো ব্যাপারটা এতো সহজ আর সাধারণ হবে যে, তা চোখের সামনে দৃশ্যমান অন্য যেকোনো ঘটনার মতোই লাগবে, অল্পকিছু খুঁটিনাটি ব্যতিক্রম ছাড়া। তারপর সেটা এমনভাবে শেষ হবে, যেনো ঘটনাটা ঘটেনি কখনো।

পরবর্তীতে সেখানকার প্রকৃত উপস্থিতির চেয়েও আরও ২০ গুণ বেশী মানুষ দাবী করবে যে, ঐসময় সেখানে তারা আদতে ছিল এবং নিজেদের চোখে দেখেছে পুরো ঘটনা। আদৌ এভাবে কখনো ঘটেছে কিনা—এ নিয়েই সন্দেহ থাকা ঘটনা পরিণত হবে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো এক ঘটনায়। তারপর উত্তরোত্তর তার গুরুত্ব বেড়েই চলবে। ঘটনাটা বাতাসে মিলিয়ে যাবে একসময় এবং মিলিয়ে যাওয়ার পর হয় এটা পরিণত হবে এক পুরাণকথায়, অথবা মিলিয়ে যাবে নিঃসীম শূন্যে। বছরের পর বছর কেটে যাবে, সবকিছু পুরনো হতে থাকবে, কিন্তু এই ঘটনাটি, যা হয়তো ঘটেছে অথবা ঘটেনি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হবে আরো বাস্তব এবং আরো বিশ্বাস অযোগ্য এক বিষয়ে।

আমি সবসময় এমন একটা কিছু করতে চেয়েছি, যা সময়ের সমান্তরালে সমান গুরুত্বে প্রবাহিত হয়ে চলবে। এবার মনে হচ্ছে যে, আমি সেই পথ খুঁজে পেয়েছি। হয় এটা পরিণত হবে পাশার সবচে বড় দানে, অথবা মিলিয়ে যাবে শূন্যে। তুমি যা কিছুতেই এটাকে পরিণত করতে চাও, এটা পরিণত হবে তাতেই। তবুও কারো পক্ষে সম্ভব হবে না একে সরাসরি চিহ্নিত করা। কাজটা হবে তুষারকণার মতো ক্ষণস্থায়ী, স্বপ্নের মতো স্থায়িত্বসম্পন্ন, এবং পাথরের দেয়ালের মতো নিরেট।

তার স্ত্রী বেডরুম থেকে মাথা বের করে তাকালো।

“এ সবকিছু তুমি করবে কীভাবে?”

সে কোনো উত্তর দিল না, কারণ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল কালো সড়কে নৃত্যরত তুষারকণাদের ওপর।

কিছুদিন পর, এক শীতল রবিবারে, যখন তুষারপাত বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, মানুষজন ব্রিজের নিচের বাজারের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এমন একটা ঘটনা দেখলো, যা তারা আগে কখনো দেখেনি। নকল দাঁতের বিক্রেতা, বাচ্চাদের জুতো, কিংবা দৈত্যাকৃতির কাপড়ের বিক্রেতাকে তো তারা আগেই দেখেছে। কিন্তু দোকানের ভেতর লাল, কমলা ও নীল রঙে রঙিন এক মরোক্কান চাদরের ওপর তুষার নির্মিত বল নিয়ে কারো বসে থাকার ঘটনাটি ছিলো তাদের জন্য একেবারেই নতুন। সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা বলগুলোর মধ্যে সাইজে একদম ছোতো বলগুলো ছিল সবার নিচে, এভাবে পর্যায়ক্রমে উপরে উঠতে উঠতে সবচে বড় বলগুলো রাখা হয়েছিল সবার উপরে। সবচেয়ে ছোটো বলগুলো ছিলো ডিমের আকারের। তবে তাদের রঙ ছিলো ধবধবে সাদা, আর আকার ছিলো একদম নিখুঁত গোলাকার। মরক্কোর চাদরের নকশার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এমন, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক নকশা সেই বরফের বলগুলো নিজেরাই তৈরি করে ফেলেছিলো। আর দোকানের পেছনে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল গাঢ় বাদামি বর্ণের জ্যাকেট, কালো ট্রাউজার, কেতাদুরুস্ত নেকটাই এবং রিমলেস কালো হ্যাট পরিহিত এক লোক। লোকটির দৃষ্টি ছিল সাজানো জিনিসপত্রের ওপর। প্রথম দৃষ্টিতে দেখলে তাকে মনে হবে একজন ভবঘুরে। তবে দ্বিতীয়বার তার দিকে আর একটু অতিরিক্ত মনোযোগসহ তাকালে তার পুরো পোশাকে একধরনের লুকোনো সচেতনতার আভাস চোখে পড়ে। সে কথা বলছিলো নকল দাঁতের ব্যবসায়ীর সে। দুজনেই মৃদু হাসছিলো, হয়তো কোনো রসিকতার শেষে।

সামনে দিয়ে অনেক মানুষজনই হেঁটে যায়। কিন্তু তাদের কেউই পুরোপুরি বুঝতে পারছিলো না যে, তাদের চোখের সামনে আসলে এটা কিসের প্রদর্শনী। যারা দেখছে, তাদের অনেকে তো এটাই নিশ্চিত হতে পারছিলো না যে, যা তাদের চোখে ধরা পড়ছে তা তারা আদৌ দেখছে কী না। এই লোকগুলোই পুনরায় আর একবার ঘুরেফিরে দেখছিল পুরো ব্যাপারটা। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘ্যাশ ঘ্যাশ করে তাদের মাথা চুলকাচ্ছিল। হুইস্কির বোতল হাতে একজন লোক এসে প্রদর্শনীটা দেখে দাঁড়িয়ে যায়।

“কী ভাই, এসব বিক্রি করছো?”

“এছাড়া আমার এখানে দাঁড়িয়ে থাকার আর কী কারণ হতে পারে?”

“কিন্তু বরফের এসমস্ত বল, এগুলো তো আমি নিজেই বানাতে পারি,” হুইস্কির বোতল হাতে লোকটা বললো।

“আপনার তাই ধারণা?”

হুইস্কির বোতল হাতে লোকটা কয়েকবার চোখ পিটপিট করে তাকালো, আবার সেই সারিবদ্ধ বরফের বলের দিকে, যেন সে যা দেখছে চোখে তা পুরোপুরি দেখছে না। তারপর সে অবিন্যস্ত পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায় সামনে। নকল দাঁতের দোকানের সামনে থমকে দাঁড়ালো কিছুক্ষণের জন্য। সেখান থেকে সে একপাটি দাঁত কিনে। তারপর সে মাঝিদের দাঁড় বাওয়ার গান গাইতে গাইতে মিলিয়ে গেল দূরে।

এক মুহূর্তের মধ্যেই আরো একজন লোক এলো। বরফের বলের সারি দেখে সে হেসে উঠলো বেমাক্কা।

“এই পাগলামো শুধু আমেরিকাতেই সম্ভব,” হাসতে হাসতে বিষম খাওয়ার ফাঁকে সে বললো। “তুমি সত্যি সত্যিই বিক্রি করছো এসব?”

“সত্যি সত্যিই এসব বিক্রি করছি।”

“কত করে?”

বলের আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়ে, জানালো সে। সবচে ছোটগুলোর দাম ৫০ সেন্ট। সবচে বড়গুলো এক ডলার।

“একটা বরফের বলের দাম এক ডলার?”

“সস্তাতেই ছাড়ছি।”

লোকটি একবার তাকালো সেই নিখুঁত সাদা বরফের বলগুলোর দিকে, তারপর তাকাল সেই ব্যবসায়ীর দিকে, তারপর আরো একবার তাকালো সাজিয়ে রাখা সেই বলের দিকে। ধবধবে সাদা বরফের বল, আর তার বিক্রেতার কথার অস্পষ্টতার মাঝে এক গভীর অমিল আছে কোথাও, সে বুঝতে পারছিলো, কিন্তু সে ঠিকঠাক ধরতে পারছিল না ব্যাপারটা কী।

“তুমি আসলে কে ভাই? জাদুটাদু দেখাও নাকি?”

“পেট চালাতে হলে কিছু একটা করাই লাগে।”

সেই সম্ভাব্য ক্রেতা হেসে উঠল আবার। তার পক্ষে হাসি থামানো সম্ভব হচ্ছিল না। পুরো প্রদর্শনীটাই তার হাস্যকর লাগছিলো, কিন্তু সে বলতে পারছিলো না কেন। ব্রিজের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যবসায়ী তাকে পর্যবেক্ষণ করছিলো।”

“এ আমার জীবনে দেখা সেরা বুরবাকি। যদি এগুলোর একটা কিনি আমি, তবে তা কী বাতাসে উবে যাবে, বা আসলে ঘটবে কী?”

“পকেটের পয়সা খরচ করে কিনে দেখতে হবে ব্যাপারটা,” ব্যবসায়ী বললো।

ক্রেতা লোকটি কোর জন্য মন স্থির করতে পারা—না পারার মাঝামাঝি এক ঝুলন্ত অবস্থায় রইলো।

“ধোঁকা দিচ্ছ মানুষজনকে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, নাকি? আর কেউ কিনেছে তোমার এই বস্তু?”

“ভালো বেচাকেনা হচ্ছে,” জবাবে সে বললো।

“আমাকে একটা বরফের বল কিনে দাও, মা,” পাশ থেকে এক বালক চেঁচিয়ে উঠলো।

“অবশ্যই বাবা, আগে দেখি ভদ্রলোক এগুলো বিক্রি করার জন্য সাজিয়ে রেখেছেন কিনা,” বাচ্চাটার মা বললো।

তিনি তার বাচ্চাকে বহন করা বেবি ওয়াক ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়ালেন সেই ফেরিওয়ালার সামনে, তাকালেন তার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে।

“দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে আপনার,” দোকানের ভেতরে দাঁড়িয়ে বললো সে, উষ্ণ হাসির পরশ ছড়িয়ে দিয়ে।

“আরে, এ তো ম্যাজিক!” ছোট্ট ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠলো। “আমি নেবো একটা। মা, দাও না একটা আমায় কিনে!”

“আপনি এই তুষারের বলগুলো বিক্রি করছেন?”

“এ জন্যই তো দাঁড়িয়ে আছি এখানে।”

“আপনি নিজে বানিয়েছেন এসব?”

“খোদার সৃষ্টি, খোদাই তৈরি করেছেন এসব। আমি কেবল এ আকৃতিতে এনে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রেখেছি।”

“খুব সুন্দর। এতো সুন্দর তুষারের তৈরি বল আগে দেখিনি কখনো।”

“দাও না একটা কিনে আমাকে, মা।”

ফেরিওয়ালা এগিয়ে এলো। চার চাকার বেবি ওয়াকের ভেতরে সম্রাটের কায়দায় বসে থাকা শিশুটির দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞেস করলো:

“কোনটা নেবে তুমি?”

“ছোট একটা। ঐ যে ওটা,” বালকটি তার আঙ্গুল তুলে সবচেয়ে নীচের সারির পাখির ডিমের মতো ছোট ছোট বলের দিকে ইশারা করল। লোকটি এগিয়ে গিয়ে বালকটির চিহ্নিত ছোট তুষারের বলটির পাশাপাশি ওপর থেকে বড়সড় সাইজের একটা বল তুলে এনে তার হাতে দিতেই সে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে কোথা থেকে যেন ক্যামেরার শাটারে চাপ পড়ার শব্দ ভেসে এলো।

“এগুলো সত্যি সত্যি তুষারের বল, মা! সত্যিকারের তুষারের বল!”

“কত দিতে হবে আমার, সব মিলিয়ে?” বালকের মা প্রশ্ন করেন।

“দাম দিতে হবে না। উপহার এগুলো আপনার ছেলের জন্য।”

“আহ, আপনি দেখছি আসলেই খুব নরম হৃদয়ের মানুষ!”

“এভাবে বলবেন না। আমি নিশ্চিত, আমার সন্তানের সঙ্গেও আপনি একইরকম আচরণ করতেন।”

ভদ্রমহিলা এ কথা শুনে বাকরুদ্ধ এবং লাজ রাঙা হয়ে গেলেন। তিনি বেবি ওয়াকের চাকা ঘুরিয়ে উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেন। তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে ফিরে এসে দাঁড়ালেন সেই স্টলের সামনে। অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন তুষারের বলগুলোর দিকে। ঠিক তখনই আবারো ক্যামেরার শাটারে চাপ পড়ার আওয়াজ ভেসে এলো।

“এতো সুন্দর জিনিস সচরাচর দেখা যায় না, আর তাদের সারি সারি করে সাজানোটাও দারুণ মজাদার হয়েছে। আমার দিনটাই সুন্দর করে দিলো আপনার এ প্রদর্শনী।”

লোকটা মাথা নেড়ে অভিবাদন জানাল তাকে। জোয়ি তুষারের বলের স্টলের আশেপাশে কৌতূহলী মানুষের ভিড় দেখে এগিয়ে আসে।

“ম্যাডাম, আপনাকে আমি নতুন একপাটি দাঁত দেখাই?”

তুষারশুভ্র বল থেকে তার চিন্তাকে হুট করে নকল দাঁতের পাটিতে স্থানান্তর করাটা ভদ্রমহিলার জন্য একটু বেশীই শক্ত হয়ে যায়। তিনি পুনরায় ফিরে যান তার পথে। হাঁটতে হাঁটতে বারবার পিছনে ফিরে তাকান নকশাদার চাদরের ওপর সুসজ্জিত সারিবদ্ধ বরফের বলের দিকে।

এভাবে প্রচুর সংখ্যক মানুষ রহস্যময় এবং সুসজ্জিত সেসব তুষারের বল দেখে আকৃষ্ট হলো। কেউ এগিয়ে এসে উপহাস করল বিক্রেতাকে, কেউ এসে তুষার বিক্রেতাকে নিয়ে হাসাহাসি করে নিজের রগড় করার সক্ষমতাকে পরীক্ষা করে দেখতে চাইলো, কেউ এলো পুঁজিবাদের গুষ্টি উদ্ধার করতে। তাদের মধ্যে একজন তো সাদা রঙের এমন নিখুঁত এক সারি বল দেখে তার হাসিই আটকাতে পারছিলো না। সে প্রথমে অগ্রসর হয়েছিলো বলগুলোর মূল্য জানতে, কিন্তু সব দেখেশুনে তার এমনই হাসি পেল যে, হাসতে হাসতে তার দমবন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার অবস্থা তৈরি হলো। ব্যবসায়ীকে স্টলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে তাকে দমবন্ধ এবং মরো মরো অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনলো স্বাভাবিক অবস্থায়। সে যখন হাসছিলো তখন দেখা যায় যে, তার অপর পাটিতে কোনো দাঁত নেই। নকল দাঁত বিক্রেতা এগিয়ে এসে তাকে নামমাত্র মূল্যে একপাটি দাঁত বিক্রি করলো। লোকটা একটু দূরে দাঁড়িয়েও ক্রমাগত হেসেই চললো এবং স্বপ্ন খুঁজে বের করার গুরুত্ব নিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকলো।

কিছুক্ষণ পর আর একজন দর্শক এসে হাজির হলো। পেশাগতভাবে সে ছিলো শহরের উত্তরাংশে বসবাসকারী এক আইনজীবী এবং শহরের এ পাশে এসে হাজির হয়েছে কোনো এক কনফারেন্সে অংশ নিতে। সে ঘোরঘুরি করে দেখতে বেরিয়েছিল এ শহর। তার পা তাকে টানতে টানতে এখানে নিয়ে এসেছে। সে এই তুষারের বলের প্রদর্শনীকে গ্রহণ করেছিলো খুব গুরুত্বসহকারে। মাঝারি মাপের একটা বল হাতে নিয়ে সে ভীষণ দরদাম শুরু করে দেয়। তার ইচ্ছে ছিলো শিশুপুত্রের জন্য জিনিসটা বাড়িতে নিয়ে যাবে, যে নিঃসন্দেহে এই উপহার পছন্দ করবে। তার একমাত্র দুশ্চিন্তা ছিলো, বাড়ি ফিরতে ফিরতে বরফ নির্মিত এ বল টিকবে কিনা।

“হোটেলে ফিরে গিয়েই জিনিসটা একটা রেফ্রিজারেটরে ঢুকিয়ে রাখবেন। খুব টাইটফিট করে এদেরকে প্যাক করে রাখা আছে, কাজেই একে নিয়ে ধুধু মরুভূমির উষ্ণতায় হেঁটে না বেড়ালে হুট করে তা গলে যাওয়ার কারণ নেই,” তুষারের বল বিক্রেতা বললো।

এই অদ্ভুত কেনাকাটায় উক্ত আইনজীবীকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছিলো। সে খুব আগ্রহ সহকারে পকেট থেকে তার মানিব্যাগ বের করলো।

“জানতাম যে, এ শহরের রাস্তাঘাটে সব কিম্ভূতকিমাকার জিনিসপত্রের দেখা মেলে; কিন্তু তুমি যা বিক্রি করছ দীর্ঘ সময় ধরে, এতোটা অদ্ভুত বস্তু আমি দেখিনি।”

আর এ পর্যায়ে হঠাৎ করেই ক্যামেরার শাটারে ক্লিক ক্লিক চাপ পড়া আরম্ভ হলো। কেউ সে ফটোগ্রাফারকে খেয়াল করলো না। সে ভিড়ের মধ্যে মিশে দাঁড়িয়েছিলো। যে কেউ তাকে একজন অত্যুৎসাহী পর্যটকই মনে করবে, যে এসেছে সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্য থেকে, যে কিনা এ শহরের আচানক সব কাজকর্ম আর জিনিসপত্র দেখে ভড়কে গেছে।

দাঁত বের করে হাসতে হাসতে আইনজীবী চলে গেলেন নিজের পথে। হাতে তখনো শক্ত করে ধরা সেই প্যাকেটে মুড়িয়ে দেয়া তুষারের বল। সে রঙিলা চাদর ভোজবাজীর মতো ততক্ষণে পুনরায় তুষারশুভ্রতায় আচ্ছাদিত করে নিয়েছে নিজেকে, কিন্তু পিছে ফিরে সেটা দেখবার ফুসরত আর হলো না তার। শীতের কোটে শরীর আবৃত করে, একদম সঠিক মাপের হাতের মোজায় হাত ঢেকে আর গলায় মাফলার জড়িয়ে তরুণীরা এসে হাজির হলো তার দোকানের সামনে। ছোট ছোট তুষারের বলের সারি দেখে তাদের এতো কিউট লাগলো যে, কিছুতেই তারা তাদের হাহা হিহি থামাতেই পারছিলো না। কোথা থেকে এসেছেন আপনারা—বিক্রেতার তরফ থেকে এ প্রশ্ন এলে তারা লাজুক চোখে তাকাচ্ছিল তার দিকে। এভাবে শুরু হওয়া এবং চলতে থাকা সংলাপের ফাঁকফোঁকরে সে প্রায়ই দু-একটি ধারালো কৌতুকমাখা বাক্যবাণ ছুড়ে দিচ্ছিল তাদের দিকে। তবে মেয়েগুলো সেটা ধরতে পারছিলো বলে মনে হয় না। মেয়েগুলো নিজেদের মধ্যে তর্কে লিপ্ত ছিলো—জন্মদিনের উপহার হিসেবে বরফের বলগুলো উপযুক্ত কিনা, কিংবা যে বন্ধুকে তারা উপহার হিসেবে দেবে, হাতে পাওয়ার পর তার চেহারা কেমন হবে, ইত্যাদি বিষয়ে। তারা যখন নিজেদের মধ্যে এ সমস্ত আলাপে ব্যস্ত, তখন এমন এক ব্যক্তি এসে হাজির হলো, তুষারের বল বিক্রেতাকে দেখে যার চোখ বিস্ময়ে কপালে উঠে গেলো। সে অবাক হয়ে প্রায় চেঁচিয়েই উঠতে যাচ্ছিলো, কিন্তু বিক্রেতার চেহারার গাম্ভীর্য তাকে থামিয়ে দেয়।

“ভাই, তোমার খবর কী?”

“সরে যাও এখান থেকে,” তুষারের বল বিক্রেতার গলা হিসহিসিয়ে উঠলো, “অথবা এমন ভঙ্গি করো যে, তুমি আমাকে চেনো না।” 

“ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি বুঝতে পেরেছি ব্যাপারটা,” নবাগত লোকটি বললো, যে নিশ্চিতভাবে বিক্রেতার পূর্ব পরিচিত ছিলো।

কিন্তু সে জায়গাটা আদতে ছেড়ে গেল না। সে আঁচ করলো, সময় এবং ভাগ্যের চক্রে পড়ে সে এমন একটা ঘটনাস্থলে এসে পড়েছে—যা নিয়ে সে একদিন গল্প করতে পারবে তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। ফলে সে ওখানে থেকে যায় এবং আগ্রহ নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা বরফের বলগুলোকে। এমনকী সে সেই হাস্যোজ্জ্বল নারীদের কাছে গিয়ে ম্যাগনিফায়িং কাঁচের তালাশও চালালো। উত্তরে তারা বললো যে, যন্ত্রটি তাদের কাছে নেই। তারপর মেয়েগুলো হিহি করতে করতে চলে গেল তাদের রাস্তায়।

“এটা কোনো জাদুঘর না,” বরফের বল বিক্রেতা বললো। “সরে যাও সামনে থেকে, অথবা আমি এই দোকান বন্ধ করে দেব।”

পুরনো পরিচিত বন্ধুটি থমকে দাঁড়ায়।

“ঠিক আছে, তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও। আমি যাচ্ছি, কিন্তু তার বদলে আমাকে রাতের খাবার খাওয়াতে হবে একদিন।”

“সামনের সপ্তাহে যোগাযোগ করব।”

“অপেক্ষায় থাকব আমি।”

লোকি রাস্তার সরু প্রান্ত ধরে এমনভাবে হেঁটে চললো, যেন তার ওপর কেউ পেছন থেকে চোখ রাখছে। তুষারের বলের বিক্রেতা পেছন থেকে আসলেই তাকিয়েছিল তার যাওয়ার পথের দিকে। উধাও হয়ে যাওয়ার আগে সে ঘুরে তাকিয়ে আধখানা হাত নাড়িয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল। তুষার বিক্রেতা তখন জোয়িকে ডাকলো।

“সময় আছে তোমার?”

“কেন, সব গুছিয়ে বাড়ি চলে যাবে?”

“টেনেটুনে থাকবো আরো আধাঘণ্টা।”

“বরফকে গলিয়ে দেয়ার মতো গরম পড়েছে, অ্যাঁ?” জোয়ি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে তার দুহাতের তালু ঘষে গরম করতে লাগল।

“কখনো ব্যবসার সময় ভুল মানুষজন এসে হাজির হয়ে যায়।”

“ব্যবসা করার এই এক গ্যাঞ্জাম। সেদিন আমার ডিভোর্সি স্ত্রী এসে হাজির হয়। তাকে তার মাসিক খরচার বদলে এক পাটি দাঁত নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিলাম। সে রাজি হয়নি।”

“বেটিকে দোষ দেয়া যায় না।”

“শুধু খোদাপ্রদত্ত নিজের খোমাখানি দেখিয়েই এমন এক ধাক্কা দিলো আমাকে, ভাইরে ভাই, খবরই হয়ে গিয়েছিলো একদম।”

“ব্যবসা করার পক্ষে আসলেই এ এক বড় ঝামেলা।”

“ঠিক বলেছি আমি।”

ইতোমধ্যে দারুণ রূপসী এক তরুণী এসে দাঁড়িয়েছিল তুষারের বলের দোকানের সামনে। মনোযোগ সহকারে সে তাকিয়ে দেখছিলো উজ্জ্বল ঝিকমিকে তুষারবলের সারি। মনে হচ্ছিলো, সে যেন তাতে ডুবে গেছে, হারিয়ে গেছে কোনো দূর রাজ্যের জাদুতে। তার এই আত্মভোলা চেহারায় তাকে আরো নির্ভেজাল সুন্দর লাগছিলো। সে নীরবে দীর্ঘসময় ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। গোপন ক্যামেরার লেন্স ফ্রেমবন্দী করলো তাকেও। তুষারবলের বিক্রেতা তরুণীর আত্মমগ্নতা থেকে বের করে আনলো না। সে নিজেকে তরুণীর চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে থাকে অন্য দিকে। কিছু জিনিস তাদের রঙচং ছাড়া মৌলিক চেহারাতেই নিখুঁত, ভাবলো সে। কখনো একটামাত্র মুহূর্তই পুরো একটা জীবনের নিখুঁত প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হয়। হাতে একহাজার বছর সময় থাকলেও সে মুহূর্তটিকে প্রতিস্থাপন করার মতো ভালো কিছু করা সম্ভব হয় না। ক্যামেরা তার নিজের কাজ করে চললো সঙ্গোপনে। বিক্রেতার চোখ গিয়ে আটকেছিলো শহরের আকাশের প্রান্তসীমায়। উঁচু দালানের চূড়াগুলো ততক্ষণে আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে বরফে। দৃশ্যমান বিবিধ বস্তুর মাঝে বিদ্যমান প্রাচীরগুলো ক্রমশ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো একে অপরের সঙ্গে। বিচ্ছিন্ন সব বস্তুকে একত্র করে দিচ্ছিলো তুষার। আকাশ থেকে ব্যালে নর্তকীর মতো সৌকর্যে, কিন্তু দারুণ নীরবে তুষারপাত হচ্ছিলো তখন। সময় হয়ে এসেছিলো জাদুকরের এই প্রদর্শনীর সমাপ্তি টানবার। যা কিছু দেখানোর ছিল, তা এখন শেষ হয়েছে। প্রকৃত জাদু তখনি শুরু হয়, যখন প্রদর্শনী বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া আরম্ভ করে। যখন সবকিছু মুছে যায়, মিলিয়ে যায় শূন্যে। আকাশ থেকে ঝরে পড়া সাদা তুষার ঢেকে ফেলছিলো পুরো শহরকে, অচেনা করে ফেলছিলো এই চেনা শহরের সমস্ত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সত্যিকারের জাদু তো সেটাই—যখন হারিয়ে যাওয়া বস্তুরা মানুষের স্মরণের পরিধি থেকে অসীম দূরত্বে থাকা বিস্মৃতির জগত থেকে ফিরে আসতে থাকে। আগে মানুষের জ্ঞানে এই তথ্যটা পৌঁছাতে হয় যে এ মুহূর্তে একটা ঘটনা ঘটছে, একটা জিনিস অস্তমান। তারপরেই না তারা অনুভব করতে পারে এ মুহূর্তে অস্তমান জিনিস, অথবা ব্যাপার, কিংবা ঘটনা আর কখনো ঘটবে না। কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে চিরতরে; সময়ের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু মানুষের প্রবাদে, পুরাণে, বা গল্পে ফিরে আসবে বারবার।

“জোয়ি,” সে বলে, “তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ছিলো আমার জন্য বড় এক পাওয়া।”

“তুমি তো দেখছি একদম বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছো আমাকে।”

“বিদায় সম্ভাষণ! ফুটপাথে দাঁড়িয়ে নকল দাঁত বিক্রি করা ফেরিওয়ালা হিসেবে তোমার শব্দভাণ্ডার দারুণ দেখছি।”

জাদুকর তার প্রদর্শনীর সমাপ্তি ঘোষণা করা মাত্র, মন্ত্রমুগ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণী হেসে জিজ্ঞেস করে, তুষার বলের দাম কতো?


(ইংরেজিতে ‘দ্য থার্ড ল অব ম্যাজিক’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি ‘দ্য আটলান্টিক ম্যাগাজিন’-এ ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ প্রকাশিত হয়েছিলো)

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে