প্রথমে ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে খয়েরি লিপিস্টিকটা ঠাস্ নিচে পড়ে গেলো। এরপর আইলাইনারটা।
আমার ঘুম ভেঙে গেল।
রাত বাজে আড়াইটা। কেবলই চোখটা লেগে এসেছে। এমন সময় ঘুম ভেঙে গেলে কার না মেজাজ খারাপ হয়!
জানালা-দরজা বন্ধ, হালকা শীত শীত থাকায় ফ্যানও ছাড়িনি। সুতরাং বাতাসের ধাক্কায় এগুলো পড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।
ঘুমের ঘোরেই কড়া গলায় ধমক দিলাম, “কে? ফাজলামো করা হচ্ছে? চড় মেরে দাঁত ফেলে দেব।”
সব চুপচাপ। হঠাৎ একটা বাচ্চা মেয়ের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। আমার মেজাজ আরো চড়ে গেল।
“এই, কান্না করবে না। একদম কান্না করবে না।”
কান্না থামল। কিন্তু থেকে থেকে একটু পর পর ফোঁপানোর শব্দ আসতে লাগল।
আজকেই এই নতুন বাসাটাতে উঠেছি। জিনিসপত্র টানাটানি করে প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। এক ঘুমে রাত পার।
ঢাকা শহরে একা একটা মেয়ের বাসা ভাড়া পাওয়ার চেয়ে হাতে চাঁদ পাওয়া অনেক সহজ। মাস ছয়েক হলো নতুন চাকরিটাতে ঢুকেছি। বেতনও খারাপ না। দুই চারজন আত্মীয় নামের পিশাচ ছাড়া আমার তিন কূলে কেউ নেই। আর তাই ছাব্বিশ বছর ধরে মনের ভিতরে লালন করা স্বপ্নটাকে সত্যি করতে ইচ্ছা করল—একা একটা বাসা নিয়ে থাকা। অনেক খুঁজে এক রুমের এই বাসাটা পেয়েছি। ছয় তলার এই বাসাটায় বাথরুম-রান্নাঘর ছাড়াও একটা ছোট বারান্দা আছ। আশপাশ খোলা থাকায় প্রচুর আলো-বাতাস। ইচ্ছা আছে বারান্দাটায় একটা বাগান করব।
সকালে উঠতে দেরি হওয়ায় তাড়াহুড়ো করে অফিসে গেলাম। কাজের চাপে সারাদিন দম ফেলার সুযোগ পাইনি। অফিস থেকে বের হতে আটটা পার হয়ে গেল। বাসায় গিয়ে রান্না করতে ইচ্ছা করছিল না। বাসার কাছের একটা হোটেলে ট্যাংরা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে বাসায় ফিরলাম।
গোসল সেরে চুল আচড়ানোর জন্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে চিরুনিটা হাতে নিতেই আমার গতরাতের ঘটনাটা মনে পরে গেল। নিজের অজান্তেই হা হা করে হেসে উঠলাম। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ডেকে উঠলাম “পিচ্চি! কেমন আছিস?”
আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘরের কোনার আলনার পাশ থেকে একটা বাচ্চা মেয়ের অভিমানভরা কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “যাও! তোমার সাথে কথা বলব না! তুমি কালকে আমাকে বকা দিলে কেন?”
আমি বোকার মতো ঘরের মধ্যে এদিক-ওদিক তাকালাম। ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম “ইয়ে, মানে… তুমি কে? আ… আ… আমার ঘরে কীভাবে এলে?”
কণ্ঠস্বরটা উত্তর দিল, “তুমিই তো আমার ঘরে এসে উঠেছ। এই ঘর তো আমার। আমি তো এই ঘরেই থাকি। অনেকদিন থেকেই তো থাকি…।”
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
মনে হয় অতিরিক্ত পরিশ্রমে আমার এ অবস্থা হয়েছে! আমি তাড়াতাড়ি বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।
ঘুমটা কেবলই এসেছে… এমন সময়… আবারো… লিপিস্টিকটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে টুপ করে নিচে মেঝেতে পড়ে গেল। আমি জেগে উঠলাম।
খুব ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করলাম। আমার ঘরে একটা বাচ্চা ভূত আছে! কিন্তু মনে হচ্ছে সে আমার কোনো ক্ষতি করতে চায় না। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিজের সাথে একটা বোঝাপড়া করে নিলাম। থাকলে থাকুক! সে তার মতো থাকবে। আমি আমার মতো। শুধু আমাকে বিরক্ত না করলেই হলো।
আমি ঘুম জড়িত কণ্ঠে বললাম, “কি করছ? শব্দ কর না, আমি ঘুমাচ্ছি। কাল সকালে অফিস আছে।”
ভূতটা উত্তর দিল, “আমি সাজছি। হাত থেকে লিপিস্টিকটা পড়ে গেল।”
আমি ঘুমিয়ে যেতে যেতে বললাম, “শব্দ করো না…।”
ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালাতেই বাচ্চা ভূতটা বলে উঠল, “খালামণি এসেছ? আমি কতক্ষণ ধরে তোমার জন্য বসে আছি?”
আমি একটু থমকে গেলাম। ‘খালামণি!’ ভূতটা আমার সাথে আত্মীয়তা পাতাচ্ছে!
“কেন আমার জন্য অপেক্ষা করে আছ?”
“আজকে আমার জন্মদিন।”
“তাই!”
“হ্যাঁ”
“ও” অমি একটু দুঃখিত গলায় বললাম, “আমি তো জানতাম না। তোমার জন্য কোন গিফটও আনতে পারিনি।”
মেয়েটা উত্তর দিল, “আমি নিজেও জানতাম না। তোমাকে দেখেই মনে হলো।”
“আচ্ছা… তা তোমার বয়স কত হলো?”
“ছয় বছর। আমার সবসময় বয়স ছয় বছরই হয়।”
আমি হাসলাম, “দাঁড়াও, জন্মদিনে তো কিছু একটা গিফট দেয়া উচিত।”
আমি বিছানায় বসে ব্যাগ হাতড়ে একটা ছোট চকোলেটের প্যাকেট পেলাম। সেটা বালিশের ওপর রেখে বললাম, “এই নাও তোমার জন্মদিনের গিফট।”
কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললাম, “এ্যাই মেয়ে… তোমার নামও তো জানিনা… কোথায় গেলে?”
তাও কোনো সাড়াশব্দ নেই।
আমি উঠে কাপড়-তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম গোসল করতে।
গোসল সেরে চুল মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে প্রথমেই আমার চোখ গেলো বালিশের ওপর। সেখানে চকলেটটা নেই। আমি অনেকটা সময় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম।
ছোট্ট নরম তুলতুলে হাতের ছোঁয়ায় আমার ঘুম ভেঙে গেলো। হাতটা আমার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। বাইরে সকাল। সূর্যের মিষ্টি আলোয় আমার ঘর ভরে উঠেছে। জানালার গ্রিলে দুইটা চড়ুই পাখি। সমানে কিচিরমিচির করে যাচ্ছে। মৃদু বাতাসে জানালার পর্দা নড়ছে আর তার সাথে জানালায় ঝোলানো মানিপ্ল্যান্টের লতা বাতাসের তালে তালে মাথা নুইয়ে যেন আমাকে ‘শুভ সকাল’ জানাচ্ছে।
আমার মনটা ভরে উঠল। এর নামই কি সুখ? কোনো রকম দুশ্চিন্তা ছাড়া স্নিগ্ধ একটি সকাল। আমার চোখ ফেটে কান্না বেড়িয়ে এলো। বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে হলো যে, আমার সামনের দিনগুলোও হবে আজ সকালের ঐ সূর্যটার মতোই জ্বলজ্বলে।
মমতা মাখা গলায় একটা বাচ্চাকণ্ঠ জিজ্ঞেস করল, “খালামণি, তুমি কান্না করছ কেন?”
আমি মুচকি হাসলাম “এখন থেকে আমরা অনেক ভালো থাকব। তুই আর আমি। আমরা কখনো মন খারাপ করব না, কাঁদব না। সারাদিন শুধু হাসব আর খেলব। তুই আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যাবি না তো?”
একটা বিড়াল ছানা যেন গুটিশুটি মেরে আমার বুকের কাছে এসে শুয়ে পড়ল। তারপর আমার গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল, “আমি কোথাও যাব না। শুধু তোমার কাছেই থাকব।”
আমি পুতুল ছানাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
পিচ্চি ভূত আর আমি… আমাদের দুজনের সংসার। অফিস শেষে বাসায় এসে আমরা একসাথে রান্না করি। রান্নার সময় সে আমাকে এটা ওটা এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করে। কিন্তু একে তো ছোট মানুষ তার উপরে আবার ভূত, কোনো সময় তার হাত থেকে মসলার কৌটা পড়ে যায়, কোনো সময় সে পানি ফেলে রান্নাঘরের মেঝে ভাসিয়ে ফেলে। মন খারাপ করে সে মৃদু স্বরে আমাকে ‘সরি’ বলে।
সে কিন্তু মোটেও শান্তশিষ্ট বাচ্চা না। অনেক দুষ্টু! মাঝে মাঝে আমি ঘরে ঢুকলে সে দরজার আড়াল থেকে “হো!” বলে চিৎকার করে উঠে আমাকে ভয় দেখায়। যখনই আমি কাপড় গোছাতে বসি, তখনই তার দুষ্টুমি শুরু হয়। দুষ্টুমি করে সব কাপড় এলোমেলো করে দেয়। আমি রাগ করলে সে খিলখিল করে হাসে। তার হাসি শুনে আমিও আর রাগ ধরে রাখতে পারি না। আমিও হা হা করে হেসে উঠি।
কোথা থেকে যেন আমাদের ঘরে একটা বিড়ালের বাচ্চা এসেছে। সাদা-কালোয় মেশানো গায়ের রং। আমরা ওর নাম দিয়েছি ‘মিউঁ মিউঁ’। সেও এখন আমাদের পরিবারের সদস্য। পিচ্চিটা সারাদিন বিড়াল নিয়ে খেলে আর আমি অফিস থেকে ফিরলে সারাদিন বিড়াল কী কী দুষ্টুমি করেছে তার ফিরিস্তি দেয়। আমি দুষ্টুমির জন্য দু-জনকেই বকা দিয়ে শাসন করি।
আমার পিচ্চি ভূত আর আমার বিড়াল, এ দু-জনই পাবদা মাছ খেতে পছন্দ করে। আমি আদর করে কাঁটা বেছে তাদের খাইয়ে দিই। রাতের খাওয়া শেষে আমরা বারান্দায় বসে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করি। মাঝে মাঝে আমি তাদের গান গেয়ে শোনাই। গান শুনতে শুনতে বাচ্চা দুটো আমার কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি দীর্ঘক্ষণ তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকি।
আমরা বাগান করেছি। বারান্দা ভরে ফেলেছি গাছ দিয়ে। শুধু বারান্দা না, ঘরের আনাচে-কানাচে, জানালার গ্রিলে এখন শুধু গাছ আর গাছ। আমার মেয়েটার পছন্দের ফুল হচ্ছে বেলি ফুল। প্রথম যেদিন গাছে ফুল ফুটল, সেদিন যে সে কী খুশি! আনন্দে সারা ঘর নেচে বেড়িয়েছে। বেলি গাছের ফুল দিয়ে আমি তাকে একটা মালা বানিয়ে দিয়েছি। মালাটা সে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সাথে ঝুলিয়ে রেখেছে।
লাজুক চুপচাপ ধরনের ছেলে অমিত। আমাদের অফিসেই চাকরি করে। আমার সমবয়সিই হবে। আমার মতোই অফিসে ওর কোনো বন্ধু নেই। সারাদিন ঘাড় গুঁজে বসে কাজ করে।
শুরুটা হয়েছিল সকালে অফিসে ঢুকে ‘হাই’ ‘হ্যালো’ বলার মাধ্যমে। এরপর মুচকি হেসে কুশল জিজ্ঞেস করা। তারপর একজন আরেকজনের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আসা।
এখন আমরা অফিসের পরে অনেকক্ষণ একসাথে হাঁটি। প্রথম দিকে ছিল একজন আরেকজনকে বাস পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া। আর এখন আমরা অফিস থেকে বেরিয়ে অনেকক্ষণ উদ্দেশ্যহীন হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে অমিত প্রচুর গল্প করে। হাসির গল্প। আমি হাসতে হাসতে বলি, “সারাদিন তো মুখ দিয়ে পাঁচটা কথাও বের হয় না। এখন তো একেবারে কথার ঝুড়ি খুলে বসেছ!” সেও হাসে।
এভাবে একদিন হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই আমার ভেতরে কী জানি কী হয়ে গেল! রাস্তার ভিড়, মানুষের হৈচৈ, গাড়ির শব্দ সবকিছুই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে হলো আমি আর অমিত, এছাড়া এই মুহূর্তে পৃথিবীতে আর কেউ নেই। মানুষটাকে ছুঁয়ে দেখতে খুব ইচ্ছা করল। আমি আলতো করে অমিতের হাত ধরলাম। অমিত চট করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে খুব দ্রুতই চোখ নামিয়ে নিল। এরপর আঙ্গুলের ফাঁকে আমার আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে শক্ত করে হাতটা ধরে থাকল।
আজ ছুটির দিন। অমিতকে বাসায় দাওয়াত করেছি। দুপুরে খেতে আসবে। সকাল থেকেই আমার মনটা ফুরফুরে। নিজেকে মনে হচ্ছে যেন ছোট্ট টুনটুনি পাখি। এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছি। ঘুম থেকে উঠেই রান্নার জোগাড় করতে লেগে পরলাম।
আমার পিচ্চি ভূতটা সব খেয়াল করেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী হয়েছে, খালামণি? তুমি এতো খুশি কেন?”
আমি বললাম, “আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ আজকে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসবে।”
পিচ্চিটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি কি তাকে ভালোবাসো? তাকে বিয়ে করবে?”
আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন, তর হিংসা হচ্ছে?”
সে গম্ভীর গলায় উত্তর দিল, “হুম”
আমি বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বললাম, “শুধু আমি চাইলেই কি বিয়ে হবে? আগে দেখ তর পছন্দ হয় কিনা।”
অমিত আমার জন্য রজনিগন্ধা ফুল নিয়ে এসেছে। আমি ওর পছন্দের খাবার রান্না করেছি। ভাত, বেগুন ভাজি, ছোট মাছের চচ্চড়ি। খেতে খেতে আমরা কত গল্প করলাম! অমিত বড় হয়েছে গ্রামে আর এদিকে আমি কোনোদিন গ্রামে থাকিনি। ওদের ছবির মতো সুন্দর গ্রামটার গল্প শুনতে শুনতে খুব লোভ হলো সেখানে যেতে।
বিকালে আমরা বারান্দায় বসে চা খেলাম। গল্পে গল্পে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমাদের গল্প আর ফুরায় না।
হঠাৎ কানের কাছে আমার পিচ্চি মেয়েটা এসে ফিসফিস করে বলল, “খালামণি, তাকে আমার অনেক ভালো লেগেছে। তুমি তাকে বিয়ে কর।” আমি মুচকি হাসলাম।
অমিত চলে যাবে। আমি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছি। অমিত দরজার ঐ পাড়ে। অমিত বিদায় নিলো। দুই পা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ করে ঘুরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ওর ঠোঁট জোড়া নেমে এলো আমার ঠোঁটে। আলতো করে ও চুমু খেল আমায়।
আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল! শরীরে মধ্যে দিয়ে যেন হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে গেল! আমি কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেলাম।
আমি জানি এরপর কী হবে! আজ থেকে এগারো বছর আগে ঠিক এমনই হয়েছিল! এখন ও আমার ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরবে। আমি মুখের ভেতর রক্তের নোনতা স্বাদ পাব। ওর হাত আমার জামার ভেতরে ঢুকে যাবে। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠে ওর চোখ-মুখ খাঁমচে দেব। ও তখন প্রচণ্ড জোরে আমাকে চড় মারবে। চড় খেয়ে আমি মাটিতে পরে যাব। আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। ও তখন আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে আমাকে ঘরের ভিতর নিয়ে যাবে। আমার পায়জামা টেনে খুলতে চাইবে। আমি বাঁধা দেব। গলার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করতে থাকব। ও তখন ফুটবলে কিক্ করার মতো করে আমার পেটে সজোরে লাথি মারবে। সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে আমি নেতিয়ে পড়ব। ও আমার জামা ছিঁড়ে আমার মুখের ভিতর পুরে দেবে। গোঙানিটুকুও আর আমার গলা দিয়ে বের হবে না। আমার সমস্ত চেতনা তখন অন্ধকার অতলে তলিয়ে যেতে থাকবে। সে অবস্থায়ও আমি অনুভব করবো প্রচণ্ড যন্ত্রণা। জ্বলন্ত কয়লা যেন ঠেসে দেয়া হচ্ছে আমার যোনির ভিতর। আগুনের হলকা আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে যেতে আমি পুরোপুরি জ্ঞান হারাব।
যখন জ্ঞান ফিরবে তখন অনেক রাত। অনুভূতিহীন ভোঁতা শরীর-মন নিয়ে আমি তখন অন্ধকার ঘরে একা পরে আছি।
আমার জমে কাঠ হয়ে যাওয়াতে অমিত ভয় পেয়ে যায়। সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ‘সরি’ বলে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।
কিন্তু সে সব আমি কিছুই দেখিনি। তখন আমার সারা শরীরে কিলবিল করছে একশ গোখরো সাপের বাচ্চা। মুখে রক্তের নোনতা স্বাদ, ফেটে যাওয়া কানের পর্দা, ভেঙে যাওয়া পাঁজর, ক্ষত-বিক্ষত শরীর আর মানুষ হিসেবে আমার অস্তিত্বটুকু গুড়িয়ে দেয়া এগারো বছর আগের সেই দুঃসহ স্মৃতি তখন আমার শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে।
আমার গা গুলাতে লাগল। প্রচণ্ড বমি পেল। পেটের সমস্ত নাড়িভুঁড়ি উল্টে বেড়িয়ে আসতে চাইছে গলা দিয়ে। আমি ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো টলতে টলতে ঘরের ভেতরে গেলাম। চাইলাম বাথরুমে ঢুকে বমি করতে। যেতে পারলাম না। বাথরুমের দরজায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম।
অন্ধকার ঘরে আমার জ্ঞান ফিরল। সেই কোন সুদূর থেকে একটা বাচ্চা মেয়ের কান্নাজড়িত কণ্ঠ আমাকে ডাকছে “খালামণি, খালামণি”।
ভেজা শরীর আর বমিতে মাখামাখি হয়ে আমি উঠে বসলাম। মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল, “ খালামণি, খালামণি…”। আমিও আমার মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদলাম।
ও আর আমি তো একই। আমার বড় মামা আমাকে জানে মারেনি কিন্তু ওর দারোয়ান চাচ্চু ওকে এই বিল্ডিংয়েরই পানির ট্যাংকে চুবিয়ে মেরেছিল।
আমরা দু-জনই তো মৃত মানুষ! আমরা দু-জনই তো ভূত!