আমি আবীরকে দেখে খুব অবাক হলাম। বললাম, ‘তুই এত কাছে! কিন্তু কোনো কথা বলছিস না কেন? আমিই বা বুঝতে পারলাম না কেন তুই এখানেই আছিস! আর এত নীল তরলের কারণ কী, তুই জানিস?’
আবীর বলল, ‘এগুলো নীল তরল নয় দোস্ত। এগুলো আসলে রক্ত। বিষ-জর্জর, অকৃতজ্ঞতার গরল পান করে করে এগুলো হয়ে গেছে নীলান্ত নীল।’
আমি, আমাকে আবিষ্কার করি, সাগরের মধ্যে। ঠিক সাগর নয়। সাগরের মতো অতল তরলের মধ্যে। একসময় বুঝতে পারি এই তরল সাধারণ তরল নয়। নীল রঙের রক্ত। ওপরে সীমাহীন আকাশ। সামনে-পেছনে-ডানে-বামে দীগন্তহীন পৃথিবী। আকাশে ফ্যাকাশে চাঁদ। চাঁদের নিচে পাহাড়ের মতো মেঘ।
ভেবেছিলাম আমি একাই এখানে। একসময় আবীরকে আবিষ্কার করলাম। তারপর মাঝে মাঝে টের পাই এখানে অসংখ্য লোক রয়েছে। গিজগিজ করছে। তাদের ভেতরে অনেক ক্রোধ। কিন্তু মিলিয়ে যাচ্ছে তারা নিমিষেই। অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সহজেই।
আবীরও বোধহয় বিষয়টি টের পেয়ে থাকবে। নইলে হঠাৎ হঠাৎ আমাদের মুখ চাওয়াচাওয়ি হবে কেন!
আমাদের ভুবন এখন নীলান্ত নীল রক্তের দখলে। প্রবল ঢেউ। ফ্যাকাশে চাঁদের আলো নীল রক্তের ওপর মেঘের প্রতিবিম্ব রচনা করছে। রক্ত-ঢেউয়ের দংশন শুরু হয়ে যায় মাঝে মাঝে। একদিকে নীল ঝিকিমিকি অন্যদিকে নীল দংশন। এই নিয়ে আমি আর আবীর এখানে। মাঝে মাঝে টের পাওয়া কিছু দৃশ্য-অদৃশ্য ক্রোধ-উন্মত্ত মানুষ। রক্ত-জোয়ার শুরু হয়ে গেল হঠাৎ। আমরা কি সাঁতার জানি? সেটাও তো মনে পড়ছে না। তবে কি আমাদের রক্ত-সমাধি হয়ে যাবে!
হঠাৎ ফ্যাকাশে চাঁদ আর পাহাড়ের মতো মেঘ ভেদ করে দুজন ব্যক্তিকে আসতে দেখা গেল। তাঁরা খুব শান্তভাবে রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। একজন হাঁটছে একটু খুঁড়িয়ে। হাতে ক্র্যাচ। অন্যজনের চোখে রোদ-চশমা। আমার হঠাৎই বলতে ইচ্ছে করল এখন তো রোদ নেই তাহলে ওই চশমাটিকে জ্যোৎস্না-চশমা বলা যাবে কি? কিংবা রক্ত-চশমা?
আবীর বলল, ‘আমি এঁদেরকে চিনি।’
আমি বললাম, ‘কে এঁরা?’
‘একজন সাবেক কর্নেল, আরেকজন মেজর জেনারেল।’
দুধেল বর্ণের জ্যোৎস্না বিধৌত নীলান্ত নীল সাগরে হঠাৎ করে নাজিল হওয়া এঁদের কে দেখে কৌতূহল জাগে বইকি।
আবীর যাঁকে সাবেক কর্নেল বলেছিল, দেখা গেল তাঁর হাতে একটি ছড়ি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন তিনি। তিনি খুব অস্থিরভাবে বাতাসে ছড়িটি ঘোরাতে লাগলেন। আমি এবার অন্য লোকটার দিকে তাকালাম, আবীর যাঁকে মেজর জেনারেল হিসেবে ইঙ্গিত করেছিল। দেখলাম, তাঁর সূক্ষ গোঁফের নিচে পাতলা ঠোঁট। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে জিহ্বার অগ্রভাগ। সাবেক কর্নেল এই দৃশ্য দেখে ছড়ি ঘোরানোর গতি একটু কমিয়ে দিলেন। মেজর সাহেব এবার জিহ্বার অনেকটাই বের করলেন। সাবেক কর্নেল এই দৃশ্য দেখে পাগলের মতো ছড়ি ঘোরাতে লাগলেন। বাতাসের গায়ে সে ছড়ি সপাং সপাং শব্দ করে আঘাত করতে লাগল। প্রশ্ন হলো, ওখানে কি শুধুই বাতাস ছিল? আমরা যে মাঝে মাঝে কিছু মানুষ, কিছু ক্রোধ-উন্মত্ত মানুষের উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম, দৃশ্যে-অদৃশ্যে, তাঁদের শরীরে কি সে আঘাত লাগছে না?
আমরা দেখলাম, ঢেউগুলো আর আগের মতো প্রবল বেগে আসছে না। একটু স্থিরভাব চলে এসেছে এই নীলান্ত নীল রক্তের সাগরে। আমরা আরও দেখলাম, একটা বিশাল অসমাপ্ত ঢেউয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা। একজন সাবেক কর্নেল আরেকজন মেজর জেনারেল।
সাবেক কর্নেল বাতাসে আরও জোরে ছড়ি দিয়ে আঘাত করতে শুরু করলেন। ক্রমাগত সে বেগ বাড়তেই থাকল। এদিকে মেজর সাহেবের জিহ্বা আগের চেয়ে বৃহৎ হতে হতে মুখগহ্বর থেকে বের হয়ে এলো। আগের হাসি হাসি মুখকে এখন কিম্ভূত লাগতে শুরু করেছে। সাবেক কর্নেল যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মেজর সাহেব একটা অট্টহাসি দিয়ে এমনভাবে তাঁর জিহ্বা বের করলেন যে দুধেল বর্ণের সমস্ত জ্যোৎস্না অন্ধকার গ্রাস করে ফেলল। সেই আতিকায় জিহ্বার ওপরে দেখা গেল একটা পতাকা দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে।
মেজর সাহেব কী যেন বললেন ফিসফিস করে। অমনি পতাকাটি নড়তে শুরু করল। বিস্তৃত হতে থাকল তার জমিন। একসময পতপত করে উড়তে থাকল।
আমরা লক্ষ করলাম তার জিহ্বার ওপরে উড়তে থাকা সে পতাকা। চাঁদ আছে সে পতাকায়। তারা আছে। আমরা খেয়ে না-খেয়ে থাকলেও জ্যোৎস্না পছন্দ করি। কিন্তু ওই রকম চাঁদ-তারা আমরা কখনোই পছন্দ করিনি। আমরা পছন্দ করি সবুজের সমারোহের মধ্যে ভোরের উদীয়মান কিংবা উদিত সূর্য। আমরা হতাশ হয়ে, বিহ্বল হয়ে যখন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি তখন দেখা গেল তাঁর জিহ্বার ওপরে উড়ন্ত পতাকার নিচে কতিপয় কিম্ভূত প্রাণীর মুখ। তারা কথা বলছে। কথা বলছে উর্দুতে।
সেদিকে সাবেক কর্নেল তাকালেন। চোখ সরু করে বোঝার চেষ্টা করলেন। তখন আমাদের ভেতরেও যেন অলৌকিক ক্ষমতা বিরাজ করছিল। আমরা সাবেক কর্নেলের চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম এবং এত দূর থেকে, জিহ্বার অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া চাঁদের ফ্যাকাশে আলোর ভেতর থেকে, কিম্ভূত হয়ে যাওয়া মেজর সাহেবের চেহারা ভেদ করে, কর্নেলের ছড়ি ঘোরানোর চঞ্চলতা ভেদ করে তাঁর চোখের ভেতরে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে গেল। আমরা জানি, এত দূর থেকে কোনোভাবেই এত সূক্ষ্মভাবে দেখা সম্ভব নয়। আমরা কীভাবে কীভাবে যেন এই ক্ষমতা অর্জন করে ফেললাম।
আমরা দেখলাম কর্নেলের চোখের ভেতরে অনেক আনন্দ। কারণ তাঁর চোখের ভেতরে দেখা যাচ্ছে লাল-সবুজের পতাকা। পতাকা ঘিরে তাঁর অনেক স্বপ্ন। কর্নেল দেখছেন, মেজর সাহেবের জিহ্বার ওপরে যারা কথা বলছে, তারা সবাই গাইছে, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
কর্নেল সাহেব ছড়ি ঘোরানো বন্ধ করে রক্ত-প্রবাহের ওপরে জোরে একটা আঘাত করলেন। রক্তগুলো তখন যেন উন্মাদ হয়ে গেল। রক্তগুলো যেন মেঘ হয়ে উড়তে চায়। রক্তগুলো যেন পাহাড় হয়ে উঠতে চায়। রক্তগুলো যেন রাক্ষস হয়ে উঠতে চায়। রক্তগুলো ঠিক রক্তাক্ত খেলায় মেতে উঠতে চায়। রক্তগুলো মেজর সাহেবের জিহ্বা ছুঁয়ে ফেলল। তখনই সেখান তেকে বের হয়ে এলো শত শত মানুষ। তাঁদের কণ্ঠে একটাই কথা, জয়বাংলা।
মানুষগুলো মেজর সাহেবের পায়ের কাছে এসে জড়ো হলো। মেজর সাহেবের জিহ্বা এবার খুব লকলকিয়ে উঠল। আগের মানুষগুলো, যারা উর্দুতে কথা বলছিল, তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। কারণ মেজর সাহেবকে দেখা গেল, যাঁদের কণ্ঠে জয়বাংলা ছিল, তাদেরকে তিনি এক এক করে গিলে ফেলছেন।
কর্নেল সাহেবের চোখে এই দৃশ্য ধরা পড়ল।
তাঁর চোখে দেখা গেল বিস্ময়। বিস্ময় রূপান্তরিত হলো রাগে। রাগের ঝিলিকে নীল রক্তগুলোও কেঁপে উঠল কি একটু! তিনি ছড়িটি মেজর সাহেবের কপালে তাক করলেন। তারপর মুখমণ্ডল বরাবর বৃত্তাকার পথে ঘোরাতে চাইলেন।
মেজর সাহেবের চোখেমুখে বা দেহ-ভাষায় কোনো ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না। খুব ধীরস্থির, শান্ত, প্রশান্ত, প্রসন্ন এবং সহজ দেখা গেল তাঁকে। তাঁকে একটুও বিচলিত, বিস্মিত এবং বিহ্বল মনে হলো না।
কর্নেল সাহেব তাঁর ছড়িটি মেজর সাহেবের মুখমণ্ডল বরাবর একবারও বৃত্তাকার পথে ঘোরাতে পারলেন না। ধীর মস্তিষ্কের মেজর সাহেবের লকলকে জিহ্বাটি আবারও অতিকায় রূপ ধারণ করল।
এবং কর্নেল সাহেবকে এক চুমুক শরাবের মতো গিলে ফেললেন মেজর সাহেব।