তাদের সবাইকে সুখী দেখাচ্ছিল।
শিকারেরা খুশি ছিল, কেননা এখন কোথাও পায়ের চিহ্ন পড়ে না। তারা ঘুরতে পারে নিশ্চিন্তে। চিহ্ন ধরে ধরে কেউ আর তাদের অনুসরণ করতে পারে না।
শিকারিরাও আনন্দিত। এখানে বাতাস নেই, ফলে তাদের গায়ের কটু গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে না। আগে উৎকট গন্ধ পেয়ে শিকার সাবধান হয়ে যেত, তারা আর সে সুযোগ পায় না। শিকার করা অনেক সহজ এখন।
এটা সম্ভব হয়েছে কেননা নালাগুলো এখন কংক্রিটের পথ, ডাল আর কাঁটা বাঁচিয়ে পাতার ফাঁকফোকর গলিয়ে চলা পথগুলো এখন লাল ইটের প্রশস্ত ফুটপাত। দাগ পড়ার উপায় নেই। হালকামতো ছাপ পড়লেও তা কিছুক্ষণের বেশি টেকে না। রোজ সকালে ঝাড়ুদারের ঝাড়ু আর বিশাল গাড়ির গোল পেট হতে বের হওয়া অজগরের মতো পাইপ তীব্র পানির বেগে সব ধুয়ে-মুছে দেয়। কিছুদিন পরপর বদলে যায় ইটগুলো, বদলে যায় তাদের রং আর ডিজাইন। তাছাড়া পথচারীদের লম্বা লাইন তো আছেই। একের চিহ্ন অন্যের পায়ের নিচে ঢাকা পড়তে কতক্ষণ?
গাছগুলো এখন নানা আকারের ঘর-বাড়ি। বড় গাছগুলো অট্টালিকা, মাঝারি গাছগুলো মাঝারি সাইজের দালান আর ছোট ঝোপগুলো এখানে-ওখানে বস্তি।
বাঘ, ভালুক আর হাতিদের গায়ে মেদের পুরু স্তর। তারা জল ভালোবাসে। বনের ডোবাগুলো এখন শীতাতপ যন্ত্র। তারা বড় প্রাসাদগুলোয় থাকে, আর সে যন্ত্রের শীতল আদর গায়ে মাখে।
বনে যারা লাফাত-ঝাপাত, সেই হরিণরা এখনও লাফায়। যাদের আট প্রহরের চাঞ্চল্য, সেই বানরকুল এখনও তেমনি ব্যস্ত। শিকারির ভয় নেই। সবাই নিশ্চিন্তে রাস্তায় কিলবিল করে। অবশ্য এরা জানে প্রাসাদগুলোয় বাঘ-ভালুক থাকে, কিন্তু তারা কীভাবে থাকে তার কিছুই জানে না। তারা আদৌ শিকার করে কিনা, করলে কখন করে, কীভাবে করে, কিছুই না।
আগে মধ্য দুপুরে বা রাতের গভীরে বন ঝিমোত। চাঁদ ডোবার পরে আলকাতরার চাদর এসে চারদিক ঢেকে দিলে সুনসান নীরবতা। এখন সে অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয়। বিজলীর আলোয় বড় বেশি অপাঙ্ক্তেয়। এখানে রাত নেই। রাত নেই তাই দিনও নেই। সকাল-সন্ধ্যায় আলোর সমান সমাহার। তাই সারাক্ষণের হুটোপুটি-লুটোপুটি।
হবেই বা না কেন? সামনে সতত সঞ্চরণশীল শিকারি শ্বাপদ নেই, কে কোথায় দৌড়াচ্ছে তা টুকে রাখবার কেউ নেই, পথে ছাপ পড়ার ভয় নেই। চারপাশ অবাধ ও অনন্ত।
সময়টা সুখের, সময়টা স্বস্তির, সময়টা সমৃদ্ধির।
কদাচিৎ ঢেউ ওঠে। যে-রকম ওঠে সেরকম মিলিয়েও যায়। একইভাবে, কোনো চিহ্ন না রেখে।
আজ যখন রাস্তায় একটা পাগল বিড়বিড় করতে করতে হাঁটছে, প্রায় কেউই তাকে লক্ষযোগ্য ঢেউ ভাবল না। যে দু-একজন তাকাল, তারাও ধরে নিল বিশাল হ্রদে সে একটা ছোট্ট নুড়ি, আলোড়ন তোলার আগেই মিলিয়ে যাবে। কাজেই তাদের চোখও তাকে ছেড়ে গেল।
পাগল হাঁটছে তো হাঁটছেই। মুখ নীচু, ঠোঁট আর জিভে শব্দের অস্পষ্ট ফুলঝুরি।
তার বগলে একটা ব্যাগ। কাঁচা হলুদ রঙের মসৃণ একটা ব্যাগ।
পাশ দিয়ে হন হন করে যাচ্ছিল একজন। ব্যাগটার বের হয়ে থাকা কোণায় সে ধাক্কা খেল। কত্ত বড় সাহস! সামান্য পাগল তার চলার পথে বিঘ্ন ঘটায়। তবে রে— সে হুংকার দিয়ে ওঠতে যাচ্ছিল। তখনই ব্যাগটা চোখে পড়ল। এবং তদ্দন্ডেই তার প্রলম্বিত জিভ আরও লম্বা হয়ে বাইরে ঝুলে পড়ার উপক্রম হলো। বড় হয়ে যাওয়া চোখের মণি সামলাতে কপাল আর চোখের পাতা যদ্দূর সম্ভব ছোট করে সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল—
“এই ব্যাটা, তুই সোনার ব্যাগ কোথায় পেলি? চুরি করেছিস নাকি?”
পাগল ফিরেও তাকাল না। যেমন চলছিল তেমনি চলতে লাগল।
“বললি না সোনার ব্যাগ কোথায় পেলি?” এবারে সে গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করল।
আশে-পাশের কানগুলো সব খাড়া হয়ে গেল।
সোনা! খাঁটি সোনার ব্যাগ ওটা!
পাগল নায় না, চায় না, খায় না। সোনায় তার দরকার কী?
“এ ব্যাগ আমার।” সবচেয়ে কাছে থাকা মুখ দাবি করল। সবচেয়ে কাছে থাকা হাত পাগলের দিকে ছুটে এলো।
“এ ব্যাগ আমার।”
শত শত কণ্ঠ।
শত শত হাত।
পাগল দৌড় দিল, ছুটল প্রাণপণ। পিছনে লম্বা মিছিল।
“এ ব্যাগ আমার।”
হাজার হাজার কণ্ঠ।
হাজার হাজার হাত।
সময় যত যাচ্ছে, মিছিলের লেজও তত বাড়ছে। সমানতালে।
পিঁপড়েরা এলো, তেলাপোকা এলো, টিকটিকি এলো, এলো ছুঁচো আর ইঁদুরের দল। দৌড় থেকে বাদ গেল না খরগোশ, বিড়াল আর কুকুরও। এলো গরু, ছাগল, আর খেক শিয়ালের দল।
পাগল ছুটছে, ছুটছে আর ছুটছে। ক্লান্তি নেই, ভাবান্তরও নেই।
এলো বাঘ আর ভালুকরা। দাঁত আর নখগুলোকে আচ্ছামতো শান দিয়ে। দাবার গুটিগুলো ঠিকমতো সাজিয়ে।
সবশেষে হাতি এলো গজেন্দ্র গমনে।
পাগল হঠাৎ থেমে গেল। মিছিলের দিকে ফিরে চাইল ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে।
“সাবধান! কেউ এক পা এগিয়েছ তো ব্যাগের চেইন খুলে দেব।”
“কী, কী আছে ওতে?”
“তোমাদের সবার হাঁড়ির খবর। সবার গোপন খবর।”
মিছিল হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। হাজার হাজার অনড় ভাস্কর্য।
পিচঢালা পথ কোনো চিহ্ন রাখে না। দাগ পড়ে না ফুটপাতেও। যা করার সবাই প্রকাশ্যে করছে, সূর্য কিংবা নিয়ন বাতির আলোয়। রাখ-ঢাক কারোরই ছিল না। তবু এই মমি হয়ে যাওয়া।
পাগল আবার পথ চলতে লাগল। বগলে সোনার ব্যাগ তেমনি চকচক করছে।
হাতি কেশে গলা পরিষ্কার করল। এ রকম সংকটে তার কিছু একটা করা উচিত। সবকিছুতে সে আসে সকলের পরে, কিন্তু কথা বলে সকলের আগে।
“প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আজ আমরা বুঝলাম আমাদের হাঁড়িগুলো কত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সকল প্রাপ্তির চেয়েও। সকল অর্জনের চেয়েও। সোনার ব্যাগের চেয়েও। বিষয়টি আমরা সিরিয়াসলি দেখব। এমন নিয়ম করব যেন কেউ কোনোদিন ঐ ব্যাগের চেইন খুলতে না পারে।”
মিছিলে প্রাণ ফিরে এলো। গুঞ্জন শুরু হল। যাক, কিছু একটা তাহলে হচ্ছে। তারা আবার আনন্দিত হলো। কেননা একটু আগের বিকার থেকে তারা মুক্ত হয়েছে। বস্তুত নির্বিকার হওয়ার মতো স্বস্তিদায়ক আর কী হতে পারে?
যার যার গায়ের ঘাম মুছে ফেলে মিছিল আবার নিজ নিজ পথে ছুটতে শুরু করল।