X
রবিবার, ১২ মে ২০২৪
২৯ বৈশাখ ১৪৩১
ঈদসংখ্যা ২০২৩

ছেঁড়া স্বপ্নের জাল

সাজিদ উল হক আবির
১৫ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:০০আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:০০

এক.

“লাইক আ নিউ ডিজিজ, শি ইজ স্টিল টু ইয়াং টু ট্রিট...

লাইক আ নিউ ডিজিজ, শি ইজ স্টিল টু ইয়াং...

লাইক আ নিউ ডিজিজ, শি ইজ...”

‘বুকের ভেতর কচি লাউ ডগার মতো ফিনফিনিয়ে বাড়তে থাকা নতুন এক রোগ সে—এখনই তার চিকিৎসা করাতে চাই না।’

জীবনের গভীরতম এক আনন্দের মুহূর্ত হলো এমন কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ কিংবা পরিচিতি, যার সঙ্গে খানিকক্ষণ আলাপের পরেই অনুভব হয়, লোকটা আপনাকে পুরোপুরি বুঝতে পারছে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার অনেক গভীরে ডুবে আপনারা কানেক্ট করতে পারছেন একে অপরের সঙ্গে। অন্যদিকে জীবনের গহিনতম এক দুঃখ হলো এই উপলব্ধি, যে—আপনাকে পুরোপুরি বুঝতে পারা, ভেতর-বাহিরে পড়তে পারা মানুষটির সঙ্গেও আপনার সম্পর্ক টিকবে না আজীবন। দূরত্ব তৈরি হবে। অতিবাহিত হয়ে যাওয়া সময়ের স্রোতের মতোই একসময় সে হারিয়ে যাবে আপনার জীবন থেকে।  

আনন্দ-বেদনার এই তত্ত্ব অবশ্য আপনাদের, তথা মনুষ্যকুলের জীবন সংক্রান্ত। আমার জন্য নয়। মানুষের জীবনের জ্বালাপোড়া, উত্থানপতন, প্রাপ্তি-প্রস্থানকে ধারণ করবার জন্যই আমার জন্ম। তবে আমি মানুষ নই। আমি মানুষের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ। আমি একটি গান। সুখে-দুঃখে কখনো আপনারা আমাকে গুনগুন করেন, কখনো বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে ফরমালি গীত হই আমি। মানুষের এক মৌলিক দুঃখের জায়গা হলো—তাকে বোঝার মতো, উপলব্ধি করার মতো অপরাপর মানুষের দেখা সে একজীবনে বেশি একটা পায় না। আমি যেহেতু মোটের ওপর বিখ্যাত একটা গান, আমার সে সমস্যা নেই। আমাকে শোনার, বোঝার, উপলব্ধি করার মতো মানুষের অভাব নেই। হবেও না কখনো। পুরনো ওয়াইনের মতো, দিন যত যাবে, আমার দাম বাড়বে। গ্রাহকের চাহিদা বাড়বে। ইউটিউবের যে চ্যানেল থেকে আমাকে আপলোড করা হয়েছে, তার সাবস্ক্রাইবার বাড়বে। আমার লিসনার-ভিউ বাড়বে। সেই ভিডিওর মন্তব্যের ঘরে যিনি আমাকে লিখেছেন, সুর দিয়ে গেয়েছেন, তার প্রতি শ্রোতাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বাড়বে। কীভাবে আমার মধ্যে দিয়ে আমার স্রষ্টা তাদের মনের কথাকেই উপস্থাপন করেছেন, কীভাবে এই গানটা তাদের জীবনের সুখ-দুঃখের সারথি হয়ে আছে দীর্ঘকাল ধরে, তা নিয়ে জমা হবে লম্বা লম্বা প্যারাগ্রাফ। পাঠক, আপনি হয়তো এখনও শোনেননি আমাকে। সেজন্য আপনাকে দোষ দিই না। সমাজে ভালো জিনিসের কদর এমনিতেই কম। আপনি তো আপনি, যাকে নিয়ে এই গল্পের শুরু, যে ছেলেটা আমাকে গত কয়েকদিনে কয়েকশোবার শুনে ফেলেছে টানা, লুপে ফেলে—সে নিজেই তো আমার হদিস পেল এই তো সেদিন। এক পুরুষ আর এক নারী কণ্ঠ ফিসফিসে করে গেয়ে চলেছে আমাকে আদ্যোপান্ত, অনেকটা প্রশ্নোত্তরের মতো করে। যেমন কিনা আপনাদের কবিগানের আসরে কবির লড়াই, বা ওদের ইকবালের শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া। এই আপনাদের-ওদের সীমানা পেরিয়ে, আমার মধ্যে সাংগীতিক সৌন্দর্যটা তবে কোথায়? আছে নিশ্চয়ই কিছু, নইলে আমাকে ধারণ করা ভিডিওতে এরকম লাখো শ্রোতা ভিড় জমায় কেন? কেনই বা এই গল্পের প্রধানপুরুষ এরকম লুপে ছেড়ে আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শোনে?   

এতবার, এত এতবার, এত দীর্ঘ সময় ধরে আমাকে শুনতে থাকার পর, আমি এই মুহূর্তে ঠিক আর সে গানটাও নই; বরং আমি পরিণত হয়েছি এই গান সংক্রান্ত এক অনুরণনে। সাইফের মস্তিষ্কের, সাইফের স্মৃতির, সাইফের চিন্তা প্রক্রিয়ার একটি অংশ এখন আমি। গেঁথে আছি ওর মনে, মননে।   

সাইফ আর অরুর প্রথম ফরমাল দেখা হবার একটা কাব্যিক বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করি। শরতের সেই বিকেলে আকাশে সাদা মেঘের উপস্থিতি ছিল দস্তুরমতো—যতটা থাকলে কবিরা কবিতা লিখতে উৎসাহ পায়, গীতিকারেরা আপন মনে গুনগুনিয়ে ওঠে নতুন সুর, চিত্রকরেরা রং তুলি সাজিয়ে বসে নতুন ছবি আঁকতে। শরৎকালের কাশফুলের উপস্থিতি ছিল না পিচঢালা রাস্তায়, কিন্তু মোড়ের এপাশে ওপাশে দাঁড়ানো হাওয়াই মিঠাইওয়ালার উঁচু করে ধরে রাখা বাঁশের খুঁটির এখান-ওখান থেকে বেরিয়ে থাকা সাদা-গোলাপি-নীলরঙের হাওয়াই মিঠাইগুলো যেন কাশফুল হয়েই দোলার আর ওড়ার অপেক্ষায় ছিল। বাবলস বিক্রেতার ফুঁ দিয়ে ওড়ানো সোনালি-রুপালি বুদবুদে আবৃত রাস্তাটা হয়ে ছিল স্বপ্নিল। পান্থপথের ব্যস্ত সিগন্যালে নানারকম পণ্যের ফেরিওয়ালার উপস্থিতি গাড়ির চালক ও যাত্রীদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। শরৎকাল বলতেই আপনাদের চোখের সামনে যে বিস্তীর্ণ নীল আকাশের নিচে দিগন্তজোড়া খোলা মাঠের দৃশ্য ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে প্রবল বৈপরীত্য সৃষ্টি করে রাস্তা জুড়ে উৎকটভাবে ফুটে ছিল জ্যাম। সাইফকে অবশ্য বেশি ভুগতে হয়নি। রাস্তার এ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, পান্থপথের মোড়ে মাত্র দুবার ট্রাফিক সিগন্যালের বদল, গোটা তিনেক ভিক্ষুকের ঘ্যানঘ্যান, একজন হিজড়ার হানা সামলে উঠেই সে অপর প্রান্তে অরুর মুখ আস্তে আস্তে ফুটে উঠতে দেখে। সিগন্যাল ছাড়া মাত্রই হুহু করে ছুটে চলছে প্রাইভেট কার, পিকআপ, সিএনজি, রিকশা। আর সিগন্যাল থামিয়ে দেয়া মাত্র বাইকের প্রবল হর্নে জীবন জেরবার। এরই মধ্যে ঝড়ের কবলে পড়া ভীত এক মায়া শালিকের মতো অরুর মুখখানি ফুটে ছিল রাস্তার ওপাশে।   

এত শান্ত!

এত মিষ্টি!

এত মায়াবী!  

সাইফ সেদিন গোটা সন্ধ্যা অরুর থেকে চোখ ফেরাতে পারেনি।

অথবা, সঠিকভাবে বললে, সাইফ সেদিন গোটা সন্ধ্যা অরুর থেকে চোখ ফেরাতে চায়নি।  

সেদিন বিকেলে সাইফ তার বছরজুড়ে উদযাপন করে চলা অন্যান্য ক্যাজুয়াল ডেটগুলোর মতোই গড়পড়তা এক ডেটে বেরিয়েছিল অরু নামের মেয়েটার সঙ্গে। আগে, সাকুল্যে হয়তো একবারই সে তাকে বলেছিল যে তার শাড়িতে শরীর জড়ানো আটপৌরে বাঙালি রমণীর সঙ্গ পছন্দ।  তাও ঠিক কতদিন আগে যে এ বিষয়ে কথা হয়েছিল তাদের মাঝে, তা তার মনে নেই। অথচ অরু দাঁড়িয়ে আছে মাঝরাস্তায়, গায়ে চোখ ধাঁধানো জর্জেটের শাড়ি জড়িয়ে। গাঢ় খয়েরি জমিনে সোনালি পাড়। মেরুন ব্লাউজ। বুকের ওপর মুক্তার দানার মতো বড় বড় পুঁতির মালা। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার ওপর বসন্তের আদুরে স্পর্শে ফুলে ফুলে ভরে ওঠা এক কৃষ্ণচূড়া গাছ যেন সে। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে সাইফের দৃষ্টি আটকে গিয়েছিল অরুর মুখের ওপর। মায়াশালিকের মতো চাহুনি যে মুখচ্ছবির সম্বল ও শক্তি।  

“ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এই মেয়ের একটা স্ক্যান্ডাল আছে না?”

পান্থপথের মোড় থেকে ধানমন্ডি ২৭, গোটা রিকশা সফর আমতা আমতা করে সাইফের বেমাক্কা তীক্ষ্ণ রসিকতাগুলো প্রতিহত করতে থাকা এ মায়াশালিক যে ২৭ নম্বরের সুদৃশ্য বইয়ের দোকানে পা রাখা মাত্র অমন প্রশ্নবোমা ফাটাবে, এটা সাইফের দূরতম ধারণাতেও ছিল না। সাইফের হাতে তখন সদ্য বইয়ের তাক ভেঙে  নামানো পাবলো নেরুদা আর লোরকার ইংরেজিতে অনূদিত কবিতাসংগ্রহ। পরিকল্পনা ছিল, অন্য সব মেয়েদের মতো অরুকেও নেরুদা আর লোরকার কবিতা নিয়ে লেকচার দিয়ে ঘায়েল করবে। বাংলা অনুবাদের চেয়ে কবিতার ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ হাতে থাকলে ভাব নেয়াটা সহজ হয়। সঙ্গের মানুষটি আরও সম্ভ্রমের চোখে দেখে।     

সাইফের নেরুদা-লোরকা সংক্রান্ত পরিকল্পনাকে ভেস্তে তুলে অরু ততক্ষণে প্রচ্ছদে আঁটসাঁট পোশাকের স্বর্ণকেশীর বইখানা তুলে দিয়েছে সাইফের হাতে। ঠোঁটের কোণে অর্থপূর্ণ তির্যক হাসি ঝুলিয়ে চোখ নাচিয়ে সে সাইফকে বলেছিল—“মেয়েটাকে তো আপনার চেনার কথা।”

সাইফ ঢোক গিলেছিল সঙ্গে সঙ্গে। পৃথিবীর বহু বিষয়ে ওর জ্ঞান অল্প, কিংবা আধখেঁচড়া। তবে বইয়ের প্রচ্ছদে থাকা এ স্বর্ণকেশীকে সে চেনে না—জ্ঞানত এই দাবি করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে বিলক্ষণ চেনে স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে। খুবই নামজাদা পর্নোতারকা। ব্যাচেলর, একাকী একটা রুম নিয়ে বাস করে, এবং বাসায় ফিরে রাতে নেট খুলে বসার অভ্যাস আছে এমন সকল পুরুষেরই এই উন্নত বুক-পাছার স্বর্ণকেশীকে চেনার কথা। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে যাওয়ায় সে আরও প্রচারের আলোয় আসে। পরে সে এই আত্মজৈবনিক বইটা লেখে, তার এস্কর্ট, স্ট্রিপার, এবং পর্নো মুভির তারকা জীবন নিয়ে।

কিন্তু, সাইফের মাথায় তখন ঘুরছিল স্রেফ একটি প্রশ্ন। যে মেয়ের চোখ মায়াশালিকের মতো, সে কীভাবে এই রূপোপজীবিনীকে চেনে?

সাইফ কৌতূহলী দৃষ্টিতে অরুর দিকে তাকাতেই অরু সাইফের প্রতি দুষ্টুমি মাখা হাসি ছুড়ে দিয়ে বইটা নিয়ে নেয় সাইফের হাত থেকে। তুলে রাখে বইয়ের তাকে। পুনরায় হাঁটা শুরু করে বইয়ের মাঝে। প্রায় ফিসফিস করে আমাকে গুনগুনিয়ে গাইছিল তখন অরু—

“ডোন্ট হোল্ড ইওরসেলফ লাইক দ্যাট, ইনফ্রন্ট অফ মি

আই’ভ কিসড ইওর মাউথ, অ্যান্ড ব্যাক

ইজ দ্যাট অল ইউ নিড?

ডোন্ট ড্র্যাগ মাই ওয়ার্ল্ড অ্যারাউন্ড

ভোলক্যানোস মেল্ট ইউ ডাউন...”

সেই প্রথম সাইফের কানে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছিল আমার সুর। সাইফের মস্তিষ্কে অনুরণন সৃষ্টি করেছিল আমার কথা। সে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল আমার ব্যাপারে।

“এটা কোন গান গাইছেন আপনি?” প্রশ্নটা করবার সময় সাইফের ঠোঁট ছিল অরুর কানের খুব কাছাকাছি। অরু অবাক হয়ে সাইফের দিকে তাকাতেই সাইফ মুখভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছিল, এরকম একটা সেমি লাইব্রেরি, সেমি বুকশপে যথাসম্ভব নীরবতা বজায় রেখে কথা বলাটাই দস্তুর। স্বাভাবিক হয়ে অরু মিষ্টি হেসে আবারও আমাকে গুনগুন করে গেয়ে চলে। ততক্ষণে তার হাতে উঠে এসেছে বুদ্ধদেব বসুর আত্মজৈবনিক।

“হোয়াট আই অ্যাম টু ইউ, ইজন’ট রিয়েল

হোয়াট আই অ্যাম টু ইউ, ইউ ডু নট নিড

হোয়াট আই অ্যাম টু ইউ, ইজ নট হোয়াট ইউ মিন টু মি

কজ ইউ গিভ মি মাইলস অ্যান্ড মাইলস অব মাউন্টেন

হোয়াইল আই অ্যাস্ক ফর দা সি...”

বইটা অরু কেনে। সাইফই গিফট করে অরুকে। অরু কথায় কথায় শেয়ার করে আত্মজৈবনিক ধাঁচের বইপত্রের প্রতি তার আগ্রহের ব্যাপারটা। তারপর, ধানমন্ডি ২৭-এর সেই বইয়ের দোকান থেকে বেরিয়ে যখন তারা হেঁটে চলা শুরু করেছে মিনা বাজারের পাশের রাস্তা ঘেঁষে, তখনও অরু কণ্ঠে আমি—“হোয়াট আই অ্যাম টু ইউ...”

এ পর্যায়ে সাইফ অরুকে থামিয়ে প্রশ্ন করে, “গানটা আসলে কী বলতে চাইছে?”

“গানটা বলতে চাইছে যে, যে...” শরৎ সন্ধ্যার দমকা হাওয়া অরুর শরীরের ওপর হামলে এসে পড়ে। তার মুখের ওপর ঝাপটা দিয়ে এসে পড়ে অবিন্যস্ত কেশগুচ্ছ। সে কেশ গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতেই ওর শাড়ি কিছুটা এলোমেলো হয়ে পড়ে। সাইফের চোখ ঝলসে দেয় অরুর শাড়ির ফাঁকে উন্মোচিত হওয়া ধবধবে সাদা পেট, স্ফীত স্তনের একাংশ। অরু বেপরোয়ার মতো আগে তার চুল সামলায়। তারপর টেনেটুনে শাড়ি ঠিক করে। ততক্ষণে সাইফ নিপাট ভদ্রলোকের মতো তাকিয়ে আছে রাস্তার ওপাশে, দূরে কোথাও।

“গানটা বলছে যে,” নিজেকে সামলে নিয়ে অরু আবারও কথা বলা শুরু করে, “তোমার কল্পনায় আমার যে রূপ তুমি তৈরি করে নিয়েছ, বাস্তবে আমি অমনটা নই; আর যে আমি সত্যিকারের আমি—সে আমাকে পুরোপুরি জানার পর তুমি হয়তো আমাকে এতটা উতলা হয়ে আর চাইবে না; তুমি আমার কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ—আমি এখনও তোমার কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারিনি; জীবনের কাছে আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল সুউচ্চ পর্বতমালা, আর তুমি এসে হাজির হলে মাইলের পর মাইল জুড়ে থাকা সোজাসাপটা সমুদ্রসৈকতের মতো।”

“এ গানটায় আপনার জন্য একটা ম্যাসেজ আছে,” অরু হাসিমুখে বলে। “সেটা ধরতে পেরেছেন?”

সাইফ ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে চুপচাপ হাঁটতে থাকে। এটা তার সদ্য রপ্ত করা এক টেকনিক। যে প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই, তার জবাবে সে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে চুপ মেরে থাকে।

ততক্ষণে তারা পায়ে পায়ে একটা কফি হাউজে ঢুকে পড়েছে। দরজায় দাঁড়ানো বেয়ারার সাদর সম্ভাষণ পার করে ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়, কফি হাউজটায় নানারকম বসার ব্যবস্থা আছে। জানালার পাশে সরু লম্বা লম্বা টুল পাতা, তার সামনে কাঠের তক্তা টেবিলের মতো করে এঁটে দেয়া দেয়ালের সঙ্গে; আরও আছে ছোট ছোট চৌকোনা টেবিলের সামনে পেতে রাখা রেগুলার চেয়ার; মেঝেতে কার্পেটের ওপর গদি আর নিচু টেবিল পেতে রাখা আছে; আরও আছে রেগুলার সোফা ও টি-টেবিল। যার যার পছন্দমতো আসনে বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে গোটা ত্রিশেক লোক। আরেকটু নীরব জায়গা হলে সাইফের জন্য ভালো হতো, কিন্তু অরুর পছন্দ যেহেতু এই কফিশপ, কাজেই সে আর উচ্চবাচ্য করে না। এমনকি, মেঝেতে পেতে রাখা কার্পেট-গদির ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতে পারলে তার ভালো লাগত, কিন্তু শাড়ি নিয়ে যেহেতু অরু নিচে বসতে পারবে না, অগত্যা দুজনে মিলে বসেছিল রেগুলার টেবিল চেয়ারেই। সুন্দরী নারীসঙ্গের জন্য নিজের পছন্দ অপছন্দকে সেক্রিফাইস করতে সাইফের সেদিন খুব একটা গায়ে লাগেনি।

 

দিনটা ছিল শনিবার। দুজনেরই সাপ্তাহিক ছুটি। সাইফ একটা ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক। প্রস্তুতি নিচ্ছে পড়াশোনা করতে বাইরে যাবার জন্য। অরু তখন এক প্রাইভেট ব্যাংকের ইন্টার্ন। দুজনের পরিচয় ব্রিটিশ কাউন্সিলের আইইএলটিএসের কোচিংয়ে। একই ব্যাচ, একই কোর্স টিচারের অধীনে পড়তে পড়তে, গ্রুপ স্টাডি থেকে পেয়ার স্টাডি, ফুলার রোড থেকে দুসপ্তাহের মাথায় ধানমন্ডি ২৭। আলাপের বিষয়বস্তুও এর মাঝে আইইএলটিএসের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বহুদূর।       

ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে বসে প্রথম দিনের আলাপে কথায় কথায় অনেক বিষয় নিয়েই আলাপ হয়েছিল তাদের। সাইফ অবাক হয়ে লক্ষ করেছিল, অরুর হালের পপকালচারের প্রতি তীব্র ঝোঁক। মেয়েটা বিস্তর খোঁজখবর রাখে দুনিয়ার কোথায় কী হচ্ছে—এ নিয়ে। হেনরি কেভিলকে হারিয়ে কোন কে—পপ স্টার দুনিয়ার সবচেয়ে আবেদনময় পুরুষ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে এ নিয়ে তারা দুজন বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি করল (সাইফ মনে মনে খোদাকে অনেকগুলো ধন্যবাদ দিয়েছিল সেদিন। পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের চোদনে এই আধামেয়েলী ধাঁচের কোরিয়ান পপ সিংগার ছেলেগুলোকে নিয়ে মনের আশ মিটিয়ে ঝাল ঝাড়া যায় না বেশিরভাগ মেয়েদের সামনে)। জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজের ‘বড় লোকের বেটি লো’ গানের ড্যান্স স্টেপ চেয়ারে বসেই খানিকটা নেচে দেখিয়েছিল অরু, তার সঙ্গে তাল রাখতে সাইফও গানটা গাইছিল তার বেসুরো ভাঙা গলায়। সবশেষে দুজনে প্রাণখুলে হেসেছিল অনেক। সেদিন দুজনে আলাদা হবার আগে সাইফ অরুকে জানিয়েছিল যে ওর ‘ফ্রেন্ডস’ টিভি সিরিজটা মাত্র দেখা শেষ হয়েছে। অরু সঙ্গে সঙ্গেই সাইফকে রেকমেন্ড করে ‘আ মিলিয়ন লিটল থিংস’ নামে আরেকটি সিরিজ। বলেছিল, এটার প্রেক্ষাপটও একদল বন্ধু, তবে এর থিম এবং প্লট বাস্তবতা সংশ্লিষ্ট, এবং বেশ রুঢ় এবং ডার্ক।

কফিশপে বসে সাইফ একটু অস্বস্তিতে ভোগে। সে একজন সদ্য সেপারেটেড অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর। এভাবে পাবলিক প্লেসে তাকে এক লাস্যময়ী তরুণীর সঙ্গে কোনো স্টুডেন্ট দেখে ফেললে ছবি তুলে ফেসবুক-ইন্সটাগ্রাম সব জায়গায় ছড়িয়ে দেবে। ইউনিভার্সিটিতে জানাজানি হলে এ নিয়ে নানারকম কথাবার্তা হবে। মাস্টারের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। শিক্ষার্থীদের নিজের পুত্রকন্যাবৎ ট্রিট করা লাগবে, চাকরির শুরুতেই ডিপার্টমেন্ট প্রধান সাইফকে ডেকে বলেছিল। এদিকে জয়েন করার পরপরই উঁচুক্লাসের দুটো কোর্স সাইফকে ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওর চেয়ে দু-এক বছরের ছোট ছেলেমেয়েগুলো প্রথম প্রথম সাইফ ক্লাসে ঢুকলে তাকে পাত্তাই দিত না মোটে, আর বসের কথামতো তাদের বাপ হওয়ার প্রচেষ্টা তো দূরের স্বপ্ন। কন্যা হতে না চাইলেও কেউ কেউ অবশ্য সাইফের ঘরণী হবার আগ্রহ দেখিয়েছিল হাবেভাবে, বা ফেসবুকে ম্যাসেঞ্জারে। এসব প্রলোভন লিওনেল মেসির মতো ড্রিবলিং করে কাটিয়ে-এড়িয়ে মোটের ওপর এক ক্লিনস্লেটের শিক্ষক হিসেবেই পেশাদারি জীবন কাটাচ্ছিল সাইফ।  অথচ অরু আর সে মুখোমুখি বসে এখন, মধ্যিখানে কেবল একটি ছোট্ট টি-টেবিলের দূরত্ব। যতই স্টুডেন্ট নামক পাপ্পারাজ্জিদের ক্যামেরায় বন্দি হবার ভয় থাকুক, সাইফের ভালো লাগছিল এই আগুন নিয়ে খেলা। আগুন নিয়ে খেলা অবশ্য এ ক্ষেত্রে এক ভুল মেটাফর। শীতের রাতে আগুন পোহানোর জন্য আগুনের কাছে আসার সঙ্গে তুলনা দিলে তার আর অরুর এই মিটিং আরও যথার্থ হয়।  

“আপনি কফি খান তো স্যার?”

অরু মিটিমিটি হাসছিল প্রশ্নটা করার সময়। ইচ্ছে করেই প্রতিবার অনাবশ্যক রকমের উচ্চকিত কণ্ঠে স্যার শব্দটি জুড়ে দিচ্ছিল সে, প্রতিটি উচ্চারিত বাক্যের আগে—সাইফকে অস্বস্তিতে ফেলবার জন্য। যেন টিচার-স্টুডেন্ট, বা বস-পার্সোনাল সেক্রেটারি টাইপের একটা অলীক স্ক্যান্ডাল তৈরিতে খুব আগ্রহ তার। সাইফ প্রথম দু-একবার আঁতকে ওঠার পর ওর খেলাটা ধরতে পেরে আর প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিল না। মুচকি মুচকি হাসছিল কেবল। কফি ওয়ার্ল্ড দারুণ ব্যস্ত এক কফিশপ, পশ-হোমরাচোমরা লোকজনের উপস্থিতিতে প্রায় সবসময় গমগমে। ওরা দুজন কফিশপটার ভেতরের দিকে একটা ছোট টেবিলে মুখোমুখি রাখা দুটো চেয়ারে বসা। ওপর থেকে একটা মাত্র আলো সরাসরি তাদের টেবিলে এসে পড়ছে। এই আলোতেই সাইফ অরুর কপালে তারার মতো ফুটে থাকা টিপটা লক্ষ করে। স্টাইলটা একটু ভিন্ন, অপরিচিত। টিপ কি আসলে একটা না দুটো? বড় একটা গোল টিপের নিচের দিকে সংযুক্ত অপেক্ষাকৃত ছোট আরেকটি টিপ। অরুর প্রসাধনীর প্রতিটা খুঁটিনাটি ডিটেইল সাইফের চোখে আলাদা করে ধরা পড়ছিল, মূলত অরুর মিষ্টিপনা মুখচ্ছবির জন্যে। 

“অরুর কি প্রথম থেকেই বাইরে স্যাটল হবার প্ল্যান?” খেজুরে আলাপ চালিয়ে নেয়ার জন্য সাইফ প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার চেষ্টা করে।   

“তাই তো ছিল এতদিন,” অরু কফির মগে সুড়ুৎ করে চুমুক দিয়ে বলে, “আপনার সঙ্গে দেখা হবার পর অবশ্য উদ্দেশ্য বদলে গেল। ভাবছি আপনার সঙ্গেই স্যাটল হব।”        

বিষম খেয়ে সাইফের মুখের তালু পুড়ছিল খানিকটা, গরম কফিতে।

“আরে দুষ্টুমি না। সত্যি সত্যি বলেন।”   

এই প্রশ্নে অরুকে আনমনা লাগে যেন খানিকটা। শনিবারের সন্ধ্যার উসিলায় জনাকীর্ণ ধানমন্ডি সাতাশের পানে চেয়ে থাকে চুপচাপ। তারপর সাইফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল,

“এসব ক্যারিয়ার বিষয়ক জীবনমুখী আলোচনা করবেন বলে তো আমাকে নিয়ে বের হননি সাইফ স্যার। আপনার কথা বলুন। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সে এসেও আমার বয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে আপনার এসব ছুটির দিনের বিকেলগুলো বরবাদ করা লাগে কেন?”   

“দু-একটা ছুটির বিকেল বরবাদ করে যদি জীবনটা নতুন করে আবাদ করা যায়, ক্ষতি কী তাতে?” সাইফের ঠোঁটের কোণে ছিল দুষ্টুমিমাখা হাসি। খেলা জমে উঠছিল আস্তে আস্তে।  

তারপর তাদের কথা হয় ঢাকার যানজট নিয়ে, বাংলাদেশের ছেলেপেলেদের বিসিএসমুখিতা নিয়ে, অ্যাভেঞ্জারস এন্ডগেমের সমাপ্তি নিয়ে, গেম অব থ্রোনসের শেষ সিজনের তৃতীয় এপিসোড নিয়ে, কোন লেখকের লেখা ইদানীং বেশি পড়া হচ্ছে, মুরাকামি এ বছর নোবেল পাবে কি পাবে না—তা নিয়ে, পাবলিক আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির কালচারের তফাত নিয়ে। এরকম টুকটাক আরও নানা বিষয়ে তাদের কথা হয়। তারপর, একটা পর্যায়ে এসে তাদের আলাপ বয়স্ক, লক্করঝক্কর ছ্যাঁকরা গাড়ির মতো ব্রেক কশে দাঁড়িয়ে যায়। আর এগোয় না। দীর্ঘায়িত নীরবতা তাদের মধ্যে অস্বস্তি বৃদ্ধি করে চলে। অরুর মতো এক ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে অফিসে সেন্স অব হিউমারের জন্য বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন সাইফের কথাবার্তা এগুচ্ছে না—ব্যাপারটা সাইফের জন্য আরও এককাঠি এমব্যারেসিং হিসেবে প্রতিভাত হয়।

 

“আজ উঠি তবে,” অরু তার স্মার্টফোনটা ব্যাগ থেকে বের করতে করতে বলে।

 

দুজন বেরিয়ে আসে কফিশপ থেকে। ধানমন্ডি ২৭-এর রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। ভেজা বাতাসের তোড় ততক্ষণে আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল। বৃষ্টি শুরু হবে হবে—এমন এক পরিবেশ। বড় বড় দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি অবিন্যস্তভাবে পড়ছে এর ওর গায়ে মাথায়। সবার মধ্যে একটা ত্রস্ত ভাব। সবাই প্রায় ছুটে চলছে। সাইফের মনে পড়ে সকালের আবহাওয়ার পূর্বাভাস। উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘উড়ুক’। আগামী পরশুদিন ভোরবেলা তা কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল অতিক্রম করবে। কিন্তু তার প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়া এবং বজ্রসহ বৃষ্টিপাত চলবে আজ রাত হতে আগামী তিন দিন। 

“যাবেন কীভাবে?” সাইফের এ প্রশ্নের জবাবে অরু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলে, “উবারে।”

উবার অ্যাপে কল করার পর ধানমন্ডি ২৭ থেকে আজিমপুর ছাপরা মসজিদের গলি ভাড়া দেখায় আড়াইশ টাকার মতন। উবার আসতে আসতে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। দুজনের একজনের কাছেও ছাতা ছিল না সে সন্ধ্যায়। সাইফ নিজের ব্যাগ অরুর মাথার ওপর ধরে ওকে এগিয়ে দেয় খানিকটা। নিজে কাকভেজা হয়, অপরদিকে অরুকেও বাঁচাতে পারে না বৃষ্টির ছাঁট থেকে, পুরোপুরি। সাইফকে অরু রাইড অফার করে। সাইফ মুচকি হেসে বলে, রাইড করা তার দরকার, তবে যে রাইড তার প্রয়োজন, তা উবারের রাইড নয়। কথাটার গূঢ় অর্থ ধরবার নিয়তে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সাইফের দিকে তাকিয়ে থেকে ফের হাসিতে ভেঙে পড়ে অরু। গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে স্পষ্টস্বরে অরু সাইফকে শেষ একটা প্রশ্ন করে,

“আপনি আমার কাছে ঠিক কী চান, সাইফ?”

প্রশ্নটা যেন ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে উড়তে উড়তে আচমকা এসে হানা দেয় সাইফের মনে। বৃষ্টির মাঝে মাঝরাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ে সাইফ। তৎক্ষণাৎ বলবার মতো কিছু খুঁজে পায় না। অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন সেটা ছিল না মোটেও। তাদের মধ্যের সম্পর্ক তরল থেকে ক্রমাগত ঘন হয়ে জমাট বাঁধছে, তা তারা দুজনেই টের পাচ্ছে। কিন্তু এ সম্পর্কের নাম কী? সে ঠিক কী চায়, অরুর কাছে? বৃষ্টির গতি বাড়ে। রাস্তায় জলের স্রোতের সঙ্গে খড়কুটো, চিপসের প্যাকেট, কাগজের ঠোঙা ইত্যাদি ভেসে যেতে থাকে। উবারের ড্রাইভার মুখ শক্ত করে বলে, “ম্যাডাম, জানালার গ্লাস তুলে দেন। সিট ভিজে যাচ্ছে।”

“গানটা আবার শুনবেন বাসায় গিয়ে,” জানালার গ্লাস তুলে দেয়ার আগে এই ছিল সাইফের প্রতি অরুর শেষ কথা। 

গাড়িটা যখন দ্রুতগতিতে শংকর বাস স্টপেজের দিকে বাঁক নিচ্ছে, ঠিক তখন সাইফের মনে হলো, অরুর প্রশ্নের উত্তরটা তার জানা আছে। সে চাইলে অরুকে বলতে পারে যে সে ঠিক কী চায় তার কাছে। কিন্তু ততক্ষণে সেই গাড়ি চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। রাস্তা জুড়ে ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডব, আর বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। জনশূন্য পথে মোটরযানের শোঁ শোঁ গমনাগমন।        

নিজের ছোট্ট একলা ফ্ল্যাটে ফিরতে ফিরতে সাইফের রাত এগারোটার মতো বাজে। ফিরে এসে সে পোশাক বদলায়। তারপর ফেসবুকে বসে। ম্যাসেঞ্জারের নীলসাদা খামে এসে জমা হওয়া বার্তাগুলো পড়ে। কিছু কিছুর জবাব দেয়। কয়েকটা টেক্সট অপঠিত অবস্থায় রেখে দেয়। কাউকে কাউকে উপযাচক হয়ে টেক্সট পাঠায়। অরু ফোন দেয় একটু পর। কথা হয়। প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় নানা বিষয়ে কথা। অবশেষে ফোন কেটে দিয়ে সাইফ বিছানায় শুয়ে পড়ে। সাইফের চোখ সিলিংয়ে ঝুলে থাকে, সিলিংয়ে ঝুলে থাকে ঘূর্ণায়মান সিলিং ফ্যান, সিলিংয়ে ঝুলে থাকে জর্জেটের শাড়ির নিচে মেরুন রঙের ব্লাউজ উপচে পরা অরুর স্তনদ্বয়। তার অশান্ত নাভির নিচটাকে শান্ত করার প্রয়োজন হয়। সাইফ সময় নিয়ে মাস্টারবেশন করে। অরু কল্পনায় তার সহযাত্রী হয়। অর্গাজমের সেই চরম মুহূর্ত শেষে মস্তিষ্কের প্রভাস্বর শূন্যতা কাটিয়ে বাস্তবে ফিরে আসার মিনিট খানেকের মধ্যে সাইফ আবারও তার মস্তিষ্কের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অরুর উপস্থিতি টের পায়। এক অজানা ভীতি তাকে চেপে ধরে।

অরুর সঙ্গে তার এই সম্পর্ক কি তার অন্যান্য ক্যাজুয়াল কফি ডেটের পর্যায়কে অতিক্রম করে যাচ্ছে? 

রাত প্রায় শেষ হয় হয়, কিন্তু সাইফের ঘুম আসে না। নগ্ন শরীরে সাইফ বিছানা থেকে উঠে হেঁটে হেঁটে বাথরুমে যায়। সময় নিয়ে তার শরীর ধোয়। তারপর, নগ্ন অবস্থাতেই হেঁটে হেঁটে রুমের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালা খুলে দেয়া মাত্র, যেন সাঁঝবেলার সেই ভেজা বাতাসই প্রবাহিত হয়ে যায় সারা ঘর জুড়ে। তখনও টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে ঢাকার আকাশ ভেদ করে। দীর্ঘায়িত এক শেষরাত আজ। মেঘের কারণে ভোরের আলো ফুটে উঠতে পারছে না। সামনের উঁচু উঁচু দালানের কয়েকটি ফ্ল্যাটে এখনও আলো জ্বলছে। কী করছে তারা এখন, এই মুহূর্তে, আলো জ্বালিয়ে? তাদের জীবনের সঙ্গে সাইফের জীবনের তরঙ্গস্রোত কি মেলে কোনোভাবে?

ঠিক তখন সাইফের মনে পড়ে অরুর সে অনুরোধ, “বাসায় গিয়ে গানটা শুনবেন।” সাইফ উঠে গিয়ে পিসিতে ইউটিউব ওপেন করে। আমাকে খুঁজে বের করে। গোটা গোটা অক্ষরে টাইপ করে—ভোলক্যানো-ডেমিয়েন রাইস। ক্লিক করে প্লে বাটনে। সাইফের ফ্ল্যাটে শেষ রাতের নীরব প্রকৃতি বাঙ্ময় হয়ে ওঠে চেলোর বাদনে। আমার কথায়, সুরে। 

“ ...

দিস ইজ নাথিং নিউ

নো নো! জাস্ট অ্যানাদার চান্স অব ফাইন্ডিং—

হোয়াট আই রিয়েলি নিড

ইজঃ জাস্ট হোয়াট মেইকস মি ব্লিড,

অ্যান্ড লাইক আ নিউ ডিজিজ,

শি ইজ স্টিল টু ইয়াং টু ট্রিট”

সাইফ ফিসফিসিয়ে ওঠে, লাইক আ নিউ ডিজিজ, শি ইজ স্টিল টু ইয়াং টু ট্রিট! পুরো গানটার (অর্থাৎ আমার) অর্থ—সাইফের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই কাতরতম শেষরাতে। সাইফ বোঝে, গানটা তার হয়েই কথা বলছে। কী চায় সে অরুর কাছে? অরুর কাছে তার চাওয়ার নতুন কিছু নেই, নিজেকে রক্তাক্ত করার স্রেফ আর এক নতুন উপলক্ষ্য ছাড়া। তবুও সে নতুন করে ভালোবাসায় পতিত হতে চায়, রক্তাক্ত করতে চায় নিজের ভেতর বাহির। জীবনে এমন কারও উপস্থিতি চায়, যার অখণ্ড মনোযোগ হবে তার কাম্য, যার উপেক্ষা তাকে রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত করবে, যার কাছে সে নিজেকে সমর্পণ করবে সম্পূর্ণভাবে। এসবই তো চাই তার অরুর কাছে।

এদিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে, লুপে বেজে চলছি আমি, অর্থাৎ, গানটি।       

বৃষ্টিস্নাত ভোর রাতে সাইফের শীত শীত লাগে, কিন্তু তার নগ্ন শরীরে কিছু চড়াতে ইচ্ছা করে না। পুরোপুরি দিগম্বর হয়ে সে বসে থাকে জানালার পাশে। যেন পুবাকাশে সূর্যদয় দেখা তার জন্য খুব জরুরি। সূর্যের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চিন্তার সমস্ত জট খুলে যাবে। মাস্টারবেশনের পরেও মেয়েটার চিন্তা তার মাথা থেকে উবে যাচ্ছে না, এর অর্থ কী? ইজ শি হিজ নিউ ডিজিজ? বুকের ভেতর কচি লাউয়ের ডগার মতো ফিনফিনিয়ে বেড়ে ওঠা নতুন অসুখ অরু? সাইফ টের পায়, তার মস্তিষ্ক পাখির পালকের মতো হালকা, কিন্তু মন পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে। সে তখনও জানে না যে ঢাকা শহরে এই তিন দিনের ঝড় বাদলা স্থায়ী হবে পাঁচ দিন, এবং এই পাঁচ দিনে তার অরুর সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের কোনো উপলক্ষ্য তৈরি হবে না, এবং এরপর যখন তা হবে ততদিনে সাইফের মনে আর বিন্দুমাত্র কনফিউশন থাকবে না তার জীবনে অরুর অবস্থান নিয়ে।  

সে পাঁচ দিন পরের কাহিনি। এই মুহূর্তে রুম জুড়ে বেজে চলেছি আমি, আর সাইফ মুখ ঝুলিয়ে এখনও বসে আছে। সে উত্তীর্ণ হয়েছে উপলব্ধির এক নতুন স্তরে : নিজের অস্তিত্বের ভেদকে খুলে ন্যাংটো করে দেয় এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া বিড়ম্বনা বটে, কিন্তু তার চেয়েও বড় বিড়ম্বনা, আরও নিদারুণ দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে প্রশ্নটি সঠিক মানুষের তরফ থেকে আসা। যে প্রশ্নকর্তা আসলেই বুঝবে উত্তরদাতার উত্তরের গভীরতা, বেদনার গভীরতা, অন্তর্জাত হাহাকারের তীব্রতা। সাইফ উপলব্ধি করেছে—জগতে সবচেয়ে কঠিন দুঃখের একটা হলো এই যে—আসলেই আপনার দুঃখ বুঝবে, এমন মানুষের কাছ থেকে জিজ্ঞাসিত হওয়া, আপনার দুঃখটা আসলে কী। 

আসুন, আমরা সাইফকে তার নতুন অসুখের জন্য শুভেচ্ছা জানাই!


দুই.

একঘেয়ে গানের গল্পটা কি শেষ? পেকে যাননি ওর অহেতুক দার্শনিকতায়? আসেন তবে, এবার কিছু বৈষয়িক কথাবার্তা হোক। বলেন দেখি, মানবজীবনে সোনার গহনার মূল্য কতটুকু? অথবা আমিই বলি, আপনারা কড় গুনে দেখেন, কিছু বাদ পড়ে কি না। বিয়েতে মানুষ স্বর্ণালংকার ব্যবহার করে। যেই কনের শরীর জুড়ে যত গহনা—তার তত মানমর্যাদা, শানশওকত। স্বর্ণালংকার প্রাসঙ্গিক নবজাতক শিশুর আকিকায়, মুখে ভাতে। স্বর্ণের ব্যবহার আছে বড়লোক আত্মীয়দের মধ্যে। নিজেদের স্ট্যাটাস প্রদর্শনের নিমিত্তে তারা একে অপরকে সোনার গহনা উপহার দেয়। ব্যাংকে সোনা জমা রাখা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে সোনার বার জমা থাকে। সোনার শহর এলডোরাডো নিয়ে তৈরি হয় পৌরাণিক কল্পকাহিনি। সোনার কেল্লার খোঁজে জমে ওঠে বাঙালির সবচেয়ে জনপ্রিয় গোয়েন্দা ফেলুমিত্তিরের কর্মতৎপরতা। সোনার পরিমাপও হয় নানারকমের। বারো ক্যারেট, আঠারো ক্যারেট, বাইশ ক্যারেট, চব্বিশ ক্যারেট। বারো ক্যারেটের সোনায় খাদ সবচাইতে বেশি, বাইশ ক্যারেটেরটায় কম। চব্বিশ ক্যারেটেরটা সবচেয়ে ভারী। 

মানুষ খুব যত্নে রাখে সোনার গয়নাকে। কারণ টাকার দাম কমতে পারে, কিন্তু সোনার দাম হুহু করে বাড়তেই থাকে কেবল। তাই স্বর্ণালংকারের স্থান হয় ঘরের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায়, আলমিরা বা দেরাজের ভেতর, অথবা ব্যাংকের ভল্টে।

এখন আপনাদের কাছে একটি সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন : একটা খাস্তা বাইশ ক্যারেটের সোনার চেইনের জায়গা ঘরের কোথায় হওয়া উচিত?

আমি জানি আপনাদের উত্তর কী হবে। শরীরে, বা ঘরের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায়। তাই তো?

অথচ আমি একটি বাইশ ক্যারেট সোনার তৈরি লকেট হওয়া সত্ত্বেও পড়ে আছি অরুর রুমে, সোফার নিচে, রুমের এক কোণায়। ঘরের আলমিরা, বা ব্যাংকের ভল্ট না হোক, অন্তত কোনো নারীর কণ্ঠা জড়িয়ে থাকতেও তো আমার আপত্তি নেই। ছিলামও তাই। অরুর কণ্ঠালগ্না হয়ে, অন্তত বছর পাঁচেক। অথচ আজকে আমার কী এক দুর্দশা, ভাবা যায়!

যা হোক, আমার দুর্দশার হেতু আপনাদের সামনে তুলে ধরব, যা দেখেছি, যেভাবে দেখেছি—তারই সোজাসাপটা বর্ণনায়।   

সেদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ অরু, ওর ছ’মাস বয়সী প্রেমিক সাইফকে সঙ্গে নিয়ে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। অরুর সাজগোজ সেদিন একটু ভারীই ছিল। যে ব্যাংকে ইন্টার্ন করেছে, সেই ব্যাংক থেকেই প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে জয়েনিং লেটার পেয়েছে সে। তাই সে একটু মাঞ্জা মেরেই অফিসে যায় আজকাল। লাঞ্চ আওয়ারে দুজনের ফোনে যোগাযোগ হয়। টুকটাক কথাবার্তার ফাঁকে বিকেলের পরিকল্পনা ঠিক করে দুজনে মিলে। ওরা এতদিনে প্রায় বিকালই একসঙ্গে কাটানো শুরু করেছে, অফিস শেষে। কখনো রবীন্দ্র সরোবর, কখনো ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সামনের লেক, কখনো শিল্পকলায় গিয়ে নাটক দেখা, অথবা স্টার সিনেপ্লেক্সে নতুন কোনো সিনেমা, কখনো ধানমন্ডি ৪-এ গ্যালারি চিত্রক, বা চারুকলার জয়নুল গ্যালারি, অথবা ২৭-এর বেঙ্গল গ্যালারিতে নতুন আর্ট এগজিবিশন, কখনো টিএসসির সড়কদ্বীপে বসে চায়ের কাপে চুমুক। অরুর গলায় ঝুলে ঝুলে ঘুরেফিরে বুঝেছি, ছোট এই শহরে উল্লেখযোগ্য স্থানিক বৈচিত্র্য তেমন একটা নেই। 

অফিস শেষে দুজনে একসঙ্গেই বের হয়। অরুর পরিকল্পনা ছিল সাপ্তাহিক বাজার সারবার। দুজনে মিলে ঢুকে পড়ে একটা সুপারশপে। অরু তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বাছাই করে, সাইফ সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে ট্রলি নিয়ে। সেই ট্রলি ভরে ওঠে ম্যাগি নুডুলস, কুলসন ম্যাকারনি ও পাস্তার প্যাকেটে, অরিও বিস্কিট, প্রাণ সসের বোতলে। আরও যুক্ত হয় দুই লিটার সয়াবিন তেল, মিল্কভিটার হাফ লিটারের চারটে পলিব্যাগ, এক ডজন ডিম, দুটো পাকিস্তানি কক মুরগি, ভিম লিকুইড, দুটো স্টিলের চামচ, একটা ফ্রায়িং প্যান।

অরু সেদিন সকাল থেকেই অন্যমনস্ক ছিল। ওর অন্যমনস্কতার কারণ আমি বুঝিনি। ব্যাংকের কাজে ছোটখাটো দু-একটা ভুল করেছে। ফাইল এক টেবিলের বদলে পাঠিয়ে দিয়েছে আরেক টেবিলে। টিফিন বাটিতে করে নিয়ে আসা সালাদ, দুটো রুটি, সবজি, অল্প ঝোলসহ মুরগির রান লাঞ্চের জন্য নির্ধারিত সময়ের বদলে বের করেছে ব্যাগ থেকে বিকেল চারটা বাজে। ততক্ষণে মুরগির ঝোল টকে গিয়েছিল। সুপারশপের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে অরু আবিষ্কার করে, দিনের সবচেয়ে বড় বেখেয়ালি কাজ সে ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে। পার্স ফেলে এসেছে অফিসে। হাতে বড় ভ্যানিটি ব্যাগটা আছে, কিন্তু তাতে পার্সটা ঢোকাতে সে ভুলে গেছে। অফিসের ডেস্কে ভ্যানিটি ব্যাগটা ওপরে থাকলেও পার্সটা থাকে সবসময় ডেস্কের ওপরের ড্রয়ারে। বেরোবার আগ মুহূর্তে সাইফ কল দিয়েছিল। পার্সের ভেতর রাখা ফোন বের করে কথা বলতে বলতেই বেরিয়ে এসেছে সে অফিস থেকে। পার্সটা রয়ে গেছে ড্রয়ারে। পার্সের পাঁচগুণ সাইজের একটা ব্যাগ তার কাঁধে ঝুলছে এখন, কিন্তু তাতে নেই ফুটো পয়সাও। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাইফ ওর মানিব্যাগ থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করে দেয়। তাতে পরিশোধিত হয় বিল। আমি তখনও অরুর কণ্ঠালগ্না।

“মানুষ প্রেমিকাকে কতকিছু উপহার দেয়,” অরু হাসতে হাসতে বলে। “আর তুমি উপহার দিচ্ছ কক মুরগি, আর মুরগি রান্নার তাওয়া!”

“কক তাওয়ায় রান্না করা ছাড়াও খাওয়া যায়,” সাইফ ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে। কী বেহায়া একটা কথা! আমার নিজেরই লজ্জা লাগে শুনতে।       

সুপারশপ থেকে বেরিয়ে সাইফ এত ভারী আনাজপাতির বোঝা অরুকে বহন করতে দিতে চায় না। দুটো বিশাল বিশাল প্যাকে বোঝাই করা বাজারসদাই নিয়ে সাইফ সঙ্গ নেয় অরুর। দুজনে মিলে একটা সিএনজি ভাড়া করে, আজিমপুর পর্যন্ত। আমার কথা বলার শক্তি নেই। থাকলে ঐ তালঢ্যাঙ্গা লোকটাকে বলতাম, অরু আগে এর চেয়েও ভারী বোঝা টেনে ওপরে তুলেছে। সে এক স্বাধীনচেতা, আধুনিক মেয়ে। আই মিন, হতে পারি সোনার গহনা, কিন্তু নারীর শরীরের সঙ্গে লেগে থাকতে থাকতে আমিও বেশ নারীবাদী হয়ে উঠেছি। কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, অরুই যেন খানিকটা আগ্রহী হয়ে সাইফকে প্রশ্রয় দিল। সুযোগ দিল, বাজারের ব্যাগসহ তার সঙ্গী হবার।  

দারোয়ানের কোঁচকানো ভ্রু অতিক্রম করে আটতলা দালানের চিলেকোঠার ছোট্ট দুরুমের ফ্ল্যাটে উঠবে তারা দুজন, এমন সময় দেখা গেল লিফট বন্ধ। লিফট কি আগে থেকেই বন্ধ ছিল, নাকি এখন বন্ধ করা হয়েছে, নাকি লিফট নষ্টই হয়ে গেছে—নানারকম প্রশ্ন তাদের মাথায় খেলা করে। তবে এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য সে দারোয়ানের সঙ্গেই আবারও কথা বলা লাগত। সে লোকের মুখোমুখি হবার কোনো ইচ্ছা তখন তাদের দুজনের একজনেরও ছিল না। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে অরু একাধিকবার হোঁচট খায়। এমন না যে আলো কম ছিল। এ যেন তার সারা দিনের অন্যমনস্কতারই ধারাবাহিকতা। পায়ে হেঁটে আটতলা উঠতে উঠতে দুজনেই গরমে ঘেমে নেয়ে একসা।

বাতাস ছিল বদ্ধ গুমোট। জলীয়বাষ্পের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। আটতলা সিঁড়ি বেয়ে দুজনের শরীরেই সাজপোশাক ঘামে ভিজে সপসপে হয়ে গিয়েছিল। ড্রয়িংরুমের ফ্যান ফুল স্পিডে ছেড়ে সাইফকে টিভি সেটের সামনে বসিয়ে রেখে অরু ভেতরের রুমে যায় গোসল করে ফ্রেশ হতে। আমি, একটি বাইশ ক্যারেটের সোনার চেইন, তখনও অরুর গলায় সেঁটে আছি।

অরু আজ বেশ সময় নিয়ে গোসল করে। যত্ন নিয়ে প্রতিটি চুলের গোড়ায় গোড়ায় পৌঁছে দেয় সানসিল্ক শাইনিং ব্ল্যাক শ্যাম্পুর কনিকা। তারপর, চুলকে ফেনায় ফেনায় ভরিয়ে রেখে মনোযোগ দেয় তার শরীরে ডাভ লিকুইড সোপের প্রয়োগে। চুলের অনুরূপ পুরো শরীরও খুব শীঘ্র ফেনায় ভরে যায়। সময় নিয়ে সাবান ঘষে সে বাহুমূলে, গ্রীবায়, স্তনে, জঙ্ঘায়, পায়ুর আশপাশে, নিতম্বে, ঊরুতে। সাবানের ফেনা পৌঁছে দেয় পায়ের নখের গোড়ায়, আনাচেকানাচে। পর্যাপ্ত পরিমাণ সাবান ব্যবহারের পর, শাওয়ারের ঠাণ্ডা পানি যখন প্রথম আঘাত করে তার ক্রমশ নরম হয়ে আসা ত্বকে, তার পুরো শরীর শিউরে ওঠে ঠাণ্ডায়। শাওয়ার থেকে ছিটকে আসা পানির সরু স্রোত সবার আগে আঘাত করে তার বুকে, স্তনের একটু ওপরে। খুব কাছে থেকে আমি দেখলাম, অরুর স্তনবৃন্ত শক্ত হয়ে উঠছে। সে হাত ব্যবহার করে না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে পানির নিচে। ওকে ক্লান্ত লাগে। এই প্রথম আমি উপলব্ধি করতে পারি, ওর আজকের পুরো দিনের যে অন্যমনস্কতা—তা ওর অন্তর্গত এক লড়াইয়ের বহিঃপ্রকাশ। বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে আজ ও। বড় একটা পদক্ষেপও বটে। দাঁড়িয়ে থাকে অরু শাওয়ারের তলায়, পানি নিজের কাজ করতে থাকে আপন গতিতে। ফেনার দখল থেকে ক্রমশ উদ্ধার করে চলে অরুর নগ্ন কোমল ত্বক।     

প্রায় পৌনে একঘণ্টা পর অরু বাথরুম থেকে বাইরে পা রাখে। ততক্ষণে ওর শরীর জড়িয়ে আছে লাল রঙা ব্লাউজের ওপর একটা নীল সুতির শাড়ি। ভেজা চুল জড়ানো লাল-সাদা ডোরাকাটা একটা গামছায়। কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ। গলায় তখনও ঝুলে আছি আমি, বাইশ ক্যারেট সোনার লকেট। ঝুলে আছি, ডুবে আছি অরুর বুকের ভাঁজের মাঝখানে।

সাইফ সোফায় বসে ওর স্মার্টফোন সার্ফ করছিল। অরু যখন দ্বিধাবিভোর পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়, সাইফের চোখ সবার আগে গিয়ে পড়ে অরুর মাথায়। ভেজা ভর্তি ভেজা চুল যেখানে গামছায় মুড়ে খোঁপা করে বেঁধে রাখা। আজকালকার মেয়েরা সবাই টাওয়েল ব্যবহার করে গোসলের পর। গামছা কেউ কি ব্যবহার করে আর, শরীর মুছতে, মাথার চুল শুকাতে, ভেজা পানি ঝেড়ে ফেলতে? সাইফের মফস্বলে কাটানো কিশোরবেলায়, যখন তার ঠোঁটের ওপর সদ্য গজিয়েছে ফিনফিনে গোঁফের রেখা, আর নারীদেহের কথাই যখন সবসময় ঘুরপাক খেত মাথায়, শরীর থাকত তেঁতে, নাতিশীতোষ্ণ দখিনা হাওয়ার এক ঝলকেই শক্ত হয়ে উঠত পুরুষাঙ্গ—তখন তাকে মাতিয়ে রেখেছিল যে নারী, তার নাম ছিল রানী আপা। ছোটভাই হিসেবেই আদর করত সাইফকে, পাশের বাসার সে তরুণী। সাইফ কখনো বলতে পারেনি তাকে, নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি—কবে থেকে রানী আপাকে দেখলে শক্ত হয়ে উঠত তার পুরুষাঙ্গ। পড়ন্ত দুপুরবেলা রানী আপা গোসল ছেড়ে তাদের একতলা পাকা বাড়িটার ছাদে উঠে কাপড় রোদে মেলত, চুলে অরুর মতন ঠিক একই রকম একটা গামছা জড়িয়ে। কাপড় মেলে দেয়ার জন্য তার উঁচু করা দুহাতের নিচে শাড়ি সরে যাওয়ায় উন্মুক্ত হয়ে পড়া পেট আর উপচে পড়া বুকের দৃশ্য সাইফ গেঁথে রাখত মস্তিষ্কের গহিনতম প্রকোষ্ঠে। বহুরাতে সে দৃশ্য সঙ্গী হয়েছে সাইফের স্বমেহনের। সেই থেকে গোসল শেষে মাথায় গামছা ব্যবহার করে খোঁপা বেঁধে চুল শুকানো নারী তার জন্য উত্তেজনার এক অসাধারণ মাদক। আজ অরুর মাথায় টেনে বাঁধা সে গামছা ঘরময় ছড়িয়ে দিল কৈশোরকালের সে মাদকের বাস।     

অরুর দিক থেকে কোনো ইঙ্গিত ছিল কী? বলা মুশকিল। সুতির শাড়ি তো পাতলা না সে অর্থে। ব্লাউজটা অবশ্য একটু পাতলাই ছিল।  

পুরো প্রক্রিয়াটা এভাবে শুরু হয়—এক বিন্দু পানি, গামছার ফাঁকে বেরিয়ে থাকা একগোছা চুলের প্রান্ত থেকে টুপ করে গড়িয়ে পড়ে অরুর কণ্ঠার হাড়ের ওপর। সেখান থেকে পিছলাতে পিছলাতে সেটা জড়িয়ে ধরে আমাকে। সাইফের চোখ অরুর ভেজা গামছা, ভেজা চুল থেকে সরে গিয়ে অনুসরণ করছিল সেই পানির ফোঁটাকে। সেখান থেকে ওর চোখ গিয়ে পড়ে অরুর গ্রীবায়। সবশেষে, ভেজা শাড়ির নিচে দৃশ্যমান হয়ে ওঠা আমাতে। তারপর ঘটনা দানা বাঁধতে থাকে সাইফের কল্পনায়। সাইফ হিসেব করে দেখে, অরুর দুই স্তনের ঠিক মাঝখানে গিয়ে মিশেছে আমার শেষ প্রান্তটি। সাইফ আর কল্পনা করতে চায় না। সঙ্গে সঙ্গে জোর করে চোখ সরিয়ে নিয়ে আসে টিভির ওপর। টিভিতে তখন নায়িকা অপু বিশ্বাস কোন এক জন্ম নিয়ন্ত্রণের ইনজেকশনের বিজ্ঞাপনে বক্তৃতা দিচ্ছে। মেয়েটা মোটা হয়ে গিয়ে আরও আকর্ষণীয় হয়েছে।

অরু ঠিক তখনই উঠে দাঁড়ায়। ঘুরে হাঁটা শুরু করে রান্নাঘরের দিকে। ওর পেছনে পীঠ এবং পেটের অনেকটাই ছিল অনাবৃত। চুলে জড়িয়ে রাখা গামছার বাঁধন আলগা হয়ে গেলে সে ঘুরে দাঁড়ানো অবস্থাতেই দুহাত দিয়ে সে বাঁধন আবার আঁট করে বাঁধা শুরু করে। এমন সময় সাইফ আবার ফিরে তাকায় অরুর দিকে। দেখে, ব্লাউজের নিচে অরুর বাহুমূলের অংশটুকু ভিজে আছে। তারপর সাইফের পা জোড়া যেন নিজে থেকেই ওকে টেনে বেড়ালের মতো নিঃশব্দে দাঁড় করিয়ে দেয়। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় অরুর দিকে। সাইফকে চুম্বকের মতো অরুর কাছে টেনে নিয়ে চলে তার শৈশবের আরেক অমোঘ স্মৃতি।

একদম শৈশবকাল থেকে—সে কতোটুকু বড় হয়েছে, তা পরিমাপের জন্য সাইফের ছিল এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিগত খেলা। তাদের বাড়ির পেছনের বাগানে ছিল এক বিশাল পেটমোটা আমগাছ। সে ছোটবেলা থেকে চেষ্টা করত, দুহাতে সে গাছ বেড় দিয়ে ধরতে। তার কাঁচা মনের ধারণা ছিল এই যে, যেদিন সে দুহাতে এই আমগাছ বেড় দিয়ে ধরতে পারবে, সেদিনই এটা প্রমাণ হবে যে সাইফ আসলেই বড় হয়েছে। তারপর দিনের পর দিন চেষ্টা করে গেছে সে। কিন্তু দুহাত দিয়ে সম্পূর্ণ সে গাছ বেড় দিয়ে ধরার স্বপ্ন তার আর পূরণ হয়নি কোনোদিন। এমনকি মাসখানেক আগে, শেষ যেবার বাড়ি গেল সে, সেদিনও সাইফ ঠিক একই কাজ করেছে, খানিকটা কৌতূহলে, অনেকটাই বহু বছর পুরনো অভ্যাসের সূত্রে। বলা বাহুল্য, ব্যর্থ হয়েছে সে।

আজ অরুর ভেজা শরীরের সঙ্গে ঘেঁষে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো, তার বড় হওয়া পরিমাপের ভিন্ন এক মাপকাঠি আজ এ মুহূর্তে তার সামনে উপস্থিত। মিলিত হওয়া : শুধু শরীরের টানে নয়, বরং হৃদগ্রন্থির অভিন্ন অনুরণনে। মিলিত হওয়া : শুধু শরীরের নিচে চাপা পড়া শরীর নয়, বরং আত্মায় আত্মায় কথোপকথন। শরীরে শরীরে প্রতিটা ধাক্কায়, অঙ্গের সঙ্গে অঙ্গের প্রতিটা আঘাতে একে অপরের প্রাণশক্তির আলিঙ্গন।   

সাইফ চোখ বুজে এমনভাবে অরুর ভেজা কোমর জড়িয়ে ধরে, যেন সে জড়িয়ে ধরেছে ছোটবেলার সেই আমগাছ। এবং জীবনে প্রথমবারের মতো তার হাতের বেষ্টনীর মাঝে সে ছেনাল বৃক্ষ বরাবর এঁটে যায়। সাইফ অনুভব করে, সে তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন আজ পূরণ করেছে।

“সরো সাইফ!” কথাটা অরু এমনভাবে বলে, যেন সে কথাটা আদৌ বলতে চাচ্ছে না, অন্য কেউ জোর করে তাকে বলাচ্ছে। তারপর, সে বহু কষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সাইফের চেহারায় কাম নেই, উত্তেজনায় ফুলে নেই নাকের পাটা। বরং তার চোখ বোজা, ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে অসম্ভব প্রশান্তির এক হাসি। এরপর যা কিছু ঘটে, অরু আর বাধা দেয় না। মনে হয়, এতে কোনো ক্ষতি নেই তার।  

যেন শৈশবের ব্যর্থতাকে স্মৃতির পাতা থেকে সমূলে উৎপাটনের জন্যেই গোটা গাছকে শেকড়চ্যুত করে উপড়ে ফেলার মতো এক ঝটকায় মাটি থেকে শূন্যে তুলে ফেলে অরুকে, সাইফ। তারপর, বুড়িগঙ্গার তীরের কাঠ চেরাইয়ের দোকানগুলোর কর্মচারীরা যেভাবে কাঁধে কাঠের গুঁড়ি ফেলে হেঁটে চলে হনহনিয়ে, ঠিক তেমন করে অরুকে কাঁধে ফেলে বড় বড় পায়ে হেঁটে যায় সে অরুর বেডরুমে। বিছানায় প্রায় ছুড়ে ফেলে অরুকে। ঝুঁকে পড়ে অরুর ওপর। এমতাবস্থায় অরু কিন্তু চাইলেই সাইফের কিডনি বরাবর নিজের হাঁটু প্রয়োগ করে ওকে হটিয়ে দিতে পারত ওপর থেকে, অথবা দুহাতের নখের ধার পরখ করে দেখতে পারত সাইফের মুখে। তাই হয়তো সে করে বসত একপর্যায়ে, কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখে, শেষবিকেলের ম্লান রোদ এলিয়ে পড়ে আছে তার খাটের ওপর, এবং সে রোদ তার মধ্যে যে বিষণ্ণতা সঞ্চার করে, সে বোঝে—তার শরীরের বহিঃভাগের যে পাঁচটি প্রবেশদ্বার, তার নির্দিষ্ট একটির মুখে তীব্র ঝাঁঝালো ব্যথা ছাড়া তার পক্ষে এই বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। সে উপলব্ধি করে, বিষণ্ণতা নিরাময়ে জীবনের প্রতি গভীর কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা ছাড়া উপায় নেই। তার চোখের কোণ থেকে দুফোঁটা তপ্ত পানি গড়িয়ে পড়ে। সে পানির ফোঁটা অরুর চেহারা থেকে বিছানায় গড়িয়ে পড়তে না পড়তেই সে উন্মাদের মতো হাসা শুরু করে। সাইফের জান্তব অগ্রসরায়মানতা থামত না কোনোভাবেই, থামার কথা ছিল না, সে শৈশবের গাছ উপড়ে ফেলেছে আজ একদম শেকড় থেকে যেহেতু। কিন্তু সে হুট করে থেমে গেল সেই হাসির তীক্ষ্ণ আওয়াজে, যা কেবল জঙ্গলে শোনা যায়, আর শোনা যায় পাগলা গারদে।

সে হাসির পাঠপ্রতিক্রিয়া ভিন্নভাবে সঞ্চারিত হয় সাইফের মাঝে। সে নিজেও হাসা শুরু করে, অরুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে। হাসতে হাসতেই এক হ্যাঁচকা টানে সে অরুর সমগ্র শাড়ি খুলে ফেলতে চায়। হায়রে আনাড়ি পুরুষ মানুষ! অবশ্যই তার সে প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখে না। কিন্তু টানাটানিতে লাভের লাভ যা হয়, তা এই যে— শাড়ি সরে যায় অরুর বুক-পেটের ওপর থেকে। সাইফ দেখে, অরুর পেট, অরুর বুক-ভেজা। এই সিক্ততা শাওয়ারের পানির নয়। অরুর লোমকূপ চুইয়ে নির্গত স্বেদবিন্দু ওর শরীর ভিজিয়ে দিয়েছে। অরু ঘামল কখন, এতখানি? ঘামলই বা কেন? কীসের কামনায়? সাইফ হাতের বদলে মুখ ঘষতে থাকে ওর পেটে, বুকে, গলায়। ঘষে ঘষে সমস্ত স্বেদবিন্দু শুষে নেয় অরুর শরীর থেকে। 

সাইফের পরবর্তী হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল অরুর ব্লাউজ। সাইফ দুটো হাতে আঁকড়ে ধরে ব্লাউজের ওপরের অংশ। এক হ্যাঁচকা টানে পটপট ছিঁড়ে যায় ব্লাউজের সবগুলো হুক। শাড়ির মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অক্ষম হয় অরুর স্তনকে আবৃত করে রাখা সে চিলতে পোশাক। সাইফ অবাক হয়ে আবিষ্কার করে, ব্লাউজের নিচে অরু কোনো বক্ষবন্ধনী পরেনি। কাপড়ের নিচে অরুর যে শরীর তা সে কল্পনায় আবিষ্কার করেছে বহুদিন, এর আগেও। আজ প্রথমবারের মতো সেই কল্পনার দরজা ধাক্কা দিয়ে উন্মোচিত করার অভিজ্ঞতা হলো তার। ত্বকের সেই রং আর সেই মসৃণতা, শরীরের উঁচুনিচু অংশ, স্তন বিভাজিকার ঠিক ওপরে একটুখানিক একটা তিল—সবকিছু।

তারা দুজন দুজনার মুখোমুখি ছিল সে মুহূর্তে, যেন দীর্ঘদিনের দুই শত্রু একে অপরের মুখোমুখি হয়েছে আজ একটা শেষ বোঝাপড়ায় লিপ্ত হবার জন্য। কিন্তু কে কাকে প্রথম আঘাত হানবে, তা নিশ্চিত হতে দুজনেরই সময় লাগে। এর মধ্যে সাইফ নিশ্চিত হয়, অরুর সুপ্ত আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটেছে। গলিত লাভা বেরিয়ে আসছে অনবরত গুহামুখ থেকে। এ অবস্থায় সে আর দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে গলিত লাভার মধ্যে ভেলা ভাসিয়ে দেয়। সেই ভেলা ভেসে ভেসে অগ্রসর হতে থাকে, দুলতে থাকে এদিক সেদিক, সামনে পিছে।

আগ্নেয়গিরির লাভার মধ্য দিয়ে ভেলা ভাসানোর সময় অরুর হাসি থেমে গিয়েছিল। তার ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল, মুখের ত্বক-মাংসপেশি শক্ত হয়ে গিয়েছিল, তার কণ্ঠ থেকে যে আওয়াজ বেরিয়ে এসেছিল সর্বপ্রথম, তা ছিল এক অস্ফুট গোঙানি। তারপর, মোটামুটি একটা লম্বা সময় ধরেই সেই গোঙানিই থাকে তার একমাত্র সম্বল। বাড়ির খোলা জানালায় তখন এসে বসে দুটো চড়ুই পাখি। তাদের ছায়া নেচে চলে বাড়ির দেয়াল জুড়ে, শেষ বিকেলের ম্রিয়মাণ রোদে। কিচিরমিচির, আর ছায়ার লাফালাফি—এ দুই জিনিস সাইফকে বিরক্ত করে তোলে। সে কিচিরমিচিরের আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছিল অরুর মৃদু গোঙানোর শব্দ। খাটের লাগোয়া দেয়ালে তাদের দুজনের সঞ্চালনের চেয়ে চড়ুই পাখি দুটির সঞ্চালনের ছায়া ছিল আরও গতিশীল। যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ লেগে সাইফ ক্ষেপে ওঠে। উন্মত্তের মতো দোলাতে থাকে তার শরীর। অরুর শরীরে, গলার কাছটায় তখন ঝলসে উঠছি আমি, শেষ বিকেলের ম্রিয়মাণ রোদের ঝলকে। হঠাৎ টের পাই, অরু আওয়াজ করা বন্ধ করে দিয়েছে একদম। ওর চেহারা কুঁচকে ওঠে, চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। অরু হঠাৎ হুট করে খামচে ধরে আমায়। তারপর যা ঘটে, অরুর শরীরের সঙ্গে গত পাঁচ বছর ধরে লেপটে থাকা এক ২২ ক্যারেট সোনার লকেট হিসেবে আমার তা মেনে নিতে অসম্ভব কষ্ট হয়। সাবান দিয়ে ঘষে গোসল করার সময়ও যে আমাকে অরু একটিবারের জন্যও শরীর থেকে আলাদা করে না, সে আমাকে সে এক হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলে তার গলা থেকে। তারপর ছুড়ে ফেলে আমাকে, সে নিজেও জানে না কোথায়। আমি ওর শরীর থেকে আলাদা হবার পরপরই অরু গোঙানোর বদলে চিৎকার করতে থাকে পশুর মতো, সাইফের প্রতি ধাক্কায়। সে চিৎকারে এত জোর ছিল যে, চড়ুই পাখি দুটো ভড়কে গিয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে চলে যায় জানালার পাশ থেকে। আমি ততক্ষণে ঝুলছি ওর রুমের একটা চেয়ারের হাতলের সঙ্গে।

ওখান থেকেই দেখলাম, অরু চিত হয়েই শুয়ে আছে, মাথা ডানে ঘুরিয়ে নাক ডুবিয়ে দিয়েছে তার বাহুমূলে। চিৎকার করে চলেছে সমানে। সাইফের দুটো হাতে শিরা উপশিরা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। লৌহ বেষ্টনীর মতো হাত দুটো আঁকড়ে ধরে রেখেছে অরুর কোমরের দুই পাশ, আর সমানে সঞ্চালিত হচ্ছে ওর নিজের কোমর, সামনে পিছে। অরুর হাতদুটো মাথার পেছনে, সারেন্ডার করার মতো ভিঙ্গিতে দেয়াল ধরে রাখা। ওর স্তনদুটো এত জোরে দুলছে যেন উড়ে আলাদা হয়ে যাবে ওর শরীর থেকে। অরুর চিৎকার অব্যাহত থাকে। সেই চিৎকার দিতে দিতেই অরু পাগলের মতো খাটের ওপর হাত ঘুরিয়ে কিছু খোঁজে। ভেলার চালক সাইফ বুঝে উঠতে পারে না যে অরু আদতে কী চাইছে। তার একটু সময় লাগে, ব্যাপারটা বুঝতে যে, কেন কিছু খুঁজে না পেয়ে শেষমেশ নিজের ভেজা চুল জড়িয়ে থাকা গামছার শেষমাথা সে পেছন থেকে খুলে এনে দুদাতের মধ্যে ফেলে প্রাণপণে চিবিয়ে ধরে গোঙাতে থাকে প্রতি ধাক্কার সঙ্গে। তাতে চিৎকারের আওয়াজ খানিকটা কমে, কিন্তু তাদের মিলনের জান্তবতা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এ সবকিছুর ফাঁকে অরু চোখ খোলে না একদম। কারণ চোখ খুললেই তার ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। কিছুক্ষণ পর সাইফের পুরুষাঙ্গ অরুর শুভ্রকোমল পেটকে শিলালিপির মতো নানা ব্যাখ্যাতীত সাদা অক্ষরে আবৃত করে ফেলে। সংগমের পর খাটে শুয়ে দুজনে গল্প করে প্রায় আধাঘণ্টা। সে সময়ই সাইফ একে একে খুলে বলে ওর গাছ সংক্রান্ত শৈশবের পুরাণ, রানী আপার গল্প, কৈশোরকালের ফ্যাটিশ।

ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত সাড়ে ন’টা। সাইফ চলে গেছে ঘণ্টাখানেক আগে। অরু দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে। তার চুল শুকিয়ে গেলেও সে মাথায় জড়ানো গামছা খোলেনি এখনও। যাওয়ার আগে সাইফ তার চিবুকে চুমু খেয়ে বলে গেছে—এভাবেই তাকে দারুণ সুন্দর লাগে। ফলে, সে আর পোশাকাদি বদলায়নি মোটেই। সবকিছুর পর আমাকে যে অরু আর খোঁজেনি, তা নয়। সাইফ যাওয়ার পরে খুঁজেছে, খুঁজে পেয়েছেও। তারপর ছোট্ট একটা কৌটায় বন্ধ করে তুলে রেখেছে আলমারির ভেতর। মনে মনে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়েছে, সাইফ কেন আমাকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করল না, কেন সংগমের মাঝে অরু আমাকে ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলল তার কণ্ঠা থেকে, এ জন্যে।

আমি জানি, অরু তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। দীর্ঘদিন ওর কণ্ঠালগ্ন হয়ে থাকা আমি এখন ওর বিগত অতীত। পেছনের চ্যাপ্টারটুকু এখন ওকে বন্ধ করে রাখতেই হবে। একটা ঘটনা ভুলবার জন্য পাঁচ বছর বড় লম্বা সময়। এত পুরনো ঘটনার জের পুরো জীবন টানার মানে হয় না। সে নিজেকে সাইফের হাতে সমর্পণ করতে পুরোপুরি প্রস্তুত।   


তিন.

একটা হানিমুন ট্রিপে বিয়ারের বোতলের কী কাজ? ছিপি খুলে পান করাই তো? আমিও অমনটাই ভাবতাম এতদিন। ছিপি খোলো, ভেতরের বস্তু পেটের ভেতর চোঁ করে চালান করে দাও, তারপর আমাকে খালি অবস্থায় টেবিলের ওপর রেখে, বা বিনে ছুড়ে ফেলে নিজেরা যা মন চায় করো। কিন্তু এই পাগলা গ্রুপের সঙ্গে ট্রিপে এসে আবিষ্কার করলাম, ভেতরের মাল বেরিয়ে গেলে আমার আরও একটা ব্যবহার সম্ভব।

উল্লেখ্য যে, আমি একটা কার্লসবার্গ বিয়ারের বোতল। ফার্মগেটের ডিপিএল থেকে আমার মতো সব মিলিয়ে আধডজন বোতলকে ব্যাগে ঢুকিয়ে এই দলটা ঢাকা থেকে রওনা হয় বাসে করে। প্রায় বারো ঘণ্টা জার্নি শেষে দলটার সঙ্গে এসে এখানে পৌঁছাই, এই সমুদ্রতীরে। যদ্দুর সবার কথাবার্তায় বুঝলাম, আজকে ওদের এখনে শেষ রাত।    

সমুদ্রতীরের লাগোয়া একটা হোটেলের সামনে ক্যাম্পফায়ারের আয়োজন করা হয়েছে। গত তিন দিন, দুই রাত ওরা সেই হোটেলেই কাটিয়েছে। আজ শেষ রাতটা ওরা সমুদ্রতীরে ছোট ছোট তাঁবুতে কাটাবে। শুকনো লাকড়ি পুড়িয়ে আগুন জ্বালানোর পর, তার পাশে ওরা সবাই গোল করে ঘিরে বসে। আমি তখনও ওদের একজনের কোলে নবজাতক শিশুর মতো আদরে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বসে আছি। ভেতরে কিছু মাল তখনও বাকি। ফলে অচিরেই যে কী দুর্ভোগ অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য, তখনও তো জানি না। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম, কে যেন কী এক প্রস্তাব দিল, সঙ্গে সঙ্গে বাকিরা হইহই করে জোগাড়যন্তে লেগে গেল। সবার মাঝখানে বালির ওপর একটা কাঠের পাটাতন বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর শুইয়ে দেয়া হলো আমাকে এবং এখানেই আমার দ্বিতীয় ব্যবহারের আবিষ্কার। অদ্ভুত এক খেলা। ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার তার নাম।

এরা একদল বন্ধুবান্ধব। কে কাকে কীভাবে চেনে—অত ডিটেইলস আমি জানি না। আমি ছিলাম ছ’খানা বোতলের সবশেষটা। কাজেই ওদের আগের আলাপও তেমন ফলো করতে পারিনি। ঐ ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার খেলার মাঝেই যতটুকু বুঝেছি—এরা সবাই সাইফ আর অরু নামের নববিবাহিত দম্পতির কমন ফ্রেন্ড। তাদের বিয়ে উদযাপন করতে ট্যুরে বেরিয়েছে একসঙ্গে। তবে এই ট্যুর সাইফ কিংবা অরু—দুইজনের পক্ষের বন্ধুদের জন্যই ছিল বেশ অবিশ্বাস্য এবং কৌতূহলোদ্দীপক। কেননা, সাইফের বন্ধুদের ভাষ্যমতে, সাইফের মতো খেলোয়াড় যে হুট করে বিয়ে করে ফেলবে, এটা তাদের ধারণায় ছিল না। আর অরুর বন্ধুদের ধারণা ছিল, ক্যারিয়ারে খুব ভালো একটা অবস্থানে পৌঁছানোর আগে বিয়েশাদির কথা মাথায় আনা একসময় অরুর পক্ষে সম্ভবই ছিল না। তাছাড়া জীবনের সব সিদ্ধান্ত কাগজে কলমে লাভক্ষতির চুলচেরা হিসাব-নিকেশ মেপে করা অরুর প্রেমের বিয়েও এক বিস্ময় উদ্রেককারী সিদ্ধান্ত। সে যাক, জীবন তো কতিপয় বিস্ময়েরই সমষ্টি।  

আলাপে আরও জানা গেল, অরু নাকি বিয়ের জন্যে তিনটা শর্ত দিয়েছিল। এক, বিয়ের অনুষ্ঠানে আংটি বদলের পর সবসময় সে আংটি পরে থাকার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। দুই, বিয়ের দিন তারা বর কনের সাজে সারা দিন রিকশায় করে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াবে। তিন, হানিমুনের বদলে বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটা গ্রুপ ট্যুর, কক্সবাজারে। তারা, ক্যাম্পিং করবে সমুদ্রতীরের খুব কাছে কোথাও। বলা বাহুল্য, তিনটা শর্তের একটাতেও সাইফ না বলেনি।

আংটিসহ যেকোনো অলংকারে সাইফের অ্যালার্জি আছে। গয়নাগাটি তার নিজের একদমই ভালো লাগে না। নিজে ব্যবহার করে না, অন্য কেউ পরুক সেটাও পছন্দ করে না। কাজেই অরুর এই শর্ত মানতে তার কোনো আপত্তিই ছিল না। অবশ্য বিয়ের আংটির একটা প্রতীকী তাৎপর্য আছে। কিন্তু সাইফ সেসব প্রতীক ফ্রতীকেও তেমন একটা ভরসা রাখে না। অরুর দিক থেকে আংটি না পরতে চাওয়ার কারণ হয়তো আপনারা কিছুটা আঁচ করতে পারছেন। তার আগের এক প্রেমিকের উপহার দেয়া একটা সোনার লকেট ওর গলায় শেকলের মতো বাঁধা ছিল একটা লম্বা সময়। তার ভার বহন করতে করতে ক্লান্ত মেয়েটি আর চাইছিল না, এমনকি বিয়ের সূত্রেও অন্য আরেকটা বাঁধন এসে ওকে আটকে ফেলুক।

দ্বিতীয় যে ইচ্ছাটি, ঢাকা শহরে বর কনে বেশে রিকশায় করে ঘুরে বেড়ানো সারা দিন—অরুর এই চাওয়ার পেছনে কারণ ছিল দুটো। প্রথমত, সে নিজে তার বিবাহ সংক্রান্ত ভীতি কাটাবে। গভীর আবেগি এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া এবং তাতে দীর্ঘদিন জড়িয়ে থাকা নিয়ে তার যে তুমুল অনীহা এবং ভীতি, বৈবাহিক সাজপোশাকে পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্সের মাধ্যমে তা থেকে বেরিয়ে আসবে। দ্বিতীয়ত, সাইফ বদ্ধ কামরার শয্যায় যতই চিতাবাঘের মতো দ্রুতগতির জন্তু হোক না কেন, জনসম্মুখে প্রেমিকার প্রতি নিজের ভাব ভালোবাসা জাহিরে সে ঠিক ততটাই ঢিলা, বা অনিচ্ছুক। লাজুক। এমনকি নিজের প্রেমিকার হাতটা ধরে রাস্তায় হাঁটতেও তার প্রবল অনীহা। লজ্জা লাগে। পাশ থেকে কে কী ফুটনোট কাটবে—এটা নিয়েও দুশ্চিন্তায় ভ্রু কুঁচকে থাকে সর্বদা। বরের শেরোয়ানিতে একটা গোটা দিন নিজের নববিবাহিত বউকে পাশে নিয়ে ঢাকার জ্যামজর্জর রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে হয়তো তার সে জড়তা কেটে যাবে। সে মিশনেও যে অরু অনেকখানি সফল, তার প্রমাণ তাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে থাকা ওয়েডিং ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় আটক ছবিগুলো। অ্যালবাম আকারে ছবিগুলো ফেসবুকে শেয়ার করার পর তা পাঁচশ একচল্লিশজনের প্রোফাইল থেকে শেয়ার করা হয়। ঢাকার ব্যস্ত সড়কে এমন ব্যতিক্রমী ওয়েডিং ফটোগ্রাফি কেউ দেখেনি এর আগে।

আর শেষ যে শর্ত, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ক্যাম্পিংয়ে আসা, এটার পেছনে অরুর উদ্দেশ্য ছিল সংসারের পাকেচক্রে চূড়ান্তভাবে জড়িয়ে পড়ার আগে শেষবারের মতো একবার ফ্রেন্ডশিপগুলো সেলিব্রেট করা। অরু আর সাইফের কমন ফ্রেন্ডদের সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে আড্ডা তারা বিয়ের আগেও বেশ কয়েকবার দিয়েছে। সবগুলোই প্রায় সমমনা পাগলাটে মানুষ। তাদের নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা জন্মাতে বেশি সময় লাগেনি। তাই বিয়ের পর সমুদ্রতীরে এই ক্যাম্পিংয়ের প্রস্তাব অরুর মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে যা সময় লেগেছে, কিন্তু তাদের সবার একযোগে হ্যাঁ বলতে সময় লাগেনি মোটেও।

তারপর, সমুদ্রতীরে এই শেষরাতে, অরুর পরিকল্পনাতেই শুরু হলো ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার খেলা। বিয়ারের বোতলের জিম্মাদার সৈকতের ব্যাগ থেকে শেষ বোতল হিসেবে টেনে বের করা হলো আমাকে। সবাইকে হাফ লিটারের মামের বোতলে আমার ভেতরের জিনিস ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়ার পর আমার এই ব্যবহার শুরু। খেলায় অংশ নেয় সাইফ-অরু ছাড়া আরেক বিবাহিত দম্পতি, দুজোড়া অবিবাহিত দম্পতি, এক সদ্য ডিভোর্সি পুরুষ, আর সার্বক্ষণিক হিহি-হাহা করতে থাকা অরুর ক্যাম্পাস লাইফের তিন বান্ধবী। সবারই পরিচয়ের কমন সোর্স হয় অরু, নয় সাইফ।     

যারা খেলাটার নিয়ম জানেন না, তাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখা, আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হতে পারে যে এ খেলায় আমার, অর্থাৎ বোতলের সবচেয়ে বেশি ফাটে। বনবন করে ঘুরতেই থাকি যেহেতু পুরোটা সময়। কিন্তু সত্যি কথাটি হলো, প্রশ্ন উত্তর যাদের করা হয়, ওদের মতো করে ফাটে না আর কারুরই। কারণ, ঘূর্ণায়মান বোতল, তথা আমি, ঘূর্ণন শেষে থেমে যাওয়ার পর আমাকে ঘিরে গোল করে বসে থাকা মানুষজনের কারও দিকে তাক করে রাখি আমার মুখ, আর কারও দিকে তাক করা থাকে আমার পাছাটা। তো আমার পাছা যার দিকে তাক করা থাকে, সে প্রশ্ন করে আমার মুখ যার দিকে তাক করা থাকে তাকে। প্রশ্নটা হয় খুব অস্বস্তিকর। আপনি কেমন আছেন, দিন কেমন যাচ্ছে—এরকম সহজ সরল জিজ্ঞাসা নয়, বরং, যদি অরুদের এই আড্ডারই উদাহরণ দিই, অরুকে ওর তিন বান্ধবীর এক বান্ধবী সরাসরি প্রশ্ন করেছিল, ও সাইফের আগে কজন পুরুষের সঙ্গে শুয়েছে। কাজেই, বুঝতে পারছেন প্রশ্নের ধরন এবং, অতি অবশ্যই সে প্রশ্নের সত্য উত্তর দেয়া লাগে। অথবা তাকে একটা ডেয়ার দেয়া হয়। ডেয়ার বলতে একটা দুঃসাহসী কাজ। সেটাও অস্বস্তিকর। যেমন, অরু নিজেই একটু পর প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ পায়, যখন আমার পেছনের দিকটা ওর দিকে পড়ে, আর মুখের দিকটা অরুর সেই বান্ধবীর দিকে, যে একটু আগে অরুর শয্যাসঙ্গীর সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করে ওকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল। অরুর সে বান্ধবী ট্রুথ না নিয়ে ডেয়ার বেছে নেয়, এবং অরু তাকে টাস্ক দেয়, তার ডানপাশে বসা তিন বান্ধবীর একবান্ধবীর গলায় কিস করার। অরুর সে বান্ধবী খুশি খুশি এমনভাবে তার পাশে বসা বান্ধবীর গলায় চুমু খায় যে, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে দীর্ঘদিন যাবৎ মানুষের স্পর্শহীনতায় ভুগছে। পরিশেষে সবাই মজা পেয়ে হাততালি দিয়ে ওঠে। তো, এই খেলায় একটু ভীতু প্রকৃতির মানুষরা ডেয়ারের বদলে ট্রুথ বেছে নেয়, তাতে জটিলতা কম যেহেতু। আর যাদের রেপুটেশন নিয়ে চিন্তা বেশি, পার্সোনাল লাইফ খুব স্ক্যান্ডালাস, তারা ডেয়ারই বেছে নেয়। সত্যি কথা বলে থলের বেড়াল বের করে আনতে চায় না।

প্রথম নানারকম অদ্ভুত প্রশ্ন দিয়ে ওদের আলাপ শুরু হয়েছিল। যেমন, কার ফেভারিট পজিশন কী, বিছানায় করা সবচেয়ে উদ্ভট কাজ কী, কার ভেতর হোমোইরোটিক ফিলিংস লুকোনো আছে। একজন প্রশ্ন করেছিল ভার্জিনিটি হারায় কত বছর বয়সে। এই প্রশ্ন নিয়ে সবাই হাসাহাসি করতে করতে শেষ। মাঝখানে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসার মতো আড্ডা থেকে তথ্য বেরুলো—এই আড্ডায় উপস্থিত ছেলেদের মধ্যে প্রায় সবাই কানিলিঙ্গাস পছন্দ করে, ছেলেগুলো যেহেতু সবাই কানিলিঙ্গাস পছন্দ করে, কাজেই ওরা প্রায় সবাই হোমো। পরে একজন কারেকশন করে দিল : আছে যেহেতু মেয়ের সঙ্গে, কাজেই পুরোপুরি হোমো বলা যাবে না। বড়জোর বাইসেক্সুয়াল বলা যেতে পারে। ছেলেগুলো রেপুটেশন হারিয়ে মেয়েদের ব্যাপারে অভিযোগ তুলল যে মেয়েগুলো বিছানায় একদম ইনঅ্যাক্টিভ। বিছানায় পা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে টান হয়ে শুয়ে থাকতে ভালোবাসে। পালটা জবাবে মেয়েরা বলে, যেহেতু তারা জানে যে পুরো ব্যাপারটা দেড় থেকে আড়াই মিনিটে শেষ হয়ে যাবে, তাই তারা নিজেদের অতটা তাতায় না। এ নিয়ে সমুদ্রতীরেই বেশ একচোট হাতাহাতি হয়ে যায় তাদের সবার মাঝে।

তারপর আর আমার বেল থাকে না। আমি কাত হয়ে পড়ে থাকি সবার মাঝখানে। পাশে ক্যাম্পফায়ারের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। ততক্ষণে তাদের উত্তেজনা খানিকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। তারা আগ্রহী হয়ে উঠেছে দার্শনিক আলোচনায়। বলে, জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় তারা পার করে ফেলেছে চোখের পলকে। বাকি জীবন যে কখন দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাবে, তারা টেরও পাবে না। তাদের উচিত জীবনকে যতটুকু পারা যায়, পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে এখনই উপভোগ করে নেয়া। অবিবাহিত দুই দম্পতির একটা জুটি একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে।  

এমন সময়, মামের বোতলে ঢালা বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে সাইফের সে সদ্য ডিভোর্সি বন্ধু মুখ খোলে। সে বলে, তারা এক ভুল আয়োজনে উপস্থিত হয়ে জীবন উপভোগ করা নিয়ে কথা বলছে। তারা এখানে এসেছে অরু আর সাইফের বিবাহ উদযাপনে, অথচ বিবাহ এমন একটা বন্ধন যা মানুষের স্বাধীন জীবনযাপনে চূড়ান্ত দাঁড়ি টেনে দেয়। সে জোর গলায় বলে যে, তার মতে পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ মানুষ দাম্পত্যজীবনে সুখী থাকার অভিনয় করে। তারা আদতে ভীরু। মুখ ফুটে স্বীকার করার সাহস নেই যে তাদের ভালোবাসা মরে পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে এখন। বিবাহিত জীবন হচ্ছে ভীরুদের প্রতিষ্ঠান। মানুষ স্বভাবগতভাবেই বহুগামী। নারী পুরুষ নির্বিশেষে। আর বিয়ে নামক জিনিসটার উদ্ভাবনই ঘটেছে সক্ষম পুরুষ ও নারীদের শেকলে বেঁধে ফেলতে। যাতে করে কাবেল নারী-পুরুষের উত্তুঙ্গ যৌনজীবন সমাজের দুর্বল অক্ষম শ্রেণির মানুষদের চক্ষুশূল না হয়, তাদের লালা ঝরানোর বিষয়বস্তুতে পরিণত না হয়।   

এই জায়গায় এসে অরু বেঁকে বসে পয়েন্ট অব অর্ডার উপস্থাপন করে। অরু কথা বলে ভালোবাসার পক্ষে। বলে, বিয়ে মানেই ভালোবাসার মৃত্যু, এটা সে মানে না। বলে, ভালোবাসার চেহারা অনেকরকম। বয়ফ্রেন্ডের জন্য ভালোবাসা, স্বামীর জন্য ভালোবাসা, বাবা-মায়ের জন্য ভালোবাসা, সন্তানের জন্য ভালোবাসা, নিজের পছন্দের শিক্ষকের জন্য ভালোবাসা, নিজের পছন্দের স্পোর্টসম্যানের জন্য ভালোবাসা, ভালোবাসা নিজ ধর্মের ধর্মগুরুর প্রতি, স্রষ্টার প্রতি। এসব ভালোবাসা একরকম না। ভিন্ন ভিন্নভাবে তাদের উৎপত্তি ও বিকাশ। নিজের পছন্দের মানুষকে যখন কেউ বিয়ে করে, তখন সে সৌভাগ্যবান, কারণ তারা তাদের নিজ থেকে বাছাই করা মানুষের সঙ্গে পুরো জীবনের সমস্ত আবেগ অনুভূতি ভাগ করে নেবে। এই ঘনিষ্ঠতম স্পেসটুকু এ দুটো মানুষের জীবনে আর কেউ কখনো পাবে না। ভালোবাসার চেহারা তখন পালটে যাবে। পরিচয়ের প্রথম দিনগুলোর মতো উত্তুঙ্গ আকর্ষণ হয়তো রইবে না। কিন্তু ভালোবাসা পরিণত হবে মায়ায়, দায়িত্ববোধে, আবেগহীন কর্তব্যপালনে। যৌন আকর্ষণ কমে যেতে পারে, কিন্তু সন্তানকে বিছানায় দুজনের মাঝে নিয়ে শুয়ে থাকার যে আনন্দ, তা অবশ্যই ভিন্ন ধরনের, এবং কম কীসে?

সাইফ বিয়ার পান করেছিল সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। তাই সে মুখ খুলছিল না মোটেই। বসেও ছিল গ্রুপ থেকে খানিকটা সরে, সমুদ্রের কাছাকাছি। শেষরাতে সমুদ্রতীরের উন্মুক্ত আকাশে যথেষ্ট পরিমাণ নক্ষত্রপতন দুচোখ ভরে দেখে নিয়ে তারা আড্ডা ভেঙে উঠে পড়ে। ঢুকে পড়ে যে যার ক্যাম্পিংয়ের তাঁবুতে। অরু যথেষ্ট উত্তেজিত থাকা সত্ত্বেও সাইফকে দেখে বুঝতে পারে, ও যেই হালে আছে, তাতে করে এই মুহূর্তে ওর জিনিস দাঁড়াবে না। কাজেই সে চুপচাপ শুয়ে পড়ে নাক ডাকতে থাকা সাইফের পাশে। সবকিছু নীরব হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ সাগরতীর থেকে গিটারের টুংটাংয়ের সঙ্গে দরাজ কণ্ঠে গান ভেসে আসে—

“চাতক থাকে মেঘের আসে, মেঘ বরিশে সে কোন দেশে

বলো চাতক বাঁচে কীসে, ওষ্ঠাগত প্রাণ আকুল

সমুদ্র কিনারে বসে জল বিনে চাতকী মরল

ওরে বিধি হায়রে বিধি, তোর মনে কি ইহাই ছিল?”

অরু তার তাঁবুর চেইন খুলে তাঁবুর দরজায় চাদর জড়িয়ে বসে থাকে। পেছন থেকে সাইফের নাক ডাকার আওয়াজ ভেসে আসছে। সামনে, খানিকটা দূরে তাদের ডিভোর্সি বন্ধু গান গাইছে একা একা বসে, সমুদ্রের তীরে। প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড এখন প্রায় নিভু নিভু। ঘড়ির কাঁটায় রাত প্রায় চারটা ছুঁই ছুঁই। এই মাঝরাতে, শেষরাতে সদ্যই সংসার ভাঙা লোকটার কণ্ঠে এ গান অরুকে ভিন্নভাবে স্পর্শ করে। গানের কথাগুলোকে তার এই মুহূর্তে, এই জায়গায়, ঐ লোকটার—তার নিজের—বা সমগ্র মানবজাতির জীবনে অমোঘ এক সত্যবচন বলে মনে হয়। সমস্ত চাতক পাখির এই তো ভবিতব্য। সমুদ্রের তীরে বসে, আসমানের দিকে ঠায় তাকিয়ে, জল বিনে পিপাসার্ত অবস্থায় মারা যাওয়া।  

অরু কাউকে কিছু না বলে গোপনে আমাকে তুলে এনেছিল সেই ট্রুথ অর ডেয়ার খেলার আড্ডা থেকে। আমি এখন অরু-সাইফের তাঁবুর মেঝেতে পুনরায় পড়ে আছি। আমার পাছা অরুর দিকে, মুখ সাইফের দিকে। গেমটা যদি এখনও চল, তবে অরুর কথা ছিল সাইফকে প্রশ্ন করার।

অরুর মনে হয়, শীঘ্রই একদিন সাইফের সঙ্গে তার একাকী ট্রুথ অর ডেয়ার গেমটা খেলা লাগবে। 


চার.

আমি একটি ঘটনা। ঘটনাটি এরকম :

অরুর ওপর থেকে আস্তে করে বাম পাশে গড়িয়ে পড়ে সাইফ। চিত হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। মাথার ওপর এক হাত, আরেক হাত বুকের ওপর। চোখ আধবোজা। শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। পাশে শোয়া অরু বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। ওর গোটা শরীর কাঁপছে তিরতির করে। ফেইক অর্গাজম ছিল না তবে। বহুদিন পর এমন জান্তব, এমন উদ্দাম, এমন সেটিসফায়িংভাবে মিলিত হলো তারা। ভয়ডরহীনভাবে। হঠাৎ থেমে যাবে কি না, হঠাৎ বীর্যপাত হয়ে গিয়ে মধ্যখানেই সুখের বিনাশ হবে কি না—এ নিয়ে একমুহূর্তের জন্যেও দুশ্চিন্তা কাজ করেনি। অরুও মধ্যখানে হঠাৎ-জ্বলছে, আজ থাক, বলে থামিয়ে দেয়নি। বিয়ের পরপর, তাদের সেই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে তাঁবু খাটিয়ে থাকার প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এখন তারা এরকমভাবে খুব কমই মিলিত হয়। চাইতে অস্বস্তি হয়। চাইলেও তাতে নানারকম ফর্মালিটি থাকে। এমন না যে আগের মতো হুট করে যেখানে ইচ্ছা সেখানেই শুরু করে দিল। কোন এক কালে কে যেন হাসতে হাসতেই তাদের দুজনকে উদ্দেশ্য বলেছিল—বিয়ের পর যতদিন রাত্রিবেলা খাট দুলছে, ততদিন সংসার পোক্ত আছে। একদম আচমকা কথাটা শুনে দারুণভাবে রিলেট করতে পারলেও, উক্তিটা এখন আর অরু-সাইফের সংসারে তেমন প্রাসঙ্গিক নয়।   

ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। সাইফের ক্লান্ত শরীর উঠতে গড়িমসি করে। সে পাশ ফিরে অরুর দিকে তাকায়। অবাক কাণ্ড, মেয়েটা এরমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে! বার্থ অব ভেনাস ছবিতে নগ্ন ভেনাস যে অঙ্গভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে আছে, অরু ঘুমের মধ্যে খাটে শুয়ে আছে ঠিক সে ভঙ্গিতে। আস্তে আস্তে ওঠানামা করছে ওর বুক। সাইফ ওর ঘুম না ভাঙিয়ে খুব সন্তর্পণে ওর মাথার চুলে বিলি কাটতে থাকে আঙুলে। ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক করা, হাঁ করে আছে সে। ঘুমের মধ্যে ওর চেহারা আশ্চর্য সরল, শান্ত ও কান্তিময় লাগে।

সাইফ লাফিয়ে উঠে বসে। বাথরুমে যায়। সময় নিয়ে প্রস্রাব করে। যৌনাঙ্গ সময় নিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে। দাঁত মাজে। তারপর ইলেকট্রিক ভেন্টিলেটরের সুইচটা ছেড়ে এসে রুমের চেয়ারে এসে বসে—টেবিলের সামনে। ড্রয়ারে সিগারেট রাখা ছিল। অন্ধকার রুমে প্যাকেটটা খুঁজে পেতে কিছুটা সময় লাগে। রুমের ভেতর কেবল বাথরুমের সামনে জ্বালিয়ে রাখা আলো প্রবেশ করছে। আধো আলো, আধো ছায়ার মধ্যে রুমের পুরো কাঠামোয় একবার চোখ বুলায় সে। পুরোটা উডেন ফ্লোর। মাথার ওপরে ছাদেও কাঠের ডিজাইন। খোপে খোপে ছোট ছোট লাইট বসানো। তার সবগুলোই নেভানো যদিও এখন। চারপাশে পাহাড় ঘেরা জনমানবশূন্য এক এলাকায় ছবির মতো সুন্দর এক আয়োজন।

সাইফ সিগারেট আর দেশলাইয়ের বাক্স হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে যাবে, এমন সময় জানালার ওপাশে ছায়ার মতন কিছু একটা যেন নড়ে ওঠে। সাইফ ভেতরে ভেতরে খানিকটা চমকে উঠলেও, ভাবে—এ হয়তো দৃষ্টিভ্রম। সেদিকে কিছুক্ষণ ঠায় তাকিয়ে থাকার পরে আর সে ছায়ার উপস্থিতি দেখা যায় না। আর কিছু নয়, জানালার ওপাশে গাছের ডালের নড়াচড়াই হয়তো। এখনও তার শরীরে সুতোটি নেই। খাটে অরুও ঘুমিয়ে আছে শরীরে কোনো কাপড় না জড়িয়েই।

সাইফ সিগারেট আর দেশলাইয়ের বাক্স হাতে উঠে পায়ে পায়ে হেঁটে চলে বারান্দার দিকে। সিগারেটের গন্ধ অরু পছন্দ করে না। এই মাঝরাতে সিগারেটের ধোঁয়ায় রুম আচ্ছন্ন করে ফেলার কোনো মানে নেই। দরজাটা খুলে রাখলে সব ধোঁয়া বেরিয়ে যাবে। 

তাদের খাট বরাবর বড় জানালাটা অতিক্রম করার সময় আবারও সাইফ জানালার ওপাশে পুনরায় একটা ছায়ার কম্পন অনুভব করে। শুধু তাই না, সাইফের ইন্দ্রিয়সমুহ জুড়ে এক অস্বস্তিকর গা সিরসির ভাব ছড়িয়ে পড়ে। মনে হয়, কেউ তার দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। এবারে সাইফ আর জানালায় সরাসরি তাকাতে পারে না। তার ভয় হয়। কিন্তু এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। এটা তার আর অরু—দুজনেরই নিরাপত্তার ব্যাপার। সাইফ পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে জানালার দিকে।

শীতের রাত নয়, তবুও ঘেমে আছে কাচের শরীর। তাতে হাত বুলিয়ে কাচের ঘোলা ভাবটা পরিষ্কার করা মাত্র শরীরের রক্ত জমে যায় সাইফের! ভাবলেশহীন চেহারার একজন মানুষ সোজাসুজি তাকিয়ে আছে তার দিকে, জানালার ওপাশে। ঈষৎ কালচে গায়ের রং। পরনে শরীরের ওপরের অংশে কিছুই নেই। বাইরে কোনো এক উৎস থেকে তার মুখের ওপর ঘোলা সাদা আলো পড়ছে। তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার তেলে জবজব করতে থাকা চুল, কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। পুরু ঠোঁটের ওপর সরু গোঁফের রেখা। ঠোঁট ফেটে চৌচির। জিহ্বা বের করে লোকটা একবার ঠোঁটখানা চেটে নেয়। তার খসখস আওয়াজ সাইফ জানালার এপারে বসে স্পষ্ট শুনতে পায়।

সাইফ হঠাৎ আবিষ্কার করে, সে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে। তার সরে যাওয়া উচিত এখনই। টেনে দেয়া উচিত জানালার পর্দা। ফোন করে সাহায্য চাওয়া উচিত ইন্টারকমে। কিন্তু সাইফ কিছুই করতে পারে না। সে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে কেবল। যেন তার পায়ে শিকড় গজিয়ে গেছে।

ওপাশে লোকটা একবার সাইফের মুখের দিকে, আর একবার সাইফের যৌনাঙ্গের দিকে তাকায়। তারপর সে ঘাড় বাঁকিয়ে সাইফের পেছনে, খাটে শুয়ে থাকা অরুর দিকে তাকায় একদৃষ্টিতে। তার চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। পর্দা টেনে দেয়া প্রয়োজন, সাইফ কেন পারছে না? অনেক কষ্টে জমে বরফ হয়ে যাওয়া হাত নাড়িয়ে সে জানালার পর্দা টান দিতে গিয়ে খেয়াল করে, জানালায় পর্দা নেই! এটা কী হলো? রুমের জানালায় কি আদ্যোপান্তই পর্দা ছিল না? ব্যাপারটা এভাবে তাদের দুজনেরই চোখ এড়িয়ে গেল?   

পায়ের শিকড় সজোরে টেনে ছুটিয়ে সাইফ ছুটে গিয়ে দাঁড়ায় অরুর পাশে। খাটের ওপর বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ও এখনও। জোরে জোরে অরুর নাম ধরে ডাকে কয়েকবার সাইফ। অরুর তরফ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। তারপর অরুর কাঁধ ধরে জোরে জোরে কয়েকবার ঝাঁকি দেয় সে। অরুর পুরো শরীর দুলে উঠলেও তার ঘুম ভাঙার কোনো লক্ষণ নেই। সাইফ অরুকে জড়িয়ে ধরে আবারও জানালার দিকে তাকায় একবার। শিউরে উঠে দেখে যে, বুনো লোকটা জানালার ওপাশে জানালার কাচের সঙ্গে শরীর লেপটে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দুচোখ চেটেপুটে খাচ্ছে অরুর শরীর। 

অরুকে জাগিয়ে তোলার ইচ্ছা ত্যাগ করে সাইফ এবার পাগলের মতো বিছানা হাতড়ে বেড়ায় একটা চাদরের খোঁজে। চাদর তো চাদর, সাইফ এই প্রথম খেয়াল করে, তাদের খাটে কোনো বেডকভার পর্যন্ত নেই। সে লাফিয়ে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। রুমে রাখা ওয়ার্ডরোবের প্রতিটা ড্রয়ার দ্রুতগতিতে টেনে খুলে একদম নিচের ড্রয়ারে একটা ছোট চাদর পাওয়া যায়। সেটা দিয়ে অরুর শরীর ঢাকতে গিয়ে সাইফ খেয়াল করে, চাদরটা এতটাই ছোট যে সেটা দিয়ে অরুর শরীরের ঊর্ধ্বাংশ ঢাকলে ঊরু-নিতম্ব উন্মুক্ত থেকে যায়। আবার নিচের শরীর আবৃত করতে গেলে খোলা থেকে যায় কোমর-স্তন-গ্রীবা এবং মুখ। বেশ কয়েকবার টানাটানির পরেও সে চাদর দিয়ে অরুর পুরো শরীর ঢাকা সম্ভব হয় না। সে কোনোভাবে চাদরটা দিয়ে অরুর শরীরের নিম্নাংশ ঢেকে বুক পীঠ এগুলো নিজের শরীরের পিছে আড়াল করে ঢেকে বসে। তার নিজের শরীরেও এখনও সুতোটি নেই। কিন্তু তা নিয়ে কোনো পরোয়া নেই সাইফের। এই মুহূর্তে তার একমাত্র কাজ অরুর অনাবৃত শরীরকে ঢেকে বসে থাকা।

সে কোনোক্রমে ঘাড় ঘুরিয়ে খেয়াল করে, জানালার ওপাশে ঝুলে থাকা চেহারার সংখ্যা পঙ্গপালের মতো এর মাঝেই বেড়ে গেছে আরও কয়েকগুণ। বিচিত্র তাদের মুখাবয়ব, তাদের চেহারা প্রথম ব্যক্তিটির মতো অভিব্যক্তিহীন নয়। তাদের চোখেমুখে স্পষ্টত ফুটে আছে ক্রোধ ও ক্ষোভের চিহ্ন। সাইফ ভয়ার্ত ভঙ্গিতে দ্রুতগতিতে মুখ সরিয়ে নেয়ার সময় চমকে উঠে খেয়াল করে, মাথার এ পাশেও আরেকটা জানালা আছে, আর এখানেও ঝুলে আছে বেশ কিছু ক্ষুব্ধ, কামার্ত মুখ। সাইফ এমন একটা অবস্থায় আছে যে, তার আর কিছু করবার মতো অবকাশ নেই। ইন্টারকমে ফোন দেয়ার উপায় নেই। তার ছেঁড়া অবস্থায় সে ফোন ঝুলে আছে দেয়ালে।

জানালার ওপাশে সর্বপ্রথম দেখতে পাওয়া লোকটি এখনও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাইফেরই দিকে। তার চোখজোড়াই যেন পরিণত হয়েছে তার যৌনাঙ্গে। তাতে ধকধক করে জ্বলছে কাম। সাইফের দিকে তাকিয়ে সে জিভ দিয়ে আবারও তার শুকনো ঠোঁট চেটে নেয়। সাইফ স্পষ্টই আবারও সে চটচট আওয়াজ শুনতে পায়। সে অবাক হয়ে লক্ষ করে, বুনো মানুষটি আস্তে আস্তে, পায়ে পায়ে পেছানো শুরু করেছে। তার সঙ্গে জানালার ওপাশে থাকা তার দলের বাকিরাও পেছানো শুরু করেছে পায়ে পায়। পেছাতে পেছাতে অদূরে একটা টিলামতন জায়গায় তারা সবাই গিয়ে উঠে পড়ে, জড়ো হয়। দলের নেতা টাইপের লোকটির চোখ অতদূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পায় সাইফ। সাপের মতো স্থির, ক্রূর। যৌনাঙ্গের মতো উত্তেজিত, কামার্ত। তারপর ধীরে ধীরে তার চেহারা থেকে ক্রোধ, ক্ষোভ, কাম সব সরে যায়। তাতে জায়গা করে নেয় কৌতুক। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক চিলতে হাসি। তাতে স্পষ্ট বিদ্রুপ মাখা। 

সাইফ পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে অরু ঠিক আছে কি না। তার পিলে চমকে যায়। প্রবল বিস্ময়ে সাইফ লক্ষ করে, অরুর ঠোঁটের কোণেও ঝুলে আছে সেই একই বিদ্রুপের হাসি, যদিও সে ডুবে আছে গভীর ঘুমে।

এর মধ্যে টিলার ওপর জমা হওয়া লোকগুলোর নেতা উঠে দাঁড়ায়। বাকিরাও তাদের নেতাকে অনুসরণ করে উঠে দাঁড়ায় একে একে। বনমানুষ ধাঁচের তাদের সে নেতা কে জানে কীসের খোঁজে ডানে বামে তাকায়। কিন্তু যা খুঁজছে সে, তা আর পায় না। এভাবে বেশ কয়েকবার খোঁজাখুঁজি শেষে সে আবারও ভরাট চোখে তাকায় সাইফ-অরুর কামরার দিকে। 

তারপর সাইফকে চমকে দিয়ে টিলায় দাঁড়ানো সবগুলো মানুষ একসঙ্গে ছুটে নামতে থাকে সাইফদের রুম বরাবর। এত দ্রুতগতিতে তারা ছুটতে থাকে যে, মনে হয় খোদ টিলাটাও ছুটছে তাদের সঙ্গে। এত জোর তাদের পায়ে যে—তাদের পায়ের স্পন্দনে সাইফদের কামরা থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে।

এই ফাঁকে কখন যেন অরু উঠে দাঁড়িয়েছে সাইফের অলক্ষে। ছুড়ে ফেলেছে তার শরীরকে আংশিক আবৃত করে রাখা চাদরখানা। তার চোখ বন্ধ, কিন্তু ঠোঁটের কোণে ঝুলছে ঠিক একইরকম বিদ্রুপের হাসি, যে হাসি সাইফ দেখতে পেয়েছিল ঐ বনমানুষের ঠোঁটে। দ্রুতপায়ে অরু এগিয়ে চলে জানালার দিকে। সাইফ ছুটে গিয়ে তাকে টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে জানালার পাশ থেকে, কিন্তু অরুর শরীরে এতটা জান্তব শক্তি কোথা থেকে হাজির হয় কে জানে, সে হাতের স্রেফ একটা ঝটকায় সাইফকে ছুড়ে ফেলে দেয় মেঝের ওপরে। তারপর পুনরায় হাসিমুখে হেঁটে যায় রুমের অর্ধেকটা আবৃত করে রাখা জানালার পাশে। তার থাই গ্লাস এক হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলে সে। জানালার ফাঁক দিয়ে শরীর গলিয়ে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে সে ঐপাশে গিয়ে পড়ে, ঐ বুনো লোকগুলোর দঙ্গলে। তাদের শরীরের আড়ালে হারিয়ে যায় অরুর অনাবৃত শরীর। সাইফ হামাগুড়ি দিয়ে ওঠে ঐ জানালার ফ্রেম ধরে। তাকিয়ে দেখে, সবার নগ্ন শরীরের মাঝে হারিয়ে গেছে অরু। কেবল ভেসে আছে তার মুখখানি। তাতে এখনও জড়িয়ে আছে এক চিলতে বিদ্রুপের হাসি।

সাইফ টের পায়, তার কণ্ঠনালির গভীর থেকে চিৎকার উঠে আসছে। আশু চিৎকারের প্রতীক্ষায় তার গলার সবগুলো রগ ফুলে ওঠে। আর একটা সেকেন্ডও অপেক্ষা করলে তার গলাকে ঘিরে রাখা প্রতিটা রগ টং টং টং করে ছিঁড়ে যাবে। সাইফ চোখ বন্ধ করে শরীরের প্রতিটি কোষে জমে থাকা শক্তির শেষ বিন্দুটি ব্যবহার করে এক প্রাণান্তকর চিৎকারে ভেঙে পড়ে।                          


পাঁচ.

আমি সেই চিৎকার, যা আজকাল সাইফকে তার দুঃস্বপ্নের ঘোর ভাঙিয়ে জাগিয়ে তোলে। আমি সেই চিৎকার, যা সাইফকে সাহায্য করে স্মৃতির অন্ধকারতম প্রকোষ্ঠ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসা অতল নরকের তলে লুকিয়ে থাকা এক অপরিচিত আঁধারের মুখোমুখি হতে। প্রতিবার আমাকে জন্ম দেবার সময় সাইফ তার শরীরের প্রতিটি কোষে জমে থাকা শক্তির শেষ বিন্দুটিও খরচ করে ফেলে। নইলে আমি আটকা পড়ে যাই ওর শরীরের খাঁচার ভেতরেই। কণ্ঠনালি চিরে আমার আর বের হয়ে আসা হয় না। এতখানি শক্তি শরীরের ভেতরে পুনরায় আটকা পড়লে তা ওর শরীরের অভ্যন্তরের প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসে। মস্তিষ্ক পুরো ব্ল্যাকআউটে চলে যায়। একই সঙ্গে সাইফের সত্তার একটা অংশ মারা পড়ে চিরদিনের জন্য।               

আজ আমি যথাযথভাবে বেরিয়ে এসেছি ওর কণ্ঠনালি চিরে। বাতাসে যদি কান পাতেন, বা দেয়ালে যদি হাত দেন—সাইফের সে প্রাণান্ত চিৎকারের কম্পন আপনি এখনও টের পাবেন। অরু তখনও ঘুমায়নি। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় এপাশ ওপাশ করছিল বিছানায়। বিগত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ সাইফ প্রায়ই ঘুম ভেঙে জেগে উঠছে আমাকে বাতাসে ছুড়ে মেরে, অথবা অন্তত গোঙাচ্ছে সে প্রতিনিয়ত। অরু চাইলেও ঘুমাতে পারছে না। এমনিতেই ওর ঘুম পাতলা। তারপর পাশে কেউ যদি ক্রমাগত এরকম ভুতুড়ে শব্দ করতে থাকে, ওর দুচোখের পাতা এক হওয়া অসম্ভব।

সাইফ গোঙানোর সময় প্রায়ই তার নাম উচ্চারণ করে গোঙায় : অরুউউ...উহ...অরুউউ...হুমমমম...অরু...। তার নাম ধরে গোঙানোর ব্যাপারটা অরুকে একই সঙ্গে আনন্দ দেয় এবং অস্বস্তিতে ফেলে। যদি সাইফ ঘুমের ঘোরে অরুকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের নাম মুখে নিয়ে গোঙাত—তবে সেটা হতো নিদারুণ ঝামেলার এক বিষয়। তার অর্থ দাঁড়াত—সে এখন অন্য কোনো নারীতে নিমজ্জিত। কিন্তু সাইফের মুখে অরু ভিন্ন আর কোনো নাম নেই। এ নিয়ে অরু খুশি, আনন্দিত। আবার একই সঙ্গে গোঙানোর সময় অরু নামটা সে এমনভাবে উচ্চারণ করে যে, তা শুনতে অনেকটা কান্নার মতো লাগে। যেন অনুরোধ করছে সে কিছু, অরুর নাম ধরে। অনুনয় করে গোঙাচ্ছে। এখানেই অরুর অস্বস্তি। সে কেন তার নাম ধরে ঘুমের মধ্যে কাঁদবে, গোঙাবে বা ফোঁপাবে? সাইফের তার নাম ধরে গোঙানোর কারণটা সে বুঝতে পারছে না একদমই।

অরু অন্ধকারের মাঝে উঠে বসে বিছানা ছেড়ে। অন্ধকার বলতে পুরো অন্ধকার নয়, বাইরের সড়কে ক্রমাগত ছুটে চলতে থাকা গাড়ির বহর থেকে ঠিকরে পড়া আলো রুমটাকে যথেষ্ট উজ্জ্বল বানিয়ে রেখেছে। সে এখনও সচকিত, আমার উপস্থিতির জেরে। যদি ভুলে গিয়ে না থাকেন, আমি সাইফের চিৎকার।

ব্যাপারটা নিয়ে অরু যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেছে। সে জানে, ঘুমের ঘোরে মানুষ এমনি এমনি চেঁচিয়ে ওঠে না। একমাত্র দুঃস্বপ্নের সূত্র ধরেই মানুষের পক্ষে এভাবে চেঁচিয়ে জেগে ওঠা সম্ভব। কাজেই সাইফ যে দুঃস্বপ্ন দেখে—সে দুঃস্বপ্নের একটা অংশ বা উপাদান সে নিজেও, যে কারণে সে প্রতিবার অরুর নাম মুখে নিয়েই চিৎকার করে ওঠে, এবং তার ঘুম ভাঙে। কিন্তু দুঃস্বপ্নটা কী নিয়ে? সে দুঃস্বপ্নটা কী, যার কুশীলব অরু নিজেই? 

অরু তার মস্তিষ্ক জুড়ে অনেক খোঁড়াখুঁড়ি চালানোর পরেও সে দুঃস্বপ্নের সূত্র আবিষ্কার করতে পারেনি। রক্তমাংসের মানুষের নানারকম সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা, যারা চিন্তার জগতের বাসিন্দা, আমাদের তা নেই। কাজেই, অরু এ বিষয়ে তেমন কিছু না জানলেও, যেহেতু আমার উৎস সাইফের ঐ দুঃস্বপ্ন, যা সে দেখে চলেছে ক্রমাগত, দিনের পর দিন ধরে—আমি তার আদ্যোপান্ত জানি।

দুঃস্বপ্নের সূত্রপাত অরু আর সাইফের মাঝে একের পর এক মতের অমিল নিয়ে। সাইফের মনের ভেতর জমা হওয়া ক্ষোভের পাহাড় নিয়ে। সাইফ জানে, প্রেমের বিয়ে হলো সরকারি চাকরির মতো, সমস্যা যতই গাঢ় হোক—এ নিয়ে বাইরে উচ্চবাচ্য করা যাবে না। হাসি হাসি মুখেই ঘুরতে হবে সমাজে। কাজেই সাইফ কিছু বলতে তো পারছে না মুখফুটে, কিন্তু তার ভেতরে ফুঁসে ওঠা ক্ষোভ তাকে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে ক্রমশ।

অরু আর সাইফের মধ্যে সংঘটিত সর্বশেষ যে সংলাপ ও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর আজ প্রায় সাত দিন ধরে সাইফ থম ধরে আছে, দুঃস্বপ্ন দেখে গোঙাচ্ছে এবং শেষমেশ চিৎকার করে ঘুম ভেঙে জেগে উঠছে, সেই সংলাপের দিকে আমরা মনোযোগ দিই বরং।

 

অরু ও সাইফের মাঝে সংলাপ :

অরু : তো, তুমি বলতে চাইছ, আমার শরীরে আমি চড়াব, কী পরব, তা আমার আগে তোমার সঙ্গে আলাপ করে নিতে হবে?  

জবাবে সাইফ চুপ করে ছিল। তার একবার মন চেয়েছিল এটা বলতে যে—বিয়ের পর এখন তাদের ভাগের সংসার। এখানে কেবল পোশাক পরিচ্ছদকে আলাদাভাবে মূল্য দেয়াটা অর্থহীন; কী করব, কার সঙ্গে ঘুরব, কটায় বিছানায় গিয়ে কটায় উঠব, কোন টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজব, প্রক্ষালন কক্ষের টয়লেট টিস্যুর রং হবে কী, মশারির রং হবে কী, বিছানা কি উত্তর-দক্ষিণমুখী হবে না পূর্ব-পশ্চিমমুখী; কোনো বিষয়েই তো সাইফ নিজে একাকী সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো অবস্থায় নেই। শরীর এখনও ওরই, কিন্তু তাতে মাই বডি মাই রুলস বলতে যা বোঝায় তা প্রয়োগ করবার মতো পরিস্থিতি এখন নেই আর। তবে সাইফ সরাসরি আক্রমণে যেতে চায়নি। কথাগুলো আর একটু নরমভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে সে।  

সাইফ : আমি বিবাহিত জেনেও কোনো কোনো মেয়ে আমাকে ভালোবাসা জ্ঞাপন করতে পারে, আমার হাতে হাত রাখতে পারে, আমি তার শরীরে হাত রাখলে তা তার পছন্দ হতে পারে। আমি বিবাহিত, এটা জেনেও আমার সঙ্গে রাত্রিযাপন করতে কারও কারও আপত্তি নাও থাকতে পারে, কিন্তু আমি তা করতে পারি? আমি কি এ ক্ষেত্রে বলতে পারি মাই বডি, মাই রুলস? আমার শরীর—এ নিয়ে আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করব? 

অরু : ওহ খোদা! তুমি অন্য মেয়ের প্রেমে পড়েছ! আমি নিশ্চিত তুমি অন্য কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছ! আমি জানতাম! বহু আগেই টের পেয়েছিলাম আমি!  

সাইফ : আহ, ফর গডস সেইক! তুমি নিজেও জানো আমি সেটা বলছি না! 

অরু : ফর ফাকস সেইক! এই মাত্র তুমি বললে যে তোমার সঙ্গে কে না কে যেন রাত কাটাতে চায়। এটা ফষ্টিনষ্টি করা হলো না? এই কথা শুনবার জন্য আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম? পরিবারের সবার অমতে? ভালোবেসে? 

ভালোবাসা। শব্দটা শুনে হাসি পেল সাইফের। সে বুঝতে পারল, যা সে বোঝাতে চাইছে—আলোচনা সে ট্র্যাক থেকে বহুদূরে ছিটকে গিয়ে পড়েছে।

সাইফ : আমি একটা হাইপোথেটিকাল অবস্থার কথা বলছি। বোঝাতে চাইছি যে—যদি এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়ও, যদি আমার প্রতি কেউ আকর্ষিত হয়, যদি কেউ আমাকে পছন্দ করেও—আমি মাই বডি মাই রুলস দেখিয়ে তার ঘনিষ্ঠ হতে পারি না। ঠিক একইভাবে তুমি পারো না উত্তেজক পোশাক পরে পাবলিক প্লেসে মানুষের নজর কাড়তে।

অরু : তোমার মনমানসিকতা যে এত ছোট, এতটা গ্রাম্য, তা বিয়ের আগে আমাকে বুঝতে দাওনি কেন? আমি জানি আমি সেক্সি, একটা বিয়ের সার্টিফিকেট আছে বলে আমি আর নিজের সেক্সিনেস সেলিব্রেট করতে পারব না? এইভাবে ধুঁকে ধুঁকে নিজেকে লোলচর্মসার বৃদ্ধায় পরিণত করব?  

সাইফ : যদি আমার অস্বস্তি, আমার ইনসিকিওরিটি তোমার কাছে কোনো অর্থ বহন করে তো...

অরু : ওহ, তুমি ইনসিকিওর ও!    

সাইফ : হ্যাঁ, আমি তোমার প্রতি ইনসিকিওর, কারণ আমি তোমার সঙ্গে বিবাহিত। এখানে ভালোবাসা যদি আর বেঁচে নাও থাকে, তবুও আমরা চুক্তিবদ্ধ একে অপরের প্রতি লয়াল থাকবার জন্য। 

অরু : একে অপরের সঙ্গে সুখী না থাকলেও? 

অরুর প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় সাইফ। সে অনুভব করে, যুক্তির লড়াই চালিয়ে তার জন্য ডিফেন্ড করার মতো বেশি কিছু আর বাকি নেই।

সাইফ : হ্যাঁ, সুখী না থাকলেও। যদি নিজেদের মধ্যে ভালোবাসা বেঁচে না থাকে, যদি একে অপরের সঙ্গে সুখী নাও থাকি, তবুও এই সম্পর্কের প্রতি, এই চুক্তির প্রতি আমাদের সম্মান দেখাতে হবে। আমরা একে অপরের নাকের ডগায় বসে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। সুস্থ উপায়ে, পরস্পরের প্রতি সম্মান বজায় রেখে আমাদের আলাদা হতে হবে আগে। তারপর অন্য চিন্তা। অন্য মানুষ। বা যাই হোক। বর্তমান সম্পর্কের ভেতরে থেকে নয়।  

অরু : তো, তোমার এই আলাপের সঙ্গে আমার পোশাকের কী সম্পর্ক? 

প্রশ্নটা কংক্রিট আকারে সামনে উপস্থিত হওয়ায় হালে পানি পেল সাইফ।

সাইফ : আমাদের ছেলেদের প্রতি মেয়েদের আকর্ষণ যেভাবে তৈরি হয়, মেয়েদের প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ একইভাবে তৈরি হয় না। ছেলেরা প্রাথমিকভাবে আকর্ষিত হয় মেয়েদের শরীরের সৌষ্ঠব দেখে। 

অরু : কী ভয়াবহ রেসিস্ট, এবং নোংরা কথা! 

সাইফ : তোমার এমনটা মনে হতে পারে, কিন্তু আমি যা সত্যি সত্যি ফিল করি তা আমাকে বলতে হবে, অকপটে, এবং খোলামেলাভাবে। তুমি আমার স্ত্রী, আমি সবসময় চেষ্টা করেছি তোমার সঙ্গে যতটুকু সম্ভব ভালো ব্যবহার করতে। কিন্তু তোমার যে আচরণ, ব্যবহার আমাকে কষ্ট দেয়, তুমি সেগুলো দূর করতে না চাও, সেগুলো নিয়ে আমাকে অন্তত কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। আমি যে কষ্ট পাচ্ছি তোমার কারণে, অন্তত সেটা বলবার মতো সুযোগ আমাকে দিতে হবে। 

অরু চোখে বিষ ঢেলে তাকিয়ে থাকে সাইফের দিকে।

সাইফ : আমার কাছে তুমি ভিন্ন অপরাপর কোনো একটি মেয়ের হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ানো যেরকম, ঠিক একই রকম একটি কাজ তোমার অনাবৃত বুক নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া। দুটোই আমাদের বিবাহিত জীবনের চুক্তির একই রকম লঙ্ঘন। একই পর্যায়ের ব্লাসফেমি।   

অরু : তুমি আমাকে বোরখা পরতে বলছ? 

সাইফ অসহায় বোধ করে। সে বুঝতে পারে না যে, যে সহজ জিনিসটা সে বলবার চেষ্টা করছে সেটা অরুর কাছে এত জটিল মনে হচ্ছে কেন! যদি সে সত্যিই চাইত অরু বোরখা পরুক, তবে সে তা সরাসরি বলত। এত যুক্তির আশ্রয় নিত না। এত সূক্ষ্মভাবে কথা বোঝানোরও চেষ্টা করত না।

সাইফ : আমি তোমাকে শালীনতার সঙ্গে নিজেকে ক্যারি করতে উদ্বুদ্ধ করছি। তুমি রাস্তায় খোলামেলা পোশাক পরে বেরুলে রাস্তার রিকশাওয়ালা থেকে নিয়ে তোমার অফিসের দারোয়ান, পিয়ন, কলিগ, তোমার বস পর্যন্ত তোমাকে চোখ দিয়ে গিলে খায়—হাউ আই অ্যাম সাপোজড টু ডিল উইথ দ্যাট?

অরু : ছেলেদের জাতটাই খারাপ। আমি যদি সারা শরীরে বোরখা জড়িয়ে বের হই, তবুও ওরা আমার দিকে খারাপ চোখে তাকাবে। 

সাইফের একবার মনে হয় ওকে বলে যে—বোরখা পরা নারীদের দেখলে যাদের জিনিস দাঁড়িয়ে যায়, তাদের একটা গাছ দেখলেও ওটা দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু এটা বললে অরু আবারও মনে করবে যে সাইফ বোরখার পক্ষপাতী।   

সাইফ : তুমি আমার স্ত্রী। যখন আমরা একসঙ্গে পাশাপাশি হাঁটি, রাস্তায়, বা অন্য কোথাও, কোনো প্রোগ্রামে, কোনো দাওয়াতে—আমি সংগোপনে কামনা করি যে এই আয়োজন, এই প্রোগ্রামের সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে এলিগেন্ট মেয়েটি আমার পাশে। কাজেই তোমার সৌন্দর্য তোমার জন্য যেমন একটা সেলিব্রেট করার বিষয়, আমার জন্যেও তা গর্বের। কিন্তু আমার জন্য তোমার যৌনতার উগ্র বহিঃপ্রকাশ সহ্য করা অসম্ভব। 

অরু : কিন্তু তুমি তো ডিসিশন দেয়ার কেউ নও আমার জীবন নিয়ে। আমি জানি আমি সেক্সি, অরু বলে, আর আমি আমার সেক্সিনেস সেলিব্রেট করতে চাইতেই পারি। 

সাইফ : পারতে, বিয়ের আগে। বিয়ের পর আমরা আমাদের জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত পরস্পর আলোচনা করে, পরস্পরের সম্মতিক্রমে নেব। 

অরু : কিন্তু এখানে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। এখানে তুমি তোমার ইচ্ছা, তোমার মতামত আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছ।

সাইফের হতাশ লাগে। সে বুঝতে পারে না যে সে আর কীভাবে বিষয়টাকে অ্যাপ্রোচ করবে। আগামীকাল যদি অরু আবারও নাভির নিচে, কোমর-পেট আর বুকের একাংশ উন্মুক্ত করে শাড়ি পেঁচিয়ে বেরোয়, সেটা ওর মাই বডি মাই রুলসের বহিঃপ্রকাশ হবে বটে, সঙ্গে সঙ্গে ওর শরীর রাস্তার সকল ব্যাটামানুষের চোখের খোরাকও হবে। নিজের স্ত্রীকে এভাবে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়াটা তখন একটা জাস্টিফিয়েবল বিষয় হতো, যদি ও শৈশব থেকেই এমন একটা পরিবেশে বড় হতো যেখানে এগুলো ম্যাটার করে না; স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বিয়েকে ক্যাজুয়ালি দেখে। অপরাপর মানুষের সেক্সুয়াল গেজকে স্বাভাবিকভাবে দেখে; বিয়ের বাইরে স্বাধীনভাবে যে যার মতো জীবনযাপন করে; যদি সাইফের পক্ষেও সম্ভব হতো কিছু ক্যাজুয়াল বান্ধবীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখবার। কিন্তু সে নিজে একদম অপারগ এই ব্যাপারে। নারীকে স্রেফ বন্ধুর চোখে দেখবার দীক্ষা নিয়ে সে বড় হয়নি। এটা তার দোষ? গাইয়া হবার লক্ষণ? তা হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটাই তার বাস্তবতা। বিয়ের পর সে পারতপক্ষে ফর্মালিটির ঊর্ধ্বে উঠে কোনো নারী কলিগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। আগের জীবনের উত্তুঙ্গ বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখা নারীদের সঙ্গেও সম্পর্ক সীমিত করে এনেছে পর্যায়ক্রমে। মানুষ মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হবেই, এটাই স্বাভাবিক, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু সে তার সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি এক অরু ছাড়া আর কারও সঙ্গে করতে চায়নি। তবে এগুলো কোনো কিছুই এখন আর ধর্তব্য নয়। আলোচনার বিষয়ও না। অরু স্বেচ্ছায় হোক, বা না বুঝেই হোক, তাকে সেই আধুনিক নারীবাদী ট্র্যাপে ফেলে দিয়েছে যে—সে তার স্ত্রীর স্বাধীন ইচ্ছার ওপর হস্তক্ষেপ করছে।

অরু : আমি যদি জানতাম, সাইফ, তুমি ভেতরে ভেতরে এমন, আমি কখনো তোমাকে বিয়ে করতাম না। 

চূড়ান্ত তিরটা ছুড়ে অরু সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিল রুম থেকে। বহুক্ষণ ভেবে সাইফের খুঁজে বের করা লাগে যে তার অপরাধটা ছিল কী। তার অপরাধ ছিল এই যে, সে তার স্ত্রীকে বলেছিল অফিসে যাওয়ার সময় শরীরে ওড়নাটা রাখতে।          

***

সেদিন সাইফ ভার্সিটি থেকে ছুটি নেয়। সারাটা দিন কাটায় জানালার পাশে বসে সিগারেট টেনে।

বিয়ের পর অরুর যে ক্রমশ ঢাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ব্যাপারে ব্যাপক এক আগ্রহের সঞ্চার, এটাও সাইফের হাত ধরে। বিয়ের পরপর, মূলত সাইফের আগ্রহে প্রতি শুক্র বা শনিবার রাতে গিয়ে হাজিরা দিতে থাকে শিল্পকলা, বা বেইলি রোডের থিয়েটার পাড়ায়। মাসে অন্তত একদিন সিনেপ্লেক্সে গিয়ে সিনেমা দেখাটা তাদের রুটিনে পরিণত হয়। বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রে বা জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠে গুণীজন বক্তৃতামালায় শ্রোতা হিসেবে নিয়মিত পার্টিসিপেট করা শুরু করে। ঢাকা শহরের কাছে ধারে যেকোনো আর্টগ্যালারিতে এগজিবিশন হলে অফিস শেষে দুজনে মিলে হানা দেয়া শুরু করে সেখানে। সাইফের আগ্রহে অরু ভর্তি হয় ছায়ানটে রবীন্দ্রসংগীত বিভাগে। এই করতে করতে, সাইফ নিজেও জানে না যে ঠিক কখন সে সাইডলাইনড হয়ে গেছে, আর এই প্রোগ্রামগুলো পরিণত হয়েছে প্রধান ফোকাসে। অরু সাইফকে বাদ রেখেই তার অফিসের কলিগদের সঙ্গে ঘুরতে চলে যায় ঢাকার অদূরে ডে ট্রিপে, বা কোনো আর্ট গ্যালারিতে, অথবা শিল্পকলায় নাটক দেখতে। এক সন্ধ্যায় শিল্পকলার সামনে সাইফ অরুকে আবিষ্কার করে একদল মানুষের ভিড়ে, যেখানে অরুর কাঁধে ক্যাজুয়ালি হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিল এক সুদর্শন পুরুষ। সাইফের ভেতরটা সেদিনই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তখনই সরাসরি অরুর মুখোমুখি হবে, না পরে কথা বলবে—এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে সাইফ বাড়ি চলে আসে। আজকের মতো সেদিনও সে সিগারেট জ্বালিয়ে বসে থাকে জানালার পাশে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অরু ফিরে এলে সে অরুকে প্রশ্ন করে, যে অপরিচিত দুনিয়ার দরজা সে নিজে খুলে দিয়েছে অরুর জন্য, সে দরজা খোলাটা তার দিক থেকে একটা বড়সড় বোকামো হলো কি না। কেননা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির এই কুহকী পৃথিবীর যে রূপ-স্বাদ-গন্ধ, তার সঙ্গে অরুর পরিবার পরিচিত ছিল না। তারা দায়িত্ব নিয়ে অরুকে পরিচয় করিয়ে দেয়নি এ পৃথিবীর সঙ্গে। অরুরও কোনো ধারণা ছিল না এই অঙ্গনের ব্যাপারে, ছিল না প্রাথমিক আগ্রহও। সাইফের ক্রমাগত প্ররোচনায় অরুর মনের মাঝের সুকুমার বৃত্তিগুলো ফুটে ওঠে ধীরে ধীরে। আর এখন অরু চাইছে একাকী এ পৃথিবীতে সন্তরণ করতে। বা, সাঁতারের সঙ্গী নিজের ইচ্ছেমতো বাছাই করে নিতে। এসব প্রসঙ্গ অরুর সামনে তোলা মাত্রই সে প্রবলভাবে আক্রমণ করছে সাইফকে। সেই প্রথম অরুর মুখে সাইফের খ্যাত, গাইয়া, পশ্চাৎপদ মানসিকতার ব্যাটামানুষ ইত্যাদি সম্ভাষণ শোনা। তারপর থেকে সাইফ আর কোনো দিশা খুঁজে পায়নি।

সাইফের এক গভীর দুঃখের জায়গা হলো, এ সমস্ত সমস্যা শেয়ার করবার মতো কেউ নেই তার জীবনে। এমন কেউ নেই তার জীবনে, যার কাছে সে সমবেদনা খুঁজতে যেতে পারে। দিনে রাতে অরুর মোবাইলে ম্যাসেঞ্জারের টং টং আওয়াজ হয়। অরু চ্যাট করে, কে যেন কার সঙ্গে। অরু হয়তো ওর অফিসের কলিগদের সঙ্গে ওর ‘ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দুঃখ বেদনা’ নিয়ে আলাপ করে। অরুর সে কলিগরা অরুর দুঃখে বেশ সমব্যথি হয়। সমবেদনা প্রকাশ করে। ওকে খুশি করতে গিফট দেয়। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। রাত্রে আবার ওর কথা ভেবে মাস্টারবেটও করে।

অরু ইদানীং সাইফের থেকে লুকিয়ে সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়া শুরু করেছে। কেন যায়? কী বলতে যায়? অনেক ভেবেও সাইফ কোনো কারণ খুঁজে পায় না, কেবল একটা কারণ ছাড়া : সাইফের সঙ্গে অরু যে অনেক অসুখী, অরুর মস্তিষ্কে প্রোথিত এই ধারণার একটা মেডিকেল, বা ক্লিনিক্যাল স্বীকৃতি আদায়। অথচ সাইফের সঙ্গে ও আর আজকাল কোনো সমস্যার কথা নিজ থেকে খুলে বলে না। পারতপক্ষে শেয়ার করে না কিছু ওর সঙ্গে। কারণ অরুর ধারণা, সাইফ বুঝবে না।

অথচ অরুর ক্রাইসিস বুঝতে সাইফের সর্বোচ্চ কীই বা খরচ করা লাগত? সময়ই তো? অরু মনে করে সাইফের সে সময় নেই? নেই সেই সহানুভূতি, সহনশীলতা? অরুর জীবনের যে সমস্ত সমস্যা সাইফ না দেখার ভান করে এড়িয়ে গেলেও পারত, তা সে নিজের গরজে এগিয়ে এসে বুঝেছে। সমাধান করেছে নিজের চিন্তা, শ্রম, অর্থের ব্যয়ে। দুজনের যৎকিঞ্চিত আয়ে যে টোনাটুনির সংসার তারা শুরু করেছিল, তা টেনে নিয়ে যেতে অরুর কাছে কোনোদিন সাহায্য চায়নি সাইফ। বরং অরুকে নিজের মতো বেড়ে উঠতে সবরকম সহায়তা করেছে বলে তার ধারণা। এই যে পোশাকের ইস্যু, এও একদম নতুন আমদানি। বিয়ের পর অন্তত দু-তিন বছর ও কী পোশাক পরে বাসা থেকে বেরিয়েছে, কার সঙ্গে কোথায় গিয়েছে—এ নিয়ে সাইফের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। কয়েক জায়গায় ওকে বেকায়দায় আবিষ্কার করার পর ইদানীং সাইফ মুখ খোলা শুরু করেছে। অথচ এতকিছুর পর আজ সাইফকেই ওর নির্বাক, বোধশক্তিহীন এক দেয়াল মনে হচ্ছে? নিজের স্বামীর সঙ্গে কথা খুলে বলতে কষ্ট হচ্ছে? আজ সাইফের থেকে ওর কলিগরা বেশি বোঝে ওকে? ওর সাইক্রিয়াটিস্টরা বোঝে ওর মনের হদিস?

***

ভুল বোঝাবুঝির ফলে সৃষ্ট ক্ষত, আর মানসিক দূরত্ব ঘোচাবার একটা পদক্ষেপ অরুর তরফ থেকেই আসে আচমকা একদিন। আর সেটা আসে এক অদ্ভুত প্রস্তাবের আঙ্গিকে। অরু সাইফকে প্রস্তাব দেয়, মাসে অন্তত দুটো রাত তারা হোটেলে কাটাবে। ঢাকা শহরের ভেতরে, যেকোনো হোটেলে। কারণটাও অরু ভেঙে বলেছিল। সে চায়, তারা একে অপরকে প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করতে নতুন নতুন কনটেক্সটে। একই ঘর, একই কামরা, একই বিছানা, একই ভঙ্গিতে জীবনে বিরক্তি আর একঘেয়েমি চলে আসে। বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে যদি তারা নিয়মিত মিলিত হতে থাকে, হয়তো তাদের টকে যাওয়া সম্পর্কে সঞ্চার হবে নতুন রস। তৈরি হবে বাসনার নতুন ভাষা ও ভঙ্গি। খাট নড়বে এতে করে বেশি বেশি। হয়তো কোনোদিন পুলিশ রেইড দেবে তাদের হোটেল। তাদের রুমে হানা দিয়ে আবিষ্কার করবে তাদের অন্তরঙ্গ অবস্থায়। বিশ্বাস করতে চাইবে না যে তারা বিবাহিত। কাবিনের কাগজপত্র দেখতে চাইবে, পরিচিত মানুষজনকে ফোন দেবে। তারপর যখন আসলেই দেখবে যে তারা দুজন বিবাহিত, তারা বোকা বনে যাবে। ভাববে, কত অদ্ভুত খেয়ালের মানুষে ভর্তি এই শহর।  

সত্যি বলতে সাইফেরও এই প্রস্তাব বেশ নতুন এবং থ্রিলিং লাগে। সন্দেহ নেই, একটা লম্বা সময় ধরে তারা দুজন এক মৃতপ্রায় সম্পর্ককে কাঁধে বহন করে বেড়াচ্ছে। এটাকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে তাতিয়ে তোলার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে সাইফেরও আগ্রহ হয়। এবং দেখা যায়, অরুর পরিকল্পনা আসলেই দারুণভাবে কাজ করছে। ভিন্ন ভিন্ন সিচুয়েশনে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুজন মানুষ হিসেবে তারা মুখোমুখি হচ্ছে একে ওপরের। সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে আবিষ্কার করছে একে অপরকে। রাতের বাকি সব কাজ শেষে হোটেলরুমের দোর আটকে দেবার পর একমাত্র সংগম ছাড়া করণীয় আর কিছু বাকি থাকে না। সেটাই চলেছে কদিন, উত্তুঙ্গ। যদি মূলধন নেতিয়ে পড়ে, তবে জিভ দিয়ে কিংবা আঙুল দিয়ে। কিন্তু বিছানা স্থির থাকেনি একদিনও। মাসে দুবারের বদলে একপর্যায়ে তারা প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবারের রাতটা কাটানো শুরু করে ঢাকা শহরের ভিন্ন ভিন্ন হোটেলে ঘুরে।  

তারপর শুরু হলো সাইফের এই দুঃস্বপ্নের সিম্পটম। ঘুমের মাঝে গোঙানো। আর্তচিৎকারে ভেঙে পড়ে জেগে ওঠা।     

অরু বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে বাথরুমে যায়। বাথরুমের বেসিন সংলগ্ন আয়নাটা বেশ বড়। নিজের শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সে। তার স্তনের আকৃতি বিয়ের পর আরও সুগঠিত হয়েছে। ঝুলে পড়েনি এখনও। কণ্ঠার হাড় এখনও জাগরুক। চিবুক এখনও তরবারির মতো ধারালো। চুল ছেড়ে দিলে তা পীঠ ঢেকে ফেলে। চোখ দিয়ে আয়নার নিজের শরীর স্ক্যান করতে করতে নিচে নামলে তলপেট আর কোমরের চারপাশটায় এসে একটু থমকে যেতে হয়। ওখানে মেদ জমেছে খানিকটা। ইয়োগা শুরু করবে করবে পরিকল্পনা করেও শুরুটা আর করা হচ্ছে না। জঙ্ঘাস্থান আর হাত-স্তনের মিলনস্থলটা বুশি। ওখানে জমে থাকা লোম কাটা হচ্ছে না সপ্তাহ তিনেক। একটু যত্ন নিলেই, অরু এখনও সেই চোখ ধাঁধানো সুন্দরীই আছে। অরু পা টিপে টিপে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে।  

কলাবাগানের স্কয়ার হসপিটালের উলটোপাশের গলি সংলগ্ন একটা হোটেলে আজ পরপর তিন সপ্তাহ যাবৎ এসে উঠছে তারা দুজনে। অরুর পছন্দ করা এ হোটেল তাদের বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরে।

জানালার পাশে চেয়ার টেনে অরু বসে পড়ে। গায়ের ওপরে একটা তোয়ালে সে ফেলে রেখেছে আলগোছে। পেছনে বিছানায় সাইফ ঘুমাচ্ছে। অরু মোবাইল হাতে নিয়ে ম্যাসেঞ্জারটা অন করে। 

হোটেলের সামনে একটা রাস্তা, রাস্তার ওপাশে প্রায় দশকাঠার মতো খালি একটা জায়গা দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা। সেই খালি জমি পেরুলে ওই পাশে একটা আটতলা দালান। ঐ দালানে অরুদের হোটেল রুমের সরাসরি বিপরীত যে তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটটা, তাতে আলো জ্বলছে এখনও, আর তাতে যে থাকে, ম্যাসেঞ্জারে তার নামের পাশে এখনও সবুজ বাতি।

ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত সাড়ে তিনটা।                                              


ছয়.

আমি যখন আমার আম্মুর পেটে, ভ্রূণ আকারে বড় হচ্ছি একটু একটু করে, তখন আমার আব্বু অফিস শেষে প্রতিদিন বিকেলবেলা গিয়ে বসে থাকত কাঁটাবন ঢালে। কোনো অফিশিয়াল কাজে না। বিশেষ কোনো দায়িত্ব কাঁধে নিয়েও না। বিকেলবেলা ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছোঁয়া মাত্রই আব্বু তার অফিসের ডেস্কে এলিয়ে পড়ে থাকা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে পায়ে পায়ে এসে হাজির হতো কাঁটাবন। যেমনটা বললাম একটু আগে, আম্মুর পেটে তখন আমি একটু একটু করে বড় হচ্ছি, আম্মু এই সময়টায় খুব করে চাইত আব্বু তার সঙ্গে থাকুক, তাকে সময় দিক। সব মেয়েই তো এমনটা চায়। চায় যে, যখন সে গর্ভবতী, তখন তার স্বামী তাকে সময় দেবে, সঙ্গ দেবে, তার খুঁটিনাটি সাধ আহ্লাদের দিকে খেয়াল রাখবে। আব্বু যে সে সময়টা একেবারেই দিত না, তা না; তবে প্রতিদিন আব্বু অবশ্যই কিছু সময় আলাদা করে রাখতেন কাঁটাবনের জন্য।

তার এই কাঁটাবন ভ্রমণের ইতিবৃত্ত কিন্তু আর কেউ জানে না। কেবল আমাকেই বলেছিল, আমার জন্মের পর, কানে কানে। তখন তো আমি খুব ছোট, মাসখানে বয়স। আমার পাশে শুয়ে আমার সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলা ছিল আব্বুর অন্যতম প্রিয় একটা কাজ। আব্বু ভাবত, আমাকে সে যা কিছু বলছে, আমি তার কিছুই বুঝব না। খুব যে বুঝেছি তখন, তা না। শুনতাম চুপচাপ খালি। তবে এখন আমি সব বুঝি। সবকিছু।

নিশ্চয়ই এতক্ষণে আপনাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, আব্বু কাঁটাবনে গিয়ে করতটা কী?

আমার আব্বুর জীবনে কখনোই পশুপাখি পালার শখ ছিল না। ছোটবেলায় না, মেজবেলায় না, বড়বেলায় তো না-ই। তারপরেও আম্মুর পেটের ভেতর আমার বয়স যখন পাঁচ মাস, তখন আব্বু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আলাদা দুটো খাঁচায় একজোড়া লাভবার্ড, আর ছোট্ট একটা ছাইরঙা বেড়াল ছানাকে নিয়ে এলো। সবাই বলতে বাড়িতে খুব বেশি মানুষ ছিল না তখন। আম্মু নিজে, আর তার প্রেগন্যান্সির দিনগুলোতে সাহায্য করার জন্য এক ছোট্ট মেয়ে। আকাশী ছিল তার নাম। তারা দুজনেই খুব অবাক হলো। আকাশী তো খুশিতে চিৎকার চ্যাঁচামেচি লাগিয়ে দিয়েছিল। এদিকে আম্মুও ফোন করে তার ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুবান্ধবকে এ ঘটনা জানিয়েছিল। বিস্মিত আম্মু হয়েছিল বটে, তবে সেটা সুখে না কষ্টে—তা আমি এ মুহূর্তে নিশ্চিত নই।

বাড়ির সবাই হুট করে একদিন একজোড়া পাখি, আর বেড়ালছানাকে বগলদাবা অবস্থায় আব্বুকে বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল বটে, তবে আব্বুর যে সাধনার ফলশ্রুতিতে এই প্রাণীগুলো সেদিন আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলো, তার সে সাধনার আখড়া ছিল কাঁটাবন ঢালের পশুপাখির দোকানগুলো। আব্বু আমাকে প্রায় দিনই, আমার গর্ভে থাকা অবস্থায় তার দিনকাল আর মানসিক অবস্থা নিয়ে গল্প করত। আব্বু ভাবতেও পারে নাই যে তার কোলের শিশুকন্যা সবকিছু এত মনোযোগ দিয়ে শুনছে এবং বুঝছে। ব্যাপারটা আব্বু টের পায় নাই। টের পেলে খুব লজ্জা পেত। ঐ দিনগুলোতে আব্বু কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল, নিজের ভেতরেই সমস্ত চিন্তাচেতনা গুটিয়ে রাখা চুপচাপ এক মানুষ হয়ে গিয়েছিল সে। কারও সঙ্গে কিছু শেয়ার করতে চাইত না। কেবল আম্মু যখন রুমে নাই, হয়তো গোসলে গেছে, বা অন্য কোনো কাজে অন্য কোথাও, এই ফাঁকে আব্বু খাটে আমার পাশে শুয়ে ফিসফিস করে কথা বলত। সে যাক।        

তখন আম্মুর প্রেগন্যান্সির প্রথম ট্রাইমেস্টারটা শেষ হয়েছে মাত্র। কিছু জটিলতাও দেখা দিয়েছে আমাকে নিয়ে। আমার হৃদস্পন্দনের গতিপ্রকৃতি স্বাভাবিক ছিল না। মাঝে মাঝে দীর্ঘ সময় যাবৎ কোনো স্পন্দন শোনা যেত না। আম্মু নিজে থেকে সেটা বুঝত তা না, তবে ডাক্তার আন্টি যখন আম্মুর পেটে এই সেই নল লাগিয়ে কী সব মেশিনের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, তখন ধরা পড়ত। আম্মু টেনশনে পড়ে গিয়েছিল। খুব করে চাইত, তার মনখারাপের সময়গুলোতে যেন আব্বু তার পাশে থাকে, তাকে সময় দেয়। আর আব্বু ঠিক ঐ সময়গুলোতেই গিয়ে বসে থাকত কাঁটাবন ঢালে, পশুপাখিদের দোকানের সামনে।      

নানা প্রজাতির কুকুর, আদুরে চেহারার নাদুসনুদুস বিড়াল, কিচিরমিচিরে পাড়া মাতিয়ে রাখা রং-বেরঙের পাখি। সব জন্তুজানোয়ার খাঁচায় আটকানো। তাই দেখত আব্বু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কোনো কাজ বা কারণ ছাড়া তো আর মানুষের দোকানের সামনে এমনি এমনি দাঁড়িয়ে থাকা যায় না এত লম্বা সময় ধরে। কাজেই প্রথম প্রথম আব্বু সরাসরি দোকানগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াত না। রাস্তার উলটোপাশের ফুটপাতে বিড়ি সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেত, আর তাকিয়ে থাকত খাঁচায় বন্দি প্রাণীগুলোর দিকে। উপভোগ করার চেষ্টা করত খাঁচায় বন্দি পশুপাখিগুলোর প্রাণবন্ততা, ক্ষণিক সময়ের জন্য খাঁচা থেকে বের করে তাদের নিয়ে মালিকপক্ষের ঘোরাফেরা, গোসল দেয়া—এসব কিছু।

এভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পর আব্বু সরাসরি দোকানের সামনে এসে দাঁড়ানো শুরু করে। একটু কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ঐ প্রাণীগুলোকে দেখত স্রেফ, আর কিছু না। এভাবে একদিন, দুদিন, তিনদিন—সপ্তাহখানেক কাটার পর দোকানের মালিক নিজেই একদিন উঠে এসে আব্বুকে প্রশ্ন করেছিল, তার কিছু চাই কি না। কোনো পাখি বা বিড়াল, বা নির্দিষ্ট কোনো প্রজাতির কুকুর।

আব্বু মাথা নেড়ে ছোট করে উত্তর দিয়েছিল, না। একটু থেমে বলেছিল, “কিনতেই আসছি। তবে ভয় লাগে।”  

“ভয় লাগে!” দোকানি বেশ চমকে উঠে প্রশ্ন করেছিল আব্বুকে। আসলেই, চমকানোর মতো কথাই তো বলেছিল আব্বু। এতগুলো দিন, এত লম্বা সময় ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে এই পশুপাখির খাঁচাগুলোর সামনে, অথচ সে তাদের কিনতে চায় না, কারণ, তার ভয় লাগে!

“ঐ ভয় না,” একটু পর আব্বু আবারও সংক্ষেপে বলে। এত ক্ষীণভাবে, যে তার কণ্ঠ প্রায় শোনাই যায় না।

“এই পশুপাখির মধ্যে কোনটার আয়ু সবচেয়ে বেশি?” খানিক পরে সে প্রশ্নটা করে দোকানিকে। দোকানি তার এই প্রশ্নেও নাকি বেশ অবাক হয়েছিল। মানে, এমন তো নয় যে সে জানে না যে কোন প্রাণীর আয়ু কতটুকু। কিন্তু প্রশ্নটা সে আশা করেনি হয়তো ঐ মুহূর্তে, এই যা।

“ঐ প্রজাতির কুকুরগুলো বাঁচে সাধারণভাবে চৌদ্দ-পনেরো থেকে নিয়া সর্বোচ্চ আঠারো বচ্ছর,” সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিয়েছিল আব্বুকে। “বিড়ালের নির্দিষ্ট হায়াত নাই, ঐ কুকুরেরই কাছাকাছি। আর লাভবার্ডগুলো বাঁচলে লম্বা হায়াত পায়।”

কোন প্রাণী কত বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে, এটা জানবার পর আব্বুর আগ্রহ জন্মে কুকুরের প্রতি। কারণ, দোকানির দেয়া হিসেবমতে কুকুরের গড় আয়ু ছিল সবার চেয়ে বেশি।

“এই কুকুরটার দাম কত?” একটা সাদা রঙের হাস্কি কুকুরের দিকে আঙুল তুলে আব্বু প্রশ্ন করেছিলেন। মনমতো প্রশ্নের দেখা পেয়ে এবার দোকানিকেও খুশি লাগছিল।

“ত্রিশ হাজার টাকা,” বেশ হাসিমুখে জবাব দিয়েছিল সে।

আব্বু দাম শুনে থতমত খেয়ে গিয়েছিল। খাঁচায় পোরা প্রাণীদের জীবন দৈর্ঘ্যের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বেড়ালের দাম শুনেও তার থতমত ভাব কাটেনি। এক পর্যায়ে দোকানি তাকে কিছুটা সহানুভূতির সঙ্গেই পরামর্শ দেয়, তার যদি সত্যি সত্যিই যেকোনো একটা পশু পালার ইচ্ছা থাকে, তবে রাস্তা থেকে বিড়ালের বাচ্চা কুড়িয়ে নিতে। অথবা, যদি তাকে কিছু টাকা দেয়া হয়, তবে সে নিজেই বিড়ালের বাচ্চা ধরে দিতে পারবে আব্বুকে। রেটটা এই দোকানের প্রাণীদের রেট থেকে অনেক কম, প্রায় অর্ধেক। কিন্তু বিড়ালের গায়ের রং ভেদে বাচ্চার দাম ওঠানামা করবে।

আব্বু অত হ্যাপায় যেতে রাজি হয়নি। কিছুটা দরদাম করে একটা বেড়ালছানা, আর এক জোড়া লাভবার্ড কিনে আনে।

তবে সেদিনই না, আরও বেশ কিছু দিন পর।

আমি তখন আম্মুর পেটে আরও বড় হয়েছি। বড় হয়ে চলেছি। পেটের ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছি। ডিগবাজি খাচ্ছি। থেকে থেকে লাথি হাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি যে আমি আর থাকতে চাইছি না এখানে। বাইরে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে আমার।

আব্বুকে বেড়ালছানা সমেত পাখিদুটো বিক্রি করার সময় বিক্রেতা আব্বুকে প্রশ্ন করেছিল—এত দীর্ঘ সময় ধরে দেখে, শুনে, বেছে কেবল একটা বেড়ালছানা আর একজোড়া পাখিই কিনলেন তিনি? কী কারণ? প্রশ্নটায় একটা সূক্ষ্ম অর্থকড়ির সংশ্লিষ্টতা-সক্ষমতা আছে। তাই শুনতে তা অপমানজনক লাগতে পারে। কিন্তু প্রশ্নের উপরিস্তরের গভীরে ছিল আরও এক সরল জিজ্ঞাসা। আব্বু সেদিকেই মনোযোগ দেয়। তারপর সহজ ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করে দোকানিকে : “অবলা, অবোধ প্রাণী, যারা সংসারে কেবল ভালোবাসা নিতে জানে, দিতে জানে না বা দিতে পারে না, তাদের ঘনিষ্ঠ হবার আগে একটা বোঝাপড়া, একটা দীর্ঘ মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন।”

দোকানি আব্বুর উত্তর কতটুকু বুঝেছিল সেই জানে। তবে সে আর কথা বাড়ানোর আগ্রহ দেখায়নি। ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল তার দোকানের ভেতর গোছগাছে।    

আব্বু যে কথাটা ঐ লোকটাকে ভেঙে বলে নাই, আমার আম্মুকেও বলে নাই বা এই পৃথিবীর কাউকেই বলে নাই আর, কেবল মাত্র আমাকে ছাড়া, তা হচ্ছে—আব্বু আসলে বেড়াল বা পাখি পালবার জন্য না, বাবা হবার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আগে জানতাম না, এখন জানি, ভালোবাসাবাসির ময়দানে আব্বু এক দাগা খাওয়া সৈনিক। বহুবার নিজের মায়া-মমতা-ভালোবাসা (তার বিবেচনায়) অপাত্রে বেজায়গায় দান করে সব খুইয়ে আবেগের দিক থেকে সর্বস্বান্ত এক মানুষে পরিণত হয়েছে। আম্মুর গর্ভে আমার অসময়, অনাকাঙ্ক্ষিত উপস্থিতির খবর জানতে পেরে লোকটা আবারও নিজেকে প্রস্তুত করা শুরু করেছিল সর্বস্ব উজাড় করে আমাকে ভালোবাসার জন্য। মায়ের নিজেকে আলাদাভাবে প্রস্তুত করা লাগে না, যেহেতু তার সন্তান তার গর্ভের অংশ। বাবা সেটা জানত। সঙ্গে এও জানত যে—মাতৃগর্ভস্থ সন্তানের সঙ্গে তার বাবার যেহেতু সরাসরি কোনো সম্পর্ক নাই, কাজেই তার আসলে শেখা লাগবে, কীভাবে সে সম্পর্কটা স্থাপন করা যায়। বোকা বাবাটা তার পুরো পিতৃত্ব ব্যাপারটাকে এমনই সিরিয়াসলি নিয়েছিল যে, তার-আমার সম্পর্কটা যে আমি পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র আপনাতেই হয়ে যাবে, সেটা তার মাথায় একবারও আসেনি। বেচারা তখন জানতই না যে, যে মানুষ স্বার্থহীনভাবে ভালোবাসতে পারে না, অথবা স্বার্থহীনভাবে ভালো বাসতে বাসতে যে মানুষটা ভেতরে ভেতরে একদম নিঃস্ব হয়ে গেছে, নিজের সন্তানের স্রেফ একটা অর্থহীন ফোকলা দাঁতের হাসি বা ছোট্ট হাতের মুঠোয় বাবার একটা আঙুলকে আঁকড়ে ধরার মতো ছোট ছোট ঘটনা একজন বাবার মনে পুনরায় স্বার্থহীন ভালোবাসার সাগর প্লাবিত করে দেয়। আম্মুর সঙ্গে অসুখী সংসারের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাওয়া আব্বুর জীবনে আর কোনো রূপমাধুর্য, রং-রস বাকি ছিল না। তাই আব্বু আগেভাগে প্র্যাকটিস করে নিতে চেয়েছিল এই শর্তহীন ভালোবাসা ভেতরে ধারণের। এর সঙ্গে অভ্যস্ত হবার। আর সে জন্যেই সে আগে প্র্যাকটিস শুরু করেছিল বোবা প্রাণীগুলো দিয়ে।  

আব্বু অভ্যস্ত হবার সুযোগ তেমন একটা পায় নাই। আমার জন্মের দিন পনেরো আগে লাভবার্ডগুলো মারা যায়, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। আর আমি মারা যাওয়ার দুমাস আগে মারা যায় সে বেড়ালটা। এর মধ্যে অবশ্য সে বেড়ালছানা জীবনকে নানাভাবে উপভোগ করে নিয়েছিল। প্রেগন্যান্ট হয়েছিল দুবার। বাচ্চা দিয়েছিল। সেগুলো কোথায় কোথায় হারিয়ে গেছে। আমি সে হিসেবে কিছুই উপভোগ করতে পারিনি। মোটামুটি নাবালিকা বয়সেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করা লেগেছে। কেন, কীভাবে—সে বিস্তারিত বর্ণনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।       

আমি মারা যাবার পর আব্বু-আম্মু একসঙ্গে থাকে নাই। প্রাথমিক শোকের ধাক্কাটা সামলানোর পর সবার আগে আম্মু শক্ত হয়ে মনস্থির করেছিল যে, তিনি থাকবেন না এই দেশে আর। বহুবছর চেষ্টার পর দৈবক্রমে আমার জন্ম হয়েছিল। আমার মৃত্যুর পর তারা প্রায় দুবছর দাঁতে দাঁত চেপে থাকেন একসঙ্গে। ততদিনে তাদের ভেতরে কদর্যতা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তারা একে অপরের সঙ্গও মোটে সহ্য করতে পারতেন না। তবুও থাকতেন কীভাবে একসঙ্গে, কে জানে। হয়তো মিরাকুলাসলি আরেকটা সন্তান লাভের আশায় ছিলেন তারা। সেটা আর হয়ে উঠছিল না। আম্মু প্রথম জার্মানি গেলেন, দাদ স্কলারশিপ নিয়ে। সেখান থেকেই উকিল নোটিশ পাঠালেন ডিভোর্সের। আব্বুর জীবনে আম্মু তখন আর এমনিতেও প্রাসঙ্গিক না। তিনি চাকরিবাকরি ছেড়ে পথশিশুদের নিয়ে একটা অর্গানাইজেশন খুলে বসেছেন ততদিনে। রাস্তার সেই শিশুগুলো, যাদের বাবা নাই-মা নাই, জীবনে মাথায় কেউ কখনো স্নেহ ভরে হাত বুলিয়েছে কি না, তার হদিস নাই, সেই বাচ্চাগুলোকে আব্বু দেখেশুনে রাখার চেষ্টা করেন। অনেকে পরামর্শ দিয়েছেন এটাকে একটা এনজিওতে পরিণত করতে। আব্বু পারছেন না। তিনি বৈষয়িক মানুষ না। গ্রামে নিজের জমিজমা বেচে দেয়ার চেষ্টা চরিত্র করছেন এখন। আম্মু পড়াশোনা করছিলেন তখন স্পেশাল চাইল্ডদের এডুকেশন-ওয়েল বিয়িং নিয়ে। দুজন মানুষ, একে অপরের সঙ্গ একদম সহ্য করতে পারত না যারা, তাদের দুজনের মধ্যে সূত্রধরের কাজ করেছে আমার প্রতি, তাদের একমাত্র সন্তানের প্রতি ভালোবাসা। আর আমি মারা যাওয়ার পর আমার প্রতি তাদের সে বেঁচে থাকা অপত্যস্নেহ, সেটাই তাদের ভবিষ্যৎকে গড়ে দিয়েছে, পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দুই মহাদেশে। 

এতক্ষণে হয়তো আপনি বুঝতে পেরেছেন যে আমি শরীরী কোনো সত্তা না। হ্যাঁ, তা আমি না বটেই। আমিও আমার বাবার মস্তিষ্কের একটা অনুরণন। বিমূর্ত এক সত্তা। আব্বু আমাকে দশ বছর বয়সী ফুটফুটে এক কন্যা হিসেবে যেভাবে কল্পনা করতেন, আমি এখনও তার মস্তিষ্কের নিউরনে সেই আঙ্গিকেই স্মৃতি হিসেবে জাগরূক আছি। আমি যে পৃথিবীতে বাস করি, তার নাম মানুষের স্মৃতির জগৎ। একটা কাল্পনিক পৃথিবী। তামাম পৃথিবীর জীবিত মানুষের স্মৃতিতে ঠাসা এই জগৎ। যতদিন আমার বাবা-মা বেঁচে আছে, ততদিন আমিও বেঁচে থাকব তাদের স্মৃতিতে, এই স্মৃতির জগতে। তারা মরে গেলে পরে আমার আর অস্তিত্ব থাকবে না। আমাকে আর ভাববে না কেউ তখন। আমাকে মিস করবে না। ভালোবেসে দুলাইন লিখবে না আমার ব্যাপারে, ডায়রির পাতায়। অন্য কারও মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আমার কথা স্মরণ করবে না কেউ, মনে মনে।

একটা প্রশ্ন ইদানীং খুব ভাবায় আমাকে। মানুষের সম্পর্ক মরে গেলে, তাদের মধ্যে একসময় বিদ্যমান যে তুমুল ভালোবাসা, একূল ওকূল—দুকূল ছাপিয়ে যাওয়া প্রেম, সেই প্রেমের কী হয়? ব্যাপারটা আপনি কখনো ভেবেছেন, পাঠক? যাকে আপনি পছন্দ করেন, তাকে প্রথমবার দেখা হওয়ার মুহূর্তে যে তীব্র ভালোবাসার উথাল পাথাল, প্রতিনিয়ত তাকে দেখবার আকাঙ্ক্ষা, সেই যে প্রথমবার বিকেলে একসঙ্গে কফি ডেটে যাওয়া, এরকম আরও কত ‘প্রথম’-এর অভিজ্ঞতা হয় মানুষের। সব তো এখানে উল্লেখও করতে পারব না। লজ্জাশরমের ব্যাপার আছে।

সেই যে একে অপরের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তে মস্তিষ্কের প্রতিটি প্রকোষ্ঠে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ, বন্ধ কামরায় কাটানো অনিশ্চিত মুহূর্তগুলো, শরীরে পাতার পোশাক জড়িয়ে একে অপরকে প্রতিজ্ঞা করা—টিল ডেথ ডু আস অ্যাপার্ট, একসঙ্গে লড়াই সংগ্রাম করে টিকে থাকা, ভালোবাসা জমে ক্রমে ক্রমে মায়ায় পরিণত হওয়া—সেই ভালোবাসার কী হয়, যখন সেই ভালোবাসার একদা মালিক-মালেকিনরা আলাদা হয়ে যায়? কী হয় সেই মুহূর্তগুলোতে পৃথিবীর পরমতম সত্য বলে অনুভূত হওয়া সেই অনুভূতিগুলোর? সে প্রেম কি বেঁচে থাকে কোথাও? কল্পনার এ জগতে, কোথাও, কোনো এক কোনায় কি আমি সেই মুহূর্তগুলোর দেখা পাব, যেখানে আমার বাবা আর মায়ের ভালোবাসা জমে আছে মার্বেল পাথরের মতো? যেখানে উপস্থিত হলে আমি তাদের প্রথমবারের মতো একে অপরের চোখে চোখ রেখে বসে থাকার দৃশ্য বা প্রথম কোনো একটা রেস্টুরেন্টে বসে কফির মগে চুমুক দিয়ে দিতে একসঙ্গে ভাব-ভালোবাসার কথা বলাটা দেখতে পাব? আমি কি পারব তখন তাদের সামনে গিয়ে হাজির হতে? তাদের গিয়ে বলতে যে আমি তাদের সেই কন্যা, যার জন্মের উদ্দেশ্যে তারা মুখোমুখি হয়েছে আজ? তাদের কাছে চাইতে পারব সেই ভালোবাসা, যা আমি পুরোপুরি উপভোগ করতে পারিনি বা পাইনি—অকালে মারা যাওয়ার কারণে? আমি আমার বাবা-মাকে যখন কাছে পেয়েছি, তখন তার তাদের মধ্যে ভালোবাসাটা বাকি ছিল না। আমি তো আমার সেই বাবা-মায়ের কাছেই যেতে চাই, যারা একে অপরকে পাগলের মতো ভালোবাসে। রক্তমাংসের দুনিয়ায় হয়নি সেটা, স্মৃতির পৃথিবীতেও কি তা সম্ভব না?

সম্ভব না? 

সত্য যে, আমার বাবা-মায়ের মধ্যে যে প্রেম ভালোবাসা বিদ্যমান ছিল একদা, এখন সেটা আর তাদের ব্যক্তিগত জীবনেও প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু আমার কাছে তুমুলভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, আমি তো তাদের সেই ভালোবাসাবাসিরই সন্তান। তাদের মধ্যে বিদ্যমান যে ভালোবাসার ফলশ্রুতিতে আমি দুনিয়ায় এসেছি, আমি চাই তাদের একবার স্বচক্ষে দেখতে।  

আমি নিশ্চিত জানি,  আমার বাবা-মায়ের সেই ভালোবাসার দিনগুলো জমাট বেঁধে আছে এই অসীম স্মৃতির জগতের কোনো এক প্রান্তে।

আপাতত পৃথিবীর সেই শেষ প্রান্তে গিয়ে হাজির হওয়াটাই উদ্দেশ্য আমার।

হাজিরা দেয়ার ইচ্ছা, সাইফ আর অরুর, আমার বাবা আর মায়ের মৃত প্রেমের মাজারে।  

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আসামি ধরতে গিয়ে নারীর মাথায় পিস্তল ঠেকালেন ডিবি কর্মকর্তা
আসামি ধরতে গিয়ে নারীর মাথায় পিস্তল ঠেকালেন ডিবি কর্মকর্তা
জিম্মি মুক্তির দাবিতে তেল আবিবের মহাসড়ক অবরোধ
জিম্মি মুক্তির দাবিতে তেল আবিবের মহাসড়ক অবরোধ
আছে উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা, আকারে আশাবাদী চাষিরা
রাজশাহীর আমআছে উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা, আকারে আশাবাদী চাষিরা
টিভিতে আজকের খেলা (১২ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১২ মে, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
ইএফডিতে নজর দিয়ে হিরো হতে পারেন এনবিআরের চেয়ারম্যান
ইএফডিতে নজর দিয়ে হিরো হতে পারেন এনবিআরের চেয়ারম্যান
মান ভাঙলো মিমির, এলো ‘তুফান’র দ্বৈত ঝলক
মান ভাঙলো মিমির, এলো ‘তুফান’র দ্বৈত ঝলক
টাকা দিয়ে কেনা সনদের তালিকা পেয়েছি: ডিবি হারুন
টাকা দিয়ে কেনা সনদের তালিকা পেয়েছি: ডিবি হারুন
নেতানিয়াহুর কঠোর সমালোচনা করলো আমিরাত
নেতানিয়াহুর কঠোর সমালোচনা করলো আমিরাত
‘কর্তৃপক্ষের’ আদেশের দায় কার?
‘কর্তৃপক্ষের’ আদেশের দায় কার?