X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০
ঈদসংখ্যা ২০২২

৫টি ফ্ল্যাশ ফিকশন

অনুবাদ : হুমায়ূন আজম রেওয়াজ
২৬ এপ্রিল ২০২২, ১০:৩৯আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২২, ১০:৩৯

অন্যরকম সমাপ্তি ।। ডায়ানে উইলয়ামস

এইবার, আমার এই গল্পটির একটি বিস্মৃত পরিসমাপ্তি আছে।

অবশ্য এটা সত্যিও।

এই গল্পটি বলবার পর, আমি সাধারণত বলি, এমন একটি গল্পের ভিত্তিতে আপনারা একটা নতুন ধর্মের গোড়াপত্তন করতেই পারেন, তাই নয় কি?

গল্পটি শুরু হয়, আমার কল্পনায় থাকা এক বিশালাকৃতির কুকুরকে ঘিরে, একটি ডোবারম্যান—যে কিনা আমার কাছে নিষ্ঠুরতার প্রতীক, একেবারেই ভালোবাসার অযোগ্য।

কুকুরটি আমার এক প্রতিবেশীর পোষা যাদের বাড়িটি আমার বাড়ির মতই পেছনের লাগোয়া উঠান দ্বারা সংযুক্ত।

বিশাল কুকুরটি যখন তখন বেরিয়ে পড়ে, একেবারে অসময়ে।

কুকুরটি এর মালিকের কাছে যখন ফিরে এল তখন তার মুখে একটি ময়লামাখা মরা খরগোশ।

কুকুর মালিকের চোখ বিস্ফারিত—তাদের কেউ করেছে—‘পাশের বাড়ির খরগোশ! সে মেরে ফেলেছে!’ ‘আমাদেরকে অবশ্যই যেকোনো মূল্যে আমাদের কুকুরের সুনাম ধরে রাখতে হবে’–কুকুরটির মনিব এই বলে কথার ইতি টানল। তারা ভাবছে, আমাদের কুকুর বিপদে পড়েছে।

কুকুরে মালিক মরা খরগোশটিকে শ্যাম্পু দিয়ে ভালো করে গোসল করিয়ে, হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে ভালো করে শুকিয়ে নিল। সেই রাতেই তারা মৃত খরগোশটিকে প্রতিবেশীর আঙ্গিনায় ঢুকে ফের খাঁচায় রেখে দিলো।

পরদিন সকালে, কুকুরের মালিক প্রতিবেশী খরগোশ মালিকের আঙ্গিনা থেকে ভীষণ চিৎকার শুনতে পেল। তারা ভাবল, ওহ, নিশ্চয়ই তারা মরা ঘরগোশটি খুঁজে পেয়েছে! কী ঘটেছে তা দেখার জন্য তারা সেখানে ছুটে গেল।

খরগোশ মালিকদের একজন—সেই পরিবারের পিতা–দুহাতে সাদা খরগোশটির নিস্তেজ দেহ আকাশে তুলে ধরেছেন। কুকুরে মালিককে দেখেই তিনি বলে উঠলেন—‘আমরা দুদিন আগেই তাকে কবর দিয়েছিলাম!’

কুকুরের মালিক কিছুই বললেন না। তারা বলবেনই না কিছু, কিন্তু তা এই কারণে নয় যে তারা নিজেদের নিয়ে লজ্জিত।

এখানে রয়েছে, আরও গুরুতর কারণ!


এখানে ।। এস ফ্রেডম্যান

এলভিস থাকে তিনটি বাড়ি পরেই। আমাদের আসলে সে অর্থে কোনো বাড়ি নেই, এগুলো হলো উজ্জ্বল ঢেউটিনের ছাউনি, ভেতরে কিছুই নেই, আমরা ছাড়া। আমার সকাল-সন্ধ্যা একে অপরকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাই ‍সাধারণ প্রতিবেশীর মতই কিন্তু এখানে কোনো খোলা বাগান নেই গল্প জমাবার মতো, অথবা খেলাধুলা কিংবা সেই আবহ, অতএব হাত নেড়ে স্বাগত জানানোটাই সামাজিকতা এখানে। আমাদের মধ্যকার দুটি ছাউনি অফিসিয়ালি ফাঁকা। হাট করে খোলা দরজা দিয়ে সিমেন্টের মেঝে উঁকি দিচ্ছে। সুতরাং, আমাদের আলাপের বিষয় হতে পারে এখানে কার ছিল বা কারা আসবে, কিন্তু সত্যি বলতে কি এখন পর্যন্ত আমি আসলে সামান্যতম আলাপের শুরু করতে বেশ বিব্রত বিশেষত কোনো মৃত কিংবদন্তি নিয়ে আলাপ করতে। আমি ভীষণভাবে আমার বাবা-মাকে এখানে দেখতে চাইতাম, অথবা সুন্দরী ন্যান্সি যার ব্রেইন টিউমার হয়েছিল যখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে। কিন্তু আমরা এখানে এসেছি বরং এক প্রতিশোধস্পৃহা থেকে, শুধু ব্যতিক্রম যেমনটা বলেছি, যখন আমাদের প্রতিবেশীদের যখন কাজের শুরুতে এবং শেষে দেখি এটুকু। আমরা এখানে আসলে পুরোদস্তুর আগন্তুক যাদের কাজের সময়সূচিতেই শুধু মিল রয়েছে।

আমি ঠিক জানি না, কে কোথায় যায় বা কোথা থেকে ফেরে। আমার ঠিক বিপরীত দিকের বাড়িতে একজন খর্বাকায় মহিলা থাকেন, সম্ভবত বামন। তিনি সবসময় ১৯৪০ সালের স্টাইলে খাটো বক্স ডিজাইনের পোশাক পরেন এবং সাথে থাকে একটি নীল লাঞ্চবক্স। তিনি সবসময় আমাকে অকৃত্রিম হাসি উপহার দেন যা এলভিসের মতো নয় এবং যার অন্তর্নিহিত শৌর্য ও মাধুর্য আমাকে উষ্ণ করে তোলে। তিনি ছাড়াও পাগড়িধারী এক স্থূলকায় শিখ থাকেন যার হাঁচির বিকট শব্দ শুনতে আমরা যে যার পথে বেরিয়ে পড়ি। কারো সাথে কারো গন্তব্য মেলে না। আমরা সম্মুখের পথ ধরে হাঁটতে থাকি কিন্তু দিগন্ত ক্রমশ প্রসারিত হতে হতে আমাদের পথ বদলে দেয় আর শীঘ্রই একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আমার মোটামুটি ভালোমানের একটি চাকরি আছে কিন্তু এজন্য আমাকে অনেক দূরে যেতে হয়। আমি কখনো ঠিক বলতে পারি না কতদূর যেতে হবে আমাকে কেননা পথটি প্রতিনিয়ত আমার জীবনের নানা অলিগলির সমন্বয়ে নতুন পথ হয়ে ওঠে—আমার স্মৃতিতে থাকা প্রথম বাফির পেছনের বনভূমি, লোহার সিঁড়ি বেয়ে আমার বাবার আইন ব্যবসার অফিসে যাওয়া, আমার স্কুলের মাঠ পেরিয়ে, আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর আবার বিয়ের পর তার বাড়ির গাড়িবারান্দা ছাড়িয়ে। এইসব স্থান এখন পরিত্যক্ত প্রায় একমাত্র আমার কাছে ছাড়া। ঘটনাচক্রে, এইরকম কোনো একটি দৃশ্যপটে আমি দেখতে পাই আমার বেঞ্চখানিতে আমার দিনের সব কাজ আমার অপেক্ষা করছে, একেবারেই স্বব্যাখ্যাত বিষয়, আপন খেয়ালেই বাজারে যাওয়া পথে করা হয়ে যায় কখনো, যেমন রাং ঝালাই, কিংবা দিনের কোনো এক ফাঁকে একগাদা চিঠি পোস্ট করা। কাজ করতে পারাটা স্বস্তিদায়ক, আমার কোনো অনুযোগ নেই এতে। কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, এলভিস এর খুব কাছে থেকেও দূরে থাকাটা আমাকে লক্ষ্যচ্যুত করে এবং কাজের সময়টাতে আচ্ছন্ন করেও রাখে।

আমার কাছে এটা স্পষ্ট নয় আমি একবারেই স্বতন্ত্র কি না। হতে পারে এখানে সবাই এলভিস এর কাছেপিঠেই আছে এবং সবাই তা যার যার মতো মানিয়ে নিয়েছে। হতে পারে এটা তাদের কাছে, যারা আমার মতো তার রেকর্ড বাজাতো বাবাকে বিরক্ত করবার জন্য এবং সেই রেকর্ডগুলো বাজেয়াফত করা হয়েছে কিংবা ভেঙে দুই টুকরো করা হয়েছে, কিংবা আবারও আমার মতো কেউ যে কি না তেরো-চৌদ্দ বছরের কিশোরীদেরকে বদমতলব হাসিল করতে পটানোর উদ্দেশে তার রহস্যময়তাকে কাজে লাগাত, তারা এখন রোজ দিনের শুরু ও শেষান্তে তার মুখোমুখি হচ্ছে, এবং ভাবছে তাকে কী বলা যায়। কিংবা হতে পারে আমি সহস্র কোটিজনের ভিড়ে একাই সৌভাগ্যক্রমে এই খ্যাতিমান মানুষটির নিকটতম প্রতিবেশী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেমন করে আমি এই মুহূর্তটিকে উদযাপন করব?

এবং প্রতিদিন, টিনের শিটগুলিকে ভাঁজ করতে করতে কিংবা কুঁচকে যাওয়া খামগুলো ঠিক করতে করতে আমি প্রথম সাক্ষাতের প্রস্তুতি নেই। আমি অবশ্যই তাঁর ওপর হামলে পড়ব না কিংবা তার প্রাইভেসি ক্ষুণ্ন করব না। আমি তাঁর দিনটাকে মোহনীয় করে তুলব যেমনটি করে সেই বামন মহিলাটি আমার জন্য। মাঝে মাঝে আমার ভীষণ ইচ্ছে করে প্রসঙ্গক্রমে তাঁর কোনো একটি জনপ্রিয় গানের লাইন উদ্ধৃত করতে। ‘একাকী রাস্তা ধরে চল যাই’ 'Takin’ a walk down Lonely Street’ আমি গেয়ে উঠতে পারি। আমি বেঞ্চে বসে উচ্চস্বরে গানটি অনুশীলন করতে থাকি; এটা করতে গিয়ে আমার কাঁপুনি আসে বারবার। আমার কি বলা উচিত হবে যে আপনাকে দেখতে দারুণ লাগছে? তিনি নিশ্চয়ই জানেন যে আসলে তা নয়। প্রায়শই সকালে দরজা খুলতে তার ভীষণ বেগ পেতে হয় এবং দরজা বন্ধ করে বেরুনোর আগে তাকে একবার লম্বা করে দম নিতে থামতে হয়। যখন তিনি তাঁর ছাউনি থেকে বেরিয়ে দিনের আলোর তীব্রতা মাপার জন্য কপালে হাত রেখে আকাশ পানে তাকান তখন তাঁর চোখ প্রায় বোঝা থাকে। কিন্তু তাঁর আত্মবিশ্বাসের দ্যুতি বিশেষভাবে চোখে পড়ে। যদি তিনি একটা গলিত লাশ হতেন কিংবা নিরেট কংকাল তিনি তখনও এলভিসই থাকতেন। তিনি যেখানেই যান সেটিই তাঁর জন্য উপযুক্ত মনে হয়। আমি বরং তাঁকে সহজ কখায় সম্ভাষণ জানাব যা তাঁর খ্যাতির বিড়ম্বনা হয়ে তাঁকে আঁকড়ে ধরে রাখবে না।

প্রতিদিনকার পথ ক্রমশ যেন দীর্ঘতর হয়ে যাচ্ছে, আমারে সবার জন্যই। আমরা যাত্রা করছি ঢের আগে এবং ফিরছি বহু পরে, অন্তত আমি, প্রকৃত কাজের সময় কমে যাচ্ছে আরও আরও। এটা পুরস্কার কিংবা শাস্তি দুইই হতে পারে। কিন্তু এর ফলে আলাপ জমাবার অবকাশ থাকে না খুব একটা। এর ফলে ক্রমশ আমরা একে অপরের কাছে স্রেফ ছায়া হয়ে উঠছি যার শুরু ঠিক উষাকালে আর সমাপ্তি গোধুলিলগ্নে। আজ সন্ধ্যায় আমি ভীষণ মরিয়া হয়ে তাঁকে দুহাত নেড়ে তাকে সম্ভাষণ জানালাম, ঠিক এমন ব্যাকুলভাবে যেন তাঁকে জরুরি কিছু বলবার আছে। তা দেখে এবং ঝালরঅলা জ্যাকেট পরে দরজার হাতলে হাত রেখে বিশালাকৃতির একটা মূর্তির মতো তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং আমার কথা শোনার জন্য কান পাতলেন। আমি বললাম, ‘বাড়ি, অবশেষে বাড়ি ফিরলাম।’ আমি তাঁর পুরো অবয়ব ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না কিন্তু আমার বিশ্বাস তিনি আমার দিকে তর্জনী তাক করলেন এবং কাউবয়দের মতো করে বৃদ্ধাংগুলি নোয়ালেন। এটা ছিল দারুণ মধুর ক্ষণ! এটা তিনিই ছিলেন। তিনি আমাকে চেনেন।


একজন কথাকারের পাপ ।। পাভাও পাভলিচিচ

একদা, যখন ত্রাসের রাজত্ব চারদিকে, গণগ্রেফতার হয়ে উঠল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রায়শই রাতেই এটা ঘটত, হুডিতে মুখ ঢাকা একদল মানুষ দরজায় সক করত এবং নিদ্রালু গৃহকর্তাকে পোশাক পরে নিতে বলত এবং এরপর তাকে নিয়ে যেত শহরজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট কারাগারগুলোর কোনো একটাতে। কখনো কখানো পুলিশরা পুরো পরিবারের সবাইকেই গ্রেফতার করত, শিশুদের এবং এমনকি বয়স্কদেরও যারা রসুইঘরে চুলার পাশে ঘুমাত।

শহরের জনসংখ্যা ক্রমশ কমে আসছিল এবং সারা রাত সমরাস্ত্র সজ্জিত গাড়িবহর বিভিন্ন কোণ থেকে লোকজনকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অনেকেই রাত্রে রীতিমতো পোশাক আশাক পরে গ্রেফতার হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই অপেক্ষা করতে লাগল, মাথার নিচে একটি পুঁটলি রেখে ঝিমানো যেন দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। মানুষজন আশ্চর্য হয়ে দেখল কারাগারে জায়গার কমতি নেই! কিন্তু এরপর একে একে প্রতিটি বাড়ি কারাগারে রূপান্তরিত হতে লাগলে। একজন মানুষ আরেকজনের বাড়িতে ঠাঁই পেতে লাগল ঠিক কারাগারের মতো; ধনী কেউ কোনো দরিদ্রজনের কোয়ার্টারে এবং এর ঠিক উল্টোটাও, স্কুলে সৈন্যরা, ব্যারাকে যাজকেরা, ডাক্তার এবং রোগীরা পতিতালয়ে, লম্পটের ঠাঁই হলো গির্জায়।

সেখানে শ্রমিকের ভীষণ ঘাটতি ক্রমশ বাড়তে লাগল এবং বন্দিরাই অধিকাংশ কাজ করত। যেহেতু সবাই এক অন্যের মতো সাধারণ পোশাকে ছিল এবং কয়েদির সংখ্যা গোপন রাখা হয়েছিল, এর ফলে কে বন্দি আর কে স্বাধীন তা ফারাক করা মুশকিল হয়ে পড়ছিল। এমনকি কয়েদিদেরই অন্যকে গ্রেফতার করার কাজে নিয়োগি করা হয়েছিল; তারাই বাঁকানো তরবারি বহন করত যদিও তারা নিজেরাও কয়েদি ছিল।

কয়েদিদের সংখ্যা বাড়তে লাগলে—এর পরবর্তী শিকার হলেন শহরের বজ্জাত প্রশাসকেরা। যাজক, বণিক, প্রধান কর্মকর্তাগণ, সেন্ট্রি, পিয়ন এবং অন্যান্যদেরও আটক করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সবাইকেই কয়েদ করা হলো, এমনকি প্রশাসকদের লোকেরা স্বয়ং। সবাই সবার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছিল, সবাই কয়েদি কিন্তু কেউ জানে না কে এসবের মূল হোতা, কে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে! সবার মধ্যে এমন একটা অনুভুতি কাজ করছিল যেন সেই এই নগর পরিচালনা, গ্রেফতার এবং কারাগারে সেবা প্রদান কাজের একজন অংশীদার। এবং যেহেতু সবাই সাধারণ পোশাক পরে আছে এবং সমান সুবিধা ভোগ করছে,—সবাই বন্দি হলেও—সবাই এমন স্বাভাবিকভাবে কাজ করে যাচ্ছিল যেন কিছুই হয়নি। তারা সবাই স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিল এবং সম্ভবত কেউ তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলত যে তারা সুখেই আছে।

বেশ কয়েক বছর পর, তারা এটা স্বীকার করতে রাজি হচ্ছিল না যে আদৌ কোন গ্রেফতার ঘটেছে কখনো এবং দাবি করছিল যে এটা আজগুবি বানোয়াট গল্প এবং নিঃসন্দেহে দুরভিসন্ধিমূলক উপাখ্যান।


রুটি ।। মার্গারেট অ্যাটউড

এক টুকরো পাউরুটি কল্পনা করুন। আপনাদের ঠিক কল্পনা করতে হবে না, এটি এখানে রান্নাঘরেই আছে, রুটির বোর্ডে, একটা পলিথিনে মোড়ানো, পোশেই রুটি কাটার ছুরিটা শোয়ানো। ছুরিটা বেশ পুরনো যা একদা নিলাম থেকে কিনেছিলেন যার কাঠের হাতলে ব্রেড শব্দটি খোদাই করা আছে। আপনি ব্যাগ খুলে মোড়ক সরিয়ে নিচজর জন্য পাতলা একটা টুকেরো কেটে নিলেন। আপনি এতে প্রথমে বাটার লাগালেন, এরপর পিনাট বাটার, এবং সবশেষে মধু মাখিয়ে ভাঁজ করলেন। কিছুটা মধু আপনার হাতের আঙুলে মাখামাখি হয়ে গেছে যা চেটে খেয়ে নিলেন। রুটিটা শেষ করতে আপনার মিনিট খানেক সময় লাগলে। পাউরুটি সাধারণত বাদামি হয় কিন্তু সাদা পাউরুটিও রয়েছে ফ্রিজে এবং এক গোছা রাই যা গতসপ্তাহে পেয়েছেন, যা দেখতে ফুলে ওঠা পেটের মতো লাগছিল, এখন কিছুটা ছাতা পড়েছে। মাঝেমধ্যে আপনিই রুটি বানান, এটা আপনাকে নিজ হাতে কিছু করবার মতো একধরনের প্রশান্তি দেয়।

একটা দুর্ভিক্ষ কল্পনা করুন। এবার এক টুকরো রুটি কল্পনা করুন। দুটোই বাস্তব কিন্তু ঘটনাক্রমে এই ঘরের ভেতর আপনি এর যেকোনো একটিকে বেছে নিতে পারবেন। এবার নিজেকে অন্য একটি ঘরে কল্পনা করুন, চিন্তাশক্তির কাজই তো এটা। আপনি একটি উত্তপ্ত কক্ষে পাতলা মাদুরের ওপর শুয়ে আছেন। ঘরের দেয়াল পোড়া মাটির তৈরি, আর আপনার সাথে এ ঘরে রয়েছে আপনার ছোট বোন। সে তীব্র ক্ষুধায় কাতর, তার পেট ফেঁপে আছে, চোখের ওপর মাছি বসেছে, আপনি হাত তুলে তা তাড়িয়ে দিলেন। আপনার হাতে একটি কাপড়ও আছে, নোংরা তবে ভেজাভেজা, এবং আপনি তা দিয়ে আপনার বোনের ঠোঁট, কপাল মুছে দিচ্ছেন। সেই রুটির টুকরোটি আপনি আসলে প্রায় বেশ ক’দিন ধরেই বাঁচিয়ে রেখেছেন। আপনারা দুজনেই একইরকম ক্ষুধার্ত তবে আপনি এখনও তারমত দুর্বল নন। এভাবে আর কতক্ষণ চলবে? কখন কেউ আরও রুটি নিয়ে আসবে? আপনি ভাবছেন বাইরে গিয়ে দেখবেন খাওয়ার জন্য কিছু পাওয়া য়ায় কি না, কিন্তু বাইরে ঝাড়ুদারদের ভিড় লেগে আছে আর চারিদকে গলিত লাশের দুর্গন্ধ।

আপনার কি রুটিটি আপনার বোনের সাতে ভাগ করে নেওয়া উচিত কিংবা পুরোটাই আপনার বোনকে দিয়ে দেওয়া উচিত? আপনার কি নিজেরই পুরো রুটিটি খেয়ে নেওয়া উচিত? যাইহোক, আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি, কারণ আপনি এখনও অতটা দুর্বল নন। এই সিদ্ধান্ত নিতে আপনার কতক্ষণ সময় লাগবে?

একটি কারাগার কল্পনা করুন। আপনি এমন বিশেষ কিছু জানেন যে বিষয়ে এখনও মুখ খোলেননি। যারা এই কারাগার নিয়ন্ত্রণ করছে তারা জানে যে আপনি এটা জানেন। যারা এর বাইরে তারাও জানে ব্যাপারটা। আপনি মুখ খুললে আপনার বন্ধু, সহযোদ্ধাদের জনা তিরিশ, চল্লিশ এমনকি শতাধিক লোক ধরা পড়বে এবং মারা পড়বে। যদি আপনি মুখ না খোলেন তবে আজই হতে পারে আপনার শেষরাত্রি। ওরা সাধারণত রাতকেই বেছে নেয় এসব ক্ষেত্রে। আপনি এখন রাত নিয়ে ভাবছেন না বরং ভাবছেন সেই রুটির টুকরো নিয়ে। আর কতক্ষণ? রুটির টুকরোটি ছিল তাজা এবং বাদামি। এটা দেখে আপনার মনে পড়েছিল কাঠের ফ্লোরে রোদের লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য মনে এসেছিল। এটা আপনাকে মনে করিয়ে দিলো একটি হলুদ বাটির কথা যা আপনার বাড়িতে ছিল। এর মধ্যে রাখা থাকত আপেল আর নাশপতি; টেবিলের এক কোণে রাখা থাকত যে তাও মনে পড়ছে। মনে মনে নিজেকেই বললেন, যদি এখন এই ঘরে সেই বাটিটি কিংবা যেকোনো কিছু হাতে নিয়ে দাঁড়াতে পারতেন। তারা যে রুটিটি দিয়েছে তা হন্তারক, এটা মোটেও প্রাণদায়ী নয়।

একদা সেখানে দুই বোন ছিল। তাদের একজন ধনী এবং নিঃসন্তান। অপর বোন ছিলেন বিধবা এবং তাঁর পাঁচটি সন্তান। সে এতটাই দরিদ্র যে তার ঘরে সামান্য খাবারও ছিল না। সে তার ধনী বোনের কাছে গিয়ে পেটভরে খাওয়ার মতো রুটি চাইল। আমার বাচ্চারা মারা যাচ্ছে, সে বলল। ধনী বোনটি জবাবে বলল, আমার নিজের জন্যই যথেষ্ট পরিমাণে নেই, এই বলে দরজা হতে তাড়িয়ে দিলো। এরপর ধনী বোনটির স্বামী ঘরে ফিরে এসে নিজের জন্য এক টুকরো রুটি কেটে নিতে গেল কিন্তু যখনি রুটির প্রথম টুকরো কাটল, রুটির ভেতর থেকে রক্ত বেরিয়ে এল।

সবাই জানে এই গল্পটির মানে।

এটি একটি জার্মান রূপকথা।

আপনাদের ভেলকি দেখানোর জন্য যে রুটির টুকরোটি নিয়েছি তা রান্নাঘরের টেবিলের ফুটখানেক উপরে ভাসছে। এটি একটি সাধারণ টেবিল, কোনো লুকনো দরজা নেই। একটি নীল তোয়ালে ভাসছে রুটির নিচ থেকে। তোয়ালে এবং রুটির সাথে টেবিল বা সিলিংয়ে কোনো সুতো আটকানো নেই। এটা প্রমাণ করার জন্য আপনি তোয়ালের উপর-নিচে হাত নেড়ে দিয়ে দেখালেন। আপনি রুটি ছুঁয়েও দেখেননি। কে আপনাকে আটকাল? আপনি আসলে জানতেই চান না রুটিটি সত্যিই আছে কি না বা নেই্ কিংবা এ শুধূই মতিভ্রম যা আমি আপনাদের মগজে কোনোভাবে বুনে দিয়েছি। এত সন্দেহ নেই যে আপনি রুটিটি দেখতে পাচ্ছেন, এমনকি গন্ধও পাচ্ছেন, ইস্টের ঘ্রাণ লাগছে নাকে এবং এটাকে শক্তই দেখাচ্ছে ঠিক আপনার পেশির মতই। কিন্তু আপনি কি এটাকে বিশ্বাস করতে পারছেন? এটা কি খেতে পারবেন? আপনি তা জানতেই চান না, কল্পনা করুন।


ফ্যাক্টরি ।। ম্যারি ডিল্ওর্থ

আমি সবসময়ই এই ফ্যাক্টরিটিকে ঘেন্না করতাম। এটা যেন এটা লোহার রুগ্ন কাঠামো অনেকটা কংকালের মতো। আমি সবসময়ই এর লাল ইটের দেয়ালকে মাথায় না রেখে, রক্তিম আকাশের বিপরীতে কালো নকশা হিসেবেই কল্পনা করতাম।

অবশ্য আমি কখনো এটা নিয়ে কাউকে কিচ্ছু বলিনি, বিশেষত এরিকের কাছে। দেখতেই পাচ্ছেন সে ফ্যাক্টরিটি খুব পছন্দ করে। সে তার সামর্থ্যের মধ্যেই নিয়ন আলোর নিচে তার সাইনবোর্ড ঝোলাতে চায়। একবার সে একটা পেট্রোল পাম্পের ওপরে একটা রংধনু দেখতে পেয়েছিল। আমার মনে হয় তার ফ্যাক্টরি ছাদে ওরকম একটা রংধনুর জন্য সে সবকিছু কিছু বিক্রি করে দিতে পারে।

সে রোজ সকালে ঘুম খেকে ওঠে। সে বাথরুমে উচ্চস্বরে গান গায় আর নিঃশব্দে নাশতা করে। সে সবসময় পত্রিকার বিজনেস সেকশনের খবর পড়ে এবং যত্ন করে পত্রিকাটি ভাঁজ করে রাখে।

এটাই তার দৈনন্দিন জীবন, চার ভাগে বিভক্ত।

প্রথম অংশটি হলো তার সকালবেলা যা উপরেই উল্লেখ করেছি। তারপর সারা দিন কাটে ফ্যাক্টরিতে। সেখানে আবার সকাল-বিকাল দুটি পর্ব আছে।

সে আমাকে লাঞ্চের সময় জানানোর জন্য টেলিফোন করে। দুইবার রিং হবে, এটাই সংকেত। এর মিনিট পাঁচেক পরেই সে দরজায় হাজির।

দুপুরের আহারের সময় সে বই পড়ে, সাধারণত ওর প্রিয় কোনো ক্লাসিকস। তবে সে খুব একটা উচ্চশিক্ষিত নয়। আসলে, আমাদের প্রথম দেখা হয় শহর হতে প্রায় দশ মাইল দূরের একই ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে গিয়ে। এই ফ্যাক্টরিতে সাধারণ জুতা ও বুট জুতা বানানো হতো। আমি ছিলাম মালিকের সচিব আর এরিক কাজ করত ফ্লোরে।

প্রথম দিনটির কথা আমার প্রায়শই মনে আসে। সে খুব নার্ভাস ছিল আর এটা আড়াল করার চেষ্টা করছিল কিন্তু তার হাত কাঁপছিল। তাঁর ছুল বাদামি, চোখ বাদামি এবং ফ্যাক্টরির ওভারঅলগুলোও ছিল বাদামি। পেছনের দেয়ালে বাদামি চামড়ার জুতোর স্তূপের সাথে সে প্রায় মিশে যাচ্ছিল, সেসময় ভীষণ হাস্যকর লাগছিল দেখতে।

আমি তো তার দৈনন্দিন জীবনের কথা বলছিলাম, সে এখন আর মোটেও বাদামি নয়। ধুসর রেখাবলির মতো একফালি কাপড় মোড়ানো টাকের ওপর পাতলা চুলগুলো ছড়িয়ে রাখে সে। এবং সাধারণত সে একটা ধূসর কোট পরে, পকেটে একটা লাল রুমালসমেত। আমার মনে হয় তার চোখগুলো এখনো একই রঙের। তবে আমি তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। আপনি যদি জিজ্ঞেসও করেন আমি বলতে পারব না। আমি লক্ষ করেছি আজ রাতে তার চোখ অস্বাভাবিকরকম লাল ছিল কিন্তু তারপর সমস্ত দিন একবারে ভিন্নরকমভাবে কেটে গেল। মনে হলো যে, দিনের চারটি ভাগ একত্রে এসে উধাও হয়ে গেছে।

আমি চোখ বন্ধ করে দিনের দ্বিতীয় ভাগ বলে দিতে পারব।

বিকেলে সে অফিসে বসেই চা পান করে এবং এরপর ছয়টা পর্যন্ত কাজ করে।

টেলিফোনে দুইবার রিং হওয়া মানেই সে ঘরে ফিরছে রাতের খাবারের জন্য। তার খাবারের রুচি ভালো এবং খুব মজা করেই সব খায়।

সন্ধ্যায় সে নীরবতা পছন্দ করে। সে প্রায়শই বলে যে ফ্যাক্টরিতে ব্যস্ত একটা দিনের শেষে তার একান্ত ভাবনার জন্য কিছু সময় দরকার। এ সময় সে চোখ বন্ধ করে কনুইয়ে ভর দিয়ে দুই আঙুলে কপাল চেপে ধরে বসে থাকে। কিংবা কখনও সে ঠাঁই বসে আকাশের তারার পানে চেয়ে থাকে।

এরিক সবসময় খুব আগেভাগেই ঘুমাতে চলে যায়। এতে করে পরদিন সে খুব সতেজ অনুভব করে।

কিন্তু এখন, পরের দিনটি আর আসবে না। এটা আর এরিকের দিন হবে না। তার চোখ আজ রক্তবর্ণ, এমনভাবে তাকে আগে কখনও কাঁদতে দেখিনি।

আমি বলেছিলাম, আজকের দিনটি ছিল অন্যরকম। এখন রাত্রি, শীঘ্রই সকাল হবে। রাতের আকাশ ছিল লাল, দারুণ লাল। সেটা ছিল সুন্দর। লালোর উপর কালো। ঠিক যেন শিংঅলা কোনো শয়তান কিংবা কোনো জলসার চূড়ান্ত উদ্দাম রাগিনী।

আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। অগ্নিগর্ভ রাতের ভেতর স্টিলের বিকট কালো কংকাল। হ্যাঁ, অবশ্যই এর মধ্যে ফায়ার ব্রিগেড চলে এসেছে। আমি তাদের ডাকিনি। আকাশের বুকে লেলিহান শিখা দেখতে দারুণ লাগছিল। আমি কখনো এ দৃশ্য ভুলতে পারব বলে মনে হয় না। এরিক তখন ঘুমাচ্ছিল।

তারা এসে পৌঁছানোমাত্রই আমাদের জানিয়েছিল। এরিক শুরুতেই বুঝতে পেরেছিল যে সব শেষ হয়ে গেছে।

আমি রাত ভালোবাসি। মাঝে মাঝে আমি গভীর রাত জেগে এর আস্বাদ নেই, তারকামণ্ডলী এবং দিগন্তরেখা, আকাশের বিপুল বিস্তার, বাতাসের বাঁকবদলের খেলা।

আজ রাতটি ছিল একবারেই বিশেষ। এটা ছিল অন্যরকম এবং আমি ভীষণ ক্লান্ত তবে সুখী অনুভব করছি।

একটা দারুণ উচ্ছ্বাসের অনুভব ছড়িয়ে পড়ছে শিরদাঁড়াজুড়ে।

কেউ জানে না কী করে আগুন লাগল। দুর্ঘটনাক্রমে, তারা এটাই কারণ বলেছে। সবসময় আসলে তাই ঘটে।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
সর্বাধিক পঠিত
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!