X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ || রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অনুবাদ : কবির চান্দ
০৮ মে ২০১৮, ১৪:৫২আপডেট : ০৮ মে ২০১৮, ১৪:৫৯

আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ || রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিখ্যাত বাবাদের নিয়ে সন্তানদের স্মৃতিকথা দুর্লভ নয়। কিন্তু রবীন্দ্রপুত্র রথীন্দ্রনাথ যত দীর্ঘকালব্যাপী পিতাকে কাছ থেকে দেখেছেন, এমনটি আর কোনো সন্তানের ক্ষেত্রে ঘটেনি। পিতাকে কাছ থেকে দেখার টুকরো-টাকরো স্মৃতিস্মারক তার ‘On the edges of time’ গ্রন্থটি। যার বাঙলায়ন কবির চান্দ করেছেন ‘আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ’। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে সেখান থেকে দু’টো অধ্যায় পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

বাবার লেখালেখি

শিলাইদহের বছরগুলোতে বাবা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি লিখেছেন। কবিতা, গান, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, বক্তৃতা নানাদিকে সমান তালে তাঁর কলম চলেছে। সারাদিন ধরে তো লিখছেনই, কখনও কখনও লেখা চলেছে গভীর রাত পর্যন্ত। তিনি যখন পরিশ্রম করতেন তখন খুব কম খেতেন। মা বিরক্ত হতেন, তবে এটাও জানতেন যে বাবা কোনো বিষয়ে মনস্থির করলে অন্যদের কারও কিছু করার ছিল না। ফুফাত বোন সরলা দেবী তখন ভারতী পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। পত্রিকাটি বড় জ্যাঠামশাই দ্বিজেন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন। পরেও সম্পাদনার ভার আমাদের পরিবারেই থেকে যায়। এক সময় বাবাও এ দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারতীর জন্য ছোট নাটক লিখে দিতে সরলা দেবী বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন। নাটক লেখার তাড়না পাচ্ছিলেন না বলে তিনি এতে গা করেননি। বিষয়টি বুঝতে পেরে সরলা দেবী পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে পরবর্তী সংখ্যায় রবি ঠাকুরের নাটক ছাপা হবে। কয়েকদিন পর তিনি বাবাকে চিঠি দিয়ে জানালেন যে পত্রিকার কাটতি বাড়াতে তিনি এ ঘোষণা দিয়েছেন, এখন বাবা যেন পাঠকদের হতাশ না করেন। বাবা প্রথমে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। পরদিন মাকে ডেকে বলেন যে তিনি একটা লেখা ধরবেন, তাঁকে যেন কেউ বিরক্ত না করে। এমনকি খাবারের জন্যও নয়। মাঝে মাঝে দুধ জাতীয় কিছু দিলেই খাওয়ার কাজ চলে যাবে। এ কথা বলে তিনি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করলেন। লেখা চলল টানা তিনদিন, কোনো রকম বিরতি ছাড়া। এ তিনদিন বাবা কিছু খানওনি। তৃতীয় দিনের শেষ নাগাদ লেখা শেষ হল হাসির নাটক চিরকুমারসভা। পাণ্ডুলিপি ডাকে পাঠাতে তিনি ভরসা পেলেন না, নিজেই কোলকাতা নিয়ে গেলেন। মা জানতেন যে ভারতীতে সময়মত পাঠানোই বাবার তাড়াহুড়ার একমাত্র কারণ ছিল না। তিনি যখনই কোনো লেখা শেষ করতেন, বন্ধু-বান্ধবকে তা পড়ে শোনানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠতেন। সে সময় বন্ধুদের কেউই শিলাইদহে ছিলেন না। তাই তিনি কোলকাতায়ই চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ কয়দিনের অনাহারে ও লেখার চাপে এতই দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন যে, জোড়াসাঁকোর বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অজ্ঞান হয়ে যান। মা তখন বাবাকে স্বাভাবিক খাবার খেতে রাজি করাতে পেরেছিলেন।

 

নাটকীয় সেই ঘটনাটি

শিলাইদহের একটি ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমরা তখন গড়াই নদীতে একপক্ষকাল ধরে হাউজবোটে আছি। উনবিংশ শতকের নব্বই দশকের মাঝামাঝি কোনো এক অক্টোবরের ঘটনা এটা। আমি সবে নয় বছরে পা দিয়েছি। বাবা আমাকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। শুকনো মৌসুম তখনও শুরু হয়নি। যুৎসই বালুচরের খোঁজে আমাদের নৌকা এখানে-সেখানে ঘুরছিল। বাবা তখন সাধনানামের মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করছিলেন। পত্রিকাটির অধিকাংশ স্থান তাঁর নিজের লেখা দিয়েই ভরাট করতে হতো। প্রত্যেক সংখ্যায়ই তাঁর একটি গল্প থাকত। পরবর্তীতে এগুলো গল্পগুচ্ছে স্থান পায়। এ সময়ের বেশির ভাগ গল্পেই গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের বিস্তারিত ও অন্তরঙ্গ বর্ণনা স্থান পেয়েছে। শিলাইদহ গ্রামটির অবশ্যই একটি আলাদা গুরুত্ব আছে। কেননা, এখানেই বাবা মাটির সন্তানদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন এবং তাদের সুখ-দুঃখের কথা ভালোভাবে জানতে পেরেছিলেন।


















তিনি প্রায় সারাদিনই হাউজবোটের সামনের দিকের কেবিনে লেখালেখি করে কাটিয়ে দিতেন। আমি থাকতাম পাশের কেবিনে। ঘোর লাগা চোখে নিয়ত পরিবর্তনশীল নদী-জীবনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সূর্যাস্তের পর বাবা আমাকে ডেক-এ নিয়ে যেতেন এবং যতটা সম্ভব আনন্দ দেবার চেষ্টা করতেন। এক সন্ধ্যায় আমরা রেলিংয়ের খুব কাছে পাশাপাশি চেয়ারে বসে ছিলাম। হঠাৎ বাবার চটি নদীতে পড়ে গেল। তৎক্ষনাৎ তিনি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্রবল স্রোতের মধ্যে বেশ খানিকটা সাঁতার কেটে তিনি ওগুলো তুলে নিয়ে আসলেন। রাতের বাকি সময়টুকু চটিজুতা আর ব্যবহার না করা গেলেও তা উদ্ধার করে আনতে পেরে তিনি খুব তৃপ্তি পেয়েছিলেন।
কিন্তু দীর্ঘদিন এরকম সুখে কাটানো আমাদের ভাগ্যে ছিল না। হঠাৎ এক সকালে আকাশ কালো করে মেঘ জমল। ক্রমে সেটা রূপ নিল ঘুর্ণিঝড়ে। আমাদের নৌকাকে নিরাপদে ভিড়ানোর প্রয়োজন হল। নদীর খাঁজে খাঁজে অনেক সময় ছোট জলাশয় তৈরি হতো। জেলেরা এগুলোকে বলত দহ। এগুলোর ভেতরটা প্রশস্ত হলেও ঢোকার মুখটা হতো সরু। ফলে স্রোত বা ঢেউ প্রবেশ করতে পারত না। আমরা এ রকম একটি দহে ঢুকে গেলাম। এখানে আরও শ’খানেক নৌকা আশ্রয় নিয়েছিল। প্রায় তিনদিন ধরে ঝড় বইল। চোখের সামনে নদী আর তার সংলগ্ন গ্রামগুলোতে ঘূর্ণি হাওয়ার প্রলয় চলল। নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে আমরা দেখতে পেলাম ডুবন্ত নৌকা, উপড়ানো গাছপালা আর উড়ে যাওয়া ঘরের চালের এক অন্তহীন মিছিল যেন স্রোতের টানে ভাটায় বয়ে যাচ্ছে। নৌকার ভিতরে বসে থেকে থেকে খিল ধরে যাওয়া হাত-পা ছড়াতে আর চারপাশটা ভালো করে দেখতে তৃতীয় দিন বিকেলে আমরা ছাদে উঠলাম। ঝড়ের বেগ কিছুটা কমে এলেও নদীতে তখনও বড় বড় ঢেউ। হঠাৎ বাবা চিৎকার করে বললেন যে নদীর মাঝখানে একজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। তিনি যেদিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিলেন সেদিকে সবাই খুব ভালো করে তাকাল। মনে হচ্ছিল ঢেউয়ের ওঠা-নামার সঙ্গে একরাশ কালো চুল ভাসছে। এর বেশি কিছু বোঝা যাচ্ছিল না।
বাবা তৎক্ষণাৎ লাইফবোট বের করে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে আদেশ দিলেন। কিন্তু মাঝিরা বলল যে ঝড়ের মধ্যে যাওয়া ঠিক হবে না। বাবা বিরক্ত হলেন এবং নিজেই লাইফবোটে চড়ে বসলেন। তখনও তারা দোনোমনো করছিল। আমাদের একজন পুরনো মুসলমান বাবুর্চি ছিল। সে তখন তাদেরকে কাপুরুষ বলে বকাবকি করতে শুরু করল এবং বাবাকে সাহায্য করতে নেমে গেল। তারা তখন লজ্জা পেয়ে তার পিছু পিছু নৌকায় উঠল এবং নিজেদের সম্মান পুনরুদ্ধার করতে বাবাকে হাউজবোটে ফেরত আসতে বাধ্য করল। তাদের ছোট নৌকাটি বিশাল বিশাল ঢেউ ভেঙে এগিয়ে গেল। বাবুর্চির নেতৃত্বে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করে চলল।
ডুবন্ত মানুষটি তখন স্রোতের টানে বহুদূর ভেসে গিয়েছে। মাঝিরা যখন তাকে তুলে নিয়ে এল তখন চারদিকে আঁধার নেমে এসেছে। উদ্ধারকৃত ব্যক্তিটি যুবতী গৃহবধূ। বাবুর্চি বাবাকে বলল যে তারা মেয়েটিকে নৌকায় টেনে তোলার চেষ্টা করলে সে বাধা দেয়। তাকে ছেড়ে দিতে কাকুতি-মিনতি করে। তার বোধহয় আত্মহত্যা করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু দক্ষ সাঁতারু হবার ফলে জলে ডুবে প্রাণ বিসর্জন দেয়া সম্ভব ছিল না। মেয়েটি আমাদের জমিদারির এক প্রজার স্ত্রী। মেয়েটি ছিল সুন্দরী। এত অল্প বয়সেই জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণা এসে যাবার জোরালো কোনো কারণ ছিল না।
স্বামীটিকে ডেকে পাঠানো হল। বাবা তার সঙ্গে কথা বললেন। সে বউকে সঙ্গে নিয়ে গেল। শোনা যায় এর পর স্বামী তাকে এত আদর-যত্ন করত যে সে আর কখনও অসুখী হয়নি।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ