X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বড়সায়েব ঘোল খেলেন!

অরুণ কুমার বিশ্বাস
০৯ মে ২০২১, ১২:৪২আপডেট : ০৯ মে ২০২১, ১২:৪২

রম্যে কেবল রমণীরা থাকবেন একথা কে বলেছে! নারী ছাড়া কি নরক হয় না! হয় ভাই, হওয়ালেই হয়। আজ আমার পছন্দের ব্যক্তি বিশিষ্ট বড়সায়েব, অফিসের প্রধান ও দণ্ডমুণ্ডের কর্তা জনাব হারিছ উদ্দিন।
বলা বাহুল্য, জনাব হারিছ মেলা খেমতার মালিক। তিনি রীতিমতো দাপুটে কর্মকর্তা। সরকারি কি বেসরকারি সে প্রশ্ন তোলা থাক। সব ব্যাপারে কোয়েশ্চেন তোলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং জনাব হারিছের অদ্যকার কেচ্ছা শুনুন। ব্যাপক আরাম পাবেন।
জনাব হারিছের বাড়ি কিন্তু হারাগাছ, রংপুর। যারা ওই অঞ্চলের তারা দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলুন। দেশি ভাই, তাও আবার মেলা ক্ষমতাধর। শুনতেই বুকের ভেতরটা কেমন মুচড়ে ওঠে। আহা হা, ভাই-বেরাদার বলে কথা!
হারিছ গেছেন ফিল্ডঅফিস ভিজিট করতে। তার রিপোর্টের ওপর অধস্তনের মেলাকিছু নির্ভর করে। চাকরি না খাক, খাবারে তার অরুচি নেই কোনো। হারিছ সাহেব উদরপূর্তিতে চৌকস। চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়, কিছুতেই তার কোনো আপত্তি নেই। হারিছ মনে করেন, জন্ম যখন হয়েছে, পেটপুটে মনভরে যা পাও খেয়ে নাও। হাশরের ময়দানে কি না কি বিচার হয়, বরাতে খাওন আর জুটলেও পারে।
মাঠদপ্তরে গিয়ে চেয়ারে উপবেশন করতে না করতেই হারিছ হাঁক দেন―কইরে খাওন দাওন কী আছে নিয়ে আয়। আগে খেইয়েদেইয়ে প্রাণ ঠান্ডা করি। পিত্তি পড়লে আমার চিত্তি ঠিক থাকব না। তোগোর তহন মেলা ঝকমারি হবে।
বুঝতেই পারছেন, জনাব হারিছ খাঁটি মানে সোঁদা বাংলায় কথা কইতে বিশেষ অভ্যস্ত। কষ্ট করে প্রমিত উচ্চারণ কেন করবেন!
খাবারের এন্তার আয়োজন আছে। হাঁকপাড়া মাত্র একের পর এক আসতে লাগল। দেখে হারিছের নয়ন জুড়ায়, কিন্তু ততক্ষণে তার ধৈর্য ফুরায়। কই রে, হাতফাত কিছু ধোওন (বা মতান্তরে ধোন) লাগব তো, নাকি!
জনাব হারিছের ধমকে ব্যাপক কাজ হলো। ছোকরা টাইপ একজন তৎক্ষণাৎ স্যারের মনোরঞ্জনের জন্য জলদি করে পাতির বোতল আর হাত ধোয়ার জন্য একখানা আজব জিনিস নিয়ে হাজির।
কী জিনিস শুনবেন? শুনলে হাসতে হাসতে আপনাদের হাগুমুতু সব নিমিষে হাপিস হয়ে যাবে। এরে কয় বসের ঝাড়ি। ব্যাটা গাধা পানির বোতলের সাথে একখানা প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা ময়লা ফেলার ঝুড়ি নিয়ে এলো, যাতে কিনা হাজারো ছিদ্র। জনাব হারিছ এই প্লাস্টিকের ঝুড়িতে হাত ধৌত করে পানি ফেলবেন!
এতে জনাব হারিছ চরম খেপচুরিয়াস! চটে টকগেবুনের মতো লাল। থুক্কু, শব্দটা টকগেবুন নয়, টকবেগুন হবে। মানে টমাটো। এর নাম বর্ণ বিপর্যয়। আমরা অনেকেই যেমন রিকশাকে রিশকা, ফ্লাস্ককে ফ্লাক্স বলি।
বেল্লিক কোহানকার! তোমারে এই অফিসে কাম দিছে কেড? কোন খবিশে? ধমকের সুরে জানতে চান হারিছ।
সে মুচকি হেসে বলে, ছ্যার, আপনে খবিশে।
মাইনে? (হারিছ বলতে চেয়েছে মানে)
মাইনে খুবই কম ছ্যার। মাসে মাত্র পাঁচ।
পাঁচ মাইনে? পাঁচ পয়সা, হাজার না লাখ? তুমি কোন কুতুব আইছো যে তোমারে মেলা টেকা মাইনে দিতে অইবো! উল্লুক এট্টা!
একদফা ফলফুল খেয়ে জনাব হারিছ অফিসের কাজে ব্যস্ত ভীষণ। কাজের সাথে কাজু চিবুচ্ছেন হারিছ। কিছু একটা মুখে না থাকলে নাকি তার কাজেকামে মন বসে না। বেজায় ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আর তখনই যা নয় তাই গালাগাল বেরিয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে দপ্তরের অধঃস্তনগণ তার গুলিগালাজের হাত থেকে বাঁচার তাগিদে একের পর এক খাদ্যখানা এনে সাজিয়ে রাখছে।
জনাব হারিছের আবার পানের অভ্যেস আছে। না না, এপান সে-পান নয়, অনুপানও নয়। স্রেফ পান। আই মিন বেটেল লিফ। মুখের ভিতর দাঁতগুলো খুঁজে পাওয়া দায়। মানে এত কালো যে তরমুজের বিচিকেও হার মানায়। জনাব হারিছ যখন খান, এক রকম টকটক শব্দ হয়, যেন দুধের বাচ্চা নিপল চুষছে। অদ্ভুত কিন্তু খুব একটা বিরক্তিকর নয়। বেশ দুধের শিশু মনে হয়।
এই, এইটা কী? কি লিখছ এইটা?
এইটা হইলো ছ্যার আপনার মাথা!
খামোশ! আমার মাথা মানে! কী বলতে চাও?
আসলে ব্যাপার কি, কেরানিটির কথায় কথায় ‘আপনার’ শব্দ বলা অভ্যেস। যাই বলে, আগে একটা মাথা বসিয়ে দেয়। এই যেমন ধরুন ‘আপনার ভুল’ ‘আপনার মেয়ে’ ‘আপনার ঠ্যাঙ’ এই সব আর কি! এক রকম বাতিক।
জনাব হারিছের আরেকটা উদ্ভট স্বভাব আছে। মাঝে মাঝেই তিনি যাকেতাকে ধরে কানে কানে কথা কন। এতে নাকি আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। বুঝন একবার।
অফিসের খিদমতগার লাবুকে ডেকে মাছমাছ গলায় বললেন, একটু ইয়ে মাইনে ঠান্ডা কিছু হবে?
‘মাছমাছ গলা’ বুঝলেন না! মানে ফিসফিস করে হারিছ সাহেব অর্ডার পেশ করেন।
ঠান্ডা মানে ছ্যার, বরফ খাবেন?
হালায় কয় কী? এই, তোমারে ঢুকাইছে কোন্ মদনে? হারিছ সাবের মেজাজ জব্বর খিটখিটে এখন। পান পাওয়া যায়নি। পানিও না। লাল পানি না হোক, কালাপানি মানে কোলামোলা তো হতে পারত! সব শালা রাবিশ। অল বোগাস! কোনো কামের না!
ঢুকাইছে শুনে কিঞ্চিত মনক্ষুণ্ন হয় অফিসের ছোটবাবু রহমত। ঢোকাঢুকির কাজে তিনি মোটেও ওস্তাদ না। তিনি এখনো অপুত্রক জীবনযাপন করছেন। হারিছ সাব তাকে মিছামিছি দোষ দিতাছেন।
একটু পরে পান এলো, এলো পানীয়। পাবলিক জানে, জনাব হারিছকে খেপালে অধঃস্তন সকলের খাল খিঁচে প্রশান্ত মহাসাগর বানিয়ে দেবে। হারিছ যথেষ্ট রগচটা, ক্ষতিকারক ও চুকলিখোর প্রকৃতির মানুষ। বস্ হিসেবে সে রীতিমতো ভয়ংকর।
মধ্যাহ্নভোজনের মেলা আয়োজন। হংসডিম্ব থেকে শুরু করে হরিণশাবকের মাংস অব্দি ছিল। সকলে জানে, জনাব হারিছের প্রিয় পদ (মানে আইটেম) কোয়েলের ডিমভুনা। কিন্তু আপাতত তা পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো এক অদৃশ্য কারণে কোয়েলেরা ডিমপ্রদান বন্ধ রেখেছে। এই নিয়ে কাকেদের মনোবেদনার অন্ত নেই।
একদফা গেলার পরে হারিছ সাহেব একটু ধাতস্থ হন। তবে ভুলেও ভাববেন না যে বাসাতেও তিনি এতপদ ভোজন করেন। মানে যখন একটু টুরেফুরে যান, নিজের টাকায় টান পাড়ে না, তখন তার ‘খাই’ বাড়ে। ফাউ বলে কথা। ফাউয়ের স্বাদই আলাদা। অবশ্য জনাব হারিছ সেই লাঞ্চন গল্পের বুড়ির মতো বারবার বলে যাচ্ছে, উহু, এত কিছুর কী দরকার! ওই মদনা, এতপদ কেন পাকালে! দিন যাচ্ছে আকালে।
হারিছের টুকটাক ছন্দ আসে। এই যেমন ঢাউস একখান ঢেঁকুর তুলে অন্ত্যমিল দিলেন―
খানাদানা হল মেলা
কাজেকামে যায় বেলা!
লাবু অমনি বলে, বদগন্ধ ঢেঁকুরে, খানা খেল কুকুরে।
কী, কী বললে লাবু? আমি কুকুর! ধরে ফেলেন জনাব হারিছ। মানে তিনি কানে খাটো নন।
অমনি এত বিঘত জিভ কাটে লাবু। ছি ছি ছ্যার! আপনি কুকুর হবেন! আপনার তো ন্যাজা নাই। এমনভাবে লাবু ছ্যার বলল, যেন সাতসকালে বাচ্চারা সব লাইনে দাঁড়িয়ে ছ্যাচ্ছ্যাড় করে মুতু করছে।
হারিছের আবার ভাতঘুমের অভ্যেস। দিনভর কাজকাম তার পোষায় না। তিনি সোফায় শুয়ে ভাতঘুম দিচ্ছেন। লাবুর দায়িত্ব মশা খেদাবার। স্যারের ঘুম নষ্ট হলে বেজায় কষ্ট। লাবুর চাকরি নট।
ভরপেট খেলে কার না ঘুম পায়। ভরপেট তো নয়, বুকপেট সমান করে সাঁটিয়েছেন হারিছ। পরের হাতের মোয়া যে, মজা তো লাগবেই। লাবু বেশ গুরুত্বের সাথে তার দায়িত্ব পালন করছে। মশা তো ভালো, মশার বাচ্চাও ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে না।
ঘ্রাঁওৎ ঘ্রাঁওৎ শব্দে শিঙা ফুঁকছেন জনাব হারিছ। এমন সুরম্য সুরময় নাকডাকানো লাবু আর শোনেনি। সেও তাই আরো কাছে গিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে সশব্দ নাকাডাকা শোনার জন্য কান পাতে। এবং মজার ব্যাপার, জনাব হারিছের নাকের শব্দে মুগ্ধ হয়ে হারিছের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায় লাবু। সেই দৃশ্য বড়ই লোভনীয়। রীতিমতো দৃষ্টিনন্দন।
ঘুম ভেঙে আরেক দফা হাঁকডাক জনাব হারিছের। আরো কিছু খেতে চাই। না খেলে ঘুম ভাঙছে না। ঘুম তো বড় কম কষ্টের কাজ নয়! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শরীর কাহিল হয়ে যায়। খাবার আসছে। এই অবসরে হারিছ লাবুর সার্ভিসের ব্যাপক প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, লাবুর মতো খিদমতগার তার চাই। লাবুর জন্য তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
হারিছ সখেদে বললেন, এসো লাবু। কাছে বসো। তোমার জন্য গর্ভে আমার বুক ফুলে ওঠে।
মনে মনে বলি, শালা উজবুক বলেটা কি! গর্ভে কারো বুক ফোলে! হয় বল গর্ভে তলপেট ফুলে উঠেছে। বাচ্চা এসে গেছে। নইলে বল গর্বে বুক ভরে গেছে। ব্যাটা হারিছ, তোর ঘটে তো কিছু নাই। পুরোটাই ছাইপাস।
এই কাহিনির শেষটা বড়ই মজাদার। কাজকাম শেষে জনাব হারিছ গাত্রোত্থান করবেন। প্রায় সন্ধ্যে। হঠাৎ অধঃস্তনের মনে হলো, কিছু একটা বাদ রয়ে গেছে। জনাব হারিছ কিছু একটা খাননি।
কী খানা, তিনি যা খান না? হারিছ তো সর্বভূক, এটা সবাই জানে।
লাবু ছুটে এলো। ছারকে এবার ঘোল খাওয়ানো হবে। ছ্যার ছ্যার, একটু থামুন। এই জিনিস শুধু আপনারই জন্য। পিলিজ ছ্যার।
সে কি! ঘোল! সে তো মজার জিনিস। জনাব হারিছ বেজায় খুশি।
নিন্দুকেরা বলে, এটা কী হলো! বড়সাবকে ঘোল খাওয়ানো। এটা কোনো কাজের কাজ হলো! অফিসের বসকে ঘোল খাওয়ানো! মস্ত অপরাধ। এই অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন