X
মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
৩০ বৈশাখ ১৪৩২

আবেদআলী মামার সংসার

হাসানআল আব্দুল্লাহ
১৩ মে ২০২৫, ১৫:৫৯আপডেট : ১৩ মে ২০২৫, ১৫:৫৯

"পৃথিবীর সব স্ত্রীই স্বামীদের থেকে বেশি জানে।" —এপাড়ার একমাত্র দার্শনিক, আমাদের আবেদআলী মামা, হাত নাচিয়ে মুখ ঘুরিয়ে উপস্থিত ভক্তদের দিকে তার আপত দর্শনের প্রাপ্তিগুলোর মৌলিক ব্যাখ্যা শোনাতে থাকেন। "এমনকি ষাট বছর বয়সের কোনো ভদ্রলোক যদি বিশ বছর বয়সের নারীকে বিয়ে করেন সেক্ষেত্রেও কথাটি সত্য।" —তার হাসির ছটা চারিদিকে বয়ে যাওয়া ফুটফুটে রোদ্দুরের সাথে মিশে যায়। মামার পাটক্ষেতের লাইব্রেরির আজ আমরা মাত্র দু'জন শ্রোতা। মুরাদ ও মিঠুন। আমি মিঠুন। আমার সহপাঠী মুরাদ, একটু ত্যাড়া কিসেমের। মুরাদ প্রশ্ন করে, "আচ্ছা মামা, মামিও কি আপনার থেকে বেশি জানেন।" "আলবত!" মামা আবার হাসেন। “দেখো না, তাই ঢাকায় তোমার মামিকে রেখে আমি প্রায়ই গ্রামে চলে আসি।" মামা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “এই যে মিঠুন, তুমি একটা সাদাসিদা ছেলে। কখনো কিন্তু বিয়ে করবে না।" লজ্জায় আমার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়, “কি যে বলেন, মামা!” মামা তার কথার গতি বাড়ান, “শোনো, আমাদের দেশে কি হয়! বিয়ের বাজারে একটা ছেলের জন্যে মেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ছেলের পরিবার মেয়ের বাড়ি গিয়ে হাজির হয়।" মুরাদ ফোঁড়ন কাটে, “ঘটকই তো নিয়ে যায়।" "সে যাই হোক, মেয়েটার বাড়িতেই ছেলেটা যায়। গিয়ে মেয়েটাকে দেখে। তার সাথে দুই একটি আলাপ বিনিময় হয় পরিবারের অন্যদের। মেয়েটা আমতা আমতা করে তার নাম বলে। কোন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে তার উত্তর দেয় অতি নিম্নস্বরে। সবকিছু মিলে ছেলের পরিবার যখন মেয়েটিকে পছন্দ করে, ওদের বিয়ে দিয়ে নতুন বউকে ঘরে তুলে আনে।" মামা আমাদের দিকে নজর রাখেন, আমরা আবার মনোযোগ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেই কিনা সেটা তাকেই দেখে নিতে হয়। পাটের পাতার ভেতর দিয়ে বাতাস পইপই করে বেরিয়ে যায়। মাঝে মাঝে একটা চমৎকার শো শো শব্দও শোনা যায়। তবে নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সির সেই শব্দ আমাদের মনোযোগ ব্যাহত করতে পারে না, বরং একধরনের পেলবতা মামার কথাগুলোকে আরো যুক্তিসংগত বলে মনে করানোর চেষ্টা করে। তিনি বলে যেতে থাকেন, “তো, সেই মেয়ে যখন ঘরে আসে। তাকে দুধ-ভাত খাওয়ানো হয়। মিষ্টি দিয়ে বরণ করা হয়। হিন্দুরা বরণডালা সাজিয়ে ধূপধুনো দিয়ে দুধের থালায় পা ডুবিয়ে মেয়েটিকে ঘরে তুলে। নতুন বউ সংসার শুরু করে। একেবারে কচি পুঁইডাটার মতো তার চেহারা। কেউ কেউ বলে দুধে-আলতা।" মামা কথা বলতে বলতে কেমন যেন তার অতীতে ফিরে যান। হয়ত তার নিজের বিয়ের কথাই মনে পড়ে যায়। মুরাদ কিন্তু সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। “আচ্ছা মামা! আপনার বিয়ের সময়ও কি এমনটি হয়েছিল? মানে মামিকে যখন ঘরে আনেন তখন কি তিনিও দুধে আলতা ছিলেন?” মুরাদ জিজ্ঞেস করে। “আরে ভাগনে, তাহলে কি বলছি! আমি তো তোমার মামিকে প্রথম দেখায়ই মনে জায়গা দিয়ে ফেলেছিলাম। সে কি যে একটা অনুভূতি, মনে হয়েছিল এর জন্যেই আমি এতদিন বসে ছিলাম। একেই আমার জীবনে চাই।" আনন্দে মামার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আকাশে চারটি বক একসাথে পশ্চিম থেকে পুবে উড়ে যায়। আমরা তিনজনই তাদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকি। মামার মুখে তার বিয়ের দিনের রেস দেখা যায়। তিনি বলতে থাকেন, “কী ফুটফুটে সুন্দর তোমাদের মামি। আমি জীবনে এমন সুন্দরী মেয়ে আর দেখিনি। এমন একজন অপ্সরাকে ঘরে এনে আমি তো যারপরনাই আনন্দিত।" "মামির সাথে প্রথম কোথায় দেখা হলো?” আমি প্রশ্ন করি। “ঢাকায়।" মামা এবার মুচকি হাসেন, “সেই দেখা হওয়ার কাহিনিও এক উপন্যাসের অংশ বলে মনে হয়।" মুরাদ কথা না বলে থাকতে পারে না, “আমরা শুনতে চাই সেই উপন্যাস, মামা!” “শোনো প্রত্যেকের জীবনই এক একটি উপন্যাস। কারো কাহিনি মধুর, আর কারো কাহিনি ভয়াবহ। তবে সবার জীবনেই আলাদা আলাদা কষ্ট থাকে। আমি সদ্য চাকরি পেয়েছি। একটা মেসে তিনজন থাকি। আমাদের এক ভদ্রমহিলা রান্না করে দিয়ে যেতেন। কিন্তু, তিনি যখন আসতেন না, আমরা নিজেরাই পালাক্রমে রান্না করতাম। এরই মাঝে হঠাৎ একদিন হার্ট অ্যাটাক করে আমাদের একজন চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। ভদ্রলোক বেশ বয়সী ছিলেন। গ্রামে তার স্ত্রী ও সন্তানেরা থাকতো। তিনি সকালে গ্রামে যাবেন বলে নানারকম বাজার করে নিয়ে এলেন স্ত্রী ও সন্তানের জন্যে। মা-বাবা আত্মীয়দের জন্যে। যেমনটি হয়, আমি যখন ঢাকা থেকে গ্রামে আসি সবার জন্যেই কিছু না কিছু আনার চেষ্টা করি। আর ভদ্রলোক প্রায় বছরখানেক পরে বাড়ি ফিরছিলেন, ফলে তিনি একটু বেশি বাজার করেন। সেদিন রাতে আমি রান্না করেছিলাম। দু'জন ইতোমধ্যে খেতে বসে গেছি। তার আসার অপেক্ষায় আছি। তিনি বাজারঘাট করে ক্লান্ত হয়ে রুমে ফিরেছেন। কিন্তু এরই মধ্যে তার রুম থেকে জোরে গুমরে ওঠার শব্দ শুনে আমরা দৌড়ে গিয়ে দেখি মুখে ফেনা ওঠে গেছে। বিছানার উপর ঢলে পড়েছেন। অ্যাম্বুলেন্স এসে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু তার আগেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।" আমি বলি, “খুবই দুঃখজনক ঘটনা মামা।" "হ্যা, ভাগনে খুবই প্যাথেটিক!" মামা ইমোশনাল হয়ে পড়েন। মুরাদ বলে, “মামির সাথে প্রথম দেখা কীভাবে হলো সেটা কিন্তু বলেননি।" "আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে।" মামা সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, “তবে সেই কাহিনি আজ আর বলতে ভালো লাগছে না। তোমাদের মামির সাথে সংসার করার শুরুতেই আমি রামপুরায় একটি বাসা নিলাম। ছোট্ট বাসা। দুটো রুম আর রান্না ঘর। এতেই আমাদের হয়ে যেতো। তোমাদের মামি একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। আর আমার তো ব্যাংকের চাকরি। বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিল আমাদের। কিন্তু দিনে দিনে তোমাদের মামি বাসায়ও শিক্ষক হয়ে উঠলেন। বিয়ের সময় যিনি ঠিক মতো রান্না করতে পারতেন না, মাছ ধরতেন খুব কষ্ট করে, তিনিই এক সময়ে রান্নায় পটু হয়ে উঠলেন। কথায় কথায় আমাকে ধমক দিয়ে ওঠেন।" আবেদআলী মামা পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ওটাকে মুখে পুরে ম্যাচের কাঠির সাহায্যে ধরান। তারপর একটা সুখটান দিয়ে বলেন, “আগে তো বুঝিনি সংসার এতটা কঠিন। এতটা নির্মম! কয়েক বছরের ভেতর আমাদের একটি সন্তান হলো। তারপরের বছর আরেকটি। আমি সংসারে থেকেও না-থাকার মতো। তোমাদের মামিই এখন সব করেন। আমি শুধু প্রয়োজনীয় কাজগুলো যেমন বাজার সদাই করে দেয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন দেয়া, আর মাস শেষে বেতন পেয়ে তোমাদের মামির হাতে টাকা তুলে দিয়েই খালাস। যাকে দেখেশুনে একদিন ঘরে নিয়ে এলাম, খুবই শান্ত ও নম্র স্বভাবের, সে-ই হয়ে উঠলো বদরাগী এক গৃহকর্ত্রী। বোঝো ঢেলা! আমি কিছু শুনাতে গেলে তিনি তার থেকে বেশি শুনিয়ে দেন। আমি কিছু বুঝতে গেলে তিনি তার থেকেও বেশি বুঝিয়ে দেন। আমিও আস্তে আস্তে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।" আমি বলি, “কিন্তু মামা, দু'টি সন্তানের লালনপালন তো কম কথা নয়। তিনি তো সেদিকে খেয়াল করছেন।" মুরাদ বলে, “তাছাড়া সংসারের কাজ তো কম থাকে না। তিনিও তো চাকরি করেন।" "দেখো, বাবারা তোমাদের বোঝাতে পারব না। আমার দুই সন্তানই এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। তাদেরকে তোমাদের মামি সময় দেন সেটা আমি জানি। সেটা দেয়াও দরকার। কিন্তু আমি তো আছি। আমি তো মারা যাইনি। আমারও তো সময়ের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তিনি ছুটির দিনগুলোতেও ওই সন্তানদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। সিনেমা দেখা, শপিং করা, কোথাও ঘুরতে গেলেও ওদের নিয়েই যান।" "কেনো আপনি সাথে যান না?" আমি প্রশ্ন করি। “কখনো কখনো যাই। ব্যাংকের চাকরিতে আমাকে খুব বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। অন্যদিকে, শপিং আমার পছন্দের নয়।" আবেদআলী মামা অনেকটা ডিফেন্সিভ হয়ে যান। “আচ্ছা মামা, আপনি মামিকে ভালোবাসেন না?” মুরাদ বেশ উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করে। “তা বাসব না কেনো। বিয়ের পর আমাদের ভালোবাসাই তো সংসারটিকে এতোদিন ধরে রেখেছে। আমরা তখন একে অপরকে ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছি। স্কুলের চাকরি থেকে আমার স্ত্রী বেশ আগে আগে বাসায় ফিরতেন। আমি না ফেরা পর্যন্ত খাবার খেতেন না। সেই সময়টা অন্যরকম ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে তোমাদের মামি যখন গৃহকর্ত্রী হয়ে উঠলেন, আমরাও একে অপর থেকে দূরে চলে যেতে থাকলাম। এখন তিনি আমারও শিক্ষক।" আমরা দু'জন হো হো করে হেসে উঠি। মামা বলেন, “যে বন্ধুর সাথে ম্যাসে থাকতাম। সেও আমার বিয়ের পরপরই বিয়ে করে ফেলে। সে এখন থাকে লালমাটিয়া।" কথা বলতে বলতে ততক্ষণে তার হাতের সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরেকটি সিগারেট ধরান। “তো, এই বন্ধুটির কোনো ছেলে-মেয়ে নেই। আমাকে কি বলে জানো?” আমরা সমস্বরে প্রশ্ন করি, “কি বলে?” “সে বলে, পৃথিবীর সব স্ত্রীই স্বামীর শিক্ষক।" মামা গম্ভীর হয়ে বলেন, “আমার বন্ধুটি নাকি বাসায় কোনো কথা বলতে ভয় পায়। যদি কোনো প্রকারে তার কথা ভাবির মতের বিরুদ্ধে যায় তো দিনটাই মাটি। ঝগড়া করার জন্যে নাকি ভাবী মুখিয়ে থাকেন।" আমি ও মুরাদ চোখ চাওয়াচাওয়ি করি। মুরাদ বলে, “কই আমার বাবা-মা তো অমন নন। তারা তো দিব্যি একে অপরকে সম্মান করেই সংসার করেন। তাদের ভেতরে তো মন কষাকষি দেখি না।" আমি বলি, “আমার বাবা যদিও মাঝে মাঝে মায়ের উপর চোখ গরম করেন, কিন্তু মা তখন ভয়ে সরে যান। কোনো ঝগড়া তাদের মধ্যে কখনো হয়েছে বলে আমার জানা নেই।" "ঠিক বলেছো, তোমরা। গ্রাম আর শহরের ভেতরে এই হলো পার্থক্য। এখানে তোমাদের বাবারা হলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম। কৃষিকাজ করেন। যা ফলে তাই দিয়ে সংসার চালান। তোমাদের মায়েদেরও সেই হিসেবে ডিমান্ড কম। তবে, শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ব্যাপারটা আলাদা। আমার বন্ধুটি তো বলে যে একজন প্রফেসর যদি তার ছাত্রীকে বিয়ে করেন, বছর না ঘুরতেই ছাত্রীটি হয়ে যায় প্রফেসর আর ওই প্রফেসর হন তার ছাত্র।" মামার এইসব দার্শনিক কথাবার্তা আমাদের তেমন বোধে আসে না। তবে বুঝতে পারি যে আবেদআলী মামার সংসারে কোনো না কোনো সমস্যা আছে, নাহলে তিনি যখন গ্রামে আসেন, মামিকে একবারও সাথে নিয়ে আসতে দেখিনি। তার এই একা একা গ্রামে আসা কিংবা মামির থেকে দূরে দূরে থাকাটা আমাদের কাছে সন্দেহের মনে হয়। আমরা ভাবি হয়ত সমস্যাটি মামির নয়, মামার। এর পরের বার মামা গ্রামে এলেন প্রায় ছয় মাস পরে। আমরা সেই ছয় মাসে বেশ বড় হয়ে গেছি। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষা করছি। আমাদের সময়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই পরীক্ষা পাশ এবং কলেজে ভর্তি হওয়াকে অনেকটা ম্যাচিউরিটির অংশ হিসেবে দেখা হতো। ততোদিনে ছেলেমেয়েদের অনেকেই প্রেম করতে শিখে যেতো। মেয়েরা বুঝত ছেলেদের ছাড়া তাদের ভবিষ্যৎ নেই, আর ছেলেরা বুঝত মেয়েরাই তাদের আগামী স্বপ্ন বাস্তবায়নের মূল। ফলত, মুরাদ একাধিক প্রেমে পড়ে যায়। এই গ্রাম ওই গ্রামের বেশ কয়েকজন মেয়ের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। নিজেদের পাড়ায় দুইজনের সাথেও তার বেশ ভাব হয়। কিন্তু আমি ছিলাম লাজুক প্রকৃতির, মেয়েদের দেখলেই আমার গা থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দিত। মুরাদ বলত, “তুই হলি ভিতুর ডিম।" কিন্তু ওর মেয়ে পটানোর কায়দা এবং দুই একবার পাট ও ইক্ষু ক্ষেতে সময় কাটানোর গল্পগুলো আমার ভালো লাগত। গল্প শুনতে শুনতে আমি লক্ষ্য করতাম নিজের শক্তি দণ্ডটি বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। এসময়ে মুরাদই আমাকে প্রথম শেখায় কীভাবে মাস্টারবেটিং করতে হয়। ফলে, আমিও জীবনে নারীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকি। কিন্তু মামার কথা আমাদের একদিকে আশান্বিত করলেও অন্যদিকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলে। মামা বলেন, “তুমি যদি চার ঘণ্টা কারো সাথে কথা বলে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যাও তাহলে মনে করবে তিনি একজন দার্শনিক, আর যদি আধাঘণ্টা কারো সাথে কথা বলে মনে হয় তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে অপদার্থ লোক, নিকৃষ্ট প্রজাতির মানুষ, তাহলে তিনি নির্ঘাত তোমার স্ত্রী।" তার মানে আমরা বুঝতে পারি নিজের স্ত্রীর কাছে কোনো পুরুষই আদতে পূর্ণবয়স্ক নয়, কোনো না কোনো খুঁত যে তার আছে সেটা স্ত্রীর মারফতেই হয়ত প্রথম গোচরে আসে। জীবনের সেই সময়ে আবেদআলী মামা আমাদের আরো একটি চমৎকার শিক্ষা দেন, তাহলে, “যে তোমাকে আদেশ করতে পারে সাধারণত তার সামনে দিয়ে না যাওয়ার চেষ্টা করবে। মানে তাকে যতটা এড়িয়ে চলা যায় সেটাই হবে তোমার প্রধান কাজ। অফিসে বসের সামনে দিয়ে হাঁটবে না। বাথরুমে যেতে হলে যদি ঘুর রাস্তায় যেতে হয় তাই করবে। এবং মনে রাখবে স্ত্রীও কিন্তু তোমার বস।" মুরাদ এবং আমি মামার এই আদেশ সারাজীবন মনে রেখেছি এবং পরবর্তীতে আমরা যখন নিজেরাই চাকরিতে ঢুকি তখন কিন্তু এই উপদেশ বেশ কাজেও লেগেছে। আরো পরে, বিয়ে করার পর, মুরাদ ও আমি মামাকে বার বার স্মরণ করেছি, যদিও তিনি তখন আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। আমি ঢাকায় একটি চাকরি নিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ বেশ ভালোই আছি। আমার সহকর্মীরা বলেন যে আমি নাকি ভাগ্যবান, ভালো স্ত্রী পেয়েছি। আমিও অস্বীকার করতে পারি না। আমার স্ত্রী সকালে অফিসে যাওয়ার আগে আমার নাস্তাটিও ঠিক করে যান। আমি একটু দেরিতে অফিসে যাই বলে তিনি নিয়মিত এই কাজটি করেন। অনেকবার তাকে বলেছি যে আমি নিজেই তো নিজের নাস্তা করে নিতে পারি। কিন্তু তিনি বলে যে তিনি যেহেতু নিজের জন্যে সকালে নাস্তা বানান, সাথে আমারটিও বানাতে তার কোনোই অসুবিধা নেই। ওদিকে আমার বন্ধু মুরাদ কলেজ পাশ করেই আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। দুই ছেলে ও ভাবিকে নিয়ে বেশ ভালোই আছে। সেও ভালো বউ পেয়েছে। মাঝে মাঝেই তার সাথে আমার ফোনে কথা হয়। সে বলে, “বন্ধু আমার একটাই দুঃখ যে এতকিছু করার পরও আমার স্ত্রী প্রায়ই বলেন আমি তার জন্যে কিছুই করিনি। যা কিছু করেছি তার সবই আমার মা-বাবা ভাই-বোনদের জন্যে।" আমি তাকে সান্ত্বনা দেই, “নিশ্চয়ই সেটি তিনি যখন রেগে যান তখন হয়ত বলেন, কিন্তু তুই যে ওই দেশে গিয়ে অমানুষিক কষ্ট করে জীবনটা গড়ে তুললি, ভাবিকে এখান থেকে নিয়ে গেলি, তার লেখাপড়ার ভার নিলি, তিনি অবশ্যই সেটা বোঝেন ও স্বীকার করেন। আর যদি না-ই করেন তাতেই বা তোর কি আসে যায়। তুই তো আদতে নিজের জীবনটাই গড়েছিস, সব কিছু মিলেই তো তোর জীবন। ভাবী, তোর সংসার, চাকরি এর সবই সেই জীবনের অংশ।" যাহোক ফিরে আসি আবেদআলী মামার জীবনের গল্পে। তিনি যে সংসারে সুখী ছিলেন না সেটা আমরা সেই বয়সেই বুঝতে পারি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর একবারই মামার সাথে আমাদের দেখা হয়। কোনো এক ঈদে আমরা বাড়ি গিয়ে শুনতে পাই মামা অসুস্থ, তিনি শহর ছেড়ে গ্রামে চলে এসেছেন। দুজনেই ছুটে যাই তাকে দেখতে। জীর্ণ শীর্ণ হয়ে বিছানার এক কোণে পড়ে আছেন। কি যে চেহারা হয়েছে তা বর্ণনা করার মতো না। চোখ কোটরে দেবে গেছে। হাতে পায়ে মাংস বলতে কিছুই নেই। হাড্ডিগুলো কোনোরকম চামড়ার নিচে সেঁটে আছে। কথা বলার শক্তি অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছেন। মামার ছোটো বোন তার দেখাশোনা করেন। খবর নিয়ে জানতে পারি, মামা বেশ কয়েকমাস আগে ভগ্ন স্বাস্থ্যে একা একাই গ্রামে এসেছেন, এবারও মাম সাথে আসেননি। ইদ শেষে স্বভাবতই আমরা কলেজে ফিরে যাই। ব্যস্ত হয়ে পড়ি নিজেদের লেখাপড়া নিয়ে। কিন্তু আবারো মাসখানেক বাদে হন্তদন্ত হয়ে পড়িমরি গ্রামে ছুটে আসতে হয় মামার মৃত্যুর সংবাদে। যার সাথে আমাদের প্রাণের একটা অসম্ভব যোগাযোগ ছিল, যিনি আমাদের সন্তানস্নেহে দেখতেন, তার মৃত্যুতে কি কলেজে বসে থাকতে পারি! মামাকে দাফন করার সময় তার ছেলে-মেয়ে দুজনেই গ্রামে এসেছিল। ওরাও বেশ বড়। আমাদের বয়সী। ছেলেটি সম্ভবত আমাদের থেকে বড়ই ছিল। কিন্তু মামিকে না দেখে আমরা সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম। স্বামীর মৃত্যুতেও যে স্ত্রী ছুটে আসতে পারেন না তিনি কেমন মানুষ, এমন একটি প্রশ্ন আমাদের মনে পাক খেতে থাকে। আমরা এক ফাঁকে মামার মেয়েকে জিজ্ঞেস করি, “মামি আসলেন না!” মেয়েটি বলে, “মাকে তো আব্বার মৃত্যুর সংবাদ দেওয়াই হয়নি।" উত্তর শুনে আমি ও মুরাদ একে অপরের মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকাই। স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ স্ত্রী জানতেই পারেননি। তাকে সেই সংবাদ দেওয়াই হয়নি, এ কেমন কথা। মেয়েটি আমাদের চোখের ভাষা পড়তে পারে, আসলে সব মেয়েই পুরুষের চোখের ভাষা ধরে ফেলার ক্ষমতা রাখে। তাই আমরা পুনরায় প্রশ্ন করার আগে সে বলে, “বাবার মৃত্যুর সংবাদ মা নিতে পারবেন না। তার অসুস্থতা আরো বেড়ে যাবে।" আমরা দুইজনেই একযোগে বলে উঠি, “মানে কি?” “আপনারা বোধ হয় জানেন না, আমার মা দশ বছর আগে স্টোক করেছিলেন। সেখান থেকে তার শরীরের একপাশ অবশ হয়ে গেছে। বেঁকে গেছে মুখও। মোটামুটি বিছানায়ই তার জীবন কাটে। একজন কাজের বুয়া তাকে খাইয়ে দেয়, তার যাবতীয় দেখাশোনা করে।" মুরাদ ও আমি যথেষ্ট বিমর্ষ হই। আবেদআলী মামার জীবনের এই পরম সত্যটি আমরা বোধহয় না জানলেই ভালো হতো। বেশ কয়েকবছর পরের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। গ্রামে এসে মামার ছোটবোন, আছিয়া খালার সাথে দেখা। তিনি বললেন, “তোর সাথে দেহা হইয়ে ভালোই হইলো। বাড়িতে এটটু আসিস।" পরদিন আমি দেখা করতে গেলে তিনি আমার হাতে বেশ কিছু কাগজপত্র তুলে দেন যাতে মামার নানারকম লেখালেখির নমুনা পাওয়া যায়। আছিয়া খালা বলেন, “আমি মুকখু শুকখু মানুষ, এইসব আমি বুঝব না। তুই লইয়া যা। পইড়ে দেহিস।" এইসব কাগজে মামার নানা রকম দার্শনিক ভাবনা লেখা, অনেকটা নিৎসের মতো করে তিনি ছোটো ছোটো বাক্যে নানা মূল্যবান চিন্তা লিখে রেখেছেন। এর একটিতে আমার চোখ আটকে যায়। মামা লিখেছেন, “জীবন একটি জ্বলন্ত পাটকাঠি, সবটুকু জ্বলে গেলে ছাই ছাড়া আর কিছু থাকে না।" আমি মনে মনে ভাবি, তাহলে জন্ম থেকেই কাঠিটি জ্বলতে থাকে! সবটুকু জ্বলে গেলেই মানুষের মৃত্যু ঘটে। আবেদআলী মামার জীবনের কাঠিটিও দমকা বাতাসে দ্রুত জ্বলে শেষ হয়ে গিয়েছিল।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ব্যবসায়ীর ওপর হামলা করে ৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ
ব্যবসায়ীর ওপর হামলা করে ৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ
বিনিয়োগে দেশি উদ্যোক্তাদের গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান রাজনৈতিক দলগুলোর
বিনিয়োগে দেশি উদ্যোক্তাদের গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান রাজনৈতিক দলগুলোর
বলিউডের পোস্টার থেকে উধাও পাকিস্তানি তারকারা!
বলিউডের পোস্টার থেকে উধাও পাকিস্তানি তারকারা!
কোরবানির চামড়ার ব্যবস্থাপনায় ১৭ সদস্যের কমিটি
কোরবানির চামড়ার ব্যবস্থাপনায় ১৭ সদস্যের কমিটি
সর্বাধিক পঠিত
আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতার আত্মসমর্পণ
আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতার আত্মসমর্পণ
স্বর্ণের দাম আবার কমলো
স্বর্ণের দাম আবার কমলো
হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল ইতিহাসে এটাই প্রথম: প্রধান বিচারপতি
হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল ইতিহাসে এটাই প্রথম: প্রধান বিচারপতি
পাকিস্তানে ভারত হামলা করলে সহায়তা করবে বালুচ লিবারেশন আর্মি
পাকিস্তানে ভারত হামলা করলে সহায়তা করবে বালুচ লিবারেশন আর্মি
নটর ডেম কলেজের আরেক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার
নটর ডেম কলেজের আরেক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার