X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২
ঈদসংখ্যা ২০২৩

বাবুনি আমার বাবুনি

হোসনে আরা মণি
১৪ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:০০আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:০০

শহরের আকাশে অগণিত প্রেমের অবাধ ওড়াউড়ি। অথচ ট্রাফিকবহুল ধূলিমলিন রাস্তাগুলোতে অপ্রেমিক মানুষগুলোর উদ্ভ্রান্ত-বিফল দৌড়াদৌড়ি। প্রেম-অপ্রেমের এ চিরকালীন দ্বন্দ্বরেখায় আমার বসবাস।

অথচ মন আমার আকাশচারী। আদিগন্ত মেঘ-রোদের মায়াবী লুকোচুরি। মাঝে মাঝে কয়েক পশলা বৃষ্টিও ঝরে। দাপ্তরিক কাজকর্মের নীরস ভূমিতে সে বৃষ্টি আমার অন্তরাত্মাকে ভিজিয়ে রাখে।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি গল্প-কবিতা লিখি। জানি যে সেসব হয়তো খুব উঁচুদরের কিছু হয় না। তবু লিখি। না লিখে পারি না তাই লিখি। লিখতে লিখতে মনকে এই বলে প্রবোধ দেই যে, তোমার ভাগ্য ভালো যে তুমি তবু কিছু তৃতীয় শ্রেণির সাহিত্যসম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করছ, কোনো মানুষের মৃত্যুর নীলনকশা অন্তত তোমায় আঁকতে হচ্ছে না। পৃথিবীতে বহু বৈধ পেশা আছে যাদের কাজই মানুষের মঙ্গলের আড়ালে অমঙ্গল কামনা করা, সে দায় থেকে অন্তত কবি ও কথাসাহিত্যিকরা মুক্ত। না-হয় বাক্যবাগীশ আমরা কথার মালা গেঁথে সেই মালা বেচে খাওয়ার নিয়ত বুকে পুষে অনাহারে জীবনযাপন করি, কিন্তু মানুষের রোগ-শোক, দুঃখ-কষ্টকে উপজীব্য করে সাংসারিক উন্নতির স্বপ্ন দেখি না।

এমন যে নির্বিবাদ গোত্রের কলমজীবী, তার জীবনেও বিবাদ এসে হাজির হয়। আমি প্রেমে পড়ি এবং সেও হয়তো প্রেমে পড়ে আমার। কিন্তু এই প্রেম তো আর কোনো তরুণ কুমারের প্রতি কোনো ফুলকুমারীর প্রেম নয়। সমাজনিন্দিত এ প্রেমের আকর্ষণ যেমন অমোঘ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও অপরাধবোধের দহনও তেমন মারাত্মক। কাজেই আমি এক পা এগুলে পাঁচ পা পিছোই আর প্লাবন আমার দিকে দশ পা এগুতে থাকে। আমি তাকে অবিশ্বাস করি। অবিশ্বাস করি মূলত তার নিষ্ঠতায়। তার যে রূপ ও আকার-প্রকার তাতে যে ‘প্লেবয়’ শব্দটার সদর্প অথচ বিনয়ী উপস্থিতি অনুভব করা যায়! আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না যে সে এতকাল তার একমাত্র স্ত্রীরত্নের প্রতি বিশ্বস্ত জীবন কাটিয়েছে যেমন জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি আমি অনায়াসে।

প্লাবনের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় পাঁচ বছরের। পাঁচ-এগারো উচ্চতার শালপ্রাংশু পুরুষ প্লাবন। কালচে কুঞ্চিত গঠনের ঠোঁটে, নাকি বাদামি চোখের মণিতে, কোথায় যে কী তা ঠিকঠাক ধরতে না পেরেও আমি একটা অনির্বচনীয় গোছের টান অনুভব করেছিলাম সেদিন যেদিন ইনফো সরকার-২ এর প্রশিক্ষণ কক্ষে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। অফিসিয়াল ওয়েবসাইট নির্মাণ ও তার উন্নয়ন কৌশল রপ্ত করা ছিল সেই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য। আইটিতে আমি তত স্মার্ট নই। আর আমার ছোট্ট অফিসের গুটিকয় মাত্র কর্মীদের তো এ বিষয়ে তখন এ বি সি ডি জ্ঞানও ছিল না। তাই বিভিন্ন দপ্তরের জনা ত্রিশেক দক্ষ-অদক্ষ প্রশিক্ষণার্থীর ভিড়ে আমার অবস্থা ছিল খাবি খেতে থাকা মাছের মতো। একটা সাহায্যকারী হাতের প্রত্যাশায় ইতিউতি চোখ বুলোতেই যে চোখ জোড়ার গভীরে দৃষ্টি আটকে গেল তা যে জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত করল তা কি তখন বুঝেছিলাম? বোধ হয় না।

কাজ ও কাজের অছিলায় প্রশিক্ষণ পর্ব শেষেও আমাদের দেখা হলো। আর এসব সূত্রে পরিচয়টাকে ঘনিষ্ঠ করে তোলার সুযোগও মিলল। সুযোগ আমরা করে নিলাম দুয়েকটা সান্ধ্যভ্রমণের, দু-চার দিনের চা-চক্রের, এমনকি কোনো একদিন প্রাতঃরাশেরও। মোটকথা, বন্ধুত্ব জমার সূচনায় যা যা করা হয় তার কিছু আমাদেরও করা হলো, কিন্তু তবু যেন কিছু হলো না। আমার মনের একটা অংশ যেন আড় হয়েই থাকল। হয়তো আড় হয়ে গিয়েছিল প্লাবনের মনটাও। এত কম সময়ের পরিচয়ে যে মেয়ে তার প্রেমপ্রার্থীদের সম্পর্কে অবলীলায় বলে গিয়ে প্রকারন্তরে এই মর্মে সতর্ক করে দেয় যে ওসব প্রার্থীদের সমগোত্রীয় হলে তার কপালেও একই দশা ঘটতে পারে; তার ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশের উপায়টা কী? অতএব, সাড়ে চারটি বছর এভাবেই কেটে যায়। এর মাঝেই আমি মা হই। আমার দেহে মাতৃত্বের চিহ্ন ফুটে উঠতে দেখেই নাকি প্লাবন বছর খানেক নিজেকে নিশ্চুপ করে রাখে। তবে দূর থেকে সে নাকি ঠিকই আমাকে চোখের দেখা দেখতে এসে আমার অফিসের প্রধান ফটকের সামনের রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকত।

সেই প্লাবনকে আজ আমি স্মরণ করি। ফোনের আহ্বানে প্লাবনের বুকে কি প্লাবনী ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ করে ওঠে? চায়নিজ রেস্টুরেন্টের আলো-আঁধারিতে আমাকে দেখে তার বুকের ভেতর কি এক ‘আহা!’ জেগে ওঠে? জানি সেটা হলেও তা প্রকাশে সে সাহসী নয় এখনও। হয়তো দ্বিধাতুর, কারণ জানে যে, অমন কিছু বললে হাসিমাখা মুখ থেকে যে জবাব বের হবে তাতে তার মুখের হাসি নিভে যেতে সময় লাগবে না। চাটুবাক্য যে আমার কত শোনা হয় এবং সেসব শুনে যে কী প্রতিক্রিয়া হয় তার এক লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে উপসংহার টানব এই বলে যে, আচ্ছা, পুরুষদের বুকে এত ক্ষুধা কেন? এই সরল প্রশ্নের সহজতর জবাব দেয়ার হিম্মত প্লাবনের নিশ্চয় আছে; কিন্তু তাতে সম্পর্কটা হয়তো যাবে কেচে। এই আলো-আঁধারির মায়াঘেরা রোমান্টিকতায় এক ফুটি দূরত্বে মুখোমুখি বসে শীতল জল, ধোঁয়া ওড়া স্যুপ আর সুস্বাদু আমন্ড অ্যান্ড পি নাট সালাদ খেতে খেতে চিকন-মসৃণ অধরের নানা ভঙ্গিমার নড়াচড়া দেখার চেয়ে সুখের বিষয় আর কী আছে মধ্যবিত্তীয় পুরুষের ছাপোষা চাকরি আর ঘর-গেরস্তিময় জীবনে?

অতএব, আমি কত কী বলি! প্লাবন শোনে। কোথাও কোনো মন্তব্য দূরে থাক, টীকা-টিপ্পনি জুড়বার সাহসও বুঝি তার হয় না। নাকি হয়? চুপ থাকে এ কারণে যে চুপ থাকাই তার জন্য মঙ্গলের? বলা তো যায় না কোন কথায় কী প্রতিক্রিয়া ঘটে! বিগত দিনের ভালোবাসার মানুষের ভালো না বাসার গল্প কত মর্মস্পর্শী করেই না আমি বলি! আমাকে বলতে হয়। কারও প্রতি একটু দুর্বলতা অনুভব করলে এ গল্পটা বিপুল মানসিক আবেগে ফুলে-ফেঁপে উঠে আমার কণ্ঠের নিচে এসে দলা পাকায়। আর গল্পটা আমি জীবনে যত জনের কাছে করেছি ততবারই আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়েছে, প্রতিরোধ চেষ্টা সত্ত্বেও ছলছল চোখ থেকে বর্ষণ ঘটেছে! না, আমি ছিঁচকাঁদুনে নই। জীবনে গল্প-উপন্যাস পড়ে প্রচুর কেঁদেছি, কেঁদেছি পুরনো দিনের বাংলা ছায়াছবি দেখেও। কিন্তু সবই অপ্রকাশ্যে। চেষ্টা করেছি আর কোনো দর্শক-শ্রোতা যেন আমার অশ্রু উপাখ্যান না জানতে পারে। কেন জানি প্রকাশ্যে কান্নাকাটি ব্যাপারটাকে বড্ড মেয়েলি বলে মনে হতো, আজও মনে হয়। মেয়ে হয়ে জন্মেও এই যে মেয়েলি বলে অভিহিত ‘দোষ’গুলোকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা—এ তো নারীবাদিতারই লক্ষণ। মনে মনে আমিও নিশ্চয় নারীবাদী। কিছু ক্ষেত্রে বাইরেও কম নই। সমানাধিকারের প্রশ্নে আমি চিন্তনে-চেতনায় আপসহীন। কিন্তু বাস্তবের বহু ক্ষেত্রে কি আপসকামী নই? আমার এই আপসকামিতা জীবন ধারণ ও নিরুপদ্রব যাপনের প্রয়োজনেই। বিরুদ্ধ স্রোতের সঙ্গে সতত লড়াই করে কে পারে কত দিন টিকতে? স্রোতের ধারা উলটো দিকে বইয়ে দেয়ার ক্ষমতা কারও একক নয়। কেউ হয়তো পারে উলটো ধারার গুণকীর্তন করে জনমত গড়ে তুলতে, উলটে দেয়ার নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু আমার মাঝে আর যাই থাক নেতৃত্বের গুণাবলি নেই। আমি তাই গড্ডলিকায় ভাসতে ভাসতে অভিশাপ দেই এই ব্যর্থ জীবনকে, আর উদ্যত খড়্গ হয়ে থাকি তাদের ওপর যারা আমার কাছে যাঞ্চা করে প্রেম।

স্বল্পভাষী মানুষ প্লাবন, প্লাবন হাসান। কথা সে বলতে পারে হয়তো অনেকই, কিন্তু বলে না সব সময়, সব স্থান-পাত্রে। আমার মনে হয় সে সচেতন তার নীরবতার শক্তি সম্পর্কে। সে জানে মুখ বন্ধ রাখার মাহাত্ম্য। এই নীরবতার বাণ দিয়েই যে সে কত হরিণীকে ঘায়েল করেছে! কত মহিষাসুরমর্দিনীকে পর্যন্ত মর্দন করে ছেড়েছে! (এসবই তখন ছিল আমার নেহাত অনুমান)। দিলারা দিলশাদ জাহানের মতো প্রতাপশালিনী-ক্ষমতাময়ী থেকে শুরু করে কত সাধারণ রমণী তাকে পাওয়ার আকুলতায় ব্যাকুল হয়েছে! এই তো কদিন আগে তার এক দূর সম্পর্কীয় মামি তাকে কাছে পাবার আকুলতাময় বাণীতে মেসেঞ্জারে বাণ বইয়ে শেষে শুরু করল হুমকি প্রদান। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিংয়ে নারীদের মতো ওস্তাদি দখল জাত অভিনেতা পুরুষেরও বুঝি নেই। তা প্লাবন যে সেদিন রাধা মামিমাকে ফিরিয়ে দিল, তা শুধু এজন্য নয় যে সে মামার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে কৃষ্ণ বনতে নারাজ বলে; আসলে মামিমার নিবেদনের ধরণটাই তার আদপে পছন্দ হয়নি। অভিসারিকা হতে ব্যাকুল মামির আবেদনের মধ্যে সে কোথায় যেন দিলারা দিলশাদকে দেখতে পেয়েছিল, যে নারী তাকে কাছে পেতে নারীত্বের মতো ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহারের বদলে পার্থিব ক্ষমতার অনিত্য অস্ত্র ব্যবহার করেছিল।

প্লাবন ধৈর্যশীল। ‘সবুরে মেওয়া ফলে’ প্রবাদে সে সম্পূর্ণ আস্থাশীল। ‘অনেক কিছু যাও যে বলে কোনো কথা না বলি’ ধরনের চোখ-মুখ করে বসে থাকাতে তার জুড়ি মেলা ভার। আর এ ধরনের অভিব্যক্তি যে আমাকে এতটা টানে, তা কি ছাই এতদিন আমিই জানতাম! গত সাড়ে চার বছরে যা ঘটেনি, এবার কেন জানি তাই ঘটে যায়। সম্পর্কটা তরতরিয়ে এগোয়। তবে তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের ওঠানামার মতো সম্পর্কের বাঁশে উঠতেও দুই হাত উঠলে এক হাত পেছাতে হয়! আমারও একটি সত্তা ক্ষণে ক্ষণে পিছিয়ে আসতে চায়। আর এই দ্বৈত সত্তার দ্বন্দ্বময় উপস্থিতি ধরতে পেরেই কিনা প্লাবন আমার মেইলে এ দীর্ঘ চিঠিটা পাঠায়।

বাবুনি আমার বাবুনি,

তোমার জন্য আমার সেই ভালোবাসা যা তুমি সারা জীবন আকাঙ্ক্ষা করেছ অথচ না-পাওয়া জনিত শূন্যতাবোধে গুমরে গুমরে হাহাকার করেছ। কথাটা সোজা ও সরাসরি বললাম বলে কিছু মনে কোরো না। জীবনে আকাঙ্ক্ষানুযায়ী বা আকাঙ্ক্ষাযোগ্য ভালোবাসা খুব কম মানুষই পায়। তবে তোমার না-পাওয়াটাকে সাধারণ বলে মেনে নেয়া যায় না। তুমি আমার বাবুনি, আরও বহুজনের বাসনার আধার, তুমি কেন তোমার মনমতো মানুষের ভালোবাসা পাবে না? কিন্তু জানি যে এমন হয়, এমন হতে পারে। সার্থকতা লাভের যোগ্যতা যার আছে সেই যে সব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে তা তো নয়। এ পৃথিবী অজস্র দুর্ঘটনা ও ব্যতিক্রমতার সমাহার। যা ঘটা উচিত তার চেয়ে যা ঘটা উচিত নয় তার দিকেই যেন প্রকৃতি ও তার সন্তানদের ঝোঁক অধিক। তাই রত্নকে অবজ্ঞা করে সোনা-রুপার মোহে ছোটার মতো নির্বোধ জগতে বিরল নয়, বরং ওদের সংখ্যাধিক্যেই জগতের খোয়াড় পরিপূর্ণ। আর এই অবিরলতার ফলে তোমার চোখের কোলে অশ্রুহীরক যখন চিকচিকিয়ে ওঠে তখন কী দুর্বহ কষ্টেই না আমার বুকের ভেতরটা টনটনাতে থাকে!

বাবুনি, তুমি আমার বাবুনি। কত দিনের কত সাধনায় তোমাকে এই ছোট্ট শব্দটায় ডাকবার অধিকার পেয়েছি! এ আমার অর্জন, আমার চেতনার প্রচেষ্টার ফসল। তোমাকে আমি কোনোদিন কোনো পার্থিব সম্পদ-সুখের বিনিময়ে কিংবা প্রবল দুঃখের ঝোড়ো আঘাতেও হারাতে দেব না। আমি তোমাকে হারাব না বাবুনি। আমার ভালোবাসা কোনো জাগতিক চ্যালেজ্ঞের মুখে কখনো হার মানবে না। আমার এ আত্মবিশ্বাস তোমাকে অবাক করে। তুমি বলো, কীসের জোরে এ অহংকার? জোর আছে বাবুনি। জোরটা একদম বুকের তলায়, হৃদয়ের গভীরে।

তুমি বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলে। ভালোবাসাকে তুমি জানো সেক্স হরমোনের খেলা বলে। তুমি বলো মন থাকে মস্তিষ্কে। মানবিকের ছাত্র আমি। ভালোবাসা আমার কাছে মনের ব্যাপার এবং দেহেরও। দেহ তো মনের বাসগৃহ। দেহ-মনের সমন্বিত আকাঙ্ক্ষা যেখানে মিলে যায় সেই তো ভালোবাসার ইন্দ্রজালে ঘেরা ঐন্দ্রলোক। বাবুনি, তুমি আমার সেই ঐন্দ্রলোক।

বাবুনি আমার, আমার ভালোবাসায় কোনো সংশয় তোমার নেই। কিন্তু আমার নিষ্ঠায় তোমার অবিশ্বাস আছে। নিষ্ঠতা! এই কৃত্রিম শব্দটার প্রতি তোমারও লোভ, বাবুনি? যার অস্তিত্বের আয়ু কচুপাতায় জলের চেয়েও কম, দুর্বাডগার শিশিরের মতো সামান্য স্পর্শে যা ঝরে যায়, তা নিয়ে তো বড়াই করা চলে না। তাই একনিষ্ঠতার ভড়ং আমি করি না। ভালোবাসার ব্যঞ্জনায় যে ধ্রুবতা, তার সঙ্গে একনিষ্ঠতা ব্যাপারটা খুব মানানসইও নয়। তোমায় আমি কোনো কালে কোনো বিষয়ে কোনো অবস্থাতেই মিথ্যে দিয়ে ভোলাতে চাই না বলে ঐ তাত্ত্বিক ঘরানার নিষ্ঠতার প্রতিশ্রুতি দেব না। আমার বর্তমানের নিষ্ঠা তোমায় ভালোবাসায়। রহস্যময় ভবিষ্যতের কোলে কাল যেমন সতত বদলায়, তেমনি বদলায় মানুষে মানুষে সম্পর্ক, অভ্যাস, ভালোবাসা ও ভালোবাসার আধার। বাবুনি, আমি তাই তোমায় কোনো ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি না। আমি কেবল তোমাকে ভালো রাখতে চাই তোমার প্রতি মুহূর্তের বর্তমানে।

বাবুনি, যাপিত জীবনে এই বর্তমানটাই সবচেয়ে মূল্যবান ক্ষণ। বর্তমানের বর্তমানগুলো প্রতিমুহূর্তে অতীত হয়ে যায় আর অনাগত বর্তমানসমূহ কালের গর্ভে ঘুমিয়ে থাকে। ওগুলো নিয়ে মাথাব্যথা করা কোনো কাজের কথা নয়। তবু যেহেতু তুমি আমার অতীতের প্রতি কৌতূহলী আর আমাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, সেহেতু তোমাকে আমার অতীত খুঁড়ে কিছু গল্প উপহার দেয়ার ভীরু ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। আমার বিশ্বাস এ গল্পগুলো তোমাকে আমাদের জীবনে আকস্মিক ধেয়ে আসা সুনামির মতো কিংবা দীর্ঘমেয়াদে গলতে থাকা হিমবাহের মতো আচরিত সম্পর্কগুলোর রহস্যময়তা বুঝতে সাহায্য করবে। কৌতূহলী তুমি প্রায়ই জানতে চাও সেই নারীদের কথা যারা আমার জীবনে এসেছে কেউ বা উল্কা হয়ে, কেউ বা ধূমকেতু। রোমান্টিক তোমার মন। তাই কত রোমান্স নিয়ে তুমি তাদের কথা কল্পনা করো যারা আমাকে বিভিন্ন সময় টানতে পেরেছে, টেনে তুলেছে কিংবা নামিয়েছে। বাবুনি, তোমার সমৃদ্ধ কল্পরাজ্যে তুমি আমাকে রাজাভিষেক পেতে দেখতেই পারো, কিন্তু আসলে যে আমি কী পেয়েছি সে তো কেবল আমিই জানি। আর আজ জানাতে চাই তোমাকে। তাই এসো আমি আজ তোমায় একে একে পরিচয় করিয়ে দেই আমার জীবনে মাত্র এক রাতের তরে আসা এক অপরিচিতা, তিন বছরব্যাপী পীড়ন-পেষণ-পোষণ করতে থাকা ম্যাডাম দিলারা দিলশাদ জাহান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈকা প্রথম শ্রেণিতে প্রথম শিরোপা জয়ের বাসনাব্যাকুল ছাত্রী অনামিকার সঙ্গে। এদের কথা শোনার পরে যদি তোমার ধৈর্য থাকে তবে আমি অবশ্যই বলব আমার কৈশোর কালের সেই বাবুই পাখির কথা যার প্রতি এক ব্যাখ্যাতীত অনুভব আমাকে এই বহুকাল বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল সেই বোধ থেকে যাকে মানুষ প্রেম বলে জানে। আমার জীবনে বেশ কিছু কাণ্ড-অপকাণ্ডের ভিড় থেকে এই কয়টি ঘটনা তোমার দরবারে তুলে ধরে আমি অপেক্ষা করব তোমার বিবেচনার।

 

বাবুনি, প্রথমেই বলি সেই অপরিচিতার কথা যাকে আমি চোখের দেখাটাও দেখতে পাইনি। এক রাতে কিছু সময়ের তরে এসেছিল সে। কী তার নাম, কোথায় ধাম কিচ্ছু জানিনি, জানার চিন্তাও তখন মাথায় আসেনি। আর জানতে চাইলেও সে বলত বলে মনে হয় না। অলংকার খুলে রেখে, চুড়ো করে খোঁপা বেঁধে ম্যাক্সি মাত্র পরিধান করে লোডশেডিংময় ঘন কালো গভীর রাতে সবার নিদ্রার সুযোগে যে ‘কাজ সারতে’ আসে সে সম্পর্কের পরিচয় দিতে আসে না। অথচ নিকট হোক, কি দূর সম্পর্কের লতায়-পাতায়, সে আমার আত্মীয় নিশ্চয়।

তখন আমার বয়স কত—উনিশ কি কুড়ি। শৈশব থেকেই ছিলাম মাথায় উঁচু হাড় চওড়া গড়নের। চেহারাটা খাসা না হলেও মন্দ নয়, তাই না? পনেরো বছরে পা দিতে না দিতেই আমি নিজ থেকে বুঝে ফেললাম যে কালে দিনে আমি একখানা ‘জিনিস’ হব বটে। আসলে দিনে দিনে আমি যে নারীদের চোখ ও মনের দ্রষ্টব্য হয়ে উঠছি তা বুঝতে পারতাম ভাবিদের হাতে নাক টেপা আর আপাদের গাল টেপা খেয়ে। খালা-ফুপু শ্রেণিরাও কেউ কম যেতেন না। কোনো কাজের অনুরোধ করতে হলে তারা গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়েই তা করতেন। তো এভাবেই আমি নিজের দাম বুঝতে শিখি আর সচেতন হয়েও উঠি।

আমার এই সচেতনতা কিন্তু তোমাদের—মানে—মেয়েদের সচেতনতার মতো নয়। মেয়েরা যেমন আত্মসচেতন হয়ে ওঠার বয়সে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ এড়িয়ে চলতে চায়, আমি কিন্তু চাইতাম তার উলটা। আমার আকাঙ্ক্ষার জগতে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বলে কোনো শব্দ ছিল না। আসলে নারীর নরম হাতের কিল-চড়, কোমল আঙুলের চিমটি-খামচাটা প্রকাশ্যে পেলে একটু বিব্রত হতে হয় নিশ্চয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দেহ-মনের আকাঙ্ক্ষা যে তাতে আরও বেড়ে যায় সেটা কিন্তু ঐ নারীরাও জানেন। তুমি দ্বিমত এমনকি প্রতিবাদও করতে পারো বাবুনি, কিন্তু আমাকে বলতেই হবে যে, পৃথিবীতে ইভটিজিংয়ের চেয়ে অ্যাডাম টিজিংয়ের সংখ্যা ঢের বেশি। তোমাদের পরম সৌভাগ্য এই যে, অ্যাডামদের অধিকাংশই তোমাদের টিজিংকে গ্রহণ করে সারা দেহ-মন পেতে, ভালোবেসে। তবে টিজিংটা যদি হয় তাচ্ছিল্যসূচক তবে তা ইভ ও অ্যাডাম উভয়কেই সমান আহত করে। আমার কিছু হতভাগা বন্ধুর কাছ থেকে আমি এর কিছু নমুনা শুনেছি। কিন্তু আমার সৌভাগ্য যে কিছু কিছু নারী আমাকে সাময়িক সেক্স টয় হিসেবে ব্যবহার করলেও আমার আমিত্বকে কখনো হেয় করে দেখেনি, এক দিলারা দিলশাদ ছাড়া। তবে তার কথায় পরে আসছি।

ফুপাতো ভাইয়ের বিয়ে। বাড়ি ভর্তি মানুষে গিজগিজ। আরাম করে শোয়া-বসা দূরে থাক, কোথাও একটু কাত হয়ে অপরিহার্য ঘুমটা ঘুমিয়ে নেয়ারও স্থান নেই। নারীর দল ভেতর বাড়ির ভালো ঘরগুলোর খাট-মেঝে জুড়ে আর পুরুষেরা বাইরের ঘর, ভাঙা চৌচালা, বারান্দা ইত্যাদি স্থানের যে যেখানে পেরেছে বালিশ-কাঁথা সম্বল করে ঘণ্টা কয়েক কাত-চিত হয়ে পড়ে থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। ফুপুর আদরের ভাইপো আমি। আমার স্থান তাই ভেতর বাড়ির না ঘর না বারান্দা টাইপ খানিকটা ফাঁকা স্থানে। আধুনিক অ্যাপার্টমেন্টগুলোর ও স্থানটাকে নাকি ফয়ার বলা হয়। ফুফাতো ভাইয়ের পাঠানো রেমিট্যান্সের টাকায় ভেতর বাড়িটা একতলা হলেও অ্যাপার্টমেন্ট ঢঙে নির্মিত। শোয়ার জন্য আমাকে একটা তোলা তোশক দেয়া হয়েছে। শেষ কার্তিকের না উষ্ণ না শৈত্য আবহাওয়া। কাজেই গায়ে কোনো কাঁথা-কম্বলের দরকার নেই। এদিকে মফস্বলের বিদ্যুৎ, ভেল্কিবাজিতে বড় ওস্তাদ। মাঝরাত্রিতে ‘নাই’ হলে সকালের আগে আর দেখা মেলে না। তাই কবরের আঁধারের সঙ্গে তুল্য অন্ধকারে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে বা ঘুমোবার ভান করে পড়ে থাকা ছাড়া অন্য উপায় ভাবা বড় ভয়ংকর কারণ আমার পায়ের দিকে আরও গুটিকয় নানা বয়সী মানব-মানবীর দেহ ঠিকঠাক কাঁথা-বালিশ ছাড়াই সুপ্তির অতলে তলিয়ে আছে। ঘুমাবার আয়োজনের সময়ই দেখে নিয়েছিলাম—মানবীগণ ষাটোর্ধ্ব, মানবেরা শিশু।

সারা দিনের পরিশ্রান্ত দেহ। তাতে ব্যথা-বেদনাহীন শরীর ও মন। ঘুম আসতে সময় লাগল না। যদিও এমন পরিবেশে ঘুমোতে আমি অভ্যস্থ নই, তবু ঘুম এতটাই গাঢ় হলো যে গভীর রাতে কতক্ষণ ধরে একটি কোমল হাত পিলপিল করে দেহময় বিচরণ করলেও আমার ঘুম ভাঙতে ও ব্যাপারটা বুঝতে অনেকটা সময় লেগে গেল। আমি ঠিক জানি না যে কতটা সময়—শুধু সে যে কানের কাছে মুখটা নিয়ে লতিটা আলতো করে কামড়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এত ঘুম!’ —তাতেই আমি বুঝলাম যে আমি সাড়া দিতে সময় নিয়েছি আশাতীত রকম দীর্ঘ।

এরপর কী ঘটল সে বর্ণনায় আমি যাব না, বাবুনি। শুধু এটুকু বলি যে সেটা ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। অন্ধকার ছিল এতটা জমাট যা ভেদ করে আমি আমার মুখের সঙ্গে লেপটে থাকা মুখের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু স্পর্শ দ্বারা তার কমনীয়তা, লাবণ্য ও যৌবনের এবং ঘ্রাণের দ্বারা তার পরিচ্ছন্নতা ও রুচির যে পরিচয় পাচ্ছিলাম তাতে অনুমান করতে পারি যে সে মধ্যযৌবনা, দুর্দান্ত আবেদনময়ী, দোহারা গড়নের কোনো নারী যার আছে তীব্র সাহস ও তীক্ষ্ন আত্মবিশ্বাস। আজও আমি জানি না যে সেই নারী কে ছিল। তবে এরপর জীবনে কত শত-সহস্রবার রমণে রত হলাম, সেই অনন্যঅনুভূত সুখের অনুভব আর বুঝি হয়নি।

তোমাকে একটু বলতে হয় আমার স্ত্রীর কথাও। শারীরিকভাবে সে আমার জীবনের দ্বিতীয় নারী। তুলনামূলক কম বয়সে আমার বিয়েটা হয়েছিল। লম্বা-চওড়া দেহ কাঠামোয় যৌবনের জেল্লাটা হয়তো একটু বেশিই চোখে পড়ত। পাড়াতো ভাবিরা আমার দিকে যে চোখে তাকাত তাতে মায়ের মনে আশঙ্কা হতো। মা আমার প্রচণ্ড ধার্মিক ছিলেন। তাই পড়াশুনার পাঠ শেষ হতে না হতেই আমাকে বিয়ে করানো হলো। অবশ্য আমি তেমন পড়ুয়া স্বভাবের ছিলাম না, আর ক্যারিয়ারিস্ট তো নই-ই। তাই বিয়েটা মায়ের আদেশ ভেবে নিয়ে চোখ বুজেই করেছিলাম। আমার স্ত্রী সুশ্রী, শান্ত স্বভাবের মেয়ে। তার তেমন কোনো ‘চাই’ ছিল না, আজও নেই। তাই কাঠবেকার আমি বিয়ে করে সুখেই ছিলাম, আজও হয়তো শান্তিতেই আছি। যদিও এই দাম্পত্য ‘সুখ-শান্তি’র সঙ্গে তোমাকে এই ‘বাবুনি’ সম্বোধন মেলাতে গিয়ে অনেকেই বিষম খেতে পারে, কিন্তু এ কাহিনি সেসব অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নয়। যদি আমার এ জীবনকথাংশ তুমি কখনো সাহিত্যরূপ দাও তবে পাঠকের দরবারে এ কৈফিয়ত অগ্রিম দিয়ে রেখো যে, জীবন ফুটবল-ক্রিকেট-হকি-বাস্কেটবলের মতো নির্দিষ্ট মাপে দাগটানা, নিয়মের গণ্ডি আঁকা খেলাঘর নয়; জীবন আমাদের ছিবুড়ি, গোল্লাছুট, কানামাছির মতো উদার আধানিয়মতান্ত্রিক অনির্দিষ্ট আয়তনের ক্রীড়ানিকেতন।

স্ত্রীর কথা এ পর্যন্তই। জানি তার গল্পে তোমার উৎসাহও তত বেশি নেই। দিনের আলোর চেয়ে রাতের আঁধারে আমাদের আগ্রহ-কৌতূহল চিরকালই বেশি। তাছাড়া বউ নিয়ে খোশগল্প করার রুচি বিরল কিছু পুরুষের থাকে। আমি সে দলের নই।

 

হ্যাঁ, আমার পরবর্তী নায়িকার প্রসঙ্গে যাই।

ম্যাডাম দিলারা দিলশাদ জাহান। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতার টানটান গড়নের নারী। তিনি কতটা সুন্দরী সেটা যত না আমাদের চোখে পড়ত তার চেয়ে বেশি অনুভব করতাম তার প্রতি সমীহমাখা এক অদ্ভুত আকর্ষণ। শুধু আমি নই—রিয়াদ, মুহিত, বকর, তানজির প্রত্যেকের মধ্যেই বোধ হয় ব্যাপারটা একই রকম কাজ করত। মুহিত তো ম্যাডামের ব্যাপারে একধরনের ঘোরের জগতে বাস করত। ম্যাডামের সামনে দাঁড়াতে হলে তার গলা শুকিয়ে হাত-পা ঘামে ভিজে অদ্ভুত অবস্থা তৈরি হতো। ম্যাডাম কোনো কাজে ডাকলে মুহিতের যে মূর্ছা যাওয়ার দশা হতো তা দেখে আমরা হাসতাম, মাপমতো রসিকতাও করতাম। অফিসিয়াল ভব্যতার সীমা বজায় রাখতে হতো বলে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি। কিন্তু আমার মনে প্রায়ই এ কৌতূহল হতো যে, একটা ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সী বুয়েট এনজিনিয়ার ছেলে তার বসকে দেখলে অমন প্রতিক্রিয়া কেন দেখায় যেখানে বস একজন মেকাপ চর্চিত, শাড়ি-চুড়িতে অভ্যস্থ আবেদনময়ী নারী!

যা হোক, ইউনিলাভ বাংলাদেশ লি.-এর মূল ফ্যাক্টরিতে আমরা পাঁচ-ছয়জন চকোলেট বয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যথেষ্ট যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছিলাম। আমাদের মাথার ওপর এমডি (প্রোডাকশন) সালাম সোবহান স্যার ছিলেন বেশিরকম ভালোমানুষ। তার ভালোমানুষির সুযোগে প্রোডাকশন ম্যানেজারের কিছু পোয়াবারো ব্যবস্থা অলিখিত নিয়মে ফ্যাক্টরিতে চালু ছিল। যখন ওখানে অ্যাসিসট্যান্ট প্রোডাকশন ম্যানেজার পদে কাজে যোগ দিয়েছিলাম তখন আমি বয়সে বত্রিশ, দুই সন্তানের জনক এবং বাংলাদেশ সরকারের এক বড় বিভাগের প্রজেক্টে পাঁচ বছর কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। সংগত কারণেই ইউনিলাভের হালচাল বুঝে নিতে আমার বেশি সময় লাগেনি। একজন কান্ট্রি ডিরেক্টর তিনজন এমডি দিয়ে গোটা ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেন। এমডি (অ্যাডমিন) দিলশাদ হোসেন তরফদার সাতবার হজ করা নূরানি চেহারার মানুষ। এমডি (প্রোডাকশন)-এর কথা তো আগেই বললাম। আর এমডি (মার্কেটিং) দিলারা দিলশাদ জাহানের বয়স অনুমান করা শক্ত। তিনি এমডি (অ্যাডমিন)-এর কন্যা, এক ব্যারিস্টারের স্ত্রী, নিঃসন্তান, কর্মদক্ষ ও রাশভারী বলে খ্যাত। স্বাভাবিকভাবেই আমরা তাকে সমীহ করতাম এমডি (প্রোডাকশন)-এর চেয়ে বেশি। অথচ চাকরির নিয়মে আমরা যারা প্রোডাকশন সেকশনে আছি তাদের প্রতি কোনো সরাসরি খবরদারি এমডি (মার্কেটিং) করতে পারেন না। কিন্তু জগতের সব কাজ নিয়মমতো চলে না। তাই দেখা যেত, এমডি (মার্কেটিং) প্রায়ই ফ্যাক্টরি ভিজিট করতেন, আমাদেরকে আদেশ-নিষেধের চরকায় চরকি নাচন নাচাতেন। আমরা বশংবদ ভঙ্গিতে তার অমৃত বচন গিলতাম এবং তার প্রতি আমাদের আনুগত্যের প্রকাশ আমাদের ডাইরেক্ট বস এমডি (প্রোডাকশন)-এর প্রতি যা তার চেয়ে ঢের বেশি প্রকাশ পেত। ব্যক্তিত্বে দুর্বল এমডি (প্রোডাকশন)ও যেন এমডি (মার্কেটিং)-কে বস বলে ভাবতেন।

একদিন।

এমডি (মার্কেটিং) আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠালেন। এর আগে বিভিন্ন সময় তার চেম্বারে মুহিতেরও ডাক পড়ত। মুহিত ছিল আমার সমবেতনের কেমিক্যাল এনজিনিয়ার। ম্যাডাম আমাদের প্রোডাকশন ম্যানেজারকে পছন্দ করতেন না। সম্ভবত তার দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচার সম্পর্কে তিনি জানতেন কিন্তু ব্যাটা প্রোডাকশন ম্যানেজারের ঘাট খুব পোক্ত থাকায় তেমন কিছু করতে বা করাতে পারছিলেন না। যা হোক, ম্যাডামের এত্তেলা পাওয়ার পর আমার অবস্থা মুহিতের মতো অত খারাপ না হলেও বেশ একটু খারাপই হলো। হার্টবিট তো বেড়ে গেলই, সঙ্গে নানা অসুবিধা আমাকে ভেতরে ভেতরে অস্থির করে তুলল। তুমি জানো বাবুনি, আমার ভেতরের অস্থিরতার প্রকাশ বাইরে ঘটে না। শুধু তোমার ব্যাপার আলাদা। একমাত্র তোমার ব্যাপারে আমি মনের ভাব চেহারায় গোপন করতে পারি না। তোমার প্রতি আমার যত ভালোবাসা, যত আবেগ-আকুলতা, এমনকি যা কিছু ক্ষোভ-দুঃখ-বেদনা সবই আমার চোখে-মুখে তাৎক্ষণিক প্রকাশ পায়। তুমি আমার মুখ দেখে আমার ভেতরটা দেখতে পাও বাবুনি, কারণ তোমার কাছে আমি অভিনয় করতে পারি না। কিন্তু জীবনের অন্য সব স্থানে তো অভিনয়দক্ষতা আত্মরক্ষার ও আক্রমণের প্রথম অস্ত্র, নয় কি? কাজেই আমি বেশ সাবলীলভাবে সিনা টানটান অথচ বিনয়ী ভঙ্গিতে তার সমীপে হাজির হলাম। আমার আপাদমস্তক বার দুই-তিন নিরীক্ষণ শেষে তিনি ঠোঁটের ভাঁজে যে হাসিটা ফুটিয়ে তুললেন তা দেখে আমার পায়ের তলার মার্বেল কেঁপে উঠল। স্পষ্ট বুঝলাম যে আমি শিকার এখন শিকারির আওতায়।

বাবুনি, এই শিকার-শিকারির চিরন্তন দ্বন্দ্বটা দেখো। দেখো এর মিল ও বৈপরীত্য। এই পৃথিবীটাকে একটা জঙ্গল বলে ভেবে দেখো; এখানে দুটো দল—শিকারি ও শিকার। কখনো তুমি কারও শিকার, কখনো তুমিই আবার শিকারি। তো তুমি শিকার হবে, নাকি শিকারি তা কিন্তু নির্ভর করছে তোমার শক্তি-ক্ষমতা-বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের ওপর। তাই তুমি সবলের শিকার, দুর্বলের শিকারি।

ম্যাডামের সঙ্গে সেদিন যে কথাগুলো হয়েছিল তা চেষ্টা করছি এখানে হুবহু তুলে ধরতে।

প্লাবন...ইয়োর নেম ইজ প্লাবন হাসান, রাইট?

আমি ম্যাডামের টেবিলের সামনে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে। একটা লাল রঙা ফাইলের কাগজ উলটাতে উলটাতে ম্যাডাম আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললেন।

ইয়েস ম্যাডাম, অ্যাসিসট্যান্ট প্রোডাকশন ম্যানেজার।

আই নো দ্যাট। দিস ইজ ইয়োর প্রোফাইল—ব্যাচেলর অব আর্টস ফ্রম... ...

ম্যাডাম আমার বায়োডাটা গড়গড়িয়ে পড়ে গেলেন। তখনও পর্যন্ত তিনি আমায় বসতে বলেননি, আমি তাই ঠায় দাঁড়িয়ে।

প্লাবন হাসান, হোয়াই হ্যাভ ইউ নট হ্যাড অ্যা সিট ইয়েট?

সরি ম্যাম, আয়্যাম সিটিং।

প্লাবন...নট হাসান, ওনলি প্লাবন, ওকে?

ইয়েস ম্যাডাম।

ডু ইউ থিংক আওয়ার প্রোডাকশন ইজ গোয়িং থ্রু অ্যা ফেয়ারলি ম্যানার?

অফকোর্স ম্যাডাম। বাট দোয়াই দিস কোয়েশ্চেন ইজ এরাইজিং? এনি অবজেকশন?

অবজেকশন তো বটেই। তাও আবার এসেছে ফিল্ড থেকে। আপনারা ডিটারজেন্টে কিছু একটা গড়বড় করছেন। যে কারণে ইউজারদের হাত জ্বলছে, ফেনা হচ্ছে না, কাপড়ও ঠিকমতো পরিষ্কার হচ্ছে না।

সরি ম্যাডাম, এমন কিছু আমি এখনও শুনিনি।

এখন তো শুনলেন। কী কারণে এটা ঘটছে তা বলেন।

এ বিষয়ে কিছুই আমার জানা নেই। আপনি বরং প্রোডাকশন ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।

আমি কী করব সেটা আমি জানি। এই প্রোডাকশন ম্যানেজারটা আস্ত এক শুয়ার। ওটাকে আমি নর্দমায় পাঠাবার ব্যবস্থা করব। দেশের বৃহত্তম মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির প্রোডাকশন হাউজ এটা। আর আমি এর এমডি (মার্কেটিং)। কোয়ালিটির প্রশ্নে মার্কেট থেকে কোনো অবজেকশন আসলে আমি তা বরদাস্ত করব না।

ম্যাডাম, এটা নিয়ে দোষারোপ করতে হলে কিউসিকে আগে করতে হয়। ম্যানেজার (কোয়ালিটি কন্ট্রোল) তার বাহিনী নিয়ে কী করছেন?

আমাকে আগে গলদটা খুঁজে বের করতে হবে। তারপর সবগুলোর ব্যবস্থা নেব।

ম্যাডাম, সমস্যা শুনে মনে হচ্ছে ল্যাপচার মান বা পরিমাণে কিছু কম-বেশি ঘটছে।

ল্যাপচা মানে সালফোনিক অ্যাসিড তো? এর চালান তো ইন্ডিয়া থেকে আসে?

জি ম্যাডাম। ইআরসি এন্টারপ্রাইজ এর একক সরবরাহকারী।

ওদের রেপুটেশন তো ভালো। মান নিয়ে তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সমস্যা পরিমাণে। আপনারা ল্যাপচার ড্রামগুলো অন্য কোম্পানিতে পাচার করে দিচ্ছেন না তো?

সরি ম্যাম। আপনার সন্দেহ আমি মেনে নিতে পারছি না। যদি আমরা তাই করে থাকি তাহলে ম্যানেজার ডিপোরও তাতে সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা। এছাড়া কোয়ালিটি কন্ট্রোল সেকশনের কথা তো আগেই বললাম।

আই সি। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে এমডি অ্যাডমিনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। আমাদের চেয়ে বাজারে কিলো প্রতি দুই টাকা কম দরে অন্যান্য ডিটারজেন্ট বিক্রি হয়। ওদের কারও কারও কোয়ালিটি নাকি ইদানীং আমাদেরকে ছাড়িয়ে গেছে। এটা কীভাবে সম্ভব?

আমি চুপ করে থাকলাম। ইতোমধ্যে আমি অনেক কথাই বলে ফেলেছি। ম্যাডামের মুখের ওপর যে এত কথা বলতে পারব তা এ ঘরে ঢোকার আগে ভাবতেও পারিনি।

ম্যাডামও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ স্বর পালটে বললেন, আগামীকাল থেকে আপনি যদি ম্যানেজার (প্রোডাকশন) হন তো কেমন হয়?

আমার হার্ট কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল। কোনোমতে আমতা আমতা করে বললাম, কিন্ত জলিল স্যার... ...

ওটার চাকরি খাওয়া একটু শক্ত। আপাতত ওকে ডিপোতে লাগিয়ে দেব।

তাহলে ডিপো ম্যানেজার?

ঐ উল্লুকটার কথা না ভাবলেও চলবে। আগামীকাল আপনি চার্জ বুঝে নেয়ার জন্য তৈরি হন। আমি এখনই অ্যাডমিনকে চিঠি করতে বলে দিচ্ছি।

বাবুনি, এভাবেই আমি রাতারাতি প্রমোশন পেলাম। চাকরি শুরুর মাত্র সাত মাসের মাথায় এই অভাবিত ব্যাপারটা ঘটল। চাকরির নিয়মে এমনিতেই আমার বেতন প্রায় ডাবল হয়ে গেল কারণ সহকারী ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে ব্যবস্থাপকদের বেতনবৈষম্য ছিল ব্যাপক। বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়—এর এক সপ্তাহের মাথায় আরেকটা চিঠি পেলাম যাতে আমার কর্মদক্ষতার পুরস্কারস্বরূপ বেতনের সঙ্গে দুইটা ইনসেনটিভ যুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

খুব খুশি হওয়ার কথা। আমিও খুশি হলাম। কিন্তু কোথায় যেন একটা অস্বস্তির কাঁটা খচখচাতে লাগল। মাকে ফোন করে খবরটা দিতেও কেমন জানি দ্বিধা হলো। স্ত্রীর সঙ্গে তো এ নিয়ে কোনো কথাই বললাম না। আমার ভালোমানুষ বউয়ের অত খবরে কোনো উৎসাহও ছিল না। তার স্বামী মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছে এতেই সে তুষ্ঠ।

এরপর এলো সেই চরম দিন। এমডি মার্কেটিং আমাকে ডেকে পাঠালেন। কেন জানি না তখনই হঠাৎ টয়লেটে যাওয়ার চাপ অনুভব করলাম খুব। এই জরুরি তাগিদে সাড়া দিতে প্রায় পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে টেবিলে ফিরতেই দেখি দুটো জরুরি ফাইল নিয়ে হিসাবরক্ষক সুখচাঁদবাবু অপেক্ষায়। ওগুলো পড়ে আমি সই করলে তবেই তা ওপরের দিকে দৌড়াতে শুরু করবে। আর কী একটা ম্যাটেরিয়ালের সরবরাহ পেতে কাজটা তখনই করা জরুরি। অতএব, ফাইলে মন দেয়া গেল। এমন সময় পিয়ন মিলন চন্দর হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির। এমডি ম্যাডাম নাকি সমস্ত কাজ ফেলে আমাকে এখনই যেতে বলেছেন। ফাইলসহ সুখচাঁদ বাবুকে ঠেলে সরিয়ে মিলনের পিছে ছুট দিলাম। ম্যাডামের কামরায় ঢুকে মনে হলো যেন সিংহীর ডেরায় পা দিলাম। অপমানিত ক্ষমতাবতীর মেজাজের চেয়ে ভয়ংকর জিনিস বোধ হয় জগতে আর কিছু হয় না। গোখরার চেয়ে বেশি হিসহিসিয়ে ম্যাডাম বললেন, কতক্ষণ হলো তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি?

সরি ম্যাডাম।

নট ট্রাই টু ডিফেন্ড ইয়োরসেলফ। টেল মি হাউ ডু ইউ ডেয়ার টু ডু লেট হোয়েন আই কল ইউ?

ম্যাডাম আমি... ...

বুঝেছি। তোমাকে প্রমোশন দিয়ে বেতন বাড়িয়ে ভুল করেছি। তোমার যা যোগ্যতা তাতে এতটা তুমি কোথায় আশা করতে পারতে?

আমি নির্বাক। কেন জানি কণ্ঠটা হঠাৎ রুদ্ধ হয়ে গেল।

ওকে, সিট ডাউন।

আমি যন্ত্রচালিতের মতো একটা চেয়ারে বসে পড়লাম।

রিল্যাক্স। টি অর কফি?

নো, থ্যাংকস।

হোয়াই নো? ইটস অ্যা কার্টেসি অব ইউ টু অ্যাকসেপ্ট মাই অফার।

আমি নিশ্চুপ।

চেহারা এমন করে আছেন কেন? মনে হচ্ছে এত কিছু পেয়েও খুশি হননি?

সরি ম্যাডাম। আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না যে কিভাবে কী বলব।

প্লাবন, আপনি কি জানেন যে আপনাকে আমি কতটা পছন্দ করি?

না ম্যাডাম।

কি না ম্যাডাম? এ ক’দিনেও তা বুঝতে পারেননি?

ম্যাডাম, আমি ভেবেছিলাম যে প্রমোশনটা আমার যোগ্যতায় বা অন্যদের অযোগ্যতার ফলে হয়েছে।

ম্যাডাম তার ওষ্ঠে কৌতুক ও তাচ্ছিল্যের বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বললেন, তাই! আপনার এত যোগ্যতা?

অন্যদের অযোগ্যতায় হারানো সম্পদও তো আমার হাতে আসতে পারে।

সত্যি বলছি বাবুনি, আমি আসলে এমনই ভেবেছিলাম। মাত্র সাত মাসের চাকরিতে কারও প্রমোশন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যেহেতু ফ্যাক্টরিতে প্রচুর অনিয়ম আগে থেকেই চলছিল, যেহেতু তার অনেকটাই প্রশাসনের জানা ছিল এবং যেহেতু আমি এ ক’দিনে আমার সীমিত সাধ্যের ভেতরেও উৎপাদন বাড়ানোর নানা কার্যকর কৌশল উদ্ভাবন করেছিলাম, সেহেতু প্রশাসন আমার ব্যাপারে পজিটিভ ভাবনা ভাবতেই পারে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে কর্মতৎপরতাই তো প্রথম কথা, নয় কি?

আসলে আমার এই আত্মবিশ্বাসটার ভিত্তি ছিল আমার গত সাত মাসের কাজের মধ্যেই। উৎপাদন বাড়াবার জন্য আমি প্রথমেই শ্রমিক সন্তোষের দিকে জোর দিয়েছিলাম। প্রোডাকশন ম্যানেজার এ ব্যাপারে গুরুত্ব না দিয়ে শ্রমিকদের অসন্তোষ পুঞ্জিভূত করে তুলছিল। কিন্তু আমি ওদের সঙ্গে মিশে ওদেরকে খুশি করার এমন কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিলাম যাতে প্রতিষ্ঠানের কোনো ব্যয় বাড়ে না, অথচ উৎপাদন বাড়ে। যেমন—শ্রমিকরা যেহেতু ফ্যাক্টরির মধ্যে ধূমপান করতে পারত না, অথচ বিড়ি-সিগারেট ছাড়া তাদের একটা ঘণ্টাও চলে না, সেহেতু তারা একটু ফাঁক পেলে বা ফাঁক তৈরি করে নিয়ে গেটের বাইরে গিয়ে দরকার সেরে আসত। এতে করে গেটের বাইরে জটলা লেগে থাকত, আর তাদের যাওয়া-আসায় অনেকটা সময় ব্যয় হতো। আমি বিশেষভাবে সুপারিশ করে তাদের জন্য অফিসেরই পিছন দিকে একটা ছোট্ট রুমকে নিরাপদ স্মোকিং জোন করে দিলাম। আমি স্মোকার বলেই হয়তো তাদের প্রয়োজনের তাগিদটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। কিন্তু স্মোকার তো আরও বহু কর্মকর্তাই ছিলেন। কই, তারা তো কেউ ওদের কথাটা ভাবেনি! এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এমন আরও কয়েকটা বিষয়ের কথা বলা যায়। কিন্তু থাক। আমি জানি, তুমি অন্তত আমার প্রমোশনটাকে যোগ্যতার প্রাপ্তি বলেই ভাবছ।

বাবুনি, এরপর সেই বস নারী আমার আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে কেমন করে খেলতে শুরু করলেন সেটা বলি। পড়াশুনায় আমার সামান্যতার বিষয়টা আমাকে পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়ে এ কথা বলতেও দ্বিধা করলেন না যে তারা চাইলে আমার মতো দ্বিতীয় শ্রেণির এমএ ডিগ্রিওয়ালা ডজন ডজন পেতে পারেন। আমি প্রতিবাদ করতে পারলাম না। সত্যিই তো, লক্ষ লক্ষ উচ্চশিক্ষিত বেকারের দেশে সত্তর হাজার টাকা বেতনের চাকরির জন্য উপযুক্ত উমেদার পেতে কতটাই বা সময় লাগে! মোটকথা, আমি তারই করুণা বলে মুফতে আমার ভাগ্য খুলে নিয়েছি বলে জানলাম কিন্তু সেই করুণার পেছনকার কারণটা যেন অনুমান করেও করতে পারছিলাম না। ম্যাডাম শেষে ঝেড়ে কাশলেন। আমার নির্বুদ্ধিতায় তিতিবিরক্ত হয়েই কিনা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, আমাকে এতটা ‘ফেবার’ করার কারণটা নিঃস্বার্থ নয়। উনি আমাকে পেতে চান।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম, বাবুনি। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এরকম পদস্থ কোনো নারীর কাছ থেকে সরাসরি এমন প্রস্তাব! আমার বিস্ময় যেন সেই বিয়েবাড়ির রাতকেও হার মানাল। সে ছিল একরকম—প্রস্তুতিহীন হলেও প্রস্তুত করে নিয়ে নিঃশব্দ-নিঃশর্ত সমর্পণ। আর এটা! হায় খোদা! এতটা অপমানের পর এই প্রস্তাব!

আমাকে কাঠের পুতুলের মতো ভাবলেশহীন বসে থাকতে দেখে ম্যাডাম একটু নরম স্বরে বললেন, প্লাবন তুমি কি কখনো ভালো করে আমাকে চেয়ে দেখোনি?

আমার সংক্ষিপ্ত জবাব, না।

কেন? আমি কি দেখার মতো কিছু নই?

সরি ম্যাডাম। আপনি আমার বস। আমি ওভাবে তাকাতে পারি না।

যেন খুব আমোদ পেয়েছেন এমনভাবে খিলখিলিয়ে হেসে ম্যাডাম বললেন, আমার তো ধারণা যে তোমরা সারাক্ষণ আমাকেই দেখো, আমার কথা আলোচনা করো, আর রাতে ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে আমাকেই স্বপ্ন দেখো।

মেজাজ চিড়বিড়িয়ে উঠতে চাইল। কষ্টে নিজের মুখকে নিয়ন্ত্রণে রাখলাম।

শোনো, তুমি আমাকে অফিসে কম দেখলেই ভালো। এখন থেকে স্পেশালি দেখার সুযোগ পাবে। কি, সুযোগটা নেবে তো?

মাথাটা কেমন জানি ঘুরে উঠল। বর্ণনাতীত এক অনুভূতিতে সমস্ত শরীর-মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। চোখ তুলে ম্যাডামের মুখের দিকে তাকাবার সাহসও আর থাকল না।

মাথা নিচু করে বসে আছি। শুনি ম্যাডাম বলছেন, কতক্ষণ লাগবে একটা সহজ কথার জবাব দিতে?

আমি সময় চাইছি। ক্ষীণ অস্ফুট স্বরে উত্তর করলাম।

কতটা সময়?

কয়েক দিন।

ওকে। তিন দিন দেয়া হলো। আজ সোমবার। বুধবার অফিস সময়ের মাঝে সিদ্ধান্ত জানাবে। তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ভেবে দেখো চাকরিটা তোমার কতটা দরকার।

মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম। চেম্বারে ফিরে দেখি সুখচাঁদ বাবু তখনও আমার প্রতীক্ষায় ফাইল খুলে বসে আছে। আমাকে ঘামতে দেখে উঠে গিয়ে ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে এসে বলল, খুব আপসেট মনে হচ্ছে, কোনো সমস্যা?

আমি মাথা নাড়লাম।

সে দিন-রাত কোনোভাবে কাটল। পরদিন অফিসে ম্যাডামের খাস কামরায় ফের এত্তেলা। এ দিন আর একটুও দেরি না করে তার টেবিলের সামনে হাজির। বসতে বলার অপেক্ষায় না থেকে নিজেই চেয়ার টেনে বসলাম। আমার কোনো পরিবর্তন তার চোখে পড়ল কি না জানি না, কিন্তু তিনি অফিসিয়াল বিষয় ছাড়া অন্য আলোচনার ধার দিয়েও গেলেন না। আমার পরে মুহিতকেও ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ডিটারজেন্টের সমস্যা, বিউটি সোপের বাজার পড়ে যাওয়া, ইংল্যান্ড থেকে সেন্টের চালান আসতে দেরি হওয়া ইত্যাদি নিয়ে পৌনে এক ঘণ্টা ফলপ্রসূ আলোচনা শেষে আমরা যখন উঠতে যাচ্ছি তখন তিনি নির্দিষ্ট করে কারও দিকে না তাকিয়ে যেন আপন মনে বললেন, ওয়ান ডে গন।

চেম্বারে ফিরে এসে মুহিত আমাকে ধরে পড়ল, ওয়ান ডে গন মানে কী? ম্যাডাম এটা কেন বললেন?

আমাকে ডিটারজেন্ট সমস্যার কারণটা রিপোর্ট করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের একদিন পেরিয়ে গেল।

ভয়ে-আশঙ্কায় মুহিত আর কোনো কথাই বলল না।

 

পরদিন অফিস সময়ের মাঝে আমার সিদ্ধান্ত জানাবার কথা। কিন্তু সারা রাত এপাশ-ওপাশ করে কাটানোয় সকালে সময়মতো ঘুম ভাঙল না। সেলফোন সুইচ অফ ছিল। যখন ঘুম ভাঙল তখন মাথা ভারী, শরীরে জ্বর জ্বর ভাব। বেসরকারি চাকরিতে কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে ছুটি কাটাবার কথা কোনো বেকুবই ভাবে না। অথচ আমি নিশ্চিন্তে বিছানা আঁকড়ে থাকলাম, এমনকি ফোনটার সুইচ অন করতেও ইচ্ছে হলো না।

বেলা দেড়টার দিকে কলিংবেলের কর্কশ শব্দ। অনিচ্ছুক দেহটাকে টেনে এনে দরজা খুলতে না খুলতেই আরও দুইবার অধৈর্য হাতে সুইচ টেপা বেলের আওয়াজ। দরজায় কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিয়ন মিলন চন্দর। রাজেন্দ্রপুর থেকে লেকসিটি কনকর্ড আসতে ঢাকার দুঃসহ যানজট আর গরমে বেচারার জিভ বেরিয়ে গেছে।

অনুভূতিহীন দেহটাকে কোনোমতে টেনে নিয়ে অটোবির ফুল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের এপাশের একটা ভিজিটিং চেয়ারে বডি ফেললাম। ওপাশে বিদেশি দামি ব্রান্ডের রিভলবিং চেয়ারে এক হায়েনা।

বর্ণনাটাকে একটু সংক্ষিপ্ত করি, বাবুনি। যা বোঝার তা এতক্ষণে তুমি বুঝেই নিয়েছ। যে অতি বিরল প্রজাতির মানুষ এ ধরনের প্রস্তাবে অপমান বোধ করে বসের মুখের পরে রেজিগনেশন লেটার ছুড়ে মেরে সিনা টান করে বেরিয়ে যেতে পারে তার দলে আমি পড়ি না। আবার যে পুরুষ এমন প্রস্তাব এক কথায় লুফে নিয়ে সেরা পারফরম্যান্সের পরিচয় দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মতোও আমি না। আমি কী, কেমন, সে তুমি নিজেই ভেবে নিও। শুধু এটুকু বলি যে, সেদিন ম্যাডামের অনেক গরম কথা নরমভাবে সয়ে নিয়ে শেষে আমি তার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিলাম কিছু শর্তে। সেসব শর্ত সবিস্তার আলোচনা না করে এটা বলে রাখি যে, পরবর্তী যে তিন বছর আমি ঐ কোম্পানিতে ছিলাম সে সময়টায় ওখানে আমার চেয়ে ক্ষমতাধর কেউ ছিল না। খোদ ম্যাডাম কিংবা তার বাপ এমডি (অ্যাডমিন)-এর ক্ষমতাও আমার চেয়ে খাটো হয়ে পড়েছিল কারণ ফ্যাক্টরিতে সেটাই ঘটত যা আমি চাইতাম। সরাসরি ক্ষমতা প্রয়োগ যেটাতে সম্ভব নয় বা আমার ক্ষমতাচর্চা যেখানে দৃষ্টিকটূ সেটা আমি ওনাদের ক্ষমতা দিয়ে করিয়ে নিতে পারতাম। ভাবতে পারো, ম্যাডাম না হয় আমার দ্বারা নিয়মিত সরবরাহ পাওয়া সুখের স্বার্থে সব আবদার মেনে নিত কিন্তু তার বাবা মানবেন কেন? সত্যি বলতে কি, কেন জানি মনে হতো যে, ঐ বুড়োটা সব জানে-বোঝে, আর তাই আমাকে মনে মনে তীব্র ভয় ও ঘৃণা করলেও আমার কোনো চাওয়ায় না করত না।

তুমি আমাকে চেনো বাবুনি। আমার চাওয়াগুলো কেমন হতে পারে তা তুমি অনুমান করতে পারো। ফ্যাক্টরি তথা কোম্পানির ঘাড়ে আমি সিন্দাবাদের ভূত হয়ে চেপে বসলেও আমার মধ্যে বিবেক-বিবেচনাবোধ ছিল। যে প্রতিষ্ঠান থেকে আমার ভবিষ্যৎ নির্মিত হচ্ছে সেটাকে বাঁচিয়ে রেখে তবেই যা কর্তব্য তা করার নীতিতে আমি বিশ্বাসী ছিলাম বলেই আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানটির বাপ-বেটির অংশটা বহাল তবিয়তেই আছে।

প্রসঙ্গটা বোধহয় একটু গম্ভীর হয়ে পড়েছে। বাবুনি, এসো বরং আমরা ম্যাডামের চাওয়া-পাওয়া ও আমার দেয়া-নেয়ার দ্বন্দ্বময় অংশটাতে ফিরে যাই। আমাদের প্রথম অভিসারের দিন-রাতের ঘটনাটা বললে তুমি বাকি তিন বছরটাকে মোটামুটি চিনতে পারবে।

আমার দ্বারা মৌখিকভাবে আরোপিত শর্তাবলিতে ম্যাডামের মৌখিক স্বাক্ষর গ্রহণের মাধ্যমে সম্পাদিত চুক্তি বিবেকের পকেটে পুরে আমি তো কাজে মন দিলাম। ম্যাডাম মন দিলেন তার কষা ছক বাস্তবায়নে। এক সপ্তাহও পেরুলো না। একটা অফিসিয়াল ট্যুরের আদেশপত্র হাতে পেলাম।

বাবুনি, তুমি কি শুনতে চাও সেই প্রথম ট্যুরের অভিজ্ঞতা? জানি তোমার কৌতূহল হচ্ছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। মধ্যবয়সে প্রেম হলে প্রেমাস্পদের এতদিনের জীবনযাপনের ব্যাপারে জানার আগ্রহ তো থাকতেই পারে। আর এই আগ্রহের জবাবে কোনো ভণিতা, শঠতা, অভিনয় তথা মিথ্যাচার তো কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না, তাই না? মিথ্যার বেসাতি আমরা আমাদের দাম্পত্য জীবনে অহরহ করি। কম বয়সে প্রেমিকাদের সঙ্গেও প্রচুর মিথ্যা বলি, বলতে হয়। আমাদের জীবনবাস্তবতাবোধহীন প্রেমিকারা আমাদের কাছে যা আশা করে তাতে আশি ভাগ মিথ্যার দুধে বিশ ভাগ মাত্র সত্যের জল মিশিয়ে তাদের জন্য উপাদেয় করে আমরা পরিবেশন করি। জানি প্রেমিকারাও আমাদের জন্য তাই করে থাকে। কিন্তু তুমি তো শুধুই আমার প্রেয়সী নও, সবার আগে তুমি আমার বন্ধু। তাই মিথ্যার দুধ-মধুর চেয়ে সত্যের বিশুদ্ধ স্বাদহীন জলই আমি তোমাকে পান করাতে চাই। একই কথা তোমার বেলাতেও খাটে। জানি তুমি আমাকে কোনো মিথ্যা দিয়ে ভোলাতে চেষ্টা করোনি, করবেও না। আর তাই তোমার যাপিত জীবনের কোনো চোরা কুঠুরির খবরে আমার আগ্রহ নেই। বিশ্বাস করো বাবুনি, আমি ওসব কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমি তোমাকে চিনি। আমি জানি আর যাই হোক, প্রেমবিহীন কোনো গুপ্ত সম্পর্কে তুমি কখনোই জড়াতে পারো না। আর কোনো স্বার্থ ও শর্তের সম্পর্ক? না, তুমি কখনোই তা করতে পারো না। এই পুঁজিবাদী তুমুল প্রতিযোগিতাময় পৃথিবীতেও কেউ তো এমন থাকেই যে জীবনের সবকিছুকে ব্যবসার মূলধনে পরিণত করে না। আর তাই বাবুনি, আর তাই আমি তোমার জীবনের গল্পগুলোকে ভয় পাই। শান্ত মুখে ওসব শোনার জন্য যে বরফ হৃদয় থাকা দরকার তা আমার নেই। প্রেমিকের ছদ্মবেশে ছলনা ব্যাপারটা চিরকালই আমার ঘৃণার। ওর চেয়ে বরং ন্যায্য দামে বেশ্যাগমন আমার কাছে নৈতিক বলে মনে হয়। তাই তোমার যারা ব্যথার কারণ, যাদের প্রতি অবিশ্বাস তোমাকে তাবৎ পৃথিবীর প্রতি অবিশ্বাসী করে তুলেছে তাদেরকে আমিও ক্ষমার অযোগ্য বলে মনে করি। তোমার কুসুমিত মনটাকে অবিশ্বাসের গরলে-অনলে দগ্ধ করার চেয়ে গণহত্যাও কম পাপ বলে আমার মনে হয়। তাই বলছি বাবুনি, তোমার হৃদয় ভাঙার ভয়ংকর কাহিনির কিছুই আমি শুনতে চাই না। কিন্তু তোমাকে এ গল্পগুলো বলছি মূলত প্রেম ও কাম বিষয়ে যে মনস্ত্বাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কূপে তুমি বসবাস করো মানবজীবনে তা যে নতুন নয়, আবার তা যে চিরন্তনও নয়, সেই বিষয়ে আলোকপাত করে তোমার কূপটাকে এইটুকু আলোকিত করে তোলা, যে আলোয় তুমি তোমার নিজেকেও হয়তো নতুন করে আবিষ্কার করবে।

বাবুনি আমার, এই কাহিনি তোমাকে বলা খুব সহজসাধ্য কাজ নয়। লিখতে গিয়েই হাত আটকে যেতে চাইছে, বলতে গেলে কতটা বলতে পারতাম জানি না। হয়তো লজ্জা এবং দহনের বাষ্প আমার কণ্ঠের নিচে দলা পাকিয়ে বসত। অথচ ব্যাপারটা এতদিন আমার কাছে ঠিক এভাবে অনুভূত হয়নি। ওটা যে লজ্জার এবং অপমান বোধ করার যথেষ্ট কারণ যে ওতে আছে, তা আমার উপলব্ধিতে এসেও ঠিক যেন ধরা দেয়নি। আসলে প্রয়োজনের দাবির মুখে মান-অপমান বোধ যখন একাকার হয়ে যায় তখন যেকোনো দুষ্কৃতিতেও নিজের পক্ষে সাফাই তৈরি হয়ে যায়। অতিবড় পাপীও তার পাপের সপক্ষে গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা করতে পারে। এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত তুমি বিশ্বব্যাপী রাজনীতির ময়দানে প্রতিনিয়ত দেখেছ নিশ্চয়। তাই ক্ষোভ-ঘৃণা-অনুশোচনা ব্যাপারগুলো আমার মনের আকাশে শরতের মেঘের মতো ভেসে গেছে, স্থায়ী ঠাঁই পাততে পারেনি।

অথচ আজ বাবুনি, আজ তোমাকে আমাদের দেহজ অভিসারের প্রথম দিনটার কথা লিখতে সত্যিই হাত থেমে যাচ্ছে। আরে! আমি একজন সমর্থ-শিক্ষিত মানুষ। আমি কেন কিছু হীনবল কাপুরুষের মতো সুযোগ-সুবিধা-স্বার্থের পায়ে মানুষোচিৎ অহং ও আত্মমর্যাদাবোধকে বিসর্জন দেব! মানছি যে যেখানে জগতের বেশির ভাগ পুরুষই সুযোগসন্ধানী সেখানে নারীর পক্ষ থেকে আহ্বান এলে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মতো ‘বড়মুখ’ জগতে নেই বললেই চলে। এ লেখা যদি কোনো ‘চরিত্রবান’ পাঠ করেন আর আমার এ মন্তব্যের প্রতিবাদ হিসাবে তার জীবনের কোনো ‘মুখ ফিরিয়ে নেয়া’ কেসের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন তবে আমিও প্রতিবাদ করে এ কথা বলব যে, প্রাচীন যুগের জগদ্বিখ্যাত সব মুনিরাও তাদের শত বছরের সাধনা নৃত্যরত অপ্সরার পায়ে নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিয়ে ফেলতেন। এর দরুন তাদের সাধনা হয়তো নষ্ট হতো কিন্তু কোনো ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির মামলায় পড়তে হতো না। বর্তমান সময়ে যদি কখনো কোনো ‘মহামুনি-বীরপুরুষ’ নারীর ছলাকলাকে উপেক্ষা করে চরম ‘চরিত্রবান’-এর পরিচয় বহন করেন, তবে তিনি শুধু মামলা নয়, বরং মামলার সঙ্গে জড়িত আরও কিছু ‘নগদ প্রাপ্তি’র আশঙ্কাতেই তাদের ‘কল-কব্জা’র চরিত্র ঠিক রাখেন। চাকরি-ক্যারিয়ার—হ্যাঁ, এ যুগে এ বিমূর্ত জিনিসের মূল্য অন্য যেকোনো মূর্ত-বিমূর্ত বস্তুর চেয়ে বেশি।

পুরুষ চরিত্রে বহুগামিতার আকাঙ্ক্ষা প্রায় সব ধর্ম-সমাজেই এমনভাবে স্বীকৃত যে নারীপক্ষের আহ্বান উপেক্ষাকে সব সময় সচ্চরিত্র বলে মর্যাদা দেয়াও হয় না। এরকম ‘সচ্চরিত্র’কে বাহবা দেয়ার কালে বাহবা দাতারা দাঁত কেলিয়ে হাসে। জগতের কোনো আড্ডাতেই কোনো পুরুষ বুক ফুলিয়ে নিজেকে একগামী বলে জাহির করে না। বরং এর উলটোটা চোখে পড়ে। ধর্ষণের সেঞ্চুরিকে মোমবাতি জ্বেলে কেক কেটে উদযাপনের দৃষ্টান্ত তো এই আমরাই। কাজেই বহুগামিতা-পাশবিকতা যেখানে গর্বের সেখানে নারীপক্ষের আহ্বান... ... ..। কিন্তু আমার বেলায় এ যে আহ্বান নয়, স্পষ্টত আদেশ এবং হুমকি। রাজদণ্ডের মতো পুরুষদণ্ডও তো স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বপ্রিয়। তাহলে? এই তাহলেটা বলতে হলে আমাকে আরেকটু পিছনে ফিরতে হয়।

আমি তখন চাকরিহারা। ঠিক ‘হারা’ও হয়তো নয়; আসলে চাকরি আছে কি নেই তাই ঠিকমতো জানি না। যে প্রজেক্টের জন্য আমাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তা বন্ধ হয়ে গেছে। তবু সরকারি দপ্তরের প্রজেক্ট বলে কথা! সবার মনেই আশা এই যে, একদিন আমাদেরকে পূর্ণ সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দেয়া হবে। সেই তপস্যাধন্য মর্যাদা আমরা কবে পাব তা জানতাম না কিন্তু ঐ আশায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সরকারি বাসভবনেই আমরা মহাভারতীয় যুগের কঠোর তপস্যারত মুনি-ঋষিদের মতো অনিদ্রা-অনাহারে কোনো রকমে জীবনধারণ করে টিকে ছিলাম। কিন্তু যখন আমাদের শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগতে ভুগতে আর মামুলি অসুখেও ধুঁকতে ধুঁকতে আমাদের চোখের সামনে খাবি খেতে শুরু করল, এলাকার দোকানদারেরা বাকিতে এক পোয়া লবণ দিতেও অস্বীকার করতে শুরু করল এবং দোকানদারদের ভয়ে গভীর রাতে চোরের মতো ঘরে ফেরা অভ্যাস করতে হলো এবং আমাদের স্ত্রীদের রংজ্বলা ব্লাউজে অজস্র রিফুর এলোমেলো নকশা ফুটে উঠতে শুরু করল, তখন আমরা সরকারি চাকরি নামের মরীচিকার মায়া কাটাতে শুরু করলাম। এক দিনের এক বিশেষ ঘটনা আমি জীবনে কখনোই ভুলতে পারব না। সেদিন আমার দু’বছরী পুত্র আমার কাছে এক প্যাকেট চিপসের বায়না করেছিল। এবং অবিশ্বাস্য শোনালেও এটাই সত্যি যে আমার পকেটে চিপস কেনার দশটি টাকাও ছিল না বলে আমি গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছিলাম যাতে আমার পুত্র ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু বাসায় ফিরে দেখি সে তখনও জেগে আছে আর আমাকে দেখে প্রথমেই বলে, বাবা, চিপস...। মনে হচ্ছিল স্ত্রীকে ধরে আচ্ছা করে পিটুনি দেই—কেন সে একটা শিশুকে ঘুম পাড়াতে জানে না? কেন সে আমার অপারগতার দুঃসহ লজ্জাটা অনুভব করে না? সেই ঘটনা আমাকে বাধ্য করল নির্মম পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবতার কর্কশ মাটিতে জন্মজীবনে ডারউইনের থিওরিকে সপ্রমাণ করতে।

‘Survival of the fittest’—হ্যাঁ, ঐ ফিটনেসের প্রমাণ দিতেই আমি এমডি ম্যাডামের প্রস্তাবে শর্তসাপেক্ষে রাজি হলাম। যে পিতাকে তার শিশুপুত্রের এক প্যাকেট চিপসের বায়না পূরণের অপারগতায় পুত্রের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায় বিনা কাজে বাইরে ঘুরে-ফিরে গভীর রাতে চুপিচুপি বাড়ি ফিরতে হয়, তার পক্ষে চুরি-ডাকাতিও কোনো গুরুতর অপরাধ হতে পারে না। যদিও সেই ভয়াবহ দিন বিগত, তবু কি সেই দিন ফিরে আসার আতঙ্কে আমি সর্বক্ষণ ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে থাকি না? তোমরা মায়ের জাতি, বাৎসল্যের মহিমা নিশ্চয় তোমাকে আমার বোঝাতে হবে না। শিশুর মুখে কাঠি লজেঞ্চ পুরে বসিয়ে রেখে ঝোপের আড়ালে দেহ বিক্রি করে যে মা, তাকে যে তুমি চেনো না তা আমি মনে করি না। বাবুনি, তুমি অনেক অনুভূতিপ্রবণ, সূক্ষ্মদর্শী। দিগন্তপ্রসারি তোমার ভাবনা ও উপলব্ধি। তাই তো আমি তোমাকে আমার ভেতরটা উন্মুক্ত করে দেখাতে পারছি। তোমাকে যদি আমি অসংবেদনশীল গোত্রের বলে জানতাম, তবে এ কাহিনি এত বিস্তারিত লেখা দূরে থাক, এর ইঙ্গিত মাত্রও কখনো জানতে দিতাম না।

এখন বলো বাবুনি, তুমি কি ময়মনসিংহের রাজমহল হোটেলে এক ক্ষমতাময়ীর পুরুষসুধা পানের দৃশ্য দু’চোখ ভরে দেখতে চাও? জানি তোমার রুচি অত অধঃপাতে কোনোদিনই যায়নি।

বাবুনি, তুমি এখানে বলতেই পারো যে, নারী আর যাই করুক কখনো কোনো পুরুষকে ধর্ষণ করতে পারে না। পুরুষশরীরের ইচ্ছে জেগে না উঠলে ওটা সম্ভবই নয়। আমি তা অবশ্যই মানছি। কিন্তু শরীরী ইচ্ছে জেগে তো ধর্ষিতারও উঠতে পারে যদি তেমন পরিবেশ তৈরি থাকে বা তৈরি করা হয়। তাই বলে কি সেটা ধর্ষণ হয় না?

এ বিষয়ে আর বেশি কী বলব। শুধু ঐ সময়ে আমার মানসিক অবস্থা বিষয়ে কিছু বলার দরকার বোধ করছি। আমি যখন ম্যাডামের সঙ্গে বিছানায় থাকতাম তখন সময়টা কিন্তু খারাপ কাটত না। বিছানায় তার কামপারঙ্গমতা আমাকে বিস্মিত ও আনন্দিত করত। ও সময় কোনো নেগেটিভ চিন্তা আমার মগজের কোনো কোণেই ভেসে ওঠার সুযোগ দিতাম না। চরম শরীরী পুলক দেয়া ও নেয়া ছাড়া আর যেন কিছুই এর আগে-পরে নেই, জগতের কোথাও কারও প্রতি যেন আমার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। অথচ যখন সব উন্মত্ততার অবসান হতো, বন্যতার দাঁত-নখগুলো শিথিল হয়ে গুটিয়ে যেত, তখন এক অদ্ভুত অবসাদগ্রস্ততা আমায় পেয়ে বসত। মনে পড়ত মায়ের কথা, ‘বাবা, সব সময় সৎ পথে থাকার চেষ্টা করিস। এক জীবনে মানুষের খুব বেশি কিছুর দরকার হয় না।’ মনে হতো মাকে বলি, অনেক কিছুর দরকার হয় মা। এক জীবনের সঙ্গে যে আরও কয়েকটা জীবন জড়িয়ে যায়। আমার বাবন-পাপনদের মুখে ফেনের বদলে দুধ তুলে দিতে অনেক কিছুই করার দরকার হয়। আর ওরা যাতে বাকি জীবনটা দুধে-ভাতে থাকতে পারে তার বন্দোবস্ত করতে আরও যে কত কিছু করতে হবে!

কাজ শেষে ম্যাডাম টয়লেটে ঢুকতেন ফ্রেশ হতে, আমি পড়ে থাকতাম বিছানায়। টয়লেট থেকে শাওয়ারের ঝিরঝির শব্দ ভেসে আসত, আমার মাথার মাঝে দ্রিম দ্রিম আওয়াজ হতো। দাঁতে দাঁত পিষে মনে মনে বলতাম, খানকি। কখনো কখনো নাকি সুরের আবদার ভেসে আসত, এই, এসো না, ধুয়ে দেবে। আমি তড়াক করে উঠে বসে মুখে বলতাম, শিয়োর। মনে মনে বলতাম, হে খোদা! এই নটির হাত থেকে কবে আমায় পরিত্রাণ দেবে?

জানি, তোমার উন্নত রুচি এবার আহত হতে শুরু করছে। আমাদের হোটেল স্যুটে তুমি আর চোখ পাততে পারছ না। এবার তাহলে এসো তোমার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিই আমার রাজশাহীর বাসার বেডরুমে যেখানে আমার স্ত্রী থাকতেন।

আমার বউ খুব মিতভাষী। স্বভাবেও সে বেশ ভালো মানুষ। কিন্তু তার অনুমানক্ষমতা প্রখর। কী সে বুঝেছিল জানি না, কিন্তু ও সময় সে কখনো তার আচরণে স্ত্রীসুলভ প্রত্যাশার প্রকাশ দেখাত না। দুই-তিন মাসে একবার আমি রাজশাহী যেতাম, অথচ সে বেশ শান্ত নিরুত্তাপভাবে বাচ্চাগুলোকে মাঝখানে রেখে ঘুমিয়ে যেত বা হয়তো ঘুমের ভাণ করে পড়ে থাকত। কিন্তু আমি আমার ভেতরে তার প্রতি ‘স্বামীর কর্তব্য’ অনুভব করতাম। তার মনে যেন আমার প্রতি ঘুণাক্ষরেও কোনো সন্দেহ না ঢুকতে পায় এ জন্য আমাকে নানারকম কৌশল করতে হতো। চেষ্টা করতাম তাকে খুব প্রেম দেখানোর। দাম্পত্য প্রেমের সুবিধা এই যে, এখানে ঘটা করে ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ বলার যেমন দরকার পড়ে না, তেমনি বিভিন্ন ছোটখাটো বিষয়ে স্ত্রীর সন্তুষ্টি বিধান করেও চলতে হয় না। সম্পূর্ণ দেহজ প্রেম আর খাওয়া-পরা-থাকার সামর্থ্যমতো বন্দোবস্ত—মোটা দাগে এই তো আমাদের দাম্পত্য। তাই স্ত্রী নিয়ে আমাদের অত টেনশন কাজ করে না যতটা করে প্রণয়িনীকে ঘিরে। তবু আমার স্ত্রী-সন্তানদের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে কেমন এক অস্বস্তি হতো, তবে সেটা ক্ষণিকের। মনকে এই বলে প্রবোধ দিতাম যে, যা কিছু করছি তা তো এদেরই জন্য।

যা হোক, বাবুনি, আমার এই ম্যাডাম পর্বের এখানেই সমাপ্তি টানতে চাই। টানা তিন বছর ব্যাপারটা চলার পর একদিন আমি এ জাল কেটে বেরুতে পারলাম। তবে ততদিনে আমার জেলাসদরে একটুকরো জমি হয়েছে, আর সেই জমির বুকে একটা পাঁচতলা ভবন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গেছে। আর ব্যাংকে যা নগদ জমে আছে তাতে আগামী দশ বছর অনায়াসে বেকার থাকা চলে। সুতরাং এক সুন্দর ঝলমলে সকালে যখন আমি একটা রেজিগনেশন লেটার যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণের ব্যবস্থা করে আমার ছোট্ট লাগেজটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম তখন আমার পেছনটাকে এক অনন্ত ক্ষুধাময় হাঁ করা গুহা ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হলো না। না কোনো প্রেম, না প্রতীতি। তিন-তিনটে বছর উদ্দাম শরীরী সংসর্গের পরেও যে নারী আমার কাছে ভোক্তার বেশি আর কিছু হয়ে উঠতে পারেনি তার জন্য কী অনুভূতি আমি বয়ে নিতে পারি? কাজেই খুব ফুরফুরে মনে বাড়ি ফিরে এসে আমি তাকে করলাম একটা ব্যক্তিগত মেইল, যেখানে এই ছেড়ে আসার ব্যাপারটা প্রকাশ করলাম এভাবে :

জানি আপনি বিস্মিত হবেন, হয়তো রাগও করবেন কারণ যে পাখিকে সোনার শিকলে বেঁধে তার রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী দানাপানি জোগানো হচ্ছে সে কেন শিকল কেটে পালায়? শিকলটা সোনার, তাই কাটতে পারলাম; মায়ার শিকল হলে হয়তো এত সহজে নিজেকে উদ্ধার করতে পারতাম না। আপনাকে এ জন্য ধন্যবাদ যে আপনি সে মায়াঅস্ত্র ব্যবহার করেননি।

 

এবার আমার তৃতীয় উপাখ্যান শুরু করি, কী বলো, বাবুনি?

এই ঘটনাটা বলতে গিয়ে আমি সত্যিই লজ্জা বোধ করছি। তোমাকে এমন একটা বাজে বিষয়েও যে বলতে হবে সে বিষয়ক সতর্ক ভাবনা আগে মাথায় এলে তোমার কাছে সত্যি বলার প্রতিশ্রুতি দিতাম কি না সন্দেহ। যদিও জানি যে তুমি এতে কিছু মনে করবে না। আমাদের পূর্ব জীবনে যা কিছু ঘটেছে তার নির্মোহ স্বীকারোক্তি শেষে এক অপরের হাত মুঠোয় পুরে বাকি জীবন একসঙ্গে চলার প্রত্যয়ে আমাদের অভিসার জীবনের অভিষেক হবে— এমনই ছিল প্রতিজ্ঞা। এ প্রতিজ্ঞার দরুন আমাকে যে এখন লজ্জার তলানিটাও নিঃশেষে ধুয়ে পান করতে হচ্ছে বাবুনি। এখন মনে আশঙ্কা হচ্ছে যে আমার এতক্ষণের আখ্যান নানা বিবেচনায় তুমি স্বাভাবিক বলে মেনে নিলেও এটা নিতে পারবে কি না।

এটা কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়। আবার অতিপরিকল্পিত কোনো আয়োজনও নয়। কোনো ভালোবাসাবাসি নয়। দেহ কেনাবেচা নয়। আবার হয়তো ধর্ষণও নয়। এটা যে ঠিক কী তা ঘটনা বর্ণনার পর হয়তো তোমার কাছেই জানতে চাইব। বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তর তাত্ত্বিক পড়াশুনা তোমার। তুমি নিশ্চয় এর একটা নাম দিতে পারবে। তবে আমি মোটের ওপর এটা বুঝি যে, এটা মানুষের রক্তে মিশে থাকা বহুগামিতা ও যৌনবৈচিত্র্য তৃষ্ণারই একটি মামুলি উদাহরণ মাত্র। তখন আমি আমার সেই সরকারি প্রজেক্টের চাকরিটা পূর্ণ সরকারিভাবে ফিরে পেয়েছি। ম্যাডামের কবল থেকে পালিয়ে এসে মাত্র মাস ছয়েক বেকার দিন কাটাবার পর একদিন প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের প্রজেক্ট রাজস্ব খাতে যাওয়ার খবরটা পাই। অবশ্য এর মধ্যে আমি আরও একটা ভালো বেতনের চাকরির অফার পেলেও তাতে যোগদান করিনি। কেন জানি করপোরেট দাসত্বে যেতে আর ইচ্ছে করেনি। সরকারি চাকরি ফিরে পেয়ে আনন্দে ডগমগ। কত কাল পর নয়টা-পাঁচটা অফিস সেরে বাড়ি ফেরার পথে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা-ইয়ার্কির জীবন! তিনবেলা স্ত্রীর হাতের রান্না খাওয়া, সকাল-সন্ধ্যা সন্তানদের সান্নিধ্য পাওয়া, ছুটির দিনটা পরিবার বা পছন্দের কারও সঙ্গে কাটাতে পারা—এর চেয়ে সুখের জীবন আর কী হতে পারে? গত প্রায় চারটে বছর ইউনিলাভ বাংলাদেশ লি.-এর যাঁতায় নিজেকে আখমাড়াই হতে দিয়েছিলাম। সব রস নিংড়ে নিয়ে ওরা উচ্ছিষ্ট ছোবড়াটা ফেলে দেবে ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। সেই বঞ্চনার ক্ষতিপূরণ করতে শুরু করলাম ব্যাপক উদ্যমে। ব্যাপারটা তোমাকে একটু বুঝিয়ে বলি। ইউনিলাভে আমি ম্যাডামের মহিমায় সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিলাম ঠিকই কিন্তু তাতে আমার কোনো শান্তি-স্বস্তিবোধ ছিল না। প্রভাব-প্রতিপত্তির আড়ালে আমি যে আসলে একজন যৌন ক্রীতদাস এ বোধ আমাকে সব সময়ই কম-বেশি পীড়িত করত। দুর্বিষহ একটা বোধের অনুভব আমার হতো যখন ম্যাডামকে দেখতাম যখন-তখন ফ্যাক্টরি ভিজিটের নাম করে হিল গটগটিয়ে আমাদের প্রোডাকশন অফিসে আসতেন আর উৎপাদন বিষয়ক নানা প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জরিত করে ছাড়তেন। সব রকম হিসাব-নিকাশ আমার কণ্ঠস্থ আর ফ্যাক্টরির সব কিছু নখদর্পণে থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে তার প্রভুত্বব্যঞ্জক প্রশ্নের জবাব আমার ঘুলিয়ে যেতে চাইত। মনে হতো, এ কি সেই নারী যার গোপনাঙ্গের পাশের জরুলটি পর্যন্ত আমার কত চেনা? একই ব্যক্তির মধ্যে যে কত রকম ব্যক্তিত্বের সমাবেশ থাকে!

ম্যাডাম যখন আমাকে কোনো একটা ত্রুটি উপলক্ষ্য করে প্রকাশ্যে বকাঝকা করতেন তখন আমার ভেতরটাতে যে ভাঙচুর চলত তা অবর্ণনীয়। মাথা নত করে শালকাঠের মতো দাঁড়িয়ে থেকে, মুখের ভাবে কোনো অভিব্যক্তি না ফুটিয়ে সব সহ্য করে যখন নিস্তার পেতাম তার কিছু পরেই হয়তো হাতে পেতাম আরেকটা ট্যুরের অফিস আদেশ।

আমি অস্থির হয়ে পড়েছিলাম বাবুনি, আমার অসহ্য হয়ে উঠেছিল। অফিস পরিচালনার নিয়মানুযায়ী তার অত ঘন ঘন ফ্যাক্টরি ভিজিট করার কথা নয়। প্রোডাকশনে চুরি-চোট্টামি কী হচ্ছে তাতে তার সরাসরি নাক গলানোর কথাও নয়। কিন্তু প্রকাশ্যে আমাকে তাবে রাখতে তিনি তা করতেন এবং অপ্রকাশ্যে আমার দেহটাকে ব্যবহার করে গভীর তৃপ্তির শীৎকারে এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরের বাতাস ভারী করে তুলতেন। সত্যিই আমি আর পারছিলাম না।

এর মধ্যে দাবার ঘুঁটির চূড়ান্ত চাল ধরা পড়ল সেদিন, যেদিন জানতে পারলাম যে আমাকে সেকশন বদলি করে তার সেকশনে নেয়ার পাঁয়তারা চলছে। কক্সবাজারে একি সিভিউ হোটেলে খোলা জানালার পাশে বসে সাগরের গর্জন শুনতে শুনতে আদর আদর খেলাচ্ছলে তাকে যখন আমার বদলি রদ করার সুপারিশ করলাম তখন তিনি যে প্রতিক্রিয়া দেখালেন তাতে সেই দণ্ডেই আমার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেল। আমার যে কোনো স্বাধীনসত্তা আছে তা সেই নারী ভুলে ছিল। ক্ষমতাময়ী জানত না যে, সাপ আর মানুষ কোনো দিন কারও বশ হয় না। সাপ ভাণ জানে না কিন্তু মানুষ বশের ভাণ করে থাকে। আমি মানুষ। তাই সেই শেষ দেহজ প্রণয়ের রাতে আমি যখন অতি উদ্দামভাবে ক্রীড়ারত হলাম তখন উল্লাসের আবেশে উন্মাদ হয়ে সে বলতে থাকল যে, আমাকে আরও বেশি করে কাছে পাওয়ার তাগিদেই সে এই সেকশন বদলের কৌশল করেছে। মার্কেট ভিজিটের অজুহাতে বারবার প্রোডাকশন ম্যানেজারকে টানা দৃষ্টিকটূ এবং এ জন্য তাকে অ্যাডমিনের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। এখন থেকে আমি সার্বক্ষণিক তার কাছাকাছি থাকব এবং সপ্তায় সপ্তায় মার্কেট ভিজিটের নামে আউটিংয়ে যেতে পারব।

কিন্তু আমি কী চাই? কী আমার লক্ষ্য?—আমার পরিবারের জন্য জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন। আমি অসুরের মতো দিনরাত খেটে অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে থেকে ফ্যাক্টরির প্রতিটি ফার্নেশ দিবারাত্রি চালু রাখি। এক মুহূর্তের জন্যও উৎপাদনে বিরতি নেই। ফলে পাওয়ার সাশ্রয় হয়, কম খরচে বেশি উৎপাদন হয়। শ্রমিকদেরকে বেতনের পাশে শ্রমঘণ্টা হিসাবে বোনাস দেয়ায় ওভারটাইম করতে তারা কিছুমাত্র গড়িমসি করে না। আরও নানারকম কৌশল ছিল। সব বোঝাতে গেলে গল্প অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে, বাবুনি। শুধু এটুকু বললে তুমি বুঝবে যে সেই তিনটে বছরে আমি খুব কম রাতেই তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমিয়েছি। কাজেই আমার উপার্জন ছিল আমার সৎ পরিশ্রমের ফসল। কিন্তু মার্কেটিং সেকশনে গিয়ে দিবারাত্রি ম্যাডামের ডানার তলার ওম খেয়ে তো আমার পেট ভরবে না। একদিন তার অফিসে বসে এ বিষয়টা তাকে একটু ইঙ্গিতে বলতেই তিনি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বললেন, কেন, আমি প্রতি ট্রিপের জন্য আলাদা করে পে করব। সেই ক্ষণে আমার তার চাকরির মুখে পেচ্ছাব করে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু গোছাবার প্রয়োজনে আমি ওখানে চাকরি করেছিলাম আরও দুই সপ্তাহ।

ঐ দুঃসহ যাতনাময় দিন থেকে, কুৎসিত পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেয়ে আমি তখন পূর্ণ স্বাধীন সরকারি কর্মচারী। বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারী কখনো নিজেকে পরাধীন মনে করে না। যতই সার্ভিস রুলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদেরকে জনগণের সেবক বলা হোক না কেন, তারা নিজেদেরকে সেবাদাতার বাধ্যবাধকতায় কল্পনা করে না। আর তাই মাত্র ক’মাসের চাকরিতেই আমার অমেরুদণ্ডী শরীরেও দুটো পাখা গজাল।

কিছু বন্ধু জুটল। এদের একজন বাংলাদেশ বেতারের গীতিকার, নাকি সুরকার, না সংগীত জগতের কী এক প্রতিভা। কাজ তার সকাল-সন্ধ্যা গিটারে টুংটাং করা আর উঠতি গায়িকাদেরকে ‘লিফট’ দেয়ার নাম করে টাকা হাতানো ও দেহ বাগানো। কাজটা সে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ পলিসি মেনেই করত, কাজেই তার ব্যাপারে আমার কোনো কথা নেই।

কিন্তু কথা আছে আমার আরেক বন্ধু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ব্যাপারে। উনার একটা নাম দেয়া দরকার। আচ্ছা, উনার নিক নেম ধরো শিপলু। আর উনার নায়িকা, যাকে নিয়ে আমার এই সাতকাহন ভূমিকা, তার নাম তো আমি আগেই দিয়েছি—অনামিকা। এই শিপলু আর অনামিকা প্রকাশ্য সম্পর্কে শিক্ষক-ছাত্রী কিন্তু গোপন সম্পর্কে প্রেমিক-প্রেমিকা বলেই আমরা জানতাম। শিপলু ভাই তো আর মক্তবের মৌলবি কি টোলের টিকিদোলা পণ্ডিত নয় যে ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করলে সেটা মারাত্মক ছি-ছিক্কারের ব্যাপার হবে। শিপলু ভাই বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক। এতেও কিছু যায় আসে না কারণ একটি-দুটি পরকীয়া প্রেম এখন আমাদের জীবনে অপ্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতা। কাজেই শিপলু যখন ভাবি বাপের বাড়ি বা বাইরে কোথাও গেলে ছাত্রীকে বাসায় ডেকে নিতেন কিংবা আমাদের কারও বউ কোথাও বেড়াতে গেলে ফাঁকা বাসার সুবিধা নিতেন তখন ঐ ছাত্রীকে আমরা তার প্রেমিকা বলেই জানতাম ও মানতাম। কিন্তু এই শিপলু ভাই একদিন আমাকে করলেন এক অদ্ভুত প্রস্তাব। তিনি নাকি তার প্রেমিকাকে একদিনের জন্য আমাকে দিতে চান।

বিশাল জ্ঞানী মানুষ শিপলু ভাই। প্রচুর পড়াশুনা তার। আমি তার প্রস্তাব অবিশ্বাস করে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন গোত্র-সমাজের উদাহরণ টেনে যৌনতার বিষয়ে যত ট্যাবু ও সংস্কারের ওপর এবং বহুগামিতা চর্চায় এসবের প্রভাবের ওপর ঝাড়া আধঘণ্টা বক্তৃতা দিলেন। তার কথায় মনে হলো যেন আমি তার এ বিষয়ক পরীক্ষণের আদর্শ গিনিপিগ হওয়ার যোগ্যতা রাখি।

ভেবে দেখো বাবুনি, বছর খানেক আগে আমি ছিলাম এক ধনাঢ্য নারীর সেক্স টয়। আর এখন আরেকজন প্রস্তাব করছে গিনিপিগ হওয়ার! আমার চেহারায় কী আছে জানি না কিন্তু সবাই মনে হয় আমাকে এ কাজের জন্য বেশ উপযুক্ত মনে করে। নইলে এত চকোলেট বয়ের ভেতর থেকে ম্যাডাম কেন আমাকে বেছে নেবেন আর দুনিয়াতে এত এত পারভার্ট থাকতে শিপলু ভাই কেন তার প্রেমিকার বিছানায় আমাকেই পাঠাবেন?

মনটা যেন কেমন হয়ে গেল। শিপলু ভাইকে যতটা না দুশ্চরিত্র, তার চেয়ে বেশি বাতুল মনে হতে থাকল। নিজের প্রেমিকা অন্যের বিছানায় কেমন পারফরম্যান্সের পরিচয় দেয় এই এক্সপেরিমেন্ট যার শখ, তার মানসিক সুস্থতা নিয়েই তো প্রশ্ন আসে। তাই সেদিনের মতো শিপলু ভাইয়ের প্রস্তাবটা অবাস্তব ভেবে নিয়ে বাসায় ফিরে গেলাম। অবাস্তব ভাবার মূল কারণ ঐ মেয়েটা। শিপলু ভাই না-হয় একটা পারভার্ট আইডিয়া পাকিয়ে বসে আছে, কিন্তু মেয়েটা তা শুনবে কেন? বাসায় ফিরে যতবার ব্যাপারটা মাথায় এলো ততবারই আপন মনে হাসলাম। কিন্তু ক্রমে ব্যাপারটা থেকে হাসির অংশ কমে গিয়ে সে স্থানে ঐ মেয়েটার বিভিন্ন দৃশ্যের স্মৃতি উঁকি দিতে শুরু করল। মেয়েটাকে আমি কীভাবে দেখেছি? দেখেছি শিপলু ভাইয়ের প্রেমিকা হিসাবে তারই সান্নিধ্যে। কাজেই তার মারাত্মক ঢল ঢল যৌবনের লাবণ্যের সঙ্গে প্রেম ও কামভাবের আবিলতা মাখা চেহারাটাই আমার চোখে ভাসতে থাকল। মেয়েটা সুন্দরী নয়। স্বাস্থ্যটা উপচানো রকম ভালো অর্থাৎ মোটা। আমার স্ত্রীর তুলনায় সে কিছুই নয়। অথচ এক সময় খেয়াল করলাম যে আমি এর মধ্যে অনামিকাকে আমার নিজের মতো করে কল্পনা করতে শুরু করেছি। কবে তাকে আমার বাসার গেস্টরুমে শিপলু ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে থাকাকালে অসংবৃত পোশাকে দেখে ফেলেছিলাম ওদেরই অসাবধানতায়—সে কথা মনে পড়ায় আজ সেই গেস্টরুমে একবার উঁকি দিয়ে এলাম—যেন ওখানে আজও তাকে একই বেশে দেখতে পাব, যেন ওখানে আজ শিপলু ভাইয়ের বদলে আমি দেখব আমাকে।

অবদমিত বাসনাকে একবার উসকে দিলে কী দশা ঘটে দেখো। সে রাতে আমি যখন স্ত্রীতে উপগত হলাম, মনে হলো—স্ত্রী নয়, আমার নিচে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা নারীটি অনামিকা।

দিন গুনতে থাকলাম। কবে শিপলু ভাই বলবেন, বাসা খালি, চলে আসেন। সেদিন শিপলু ভাইয়ের মুখের ওপর অবিশ্বাসের হাসি ছড়িয়ে নিজের ভালোমানুষি ভাব জাহির করে এসেছি, এখন কী করে বলি যে, ভাই, আপনার ছাত্রীকে...। নাহ্, নিজেকে এভাবে লুচ্চা প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু এদিকে আমি যে ইদানীং অনামিকা জ্বরে কাহিল হয়ে পড়েছি, তা থেকে আরোগ্যের কী উপায়?

পথে-বাজারে-গলির মোড়ে-রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের তলায় নিতম্বভারী নারী যাকেই দেখি তাকেই পেছন থেকে অনামিকা বলে ভুল করি। কারও কারও হাঁটা-চলা, বুক টান করে দাঁড়াবার ভঙ্গিতে আমি অনামিকাকে দেখতে পাই। স্ত্রীর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। এমন দুর্দশা তো আমার এমডি ম্যাডামও ঘটাতে পারেননি।

বাবুনি, জানি না তোমার মুখের চেহারা এতক্ষণে কেমন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো সোনাটা আমার, তোমাকে মিথ্যে বলে ভোলাব না প্রতিজ্ঞা করেছি বলেই আজ আমাকে এত নোংরাও উগলাতে হচ্ছে। কী করব বলো, মানব মনস্তত্ত্ব—এ যে কী জটিল জগৎ তা তো তুমিও বোঝো। যে অনামিকার দিকে আমি কখনো কাম চকচক চোখে তাকাইনি পর্যন্ত সেই অনামিকাকে আমি তখন সময়ে-অসময়ে নানাভাবে, নানা বিভঙ্গে, নগ্ন দেহে কল্পনা করে অলস সময় কাটাতে থাকলাম। জানি না এটা কত দিন চলত। কিন্তু একদিন এলো সেই বহুকল্পিত-বহুকাঙ্ক্ষিত ক্ষণ।

শিপলু ভাই ডাকছেন। ভাবি তার খালাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষ্যে তিন দিনের জন্য আউট অব হোম। আমি যদি চাই... ... ...।

প্রায় উড়ে গিয়ে শিপলু ভাইয়ের বাসায় পৌঁছালাম। শোয়ার ঘরে চার দেয়ালে ঝুলানো ভাবির নানা ভঙ্গিমার ছবির ভিড়। ঘরের ঠিক মাঝখানে দুধসাদা এলোমেলো বিছানায় ঘন নীল স্কার্ট আর আঁটোসাঁটো সংক্ষিপ্ত গোলাপি টপ পরে অবিন্যস্তভাবে শুয়ে আছে অনামিকা।

শিপলু ভাই আমার দিকে চেয়ে হাসলেন, বুঝলেন, আপনের লাইগাই আইজ আনছিলাম। মাগার, ডেরেস দেইখা মাথা বিগড়াইছে। অসুবিধা নাই। আপনে বসেন। ও ফেরেশ হউক।

বাবুনি, তুমি কি আর শুনতে চাও না? লক্ষ্মী আমার, মেজাজ হারিয়ো না। যত গালাগাল করতে ইচ্ছে হয় কোরো। আগে সবটা শোনো।

আমার রুচিতে একটু হোঁচট লাগল ঠিকই, তবে কামনার প্রাবল্যের কাছে সেটা এমন কিছু না। বিশেষ করে মেয়েটার ন্যাকামি ভাবটা আমার ভেতরের আগুনকে উসকে দিল। শিপলু ভাই নাকি তাকে আগে থেকে সবটা বলে রেডি করেই রেখেছিল। অথচ আমাকে দেখে মেয়েটা এমন লজ্জার ভান করল যেন সে একেবারে আনকোরা। মেয়েলি ন্যাকামির কী দারুণ সৌন্দর্য! পুরুষের ভেতরটাকে একদম তাতিয়ে তোলে। অনামিকা যখন নাকিস্বরে ‘ভাইয়া, প্লিজ, এটা হয় নাকি?’ বলে ঢলতে থাকল তখন শিপলু ভাই তার হাত ধরে টেনে এনে আমার পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল, হইবে না ক্যান? তুমার বয়ফেরেন্ড তো আর একজন না। চিন্তা কইর না, এ খুব ভালো প্লেয়ার হইব। ফিগার দ্যাখছ না? তুমার ইয়াবাখোর বয়ফেরেন্ড গুলানের চাইতে আমরা তো ভালো, নাকি? আর তুমার ফার্স্ট হওন নিয়া কুনো চিন্তা কইর না। তুমি তো ফার্স্ট হইবাই, ইস্পেশাল বয়ফেরেন্ড থাকলে কইবা, খাতায় গাঁজা-গুলি যা ল্যাখে তাতেই পাশ করায়া দিমু।

ফার্স্ট হওয়ার নিশ্চিত আশ্বাসের দরুন কি না জানি না, মেয়েটা চমৎকার পারফরম্যান্সের পরিচয় দিল। কিন্তু আমার ভেতর রুচিবোধের অংশটা কেমন যেন আড় হয়ে থাকল। কাজ চলাকালে মেয়েটা আমাকে কমপ্লিমেন্ট দিতে দ্বিধা করল না। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম যে, ও কি সব পুরুষকেই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে এভাবেই সহযোগিতা করে? কিন্তু না, সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে সে করল এক সাংঘাতিক কাণ্ড। আমরা যে ঘরটাতে মিট করেছিলাম সেটাতে কোনো এটাচড টয়লেট ছিল না। কাজেই ফ্রেশ হওয়ার প্রয়োজনে তাকে বেরুতেই হলো। দরজা খুলতেই তার সঙ্গে দেখা হলো শিপলু ভাইয়ের। তিনি বোধ হয় পুরো সময়টা দরজায় কান পেতেই ছিলেন। অনামিকাকে অবিন্যস্ত চেহারায় বেরুতে দেখে চোখ মটকে একটা ফিচেল হাসি দিলেন। তা দেখে মেয়েটা যেন আহ্লাদে গলে গিয়ে বলল, দারুণ, স্যার। আপনার বন্ধুটা যা না!....উফ! অসাধারণ! কেন আগেই এভাবে উনাকে পাইয়ে দেননি? এত দিন ধরে আপনার ঐ ছোট্ট দুর্বল ইয়ে... ... ...।

শিপলু ভাইয়ের সেই মুখটা যদি ক্যামেরাবন্দি করে রাখতাম!

ফ্রেশ হয়ে অনামিকা আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত নেড়ে ভ্যানিটি ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে গেল। শিপলু ভাই আমার সঙ্গে চোখাচেখি না করে তার শোবার ঘরে ঢুকে গেলেন। পরে একদিনের আড্ডায় শিপলু ভাই বলেছিলেন, মেয়েমানুষের অকৃতজ্ঞতা দ্যাখেন—ভিডিও ক্যামেরার ভয়ে বয়ফেরেন্ডগুলারে যে সে স্থানে মিট করতে ভয় পায় বইলা মুটকিটারে এ্যাদ্দিন সেবা জুগায়া আসছিলাম, আবার ফার্স্ট কেলাশ ফার্স্ট করার আশ্বাসও দিয়াছিলাম। অথচ কারবার দ্যাখেন, কয় আমারডি ছোট্ট আর... ...। মুনে কয় লাত্থি মাইরা চুলার পাড় ভাইঙ্গা ফেলি!

আমি কোনোমতে হাসি চেপে বললাম, বয়ফ্রেন্ডদের ভিডিও ক্যামেরা ভয় পায়, আপনাকে-আমাকে ভয় পায় না কেন?

আমগোরে ভয় খাইব ক্যান, বুড়া হইছি না? এই সামাজিক অবস্থানে চইড়া থাইকা পুলা-মাইয়ার বাপ হইয়া কি আর ওসব করন যায়?

হুম। তা এ অবস্থানে না থাকলে বুঝি...?

না থাইকলে কী হইত জানি না। তয় ইউটিউবে না ছাড়লেও মাল কিন্তু কালেকশনেই আছে।

মানে?

মানে আপনের সাথে হের...।

বিশ্বাস করো বাবুনি, সেই ক্ষণ থেকে আমি বাকি জীবনের তরে অবৈধ যৌনচিন্তা পর্যন্ত কফিনে পুরে রেখেছি। প্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষের যুগে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যক্তিগত করে রাখার একটাই উপায়—কোনো শেয়ারে না যাওয়া। বিশ্বজুড়ে সেক্স টয়ের চাহিদা তো আর এমনি এমনি বাড়েনি। অনলাইন শপগুলো প্রতিদিন কতগুলো করে অর্ডার পায় তা ভাবতে পারো? মেয়েরা তো এখন বয়ফ্রেন্ড এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে স্বামীর কাছেও সহজ হতে পারছে না। ওদিকে পুরুষেরাও কোনো কামনাময়ীর আহ্বানকে, এমনকি ব্রোথেলের পেশাদারিত্বকেও ভরসা করতে পারছে না। এ আমরা কোথায় চলেছি, বাবুনি?

জানি তুমি-আমি এসবের ঊর্ধ্বে। আমরা কেউ কাউকে ডোবাবার কথা ভাবতে পারি না কারণ আমরা তো ডুবে আছি একে অপরের মধ্যেই।

আমার জীবনের যা কিছু গোপনীয়তা তার উল্লেখযোগ্য অংশ আজ তোমার কাছে উন্মোচন করলাম। এখন বিচারের ভার তোমার হাতে। আমি পুরুষ, নাকি কাপুরুষ, মানুষ নাকি অমানুষ, তা তুমিই স্থির করে জানিও। তবে যা-ই স্থির করো না কেন, এ কথাটা মনে রেখো যে সবার আগে আমি এমন এক জৈবিক সত্তা যে মূলত তার শোনিতধারায় ষঢ়রিপুর দুর্নিবারতা ধারণ করেও স্নেহ-প্রীতি, দয়া-মায়া, ত্যাগ-তিতিক্ষার তিথিডোরে বাঁধা পড়ে থাকে আজীবন। তাই এই অধমের রক্তে অর্থ-সম্পদ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যতটা লিপ্সা রয়েছে, তার চেয়ে তীব্র আগ্রহ রয়েছে আপনজনের মুখে হাসি ফোটাবার সাধনায়। কামবাসনা আমার যত প্রবল, প্রেমবাসনা তার চেয়ে কিছু কম নয়। আমি যতখানি পুরুষ, প্রেমিক বুঝি তার চেয়ে বেশি। আমার পুরুষাংশ নিয়ে এতকাল নারীরা লোফালুফি করেছে, প্রেমিকাংশ ম্রিয়মাণ হয়ে অপেক্ষা করেছে কোনো এক জাদুকন্যার আবাহনের। বাবুনি, তুমি আমার সেই জাদুকন্যা। এখন বলো, তুমি কি আমার প্রেমিক সত্তার পরিপূর্ণ বোধন ঘটাতে দ্বিধা করবে?

অপেক্ষায়—

তোমার বাবুসোনা।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এনসিপির কর্মসূচিতে আসেনি কোনও দলের শীর্ষ নেতা
এনসিপির কর্মসূচিতে আসেনি কোনও দলের শীর্ষ নেতা
গাজায় ত্রাণ বিতরণের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
গাজায় ত্রাণ বিতরণের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
আ.লীগের বিচারের আগে কোনও নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না: চরমোনাই পীর
আ.লীগের বিচারের আগে কোনও নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না: চরমোনাই পীর
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে কুড়িগ্রামে বিক্ষোভ
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে কুড়িগ্রামে বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান