X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
ঈদসংখ্যা ২০২২

৪টি ফ্ল্যাশ ফিকশন

অনুবাদ : দিলওয়ার হাসান
৩০ এপ্রিল ২০২২, ১৩:০১আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২২, ১৩:০১

বাঘ ।। মহিবুল্লাহ যেঘাম

সেদিন ছিল হাট-বার। বেশ কয়েক বস্তা আলু ট্রাকে তুলে দিয়েছিলাম। ওগুলো কুন্দোজে  নিয়ে যাব। বাজারে এসেছি তা-ও অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। দীর্ঘ শোরাও মরুভূমির পথ পাড়ি দিতে হবে আমাকে। ট্রাকের চাকা থেকে মেঘের মতো ধুলো বেরিয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।

মরুভূমি এত সমান যে মনেই হচ্ছিল না আমরা একটা পাহাড়ের চূড়া অতিক্রম করছি। ঘণ্টাখানেকের ভেতর অন্য কোনো গাড়ি আমার নজরেই এলো না।

কুন্দোজে পৌঁছুতেই  একটা চেকপোস্টে বাদামি মখমলের শার্ট পরা সশস্ত্র কজন সৈনিক আমাদের ট্রাক থামানোর জন্যে সিগনাল দিলো। তাদের একজন, যার লম্বা চুল পেছন দিকে নিয়ে একটা রুমালে বাঁধা—আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। ট্রাকের চারপাশে একটুখানি চক্কর মেরে  জামার নোংরা হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছল সে।

একটুখানি আড়চোখে তাকিয়ে  বলল, ‘এই মালগুলো কার?'

বললাম, 'আমার।'

'আসেন আমার সাথে।'

ট্রাক থেকে নেমে তার পেছন পেছন একটা দুর্গের কাছে গেলাম। একটা আঙ্গিনার সামনে দিয়ে জলস্রোত বয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ পপলার গাছের নিচে রেশমি কাপড় টাঙানো। পাঁচজন লোক মখমলের ম্যাট্রেসের ওপর বসে পাশা খেলছে। দশ পনেরো জন সশস্ত্র সৈন্য আশপাশে বসে খেলা দেখছে।  তাদের একজন বুঁদ হয়ে হাশিশ টানছিলো। জোরে টান দাও, আরও জোর। তার এক সঙ্গী তাকে খুব করে উৎসাহ দিচ্ছিল। সে ছ-সাত বার খুকুর খুকুর করে কাশল, তাদের উদ্দেশে হাত নাড়ল  তারপর হাশিশ ভরা সিগারেটটা অন্য একজনকে দিয়ে দিলো।

বড় চুলওয়ালা সৈনিক হাঁটু গেড়ে বসে খেলা দেখছিলো। কাপড়ের ওপর রাখা জুয়ার ভাগের টাকা যখন নিচ্ছিলো খেলুড়েরা সে বলল, 'তোমার ভাগ্য খুব ভালো হে।' জলাধারার পাশে বসে থাকা সৈন্যরা মাথা তুলে ওদিক তাকিয়ে একই কথা বলে চিৎকার করে উঠল।

জিতেছিল যে সে দশ হাজার আফগান নোট লম্বা চুলওয়ালার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, 'বাচ্চা ছেলেপুলের দিয়ে দাও।' তখনই আমার দিকে চোখ পড়ল তার। বলল,  'খালেস, কে ওটা?'

'স্যার, এই লোক ট্রাকের জিনিসের মালিক।'

'ওখানে কী জিনিস আছে হে?'

'কিছু আলু জনাব।'

'কোথায় নিয়ে যাচ্ছ এগুলো?'

'বাজারে নিচ্ছি বিক্রি করতে।'

'তাহলে তো ট্যাক্স দিতে হবে? '

আমি বললাম, 'ট্যাক্স আবার কিসের? আমার নিজের জমিতে ফলেছে ওই আলু।'

সে বলল, 'খালেস, এই লোককে এখানে আগন্তুক বলে মনে হচ্ছে। তোমার কী ধারণা সে গুপ্তচর?'

আমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে খালেস বলল, 'আল্লাহর কসম এই লোককে আগে কখনও দেখিনি।'

অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এই কমান্ডারকে আমি কোথায় দেখেছি। তার লম্বা চুল, সুন্দর চেহারা, লাল টকটকে ঠোঁট, গভীর কালো চোখ আর কোমল মেয়েলি কণ্ঠস্বর সবই তো আমার চেনা।

তখন আমার মনে পড়ল—এ তো  ফিরোজ। তার চিকন গোঁফ, ছাগুলে দাড়ি, লম্বা কুর্তা  আর কোমড়ে বাঁধা গুলি রাখার বেল্ট আমূল বদলে ফেলেছে তাকে।

ফিরোজ ছিল হাজি মুরাদ ভাইয়ের কাজের লোক আর নাচের বালক। অনেক দিন পরে দেখলাম তাকে। এই তো বছর কয়েক আগেও হাজি মুরাদ আমাদের দাওয়াত দিত তার বাড়িতে। নারীদের বেশে হাজির হতো ফিরোজ। পায়ে বাঁধা থাকত নূপুর। গালে রুজ পাউডার। ঠোঁটে লিপস্টিক। মেহেদি রাঙানো হাত আর সুর্মা লাগোনো মায়াবি চোখ ছিল তার। নেচে বিমোহিত করত আমাদের।

বছর পাঁচেক আগে গুজব রটেছিল ফিরোজ মুরাদ ভাইকে গুলি করে মেরে তার তরুণী বউকে নিয়ে ভেগে গেছে। ওই মেয়েটির সঙ্গে প্রেম ছিল তার। 

তিতিরপাখি শিকার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে মুরাদ মেয়ের বয়সী ওই বউটিকে পেয়েছিল। তখন আমার কানে এসেছিল ফিরোজ একটা জঙ্গি দলে যোগ দিয়ে তার কমান্ডার পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে বিস্তারিত কিছু জানা ছিল না আমার।

'এবার বলো তোমার পরিচয়। কাদের পক্ষ হয়ে তুমি গুপ্তচরবৃত্তি করছ?' ফিরোজের এই জিজ্ঞাসা আমার চিন্তার জাল ছিন্ন করে ফেলল।

'আমার নাম কুদ্দুস। আমি মুরাদ ভাইয়ের বন্ধু। আমাকে চিনতে পারোনি?' আমার এই কথা উচ্চারিত হওয়া মাত্র একটা প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘুষি আমার কাঁধের ওপর এসে পড়ল। মনে হলো শেষ হয়ে গেছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম মাটিতে সটান শুইয়ে ফেলা হয়েছে আমাকে, সঙ্গে চলছে জোরদার লাথি আর রাইফেলের বাটের বাড়ি।

মিনিট কয়েক পরে লম্বা চুলওয়ালা এক বন্দুকধারী আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে ফিরোজের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। কিন্তু আমার ব্যথা এত তীব্র ছিল যে কোনো মতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না।

ভয়ংকর দৃষ্টি হেনে আমাকে দেখল ফিরোজ। কণ্ঠস্বর কর্কশ করার জন্যে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, 'বল, আমি কে?'

'তুমি ফিরোজ।' বললাম আমি।

আমার মুখে জোরে একটা ঘুষি মেরে চিৎকার করে উঠল সে, 'না আমি কমান্ডার। আমি বাঘ।'

লেখক পরিচিতি : আফগান লেখক মহিবুল্লাহ যেঘামের  জন্ম কাবুলে ১৯৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। তিনি একজন চিকিৎসক, লেখক, অনুবাদক  ও নিবন্ধকার। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৪টি। এর মধ্যে আছে তিনটি উপন্যাস, দুটি ছোটগল্প, তিনটি শিশু-কিশোর উপন্যাস, পাঁচটি শিশু-কিশোর গল্পসংকলন আর একটি ভ্রমণকাহিনি।


সত্যনিষ্ঠ মিথ্যা ।। ফ্রাঙ্কি ম্যাকমিলান

বিশ্বাস করুন আমি একজন সত্যবাদী মিথ্যুক। আমার হৃৎপিণ্ডটা কুকুর দিয়ে খাওয়ালেও আমি আপনার কাছে সত্য প্রকাশ করব না।

জিজ্ঞেস করে দেখুন না আজ সকালে কী দিয়ে নাশতা করেছি। আমি তা-ই বলব যা আপনি শুনতে চেয়েছেন : খুব সাধারণ খাবার যা কি না আবার খাঁটি। এই যেমন ধরা যাক কলা, দুধ আর একটুখানি চিনি দিয়ে মেশানো গম থেকে তৈরি খাবার। টোস্ট আর শস্যদানা। আপনি সবই বুঝবেন। আপনার তখন মনে হবে আমি ঠিক আপনারই মতো। ঠিক আছে এখন আমাকে বক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারেন। নিন শুরু করুন।

কোনো বামনের সঙ্গে কি আমার বাগদান সম্পন্ন হয়েছিল? হ্যাঁ, কিংবা না দিয়ে উত্তর দিতে হবে। আপনি হ্যাঁটাই বেছে নিন।

তার নাম স্টান। এখন সে পরে আছে কালো স্যুট আর দরজার হাতলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে প্রস্তুত। দুপা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে যাতে আপনি মোজা আর ত্বকের মধ্যবর্তী এলাকার গোলাপি মাংস দেখতে পান। দরজা হুট করে খুলে যাবে আর সে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়বে।

তার এই যৎকিঞ্চিত নৈপুণ্য আছে তার হাতের মধ্যে। কিছু সময়ের জন্যে তার গোলগাল হাত ভীত তারামাছের মতো প্রসারিত হবে। সে চুম্বন করতে পারবে। আমার ধারণা তার জিহ্বা স্বাভাবিকের চেয়ে পুরুষ্ট। জিজ্ঞেস করুন আমাকে। জিজ্ঞেস করুন কী জানতে চান আপনি?

তার পায়ের জুতাজোড়া বিশেষভাবে তৈরি। তার পা বেশি বড় না হলেও মোটা গোড়ালির কারণে ছড়িয়ে থাকে। স্টান বরং স্যান্ডেল পরতে পারত। আমি তাকে বললাম, একজোড়া রোমান স্যান্ডেল কিনে নাও না। এখন অবশ্য কেউ ব্রগুয়েজ জুতো পরে না। যেসব ডেন্টিস্ট আত্মহত্যা করে কেবল তারা পরে ওই জুতো।

আমার ছেলেপুলেদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করুন? একদিন আমি আপনাকে নিশ্চয়ই বলব আমার চারটে সন্তান ছিল। আরেক দিন বলব তিনটে। তাহলে আর একজনের কী হলো? তাকান আমার দিকে। চিবুকটা দেখুন। চোখের দিকে তাকাবেন না। রঙের দুটি দাগ দেখতে পাচ্ছেন? গাত্রে রক্ত চলে আসছে। আমি জানাব আপনাকে তাকে হারিয়ে ফেলেছি আমি। আপনি ভাববেন আমি অসতর্ক। বাচ্চাটাকে বাসে ছেড়ে আসুন, অথবা রেখে আসুন কিন্ডারগার্টেনে চেকসার্ট গায়ে কোনো এক আগন্তুকের কাছে।

আমার শিশুর জন্ম হয়েছিল একটা গ্যারেজের ভেতর। স্টান আর আমি এসব করেছিলাম। দেয়ালে টাঙ্গান ছিল ফ্রাঙ্ক জাপ্পা পোস্টার, সিলিংয়ে ঝোলান ছিল বাটিকের ছাপ দেওয়া কাপড়।

শিশুটিকে ঠেলে দেওয়ার সময় আমি রঙের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। স্টান ডাক্তার ডাকার জন্যে দৌড়ে গিয়েছিল, ওখানে কোনো টেলিফোন ছিল না। আর পাশের বাড়ির কেউ এমন ধারার সার্কাস দেখার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। কুকুরটি চেটে চেটে বাচ্চাটাকে পরিষ্কার করে ফেলেছিল। আমি একবার হাসছিলাম একবার কাঁদছিলাম। জানতাম না কুকুর কোনো নবজাতক শিশু চেটে পরিষ্কার করে কি না।

আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন। যা-ই হোক সে মারা গিয়েছিল। কুকুরটা দুধ বহনকারী ট্রাকের তলায় চাপা পড়ে মরে গিয়েছিল। ভালো কুকুর ছিল ওটা। স্টান শিশুটাকে তুলে নিয়েছিল কারণ দেখতে সে ছিল তারই মতো। এক রাতে তাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। তার কাছে অবশ্য একটা ছাতা ছিল। আপনি ভাবতেই পারবেন না একটা ছাতা নিয়ে কী করে একটা লোক এত ছোট একটা বাচ্চাকে নিয়ে পথ চলতে পারে। স্টান পেরেছিল।

বেশ কয়েক মাস আমার স্তন থেকে দুধ ঝরে পড়েছিল। দুধের গন্ধে ভরে গিয়েছিল ম্যাট্রেসটা। ওই গন্ধটা আমাকে সর্বত্র তাড়া করেছিল।

লোকজন মিথ্যেটা ধরে ফেলেছিল। আমি আমার বাচ্চাটাকে চিরদিনের জন্যে হারিয়েছিলাম। গর্ভপাত হয়েছিল আমার। একটা হাস্যকর সত্য আপনাদের মনে চমৎকার এক ছবি এঁকে দিয়েছিল। একটা বামন, একটা ছাতা আর একটা গ্যারেজ আপনাদের মাথা ধরিয়ে দিয়েছিল। আপনারা এখন বাঁকা চোখে আমাকে দেখবেন। অবাক হয়ে ভাববেন, আমি একটা ষড়যন্ত্রে হেরে গিয়েছি কি না।

আমি যখন আপনাদের বলছিলাম আমি মিথ্যা বলছি তখনই মিথ্যেটা বলেছিলাম। আপনারা জানতেন তা। আমি আপনাদেরকে ভাবতে দিয়েছিলাম, আরও কিছু কিছু মিথ্যে আমি বলতে চাই যা আপনাদের জানা ছিল না। কারণ আপনারাও মিথ্যে বলেন। আপনাদের মিথ্যে ছোটখাটো মিথ্যে। তুচ্ছ।

বলুন আপনারা সত্যনিষ্ঠ মিথ্যায় গড়া। আপনাদের মিথ্যের উৎকর্ষে আস্থা স্থাপন করতে চাই আমি। চালিয়ে যান। মিথ্যের ফুলঝুরি ছোটান। উপযুক্ত করে তুলুন তাকে।

লেখক-পরিচিতি : নিউজিল্যান্ডের কবি ও ঔপন্যাসিক ফ্রাঙ্কি ম্যাকমিলানের জন্ম খ্রাইস্টচার্চে ১৯৫০ সালে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যান্টারবারি থেকে শিক্ষা ও সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ১৯৯৯ সালে ক্রিয়েটিভ রাইটিংসে এমএ করেছেন ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটন থেকে। তাঁর প্রথম কবিতার বই ড্রেসিং ফর দ্য কানিবালস বের হয় ২০০৯ সালে। তার অন্য কবিতার বইটার নাম দেওয়ার আর নো হর্সেস ইন হ্যাভেন। তার গল্পের বইগুলো হচ্ছে : দ্য ব্যাগ লেডিজ পিকনিক অ্যান্ড আদার স্টোরিজ, মাই মাদার অ্যান্ড দ্য হাঙ্গেরিয়ান্স অ্যান্ড আদার স্টোরিজ, দ্য ফাদার অব অক্টোপাস রেসলিং অ্যান্ড আদার স্মল ফিকসন্স ৭২ বছর বয়সের এই নারী এখন হাগলে রাইটার্স ইনস্টিটিউটে ক্রিয়েটিভ রাইটিংস পড়ান।


আমার বাচ্চাটা ।। মারিয়া নেগরোনি

বাথরুমের ভেতর খেলছে আমার বাচ্চাটা। খুব আনন্দে আছে সে। তার চুল সাফসুতরো করার কাজে হাত লাগিয়েছি। কিছুটা সময় ব্যয় করছি একাজে। তারপর শুরু করেছে সে তার কাজ। পানি ঢেলে যখন তার চুল পরিষ্কার করতে লেগেছি—তাকে আর পাইনি। আমি চোখ সরিয়ে নেই, আবার তাকে পাই। কী ঘটছে বুঝতেই পারি না। একেবারে তেতো হয়ে পড়ি যাকে বলে। আচ্ছা করে বকে দেই তাকে। যা করছে সে তা মোটেও ভালো লাগছে না। বাচ্চাটা আমার হাসতেই থাকে। আরও বেশি বেশি মজা পায়। তার চোখে-মুখে বুদ্ধির একটা আভা লক্ষ করা যায়। অতঃপর আবার হওয়া হয়ে যায় সে। আমার ধৈর্যহীনতা ব্যাপারটাকে খারাপ একটা পর্যায়ে নিয়ে যায়। তার উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টা আরও বেশি দ্রুততার সঙ্গে ঘটতে থাকে, আমাকে প্রতিবাদটুকু করবার সময় দেয় না। অস্বস্তির স্তরের ভেতর দিয়ে আমি তার দুষ্টুমিমাখা দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করি। আমার অন্ধতা তার বিজয় নিশ্চিত করে। আমার ঈর্ষা তার প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিছু সময়ের জন্যে আমি তাকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হই। জানি না কী করে অসহায়ত্বকে স্বাগত জানাব। বাচ্চাটা শুধু একটুখানি খেলতে চায়। খেলাটা খুবই চমকপ্রদ আর টিকে থাকে সারা জীবন।


জলাশয় থেকে দূরে সবাই ।। রবার্ট লোপেজ

নিউইয়র্ক শহরে লতানো উদ্ভিদের সবচেয়ে কাছের জিনিস হচ্ছে মানুষ।

কথাটা আমি জোরে জোরে বললাম আমার পাশের মহিলাকে, কারণ আমার ধারণা সে আরিজোনো এলাকার অধিবাসী।

বৃষ্টি শুরু হলেই কেন জানি আমার মনে হয় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে। যখনই ক্রিক্রিং করে ফোন বেজে ওঠে কিংবা নাম ধরে কেউ ডাকে আমাকে, মনে হয় লিউনিদাস আছে থেরমোপাইলাইয়িতে আর কুস্টার আছে লিটল বিগহর্নে।

এর মানে কি আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি না।

সুখি হওয়ার ভান করার চালাকিটুকু কোর না আমার সঙ্গে, মহিলা উত্তরে বলে।

এই কথাবার্তা চলার সময় আমরা একটা জাদুঘরে বসেছিলাম। জাদুঘরের ওই বিশেষ রুমে দেয়ালের জায়গায় আছে জানালা, যার কারণে এর ভেতরের যেকোনো স্থান থেকে বাইরের আবহাওয়া সহজেই লক্ষ করা যায়।

এখানে শুধু আমি কথা বলছি না। কিছুক্ষণের জন্য থামি আর আবহাওয়া নিয়ে আলাপ চালিয়ে যাই যতক্ষণ না নিজেকে বলতে শুনি—বজ্রপাতের একটা ঝলক আর সবাই অবকাশ যাপনের জন্যে বাইরে আছে।

আমার মনে হয় কয়েক বছর ধরে এই মহিলাকে আমি চিনি। ধারণা করি, কলেজে আমাদের দেখা হয়ে হয়েছিল আর একে অপরের কাছ থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করে আসছি। আমার আর তার সমস্যা হচ্ছে—প্রদত্ত সময়ের মধ্যে ভালো কিছু করা সম্ভব হয়নি আমাদের পক্ষে। তারপর, ধারণা করি—মাস দুয়েক আগে নিউইয়র্ক এসে দরিদ্রদের সহায়তা ও তাদের জন্যে খাদ্য সরবরাহ বা তাদের নিয়ে কাজ শুরু করি।

আমার মনে হয় আমাকে নিয়ে সমস্যা বিস্তর,

যে বিষয়ে কিছুই জানা নেই আমার।

জানি না কেন এসব হচ্ছে, যদিও আমার সন্দেহ সবই ঘটছে আমার দোষে।

বাইরে বৃষ্টির প্রচণ্ড দাপাদাপি যেন কারও ওপর তার ভীষণ রাগ। যেন এমন কেউ—বৃষ্টির মাকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করেছে।

আমরা একটা বেঞ্চে বসে আছি ডিম্বাকৃতি একটা জায়গায় যাকে ঘিরে রেখেছে বিশ জন জবরদস্ত বক্তা। বক্তাদের মধ্য থেকে শিশুগায়ক দল বিদেশি ভাষায় গান গেয়ে উঠল। সেই ভাষা হয়তো ল্যাটিন। আপনি যখন এক বক্তার কাছ থেকে আর এক এক বক্তার কাছে যাবেন ভিন্নস্বর শুনতে পাবেন। মনে হয় জাদুঘরের কারণেই এমন হয়েছে। ডিম্বাকৃতি জায়গাটা থেকে বেরিয়ে এলে এক কণ্ঠস্বর থেকে আর এক কণ্ঠস্বরের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবেন না আপনি। আমার কাছে সব কণ্ঠস্বরই এক, এমনকি ভিন্ন কণ্ঠস্বরও।

আমার পাশের মহিলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। রাস্তার লোকজন আর ভবঘুরেদের চলাচল দেখছে।সে এমনভাবে বৃষ্টি দেখছে যেন আগে কখনও ধারাবর্ষণ দেখেনি।

তখনই আমি গৃহহারাদের বিষয়ে কিছু একটা বললাম। এমন একটা কিছু শুনে মনে হলো তারা আজ অন্তত ভালো করে গোসল করতে পেরেছে। কেন বললাম একথাটা? জানি না মহিলা একথায় কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে, এ ব্যাপারে আমার প্রচণ্ড কৌতূহল।

বালক-গায়কদের কথাবার্তা আর বৃষ্টির শব্দে মহিলা আমার কোনো কথাই শুনতে পেল না, যদিও তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম কোনো বিষয়ে মনস্থির করতে চেষ্টায় রত সে, যার মধ্যে থাকতে পারে আমার কাছ থেকে সরে পড়া, বৃষ্টিতে ভেজা কিংবা শেষমেশ দরিদ্রদের খাদ্য সাহায্য প্রদানে আত্মনিয়োগ। সে যেখান থেকেই আসুন না কেন, আমি সৌভাগ্যবান, সেখানে পৌঁছেই সে আমাকে ডাক পাঠাবে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু: ‘অপরাধ আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে’
প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু: ‘অপরাধ আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে’
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম