X
মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪
৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

দীপু রুপু ডোডো

খোকন দাস
২৫ জুন ২০২৩, ০৯:০৩আপডেট : ২৫ জুন ২০২৩, ০৯:০৩

‘ওই রুপু, ওই দীপু আমার মোবাইলটা দিয়ে যা, তোর নানা ভাইয়ের একটু খোঁজ নিই, কাল বলল শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।’ ঘুম থেকে জেগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শ্যামলী মেয়েদের ডাকে। কোনো মেয়েই সাড়া দিচ্ছে না। দীপু তার বড়ো মেয়ে, রুপু ছোটো কিন্তু ডাকার সময় শ্যামলী ছোটোটাকে আগে ডাকে। শ্যামলী কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে মেয়েদের বকাঝকা করে। তারপর চিৎকার করে বলে, ‘এই তোরা কি আমার কথা শুনবি?’

দুই মেয়ে দৌড়ে এসে বলে, ‘কিছু বলছ মা?’

‘কতক্ষণ থেকে ডেকে গলা ফাটাচ্ছি, এখন বলছে কিছু বলছ, যা মোবাইল নিয়ে আয়, তোর নানা ভাইয়ের খোঁজ নেব।’

দীপু রুপু একে অন্যের দিকে তাকায়, তারপর দৌড়ে গিয়ে মায়ে হাতে মোবাইল দিয়ে দ্রুত সরে যায়। শ্যামলী মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে জিরো চার্জ, এক্ষুনি বন্ধ হয়ে যাবে। বলতে বলতে অদ্ভুত শব্দ করে মোবাইল বন্ধ হয় যায়।

‘গেম খেলে খেলে চার্জ শেষ করেছিস, এখন বন্ধ মোবাইল দিয়ে কী করবো? গেমে এতটাই আসক্ত যে মোবাইল চার্জ দেয়ার কথা মনে নেই।’

‘তোকে কত বললাম মোবাইলে চার্জ দে, চার্জ দে, তুই শুনলি না। এখন মা বকা দিচ্ছে।’

‘তুই দিসনি কেন? এখন আমার দোষ দিচ্ছিস?’

রুপু দৌড়ে এসে তার মায়ের কাছে বলে, ‘মা, সারাটা সময় গেম খেলেছে। আমাকে পাঁচ মিনিটও দেয়নি। পুরো একটা অ্যাডিকটেড বাচ্চা। বাবা এলে ভালো করে বলবা।’

এরপর দীপু এসে বলে, ‘মা, পুরা কুটনি একটা, এর কথা কিচ্ছু বিশ্বাস করো না। সারাক্ষণ গেম খেলেছে আর তোমার কাছে এসে ভালো সাজতেছে।’

শ্যামলী খেঁকিয়ে ওঠে, ‘তোরা এখন এখান থেকে যাবি?’

দীপু রুপু দৌড়ে পাশের ঘরে গেলেও তাদের ঝগড়া থামে না। কিছুক্ষণ পর দীপু এসে মায়ের পাশে বসে চোখের পানি ফেলে।

‘দেখেছ মা, ও সারাক্ষণ গেম খেলল, আর এখন আমাকে খারাপ খারাপ কথা বলছে।’

এই সময় রাস্তায় পুলিশের হুইসেল। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। রুপু দৌড়ে এসে বলে, ‘চলো চলো ছাদে চলো, পাঁচটা বেজে গেছে, ভাইরাস এসে গেছে।’

দীপু রুপু দৌড়ে ছাদে ওঠে, তাদের পিছে পিছে শ্যামলীও ছাদে ওঠে। পুলিশের গাড়ি দেখে ভ্যান-চালক রিকশা-চালক যে যেদিকে পারছে দৌড়াচ্ছে, পাড়ার ছেলেরা দৌড়ে গলির মধ্যে ঢুকে পড়ছে। পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার পর আবার গলির মুখে এসে জটলা করে।

‘দেখো দেখো মা, ভ্যানটাকে কীভাবে উলটে দিলো’ বলে রুপু হাসতে থাকে।

‘একটা গরিব মানুষের ভ্যান, সেটা উল্টে দিলো, এর মধ্যে মজার কী আছে?’

‘আহা, তোরা ছাদে উঠেও ঝগড়া করবি?’

‘মা, করোনা ভাইরাস অনেক ভদ্র ভাইরাস। বিকেল পাঁচটার পর আসে, আর পরদিন সকাল বেলা চলে যায়। করোনার এই রুটিনটা পুলিশ আংকেলরা জানলো কী করে?’

‘পুলিশ সব জানে।’

দুই
বাসার কেয়ারটেকার সাল্লু, সামনের পাটির দাঁত বিশ্রিভাবে বেরিয়ে থাকার কারণে মনে হয় সবসময় হাসে। মাঠের কোণে টং দেকানে চা বিক্রি করে, তার বউ কাজ করে কয়েক বাসায়। মাঠের টং দোকান বন্ধ, তার বউয়ের বাসার কাজও বন্ধ। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। সাল্লু চোখে-মুখে অন্ধকার দেখে। এক সন্ধ্যায় দরজা নক করে সাল্লুর বৌ, ‘দিদি আমি শারমিন, দরজাটা খোলেন দিদি।’

দরজা খুলে দেখে শারমিন কান্না করছে।

‘শারমিন তুমি কাঁদছো কেন? কি হইছে, বাসায় কোন সমস্যা?’

‘দুই দিন থেকে বাসায় রান্না নাই, বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না।’

‘তুমি শান্ত হও আমি দেখতেছি। বাড়িওয়ালিদের বলোনি, ওরা চাইলে অনেক হেল্প করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে অনেক বাড়িওয়ালা এগিয়ে আসছে শুনছি।’

‘দুই বোনের কেউ বাসায় নেই, গেছে টাঙ্গাইল। কবে আসে ঠিক নাই, মেয়ের আব্বা কয়েকবার ফোন করেছে, ধরে না। একবার ধরে সব শোনার পর কল কেটে দিছে।’

‘সাল্লু তো তাদের বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকার, তোমাদের দায়িত্ব তারা নেবে না?’

‘এরা মানুষ ভালো নয়, দিদি। দুই বোনের কারো কোনো সন্তান নেই, এতো টাকা-পয়সা কে ভোগ করবে, একটা পয়সা সহায়তা করে না। এই বিপদের দিনেও আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে পানি ঝরে না।’

‘চিন্তা করো না, মানুষের বিপদ সারা জীবন থাকে না। আমার কাছে নগদ টাকা নাই, তোমাকে চাল ডাল তেল নুন সবই দিচ্ছি, এক প্যাকেট বয়লার মুরগি আছে সেটাও দিচ্ছি, তুমি রান্না করে বাচ্চাদের নিয়ে খাও। তোমার দাদা আসবে কাল, দেখি কিছু করা যায় কিনা, তোমার দাদার খামারের অবস্থাও ভালো না। বেশি কিছু করতে পারবে না।’

রাতে শ্যামলী ফোন করে সাল্লুর পরিস্থিতি জানাতেই সুকান্ত বলে, ‘আমি জানি, সাল্লু আমাকে কল করেছিল। আমি বলেছি, কিছু সহযোগিতা করব।’

‘তোমার যা সাধ্য তুমি সেটা দেবে, এখানে জোরাজুরির কিছু নাই। আমাদের কাজের মেয়ে কাজলকেও দুই মাসের বেতন অ্যাডভান্স দিতে হবে, সেটা মাথায় রেখ।’

‘আমার পরিস্থিতি জানো না, জনে জনে কীভাবে হেলপ করব?’

‘যত কষ্ট হোক এই দুই জনকে সাপোর্ট করতে হবে, কাজের লোকের কাছে নিজেকে ছোটো করবা নাকি।’

তিন
শ্যামলী ছাদের পানির ট্যাংকের পাশে একটা টবে হাসনাহেনার গাছ লাগায়। কয়েদিনের যত্নে গাছটা লকলক করতে থাকে। ছাদে হাঁটতে উঠে বাড়িওয়ালি দিলরুবা খানমের চোখে পড়ে।

‘দিদি, গাছটা আপনি লাগিয়েছেন! আপনার হাতের যশ ভালো, কয়েক দিনে গাছটা সতেজ হয়ে উঠেছে।’

‘এটা কী গাছ লাগিয়েছেন?’

‘হাসনাহেনা, কিছ দিনের মধ্যে ফুল আসবে।’

‘সারাক্ষণ বাসায় বন্দি থাকি, সময় কাটতে চায় না। ভাবলাম একটা দুইটা গাছ লাগালে সময় কেটে যাবে।’

‘একটা দুইটা কেন, পুরো ছাদ গাছে ভরে ফেলেন।’

‘পুরো ছাদ ভরলে সবাই হাঁটবে কীভাবে? তবে আপনি যেহেতু অনুমতি দিয়েছেন কিছু গাছ লাগাব।’

‘আমারও গাছের শখ, কী করব শরীর ভালো থাকে না, মোটা শরীর নিয়ে নড়তে চড়তে পারি না। ঢাকা শহরে অক্সিজেনের বড়ো অভাব, ছাদে গাছ থাকলে একটু বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারি।’

‘আপা আপনি যখন বলছেন আপনার শখ পূরণ হবে। আমার মেয়েরাও গাছ পছন্দ করে, ওর বাবাও পছন্দ করে। ওর বাবা তার খামারে নিম, ছাতিম, জারুল, দেবদারু কত রকমের গাছ লাগিয়েছে।’

‘জারুল গাছ কোনটা, মনে করতে পারছি না।’

‘ওই যে, বেগুনি ফুল ধরে, কেবল ফুল কোনো গন্ধ নেই। পাগল করা গন্ধ হচ্ছে ছাতিমের।’

‘আমরা যেটাকে ছাইতাম বলি, সেটাই কি ছাতিম?’

‘আপনি ঠিকই ধরেছেন আপা, ওটাই ছাতিম। আপনি চিন্তা কইরেন না, ওই ছাতিম জারুলই লাগাবো আপনার ছাদে।’

‘হাসনাহেনা ফুলের গন্ধে নাকি সাপ আসে, এজন্য আমার ভয় করে।’

‘আপনি ভয় পাবেন না, ঢাকা শহরের এই চার তলার ছাদে সাপ কেন, সাপের বাপও আসবে না। আপনি নিশ্চিন্তে হাসনাহেনার নিচে বসে জোছনা দেখতে পারবেন।’

‘আপনারা আসলে মানুষ ভালো, আপনাদের মতো ভাড়াটিয়া আর পাইনি।’

চার
‘কিরে দীপু, সংসারের একটা কাজেও তো হাত দিস না। ছাদের গাছগুলোতে পানি দিবি সেটা বলে বলে করাতে হয়। গাছ কেনার সময় তো মুখে খই ফোটে, এটা কেনো ওটা কেনো, যত্ন করার বেলায় ঠনঠনা গোপাল।’

ঘুমের ঘোরে শ্যামলী কথাগুলো বলে চোখ মেলে দেখে ঘর অন্ধকার। মেয়ে দুইটার কাণ্ডজ্ঞান কবে যে হবে, সন্ধ্যা হয়ে গেছে ঘরে লাইট জ্বালায়নি।

শ্যামলী একপা দুইপা করে ছাদে গিয়ে দেখে দীপু রুপু গাছে পানি দিচ্ছে আর বাড়িওয়ালির দুই বোন রুখসানা ও রুমানা পায়চারি করছে।

‘দিদি আপনার মেয়েরা কত লক্ষ্মী, কী যত্ন করে গাছে পানি দিচ্ছে, দেখে ভালো লাগছে।’

‘বাচ্চা মানুষ কতক্ষণ ঘরে বসে থাকতে পারে? তাও আপনারা ছাদটা ব্যবহার করতে দিচ্ছেন বলে বাঁচা গেল।’

রুপু এই সময় দৌড়ে এসে বলে, ‘মা, পুলিশ আজও এক ভ্যানওয়ালার ভ্যান উল্টে দিছে, চা-ওয়ালা এক আঙ্কেলকে ধরে নিয়ে গেছে।’

‘পুলিশের যত বাহাদুরি সব গরিব মানুষের সঙ্গে। চলো বাসায় চলো, তোমাদের বাপ আসছে।’

দুই সপ্তাহ পর সুকান্ত বাসায় ফেরে সন্ধ্যায়। চায়ের টেবিলে দীপু রুপু শ্যামলী।

‘তোমরা কি পড়ালেখা একেবারে ছেড়ে দিয়েছ? তোমাদের টেবিলে বই-খাতাও কিছু দেখছি না। সন্ধ্যার সময় স্টুডেন্টরা বই নিয়ে বসে, এটাই ছোটোবেলা থেকে দেখে এসেছি। আমি বাসায় এসেছি সন্ধ্যায়, এখন রাত আটটা বাজে, তোমরা কেউ বই নিয়ে বসনি।’

শ্যামলী চোখের ইশারায় সুকান্তকে থামতে বলে। সুকান্ত চায়ে চুমুক দিয়ে বলে ‘কী যেন একটা বলতে চাইছ।’

‘বলছি তুমি অনেক দিন পর বাসায় এসেছ, তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব।’

‘কী সারপ্রাইজ দেবে?’

‘এত অস্থির হচ্ছো কেন, অপেক্ষা করো। দুইদিন তো আছে, নাকি সকালে ঘুম থেকে উঠেই দৌড় দেবে।’

বাপের মেজাজ দেখে দীপু রুপু চা-নাস্তা নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলে শ্যামলী বলে, ‘পড়ালেখা নিয়ে এত ক্যাটক্যাট করো না তো, নিজে পড়ালেখা করে যেন দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলেছ। দেখ তো, স্কুল বন্ধ, কোচিং বন্ধ, বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, আত্মীয়-স্বজনরা কেউ আসতে পারে না। ঘরবন্দি কতক্ষণ থাকা যায়। চারদিকের পরিস্থিতিও ভালো নয়, মেয়েরা মেন্টালি সিক হয়ে যাচ্ছে। আগে সুস্থ থাকতে হবে পরে লেখাপড়া।’

‘আচ্ছা বুঝতে পারছি, তোমার সারপ্রাইজ কোথায়?’

‘এতটু ধৈর্য ধরো, কী বলছি কী বলিনি অমনি উতলা হয়ে গেছ।’

‘উতলা না হলেও দোষ, হলেও দোষ। এর আগে তোমার কোনো একটা বিষয়ে আগ্রাহ দেখাইনি বলে কতগুলো কথা শুনিয়েছ, মনে আছে? তখন বললে, ইদানীং কোনো বিষয়ে তোমার আর আগ্রহ নেই, সন্ন্যাসী টন্যাসী হওয়ার লাইনে নামছ নাকি?’

‘ওরে বাবা, তুমি দেখছি কখন কী কথা বলি সেসব মুখস্থ করে রাখতে শুরু করেছ। এই দিকে মেধা খরচা না করে সংসারের আরো তো অনেক বিষয় আছে সেদিকে একটু খরচা করো।’

পরদিন বিকেলে পুলিশের হুইসেলের পর পর শ্যামলী দীপু রুপু সুকান্তকে নিয়ে ছাদে ওঠে। ছাদে উঠে সুকান্তের বিস্ময়ের সীমা থাকে না।

‘এত গাছ, পুরো ছাদ সবুজ, এই তোমার সারপ্রাইজ।’

শ্যামলী খুশিতে মাথা নাড়ে, ‘হুম এটাই আমার সারপ্রাইজ, কেমন হলো বাগানটা?’

‘খুবই সুন্দর, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না, অল্প দিনে এত গাছ কী করে হলো?’

‘তুমি কি মনে করো গুনেগুনে তুমি যে টাকাগুলো দাও সেগুলোর অপচয় করি?’

‘তা কেন করবে, তবে এখন বুঝতে পারছি একমাসে চারবার লিপস্টিকের টাকা কেন দিতে হলো।’

দুইজন হো হো করে হেসে ওঠে, সঙ্গে দীপু রুপুও।

‘তোমার এখানে অনেকগুলো গাছ আছে, এর অনেকগুলো আমি কোনোদিন দেখিনি।’

‘আচ্ছা, তোমাকে বলছি, এখানে কী কী গাছ আছে। এখানে আছে গোলাপ, বেলি, টগর, আলমোন্ডা, লিলি, নয়নতারা, রাধাচূড়া, কাঠগোলাপ, বাগানবিলাস। আর এই দিকটায় আছে ক্যাকটাস।’

‘তোমার জন্য একটা নিমের চারা নিয়ে আসব, তোমার জন্য গিফট। আচ্ছা নীম পাতা তেতো, কিন্তু এর ফল অনেক মিষ্টি এটা জানো তো?’

‘জানতাম না, এখন জানলাম।’

‘নিমের চারা নিয়ে আসবা মানে, তুমি আবার কবে যাইবা?’

‘এই তো চলে যাব, দুই দিন পর চলে যাব, অনেক পেরেশানির মধ্যে আছি। না খাদ্য কিনতে পারছি, না দুধ বিক্রি করতে পারছি।’

‘আচ্ছা, থামো থামো, চিকন পাইপ দিয়ে পানি দেয়ার অটোমেটিক সিস্টেমটা কে করেছে?’

‘কে করবে আবার, তোমার অতিবুদ্ধিমতী মেয়ে দীপু।’

‘তুমি যে কষ্ট করে এতো গাছ লাগাইছ বাড়িওয়ালি মহিলা জানে? শেষে না বলে বসে গাছ সরিয়ে ফেলেন- তখন কী করবা? এদের তো মতিগতির ঠিক নাই।’

‘এই চিন্তা তোমাকে করতে হবে না, রুখসানা আপার অনুমতি নিয়েই করছি।’

পাঁচ
রুপু রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আছে এক ঘণ্টার ওপরে। শ্যামলী দীপুকে ডেকে বলে, ‘দেখতো মা, ভিতরে কি করে, এক ঘণ্টা হইছে রুমে ঢুকেছে।’

‘দরজা দিয়ে কী করছে তুমি বুঝ না মা, সাজগোজ করছে, মেকআপ করছে, মুখে রং মাখছে। আজ বাবা আসবে তো সেই খুশিতে রং মেখে সং সাজা হচ্ছে।’

‘তাই বলে এতক্ষণ! ও পাগল-টাগল হয়ে গেল নাকি। দেখতো আসলে কী করছে।’

‘আমি দেখতে গেলে আমাকে বকা দেবে। তারপরও দেখছি।’ বলে দীপু দরজা নক করে। অকেক্ষণ নক করার পর রুপু দরজা খুলে বলে, ‘কিরে এত নক করছিস কেন? কোনো ভদ্র বাচ্চা এভাবে নক করে? ভদ্রতা বলে কিছু শিখতে পারিসনি?’

রুপু রুম থেকে বেরিয়ে সোজা তার মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

‘মা দেখতো আমাকে কেমন লাগছে?’

‘এতক্ষণ তো আয়নার সামনে ছিলি, কেমন লাগছে বুঝতে পারিসনি?’

‘আমি মাকে জিজ্ঞাসা করছি, তুই ফোড়ন কাটিস কেন?’

‘বলো না কেমন লাগছে?’

‘সত্যি কথা বলব?’

রুপু মাথা নেড়ে বলে, বলো না।

‘একেবারে ভূতনির মতো লাগছে। এই অল্প বয়সে এসব মেখে মেখে মুখের স্কিনের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছিস।’

দীপু এক পায়ে গোল হয়ে নাচতে নাচতে বলে, ‘ভূতনি ভূতনি ভূতনি..’

‘তুই থামবি? তোর শরীর থেকে শুটকির গন্ধ বের হচ্ছে, নিয়মিত গোসল করিস না, দাঁত মাজিস না- এসব আমি জানি না?’

‘মা, বাবা এখন গাজিপুর চৌরাস্তায়, আসতে বড়োজোর এগারোটা বাজবে।’

‘তোর বাপ এগারোটায় আসবে, আমি কী করবো, আমি কি নাচব?’

‘ওই শাকচুন্নিকে বলো সামনের রুমটা গোজগাজ করতে, আর তুমিও তো পেতনির মতো হয়ে আছো।’

‘ওর কথা শুনেছ, দিন দিন বেয়াদবের চরম সীমায় চলে যাচ্ছে।’

‘তুই এই কথা প্রায় বলিস, এতদিনে চরম সীমার পরে কী আছে সেখানে পৌঁছে যাওয়ার কথা।’

‘এই তোরা থামবি? কত কাজ পড়ে আছে সেগুলো করার খবর নেই, আছে ঝগড়ার তালে।’

রুপু সাজগোজ করে, ভালো কাপড়চোপড় পরে ঘরময় ঘুরে বেড়ায় আর কিছুক্ষণ পর পর ঘড়ি দেখে।

থোড়ের কোপ্তা সুকান্তের খুব পছন্দ, শ্যামলী মনোযোগ দিয়ে থোড় কাটে।

‘মা, রুপু যা করছে ঠাকুরমা নাকি এ রকম করত?’

‘করত মানে, বিকেল হলেই চুলে তেল দেয়া চুল আঁচড়ান, একবারে পরিপাটি হয়ে খাটের ওপর পা মেলে বসে ছেলের জন্য অপেক্ষা করতো। কিছুক্ষণ পর পর বলতো, বউ আমার সুকান্ত আসে না কেন? পথে কোন অসুবিধা হইছেনি? আর কোনো দিন আকাশে মেঘ করলে তো কাম সারা। দুই পায়ে দুই হাত ঘষে ঘষে সামনে পিছনে দুলতে দুলতে শুরু করবে কান্না, কী কী সব বলে আমি তো তাদের এলাকার ভাষা বুঝি না। টিকতে না পেরে ফোনে কথা বলিয়ে দেয়ার পর শান্ত হতো। তারপর দুনিয়ার চিকন চিকন সব কথা বলতো, সব আমার শ্বশুরের গল্প। মনে হয় একটু আগে কিছুই ঘটেনি। নিজে তো চলে গেছেন আমার ঘাড়ে একটা রেখে গেছেন। উপর থেকে বলছেন, তোমার কোনো নিস্তার নাই তোমার এই যন্ত্রণা ভোগ করতেই হবে।’

‘আর দাদু কী করত?’

‘তোর দাদুর কথা আর বলিস না, শেষের দিকে আমার শ্বশুর পুরোপুরি মেন্টাল হয়ে গেছে, তার বাবাও নাকি মরার আগে পাগল হয়ে গিয়েছিল। মেন্টাল বিষয়টা এদের পরিবারের ট্র্যাডিশন, আমি তো তোর বাবাকে নিয়ে চিন্তায় আছি। এই ব্যাটাও না আবার মেন্টাল হয়ে যায়, মাঝে মাঝে তোর বাপের কাণ্ডকারখানা দেখলে মনে হয় মেন্টাল হতে বেশি দেরি নাই।’

‘মেন্টাল কিন্তু কমবেশি সব পরিবারেই থাকে। নানা ভাই কিন্তু কম মেন্টাল না। সারাক্ষণ নানিকে মুর্খমহিলা মুর্খমহিলা বলতেই থাকে। আমরা কি সবসময় যাই, টিভি দেখতেছি দেখতেছি হঠাৎ এসে টিভিটা বন্ধ করে দেয়।’

‘তোর নানা ভাইর বয়স হইছে, সত্তরের ওপরে বয়স, বয়স হলে একটুআধটু পাগলামি করবেই। সেগুলো সিরিয়াসলি নেয়ার কী আছে?’

‘আর দাদু ভাইতো বয়স হওয়ার পর পাগলামি করেছে, আশি বছর বয়স হলে সবাই পাগলামি করে।’

‘বাবা, ভুল হয়ে গেছে, আর কোনো দিন বলব না, একটা পাগলের গোষ্ঠীর সঙ্গে আমার বাপের বাড়ির তুলনা।’

‘নিজের দিকে আসলে সবারই খারাপ লাগে।’

‘তুই এখন আমার সামনে থেকে চলে যা।’

দীপু কিছুক্ষণ পরে ব্যতিব্যস্ত হয়ে এসে বলে, ‘মা, সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখনই বাসায় তাণ্ডব শুরু হয়ে যাবে।’

‘কী সর্বনাশ!’

‘এখন ফোন করেছি, বাবার ফোন বন্ধ। কুটনি টের পেলে তো লঙ্কাকাণ্ড শুরু করবে।’

‘থাক কিছু বলার দরকার নাই, চুপচাপ থাক। তোর বাপেরও আক্কেলজ্ঞান নাই। মোবাইলে চার্জ রাখবে না! জানে ঘরের মধ্যে মেন্টাল রইছে একটা, ফোন বন্ধ পাইলে ঘর মাথায় করে, তারপরও মনে থাকে না।’

থোড়ের কোপ্তা রান্নার পর বেগুনভাজি করে শামলী। বেগুনভাজি করতে হয় সবার শেষে, যাতে খাওয়ার সময় গরম থাকে। গরম তেলে বেগুন ছেড়ে দেবে এমন সময় দীপু এসে বলে, ‘মা, শুরু হয়ে গেছে, কান্না শুরু হয়ে গেছে। ওই ঘরে গিয়ে দেখ খাটের মাঝখানে পা মেলে বসে সেই পা ঘষে ঘষে চিকন কান্না চলছে। ও কি কোনো দিন ঠিক হবে না!’

‘পাগলের গোষ্ঠী তো, একজন না হয় একজন সেই ধারা বজায় রাখে। থাক, তুই কিছু বলিস না, আমি আসছি।’ শ্যামলী ঘরে ঢুকে বলে, ‘কি হইছে, এভাবে কাঁদছিস কেন? এভাবে কান্না তো ভালো নয়, তুই কি ঘরে অমঙ্গল ডেকে আনবি নাকি?’

‘বাবার ফোন বন্ধ।’

‘ফোন বন্ধ হয়েছে কী হয়েছে, এতে কান্নার কী হলো। মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে, এই জন্য বন্ধ, আর চার্জ শেষ হতেই পারে।’

‘মা, ও যে কান্না করছে ওর মেকআপ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না?’

এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে রুপু দীপুর দিকে বালিশ ছুড়ে মারে, এরপর লাফ দিয়ে এসে দীপুর চুল ধরে টানতে থাকে।’

শ্যামলী বহু কষ্টে দুই বোনকে ছাড়িয়ে নেয়, এই সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পাওয়া যায়।

‘দেখ দেখ তোর বাপ এসে গেছে।’ -শ্যামলী এই কথা বলে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

কীসের কী কান্না, রুপু দীপুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। সুকান্ত রুপুর হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢোকে, দীপু দরজার হাতল ও প্যাকেট দুটো স্প্রে করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়।

ক্লান্তিতে সুকান্তকে ভীষণ বিমর্ষ দেখায়।

‘তোমার মোবাইল বন্ধ, আর এদিকে ঘরের মধ্যে তাণ্ডব শুরু হয়েছে। তুমি জানো না তোমার মোবাইল বন্ধ থাকলে ঘরের মধ্যে কী হয়?’

‘মোবাইলের আর দোষ কী, বের হইছি সেই সকাল বেলা, কতক্ষণ চার্জ থাকবে।’

এরমধ্যে রুপু ছটফট করতে থাকে। শ্যামলী তাকে আড়ালে নিয়ে শাসিয়ে বলে, ‘এক্ষুনি তোর বাবাকে কিছু বলবি না। একটা লোক এত দূর থেকে জার্নি করে এসেছে, খাবার-দাবার শেষে সুস্থির হয়ে বসলে বলা যাবে।’

মধ্যরাতে চার জন খেতে বসে, সুকান্তের দুই পাশে দুই মেয়ে, সামনে শ্যামলী। দুই মেয়ের প্লেটে কাঁটা ছাড়িয়ে মাছ তুলে দেয়। দীপুর মাছ খুব অপছন্দ, কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।

‘তা হলে শেষপর্যন্ত খামারটা বন্ধ করে দিলে?’

‘আর কী উপায় আছে বলো। লকডাউনের জন্য খাবার আনতে পারছি না, কতদিন গরুগুলোকে না খাইয়ে রাখা যায়?’

‘ছেলেগুলোকে কী করেছ?’

‘বেতন দিয়ে বিদায় করে দিয়েছি, আর শেডের মালিককেও শেডটা বুঝিয়ে দিয়েছি। চিন্তা করো না, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হোক আবার শুরু করব।’

একটু থেমে সুকান্ত সবার দিকে তাকায়, তারপর শ্যামলীকে উদ্দেশ করে বলে, ‘মেয়েরা কেমন যেন অস্থির অস্থির করছে, বাসায় কিছু হয়েছে কী?’

‘কী আর হবে, বাসায় যখন এসেছে, সবই জানতে পারবে।’

খাওয়ার পর দীপু রুপু তাদের বাবার দুই পাশে শরীর ঘেঁষে বসে। দীপু রুপুকে ইশারা করে কথাটা বলার জন্য। তাদের কোনো আবদারের কথা রুপুকে দিয়েই বলানো হয়, সে তার বাবাকে পটাতে পটু, বাবা কখনোই তার আবদার উপেক্ষা করতে পারে না। দুই মেয়ের কিছু একটা পরিকল্পনা আছে সুকান্ত তা ইতোমধ্যে বুঝে যায়।

‘বাবা, একটা কাজ করেছি, বকা দিবা না বলো।’

‘কী কাজ করেছ?’

‘আগে বলো, বকা দিবা না?’

‘বকা দেয়ার মতো হলে দেব, বকা দেয়ার মতো না হলে দেব না।’

রুপু এবার তার আসল অস্ত্র প্রয়োগ করে, বাবার গলা জড়িয়ে ঝুলতে ঝুলতে বলে, ‘বলো না বকা দিবা না।’

‘ঠিক আছে, বকা দেব না।’

রুপু তার বাবার গলা ধরে ঝুলে আছে, দীপু দৌড়ে বারান্দা থেকে একটা বিস্কুটের কার্টুন টেনে এনে সামনে রেখে বলে, ‘দেখ এটা কী?’

সুকান্ত ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, ‘এ তো দেখছি কুকুরের বাচ্চা, শুয়ে আছে, চোখ মেলতে পারছে না।’

শ্যামলীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এটা কী করে এলো?’

‘কী করে এলো, তোমার মেয়েদের মুখ থেকে শোনো। ভেবো না আমি নিয়ে এসেছি।’

দীপু তখন বলে, ‘শোনো শোনো, আমি বলছি, আমরা সন্ধ্যায় নিচে যাই বিস্কুট কিনতে, আমাদের পাশের বাসার জাবেদ আঙ্কেল, ওই যে একটা জার্মান শেফার্ড আছে তার, সেই জাবেদ আঙ্কেলের বাসার সামনে কে যেন বাচ্চাটাকে ফেলে যায়। বাচ্চাটা খুব কান্না করে। রাস্তার দিকে এলেই গাড়ি চাপা পড়ে মরে যাবে। তারপর আমরা বাসা থেকে ঝুড়ি নিয়ে তাকে বাসায় নিয়ে আসি। মা বলেন, তোর বাবা বকা দেবে, আমরা বলি রাতটা থাক, পরে দেখা যাবে কী করা যায়। বাবা না চাইলে আমরা মাঠে রেখে আসব।’

রুপু তখন বলে, ‘চোখের সামনে বাচ্চাটা মরে যেত গাড়ি-চাপায়, এটা কি ঠিক হতো?’

‘বাচ্চা মানুষ নিয়ে এসেছে কী আর করা, একটু ঝরঝরে হোক মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসব।’

‘ঠিক আছে এনেছ ভালো করেছ, কয়েক দিন পরে মাঠে ছেড়ে দিয়ে এসো। আমরা নিজেরাই ঝামেলায় আছি, বাসায় উটকো ঝামেলা রেখো না।’

দীপু রুপু হুররে বলে চিৎকার করে ওঠে, দুই দিক থেকে সুকান্তকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, ‘আমার বাবা, ভালো বাবা, আমাদের বাবা ভালো বাবা।’

ছয়
কয়েক ধাপ সিঁড়ি নিচে নেমে আবার উপরে এসে ঘরের মধ্যে মুখ বাড়িয়ে সুকান্ত বলে, ‘আমার ফিরতে কয়েক দিন লাগবে, এর মধ্যে বাচ্চাটাকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসবে, আমি এসে যেন বাসায় না দেখি।’

বাবার কথায় দীপু রুপু একে অন্যের দিকে তাকায়, তারপর দুজনে মায়ের দিকে তাকায়। এই তাকানোর অর্থ হচ্ছে তুমি কিছু একটা বলো।

‘তুমি এক জায়গায় যাচ্ছ, সাবধানে যাও, এতকথা বলছ কেন, কখন কী করতে হবে সময় বলে দেবে।’

সুকান্ত চলে যাওয়ার পর সবাই চিন্তা করে কী করা যায়। তারা কেউ বাচ্চাটাকে ছাড়তে চাইছে না। কয়েক দিনের মধ্যে শ্যামলীর যত্নে বাচ্চাটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে, তার পিছে পিছে ঘুরঘুর করে সারাক্ষণ। এতটুকু বাচ্চা, কী করে মাঠে ছেড়ে দেয়া যায়, এর বিকল্প কী করা যায় ভাবা জরুরি, হঠাৎ শ্যামলীর মাথায় আসে এডাপশনের বিষয়, এতে বাচ্চাটা যেখানে থাকুক ভালো থাকবে।

‘ক্যান্ডি লায়ন ওজি’ নামে একটা পেজের সঙ্গে শ্যামলী আগে থেকে যুক্ত, ওই পেজ যিনি চালান তিনি একটা ছোটোখাটো গার্মেন্টসের মালিক। বাসায় বেশ কয়েকটা কুকুর বিড়াল পোষেন, একটা কুকুরের নাম লায়ন, তার কারখানায়ও দুইটা কুকুর আছে; লালি-জুলি।

এরপর শ্যামলী ফেসবুকে একের পর এক এডাপশনের পোস্ট দেয়, তবে জুতসই কাউকে পাওয়া যায় না। খোঁজাখুঁজি করতে করতে কয়েকটা ডগ-লাভার গ্রুপের সন্ধান পায়। ঢাকা শহরে এতগুলো ডগ-লাভার গ্রুপ আছে জানা ছিল না তার। খিলগাঁওয়ে ‘রবিনহুড’ নামে কুকুরের একটা রেসকিউ সেন্টার আছে, রাস্তা-ঘাটে আহত কুকুরকে ধরে নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে আবার ছেড়ে দেয়। এর কাছাকাছি কুকুরের চিকিৎসার জন্য আর একটা সেন্টার আছে। অনেকে চলতে-ফিরতে অকারণে কুকুরকে ঢিল মারে, লাঠি দিয়ে পেটায়। এই শহরে এদের জন্য এমন ব্যবস্থা আছে ভাবতেও পারেনি শ্যামলী।

এই প্রাণীটাকে সবাই দূর দূর করে, অথচ মানুষের জন্য এদের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ হতে পারে না। এদের মাথায় একবার যে হাত রাখে তাকে এরা কোনো দিন ভোলে না। সবচেয়ে সুন্দর লাগে মাংসের দোকানের সামনে যখন এরা শান্তভাবে পাশাপাশি বসে থাকে তখন।

মায়ের কথায় মাংসের দোকানের সামনে অপেক্ষারত কুকুরগুলোর দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে দীপুর। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে। শ্যামলীর এডাপশন পোস্টে কেউ কেউ আজেবাজে কথা লেখে, এটা দেখে দীপু খুব মন খারাপ করে।

‘মা, মানুষ এত আজেবাজে কথা লিখছে, বাদ দাও এসব।’

‘শোনো দীপু, তুমি যত ভালো কাজ করো না কেন, কিছু লোক বাধা দেবেই। তাদের কথা শুনে থেমে থাকলে জীবনে কিছু করতে পারবে না। তুমি বেগম রোকেয়ার কথা চিন্তা করো, ভদ্র মহিলা জীবনে কম প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেছে!’

এরমধ্যে বেশ কয়েকজন রেসপন্স করে। কিন্তু শ্যামলী কাউকে পছন্দ করে না। অবশেষে পুরান ঢাকার আরজু নামের কলেজ পড়ুয়া এক মেয়েকে সিলেক্ট করে। একদিন দুপুরে আরজু এসে হাজির। শ্যামলী ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে একটা বাটি, প্লেট, কাঁথা, কিছু খেলনাসহ বাচ্চাটাকে একটা ঝুড়িতে দেয়। আরজুকে নিয়মিত বাচ্চাটার ভিডিও ক্লিপ পাঠানোর শর্ত দেয়।

আরজু নিয়মিত বাচ্চাটার ভিডিও পাঠাতে থাকে। সবাই এসব ছবি দেখে।

হঠাৎ বাচ্চাটার ছবি পাঠানো বন্ধ, সেল ফোনেও আরজুকে পাওয়া যায় না। শ্যামলী এ নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায়; মেয়েটাকে ট্রেস করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে।

শ্যামলীর এসব তৎপরতা দেখে সুকান্ত বলে, ‘বাদ দাও, মেয়েটা নিয়ে গেছে দায়দায়িত্ব এখন তার, তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ, এখন ভুলে যাও।’

‘বাচ্চাটার নিশ্চয়ই বিপদ হয়েছে, না হলে ছবি পাঠাত।’

‘বিপদ হলে হবে, তোমার সব কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে কেন?’

সুকান্তের কথা শোনার পর শ্যামলী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘তুমি বুঝবে না, তোমার বোঝার সেই ক্ষমতা নেই।’

ততক্ষণে শ্যামলীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে আরজুর এক মামার সন্ধান পেয়ে যায়। প্রথমে আরজুর ওপর শ্যামলীর ভীষণ রাগ হয়, শেষে তার মামার কাছে আরজুর সবকথা শুনে সব রাগ উবে যায়। আরজু আসলে মানসিকভাবে সিক, ফেসবুকের এডাপশন পোস্ট দেখে দেখে বিভিন্ন জায়গা থেকে কুকুর বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে বাসায় তোলে। এগুলোকে কে খাওয়াবে কে যত্ন করবে তার কোনো হদিস নেই। এদিকে তার বাবাও অসুস্থ, পরিবারে টানাটানি, তার মামা যতটুকু পারে সাপোর্ট করে।

তার মামা আরজুকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাচ্চাটা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়।

বাচ্চাটার অবস্থা খুব খারাপ, হাত পা ছেড়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর শ্যামলী আর রুপু স্যালাইন আর স্যুপ খাওয়ায়। রুপু তার মাকে বলে, ‘ভাগ্যিস এই সময় বাবা বাসায় নেই, না হলে খুব বকা খেতে হতো।’

‘বকা খেলে খেতাম, তোমার অত চিন্তা করতে হবে না।’

আসলে অযত্নে বাচ্চাটা অসুস্থ হয়ে যায়। ভয়ে সে আর বাচ্চাটার ছবি দেয় না, কী করবে সেটাও বুঝে উঠতে পারে না। সে মনে করেছে বাচ্চাটা মারা যাবে; কাজের লোককে ঠিক করে রেখেছিল মারা গেলে ডাস্টবিনে ফেলে আসার জন্য।

আরজু বাচ্চাটা নিয়ে এলে শ্যামলী তার সঙ্গে অনেক গল্প করে, জোর করে চা-নাস্তা খাওয়ায়। শ্যামলীর ভালো ব্যবহারে আরজু খুব বিস্মিত। যাওয়ার সময় আরজু বলে, ‘তুমি আমার দিদি, মাঝে মাঝে তোমার খোঁজ নেব, বিরক্ত হবে না।’

বাচ্চাটার এখন অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে। শ্যামলীর হাতে বাড়তি কোনো টাকা নেই।

সুকান্ত সন্ধ্যায় বাসায় ঢুকে বাচ্চাটাকে বারান্দায় দেখে খুব বিরক্ত হয়।

‘আবার, আবার একে নিয়ে এসেছ, তোমাদের কোনো কাজ নেই? এ তো যখন তখন মারা যাবে।’

শ্যামলী সুকান্তের কথায় তখন কিছু বলে না, পরে চা দিতে দিতে বলে, ‘তুমি তো অনেক বিরক্ত হইছ, এদিকে তো বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে।’

আরজুর পুরো ঘটনা শুনে সুকান্ত বলে, ‘তুমি পুলিশে চাকরি করলে ভালো করতে, আর তোমার এনার্জিও আছে স্বীকার করতে হয়।’

দীপু রুপুকে দায়িত্ব দেয় বাবাকে বাচ্চাটার চিকিৎসার টাকা দিতে রাজি করাতে। যথারীতি রুপু সোফায় বসে টিভি দেখার সময় বাবার গলায় ঝুলে গল্প করতে থাকে।

‘বাচ্চাটার অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে, তুমি কিনে দেবে, না করতে পারবে না। কিনে না দিলে মা মন খারাপ করবে। আমাদেরও মন খারাপ হবে। তুমি কি চাও তোমার মেয়েরা মন খারাপ করে বসে থাকুক?’

পরদিন সুকান্ত তার এক ভেট বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে অ্যান্টিবায়োটিক ও কিছু ওষুধ কিনে দিয়ে খামারে চলে যায়।

প্রথমে সবাই বাচ্চাটার আশা ছেড়ে দেয়, কিন্তু শ্যামলীর যত্ন আর ওষুধ-পথ্য পেয়ে কয়েক দিনের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে, আবার ঘুরে ঘুরে রুপুর সঙ্গে খেলতে থাকে।

কয়েকদিন পর সুকান্ত বাসায় এসে দেখে বাচ্চাটা এদিক সেদিক লাফালাফি করছে, ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে তাকে একবার দেখে নিয়ে লেজ উঁচিয়ে দৌড়ে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ে। আবার উঁকি দিয়ে দেখে দৌড়ে বেরিয়ে তার বুড়ো আঙুল কামড়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।

সুকান্ত ভ্রূ কুঁচকে বাচ্চাটার কর্মকাণ্ড দেখে কিন্তু কিছু বলেন না। দুই-এক দিনের মধ্যে তার সঙ্গে বেশ খাতির হয়ে যায়। সুকান্ত তার সঙ্গে একটু একটু রেসপন্স করে, তবে অন্যদের দেখলে চোখ-মুখ শক্ত করে রাখে।

একদিন বাচ্চাটা সুকান্তের কোলে উঠে চুপচাপ বসে আছে, সুকান্ত তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। রুপু চুপিচুপি তার মাকে গিয়ে খবরটা জানায়।

তার মা চমকে ওঠে বলে, ‘কী বলিস, তোর বাবা ডোডোকে আদর করছে!’

পায়ে পায়ে শ্যামলী এসে সুকান্তের সামনে দাঁড়ান, শ্যামলীর চোখ পড়তেই সুকান্ত একটু লজ্জা পায়।

সুকান্ত বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে শ্যামলীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দেখ না বাচ্চাটা লাফ দিয়ে কোলে উঠে বসে আছে।’

সাত
‘মা, এদিকে তাকাও, একটা কথা বলব।’

‘তাকাতে পারব না, দেখছ না কাজ করছি, ঝটপট বলে ফেলো, কান খোলা আছে।’

‘না, এদিকে তাকাও, কথা বলার সময় চোখের দিকে না তাকালে মনে হয় গাছের সঙ্গে কথা বলছি।’

‘কথার কী ছিরি, দেখছ না কাজ করছি।’

‘এক মিনিট তাকালে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।’

‘তাকালাম, বলো কী বলবে?’

‘আমাকে একটা রঙের বক্স কিনে দিতে পারবা?’

শ্যামলী রুপুর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকে বলে, ‘হঠাৎ রং দিয়ে কী হবে? পড়ালেখা ড্রয়িং তো কাড়ে উঠিয়ে দিয়েছ, কাড়ে ঠিক নয় খাটের নিছে ঢুকিয়ে দিয়েছ।’

‘ছবি আঁকব, ডোডোর ছবি। ছবি এঁকে বাবাকে পাঠাব, ছবি দেখলে ডোডোর প্রতি বাবার মায়া হবে, তখন ছেড়ে দিতে বলবে না। বুদ্ধিটা ভালো না? বলো না কিনে দিতে পারবে কী না?’

‘বুদ্ধি ভালো, কিন্তু কিনে দিতে পারব না। তোমার বাবা যে টাকা দিয়ে গেছে সেখানে রঙের কোনো খাত নেই। রং যদি কিনতেই হয় বাপের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে পারো। আমার সঙ্গে এই নিয়ে দ্বিতীয় বাক্য ব্যয় করবা না। দফায় দফায় রং, খাতা কিনে দিয়েছি, সেগুলো খুঁজে বের করো।’

দীপু এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সে বলে, ‘আমি বলেছি মা, চল খাটের নিচ থেকে রংগুলো বের করি, সে বলে ওগুলো পুরানো হয়ে গেছে। কয়দিন আগেই না বাবা কিনে দিয়েছে। টাকা না ধসালে ভালো লাগে না।’

‘তুই আবার নাক গলাতে এলি কেন? সব কিছুতে নাক না দিলে ভালো লাগে না। এভাবে নাক গলাতে গলাতে নাক বলে কিছু থাকবে না।’

‘ভালো কথা বললে গায়ে ফোসকা পড়ে…। রং কেনার জন্য একটা টাকাও দিবা না। বাবাকেও বলে দেব কোনো টাকা না দিতে।’

‘তোর বাপ গুনে গুনে টাকা দিয়েছে, আমি কোত্থেকে টাকা দেব?’

রুপু কী কারণে যেন রং পেন্সিলের জন্য জিদ করেনি। খাবার সময় সুরসুর খাবার টেবিলে চলে আসে। অন্য সময় হলে দরজা বন্ধ করে অনশনে বসে যেত।

ঘুমানোর আগে খাটের নিচ থেকে বাক্সগুলো বের করে রং পেন্সিল খুঁজতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে দীপু এসে তার সঙ্গে হাত মেলায়।

‘তুই আবার কী খুঁজছিস দিদি?’

‘আমার গানের খাতাটা, চিন্তা করছি আবার গান প্র্যাক্টিস করব। নানা ভাই ডায়রি লেখার জন্য যে দুইটা খাতা দিয়েছে সে দুটোও দরকার।’

‘হারমোনিয়াম ছাড়া কি গান হবে? বাবা বলেছিলেন, হারমোনিয়াম কিনে দেবেন।’

‘এখন তো হারমোনিয়াম কেনার মতো পরিস্থিতি নেই বাবার।’

‘ট্যাবে হারমোনিয়াম অ্যাপস ডাউনলোড করেছি, ডোডোকে গান শোনাব। দেখি কোন সুরে কেমন রেসপন্স কারে।

আট
‘দেখেছিস বাবা এখন বাচ্চাটাকে মেনে নিতে শুরু করেছেন, লাফ দিয়ে বাবার কোলে উঠে বসে থাকলেও কিছু বলেন না।’

‘শোন দিদি, এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই, বাবার মাথা কখন ঠান্ডা থাকে, কখন গরম হয় ঠিক নাই, মাথা গরম হলে ঢিল মেরে বাইরে ফেলে আসতে এক সেকেন্ড দেরি হবে না।’

‘যা হবার হবে, এখন বাচ্চাটার সুন্দর একটা নাম ঠিক করতে হবে। রুপু তুই একটা তালিকা তৈরি কর সেখান থেকে আমরা সুন্দর একটা নাম সিলেক্ট করব। তোকে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দেয়া হলো।’

রুপু রংপেন্সিল দিয়ে কাগজে একটা নামের তালিকা করে দরজার পাল্লার সঙ্গে সাঁটিয়ে দেয়। দীপু তালিকার ওপর চোখ বুলিয়ে বলে, ‘এগুলো কোনো নাম হলো?’

এ কথা শুনে রুপু ক্ষেপে যায়, দৌড়ে সে মায়ের কাছে গিয়ে বলে, ‘আমি এত কষ্ট করে নামের তালিকা করেছি, ওই হিংসুট্টি বলে একটাও নেয়ার মতো না। নিজের তো একটা নাম রাখার মুরোদ নেই, কেউ করলে তার ওপর মাতব্বরি।’

শ্যামলী দরজার পাল্লায় সাঁটানো তালিকার সামেনে এসে দাঁড়ায়।

‘মা, দেখ, ওর রুচি কোথায় গিয়ে ঠেকছে, এগুলো কোনো নাম হতে পারে? আর দেখ কতগুলো বানান ভুল করেছে, ওর আর স্কুলে যাওয়ার দরকার নাই, যে কি না ক্লাস ফোরে পড়ে এত বানান ভুল করে সে স্কুলে গিয়ে কী করবে? বাবার সঙ্গে খামারে পাঠিয়ে দাও, সেখানে কাজকর্ম করুক।’

রুপু রাগে হাতের কাছে যা পায় তা দীপুর দিকে ছুড়ে মেরে শেষে রিডিং রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কান্না শুরু করে।

‘আহা দীপু তোকে নিয়েও পারি না, তুই বড় হইছিস না। তুই পড়িস ক্লাস এইটে, ও তোর অনেক ছোটো না, এতো ভুল ধরলে হয়?’

তালিকায় চোখ বুলিয়ে শ্যামলী দীপুর দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলে, ‘ছি ছি ছি, এই সামান্য সামান্য শব্দের বানানও ভুল করেছে! আর ভূতকা ফুতকা এগুলো কী নাম লিস্ট করেছে?’

‘আমি কী এমনি এমনি বলেছি?’

‘থাক, আর কিছু বলিস না, এই রাগ কতক্ষণে কমে আর এর জন্য কত গচ্চা দিতে হয় দেখ না।’

‘মা, আমার নামের বিষয়ে বাবার হেলপ নিতে পারি, কী বলো?’

‘তুই আর মানুষ খুঁজে পেলি না, তোর বাপ দিবে নাম, সেরকম লোক হলে তো ভালোই হতো। যে কি না নিজের মেয়েদের একটা সুন্দর নাম রাখতে পারেনি, সে খুঁজে দেবে সুন্দর নাম।’

‘তা হলে তুমিই রেখে দাও।’

‘তা তো রাখব, তোর নানি ঢাকায় আসছেন, তোর নানিকে বল দেখবি সুন্দর নাম রেখে দেবেন।’

সুকান্ত খামারে যাওয়ার দুই দিন পর দীপু রুপুর নানি আসে কয়েক দিনের জন্য।

নাম বিষয়ে দীপু রুপুর সব কথা শুনে তাদের নানি বলে, ‘আমি একটা সুন্দর নাম দিতে পারি, তবে দুটো শর্ত;

শর্ত নাম্বার ওয়ান: আমি যে নাম রাখব সেটাই ফাইনাল, কারো কোনো আপত্তি চলবে না। রাজি? রাজি থাকলে পরের শর্তে যাব।’

দীপু রুপু হাত তুলে বলে, ‘প্রথম শর্তে আমরা রাজি।’

‘শর্ত নাম্বার টু: নাম রাখা উপলক্ষ্যে ছোটোখাটো অনুষ্ঠান করতে হবে। নাম ওই অনুষ্ঠানেই ঘোষণা করব, এর আগে নাম নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।’

‘দ্বিতীয় শর্তেও রাজি।’

নানির ঘোষণার কিছুক্ষণ পর রুপু হাতের ইশারায় দীপুকে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে বলে, ‘নামকরণ অনুষ্ঠানের টাকা দেবে কে?’

রুপু বলে, ‘নানি আমাদেরও একটা শর্ত আছে।’

‘কী সেই শর্ত?’

‘নামকরণ অনুষ্ঠানের সব খরচ তোমাকে দিতে হবে।’

‘তোমাদের শর্তে আমিও রাজি।’

বাচ্চাটার নামকরণ অনুষ্ঠান হবে দীপু রুপু মহা খুশি।

শ্যামলী তার মাকে সঙ্গে নিয়ে টোপর, বেলুন, মোমবাতি, কেক আর মিষ্টি কিনে আনে। শুরু হয় নামকরণ অনুষ্ঠান, রুপু এখানে সেখানে বেলুন ঝুলিয়ে রাখে, লম্বা দুই কান ঢেকে টোপর পরিয়ে দেয়। বেলুন দেখে লম্ফঝম্প শুরু করে, আর একটার পর একটা বেলুন ফাটিয়ে চলছে বাচ্চাটা। সে কী কাণ্ড। কেক কাটার জন্য সবাই অপেক্ষা করে আছে, তাদের নানির নাম ঘোষণার পরপরই কেক কাটা হবে। দীপু রুপু নানির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অধীর আগ্রহ নিয়ে...

নানি বলে, ‘ডো…ডো..., ডোডো।’

সবাই ডোডো বলে চিৎকার করে উঠে, ডোডো আরো উত্তেজিত হয়ে লেজ উঁচিয়ে লাফাতে থাকে। হইহুল্লোড়ের মধ্যে কেক কাটা হয়।

‘সবাই থামো থামো, অনুষ্ঠান এখনো শেষ হয়নি। দিদি এখন গান শুনাবে, তারপর আমি কিছু ছবি এঁকেছি ডোডোর, সেগুলো প্রদর্শিত হবে।’

ট্যাব হাতে নিয়ে দীপু বলে, ‘নানি কী গান করব?’

‘খুশির গান করো, জন্মদিনে খুশির গান করতে হয়। ওই যে রবীন্দ্রসঙ্গীতটা, আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি... সেটা গাও।’

গান শেষ হওয়ার পর ডোডো রুপুর আঁকা ছবিগুলোর একটা নিয়ে সোজা খাটের নিচে চলে যায়, রুপুর আবার কান্না শুরু হয়।

নয়
নাম ঠিক হলো, আবার নতুন সমস্যা। নানা কারণে সুকান্তের সময় ভালো যাচ্ছে না। সবসময় মাথা গরম, সামান্য কিছুতে ক্ষেপে যায়। তার কড়া নির্দেশ ডোডোকে এডাপশনে দিতে হবে। বাপকে কনভিন্স করার রুপুর কোনো কেরামতি কাজে আসছে না।

‘আমাদের কোনো কথাই তো বাবা শুনছেন না, মা তুমি একটু বাবাকে বলে দেখ না, বাবা তোমার কথা ফেলতে পারবে না।’

‘দীপু তুই ভালো বলেছিস, তোর বাপ যদি আমার সব কথাই শুনতো তা হলে ভালোই হতো। তোর বাবার খামার বন্ধ, মাথা ঠিক নাই। আমার কথায়ও কাজ হবে না।’

ডোডোর জন্য আবার শুরু হয় এডাপশন পোস্ট। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজনকে পাওয়া যায়, তার নাম আল-আমিন, থাকে নারায়ণগঞ্জে।

ডোডোকে দিয়ে দেয়া হবে শুনে রুপু আবার কান্না শুরু করে; এবার কান্না করে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে মাথার ওপর বালিশ চাপা দিয়ে। এটা তার কান্নার আর একটা স্টাইল। সুকান্ত বহু চেষ্টা করে তাকে থামায়, তাকে বোঝান হয়, কয়দিন পর ডোডোকে নিয়ে আসা হবে।

দীপু রুপুর সঙ্গে সঙ্গে ডোডোরও মন খারাপ। ডোডো আবার চলে যাবে।

‘তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।’

‘সব কাজই তো করে দিচ্ছি, আবার নতুন করে কী কাজ?’

‘ডোডোকে এডাপশনে দিয়েছি, নারায়ণগঞ্জ থেকে একটা ছেলে এসে নিয়ে যাবে, ছেলেটার নাম আল-আমিন। তুমি বৌদ্ধমন্দিরের সামনে মেইন রোডে বাচ্চাটাকে দিয়ে আসবা।’

‘বাসা থেকে নিয়ে যেতে বলো।’

‘বোকার মতো কথা বলো না, এই সময় কাউকে বাসায় অ্যালাউ করা যায়?’

‘আমি পারব না, তোমরা দফায় দফায় বাইরে থেকে বিড়াল কুকুর নিয়ে আসবে, শেষে আমাকে দিয়ে সেগুলো ছাড়িয়ে দেবে। মনে আছে এর আগে কতগুলো বিড়ালের বাচ্চা আমাকে দিয়ে ছাড়িয়েছ। বিড়াল গেছে এখন কুকুর নিয়ে শুরু করেছ। তোমরা এনেছ, তোমরা ছেড়ে দিয়ে আসো।’

‘আমি এনেছি নাকি! এনেছে তোমার মেয়েরা, এখন দুই মেয়েকে দিয়ে পাঠাই এটা তোমার ভালো লাগবে?’

‘তোমার প্রশ্রয়ে তো এসব হচ্ছে, তুমি দিয়ে এসো।’

‘আরে এমন করছো কেন, আমার শরীর ভালো না, না হলে আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসতাম। দুই মেয়েকে নিয়ে যাও, ওরা খুব মন খারাপ করে আছে। তুমি ওদের বুঝিয়ে বলো যে কয়দিন পর আবার নিয়ে আসব।’

সুকান্ত দুই মেয়ে আর ডোডোকে নিয়ে মেইন রোডে গিয়ে দাঁড়ায়। সুকান্তের কোলে ডোডো মাথা রেখে চুপ করে শুয়ে আছে, একটুও ছটফট করছে না। সুকান্তের মনে পড়ে দীপু যখন ছোট ছিল তখন তাকে কোলে নিয়ে রাস্তায় গাড়ির জন্য এভাবেই অপেক্ষা করত। পথচারীদের অনেকে সুকান্তের দিকে তীর্যকভাবে তাকায়, এক নারী তার ছেলেকে দেখিয়ে বলেন, ‘দেখ দেখ লোকটা কুকুরের বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মানুষের বাচ্চার মতো।’

কিছুক্ষণ পর একটা ছেলে এলো মজবুত গড়নের, মাথার দুই দিকে চুল ছাঁটানো। সঙ্গে মোটাসোটা একজন। ছেলেটা সরাসরি সুকান্তের সামনে এসে বলে, ‘আমি আল-আমিন, ডোডোকে নিতে এসেছি।’ আল-আমিন এসেছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে, লক-ডাউনের মধ্যে। সুকান্ত জিজ্ঞেস করে, ‘কীভাবে এলেন, গাড়ি-ঘোড়া চলছে না।’ সে বলে, ‘ভিতরের রাস্তা দিয়ে সিএজি নিয়ে এসেছি।’

ডোডোকে ভালো করে দেখার জন্য নিচে ছেড়ে দেয় সুকান্ত, তখনও সে ভদ্র বাচ্চার মতো দাঁড়িয়ে আছে, এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে না। কেবল সুকান্তের পা ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে। প্রথম দেখায় ডোডোকে আল-আমিনের পছন্দ হয়।

সুকান্ত বলে, ‘এতো দূর কী করে নেবেন, কোলে করে এতো দূর নেয়া যাবে না। একটা ঝুড়ি কিনে আনেন।’

আল-আমিন ঝুড়ি কিনতে গেলে ডোডোকে দীপু কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু সুকান্তের কোলে যাওয়ার জন্য ছটফট করে। রুপু বলে, ‘দিদি আমি মনে করেছি ডোডোকে লোকটার পছন্দ হবে না।’

‘আমি মনে মনে চেয়েছি ডোডোকে যেন পছন্দ না হয়।’

আল-আমিন ঝুড়ি নিয়ে এলে এক বোতল পানি আর কিছু বিস্কুট কিনে দেয় সুকান্ত। পথে সিএনজি থামিয়ে পানি আর বিস্কুট খাওয়াতে বলে। ঝুড়িতে রাখার পরও ডোডো ঝাঁপাঝাঁপি করেনি, কেবল সবার দিকে তাকিয়ে থাকে করুণভাবে। সুকান্ত ভেবেছে রুপু ঝামেলা করবে কিন্তু সেরকম কিছু সে করেনি। সিএনজি ছেড়ে যাওয়ার পর সবাই দাঁড়িয়ে থাকে হতবিহ্বল হয়ে।

সুকান্ত দীপু রুপুকে আইসক্রিম কিনে দেয় এবং তাদের মনোযোগ সরানোর জন্য গল্প করে, কিন্তু তাদের ভীষণ মন খারাপ, সুকান্তের কোনো কথাই মাথায় ঢোকে না।

বাসায় গিয়ে সোফায় বসতেই, ‘আমার ছেলেটাকে দিয়ে এলে’ বলে কাঁদতে থাকে শ্যামলী। শ্যমলীর কান্না দেখে দুই মেয়েও কান্না করতে থাকে। কান্না হচ্ছে বড়ো সংক্রমক, সুকান্তের চোখের কোণও ভিজে যায়। বাথরুমে ঢুকে অনেক সময় নিয়ে গোসল করে সুকান্ত এবং বাইরে চলে গিয়ে ফেরে অনেক রাতে। পরদিন ভোরে খামারে চলে যায়। ওই রাতে শ্যামলী কিছুই খায়নি।

প্রতি সন্ধ্যায় আল-আমিন ডোডোর ভিডিও পাঠায়। শ্যামলী দীপু রুপু সেগুলো দেখে। সারাদিন সবাই অপেক্ষা করে কখন সন্ধ্যা হবে, কখন ডোডোর ভিডিও দেখা যাবে। দুই একদিন পর ভিডিওতে দেখা যায় ডোডো কিছু খাচ্ছে না, আল-আমিন তার মুখে খাবার তুলে দিলে সে খাবার ফেলে দেয়।

রুপু এই ভিডিও তার বাবাকে ফরোয়ার্ড করে, তার বাবা উত্তরে বলে ‘আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, তোমাদের ভুলতে পারছে না সে জন্য এমন করছে। এই নিয়ে এতো উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’

এভাবে দেখতে দেখতে সাত আট দিন চলে যায়। এক ভিডিওতে দেখা যায় ডোডোর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, আল-আমিন তা মুছে দিচ্ছে। এই ভিডিও দেখার পর আবার শ্যামলী খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। এর পর দুই দিন কোন ভিডিও পাঠায়নি আল-আমিন।

তৃতীয় দিনের দিন দুপুরে হঠাৎ আল-আমিন শ্যামলীকে ফোন করে বলে, ‘আপা আমি ডোডোকে নিয়ে এসেছি, বাসার ঠিকানাটা একটু বলেন।’

ফোন রেখে শ্যামলী চিৎকার করে ওঠে, ‘ডোডো আসছে…। ডোডোর মামা আসছে ডোডোকে নিয়ে।’ রুপু খুশিতে লাফাতে থাকে। বাসায় ঢুকে ঝুড়ি থেকে বের করতেই ডোডো লাফিয়ে শ্যামলীর কোলে গিয়ে বুকের মধ্যে লেপটে থাকে। আল-আমিন বলে, ‘আপা ডোডো আপনাদের ভুলতে পারছে না, আপনারা ভিডিওতে দেখেছেন এই কয়দিন পানি ছাড়া কিছুই খায়নি, আমার কাছে থাকলে ও না খেয়ে মারা যাবে। তাই বাধ্য হয়ে নিয়ে এসেছি।’

‘ভালো থাকিস ডোডো, মামা পরে এসে দেখে যাব’ বলে আল-আমিন কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে, শ্যামলী পিছন থেকে কয়েকবার ডাকে, কিন্তু আল-আমিন একবারও ফিরে তাকায়নি।

দশ
এক সন্ধ্যায় রুপুর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না, দরজা বন্ধ করে কী যেন করছে।

‘এই দীপু, রুপু দরজা বন্ধ করে এত সময় থেকে কী করছে।’

‘কি করছে তুমি জানো না? উনি মেকআপ নিয়ে ব্যস্ত। ভূতনি তোমার সব মেকআপ আইটেম শেষ করে ফেলবে, কতবার বলেছি তোমার মেকআপের জিনিসগুলো উঠিয়ে রাখো, রাখোনি।’

‘কথা না বলে দেখ না কী করছে?’

‘এই দরজা খোল, আর কত মেকআপ করবি?’

দীপু দরজা খুলে দেখে রুপু খাটের নিচ থেকে কার্টুন বের করে কী যেন খুঁজছে।

‘এই তুই খাটের নিচে থেকে বইপত্র বের করে কী করছিস? আমি তো মনে করেছি তুই মেকআপ নিয়ে ব্যস্ত।’

‘তুই তো গড্ডল, গড্ডলরা এমনই ভাবে।’

‘কী খুঁজছিস?’

‘একটা গল্পের বই খুঁজছি, ওই যে কাশতানকা, বাবা গত বইমেলা থেকে কিনে দিয়েছেন, পড়ে শেষ করিনি, মনে হচ্ছে ডোডোর সঙ্গে এর মিল আছে।’

‘কাশতানকা, একটা কুকুরের নাম, রুশ গল্প, আন্তন চেখভের গল্প।’

‘তুই ঠিক বলেছিস দিদি, আগে এটা পড়ব, পরে যে বইগুলো পড়া হয়নি সেগুলো পড়ব।’

‘আমার গল্পের বইগুলো কই?’

‘তোর গল্পের বইগুলোও বের করে রেখেছি, দেখ এখানেই আছে।’

‘আজব ঘড়ির দেশে- রিজিয়া রহমানের লেখা একটা বই আছে, বাবা বইমেলা থেকে কিনে দিয়েছেন, তোর মনে পড়ে? বইটা দেখেছিস?’

‘তোরগুলো এখানে রেখেছি, তুই খুঁজে দেখ। ’

রুপু তার পড়ার টেবিলে রং পেন্সিল আর আর্ট কাগজের পাশে গল্পের বইগুলো রাখে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ‘আজব ঘড়ির দেশে’ পেয়ে যায় দীপু। ভালোই হলো আর একটা বই পাওয়া গেছে, বইটার কথা ভুলেই গিয়েছিল: ‘চাঁদের পাহাড়’। আর একটা বই এখনো খুঁজে পায়নি, ‘অব্যক্ত’। মনে পড়েছে বইটা জুনির জন্মদিনে গিফট করেছে। বইটা আবার সংগ্রহ করতে হবে, মাকে বললে বকা খেতে হবে, বাবাকে বলতে হবে চুপ করে।

এগারো
সবাইকে পেয়ে ডোডো আবার উৎফুল্ল। কয়েক দিন খাবারের অনিয়মে কিছুটা কাহিল। তবে শ্যামলীর যত্নে সে আবার শক্তি ফিরে পায়। দৌড়ে শ্যামলীর কোলে উঠে মুখটাকে লম্বা করে উ-উ-উ উ শব্দ করতে থাকে। রুপু বলে, ‘সে বলতে চাইছে তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়েছ কেন? তুমি কেমন মা এতটুকু বাচ্চাকে ছেড়ে দাও। ’

মাঝে মাঝে ডোডো দৌড়ে এসে সুকান্তের সামনে শুয়ে পড়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে।

রুপু বলে, ‘দেখো দেখো ও তোমার সঙ্গে খেলতে চায়, তুমি একটু আদর করে দাও।’

সুকান্ত চোখমুখ শক্ত করে রাখে, কিছু বলে না।

রুপু বলে, ‘বাবা তুমি বাচ্চাটাকে আদর করো না কেন? তুমি কেমন নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছ দিন দিন।’

সুকান্ত লজ্জা পেয়ে বলে ‘করি তো।’

সুকান্ত যখন সোফায় বসে কোনো কাজ করে, পায়ের কাছে সামনের পা দুটোর ওপর মাথা রেখে ডোডো শুয়ে আড় চোখে দেখে সুকান্ত কী করে। সে আসলে মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করে।

সুকান্ত ডাকে, ‘ডোডো’

সে একবার ডান দিকে আর একবার বাম দিকে মাথা নাড়ে, তারপর উঠে লেজ নাড়তে নাড়তে পায়ের কাছে বসে পড়ে।

সুকান্তের বাইরে যাওয়া তার মোটেই পছন্দ নয়। মোজা পরার পর সে কামড়ে মোজাটা খুলে নিয়ে দৌড়ে অন্য ঘরে লুকিয়ে থাকে। সে বাইরে গেলে অস্থির হয়ে একবার বারান্দা দিয়ে একবার জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। সুকান্ত দোতলায় ওঠার পর কী করে যেন বুঝে যায়, দরজা খুলে দেয়ার জন্য দুই পায়ে দরজা খামছাতে থাকে। বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সুকান্তের বুকের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে ডোডো।

দীপু রুপু যখন বলে, ‘বাবা কই, বাবা কই?’ -সে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে মুখটা লম্বা করে ডাকতে থাকে ভু ভু ভু...। এর মানে বাবা বাইরে গেছে। ডোডো মাছ মাংস ডিম দুধ ছাড়া কিছু খায় না, সকালে মাংস খেলে দুপুরে মাংস দিয়ে খায় না, হয় মাছ কিংবা দুধ দিতে হয়। তার খাবারের জোগান নিয়ে শ্যামলী উদ্বিগ্ন।

শ্যামলী সুকান্তকে একদিন বলে, ‘ডোডোর খাবারের মাংস নেই।’

সুকান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘হয়ে যাবে।’

হঠাৎ একদিন দীপুর মনে হয়, তার মা মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। দীপু তার মাকে বলে, ‘তুমি মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছ কেন?’

তার মা কোন উত্তর দেয় না, পরে বলে, ‘তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।’ দীপুর মন খারাপ হয়ে যায়, সে ভাবে রুপুকে এই কথা জানাবে, রুপু জানলে কান্নাকাটি করে পরিস্থিতি খারাপ করে তুলবে, পরে বাবা মা দুজনে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বেন।

এর কিছুদিন পর দীপু লক্ষ করে তার বাবাও মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। দীপু খাবার টেবিলে বলে, ‘বাবা তুমি মাছ-মাংস খাচ্ছ না কেন? কাজটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না।’

তার বাবা হাসতে হাসতে বলে, ‘আমার বয়স হয়েছে, বয়স হলে লিভারের প্রোটিন হজমের ক্ষমতা কমে যায়।’ শ্যামলী সুকান্তের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকে।

দীপু খেয়াল করেছে কখনো দিনের বেলা তার বাবা শুয়ে থাকলে ডোডো এদিক সেদিক থাকায়, তারপর দৌড়ে খাটে উঠে বাবার গাল চেটে নিয়ে আবার নেমে যায়। এই কাজটা সে অন্য কারো সঙ্গে করে না।

তার মা দুঃখ করে বলে, ‘ডোডো, এই কাজটা আমাদের কারো সঙ্গে করে না, ওর সেবা যত্ন করি আমি, আর ভালোবাসে তার বাবাকে।’

সুকান্ত বলে, ‘আমাকে ভালোবাসে এটা সত্য, কিন্তু তার কাছে তোমার যে আসন সেটা অন্য কেউ নিতে পারবে না। সে আমাদের চারজনকে চার রকম ভালোবাসে।’

তাকে যদি সুকান্ত বলে, ‘ডোডো বোনেরা দুষ্টামি করছে, বকা দিয়ে আয়।’

সে দৌড় দিয়ে গিয়ে ভুক ভুক করে আসে।

আবার যদি বলে ,‘ডোডো তোর মাকে বকা দিয়ে আয়’, সে উল্টো সুকান্তের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ভুকতে থাকে।

এক সন্ধ্যায় সবাই বসে চা খাচ্ছে, ডোডো শ্যামলীর পায়ের কাছে শুয়ে আছে।

সুকান্ত বলে, ‘ডোডো আমাদের অবস্থা খুব খারাপ, তুই বড় হইছিস, তুই চলে যা না এবার।’

ডোডো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর সামনের দুই পায়ের ওপর মাথা রেখে বারান্দায় শুয়ে থাকে, দুই চোখে অদ্ভুত চাহনি। এই আচরণ দেখে শ্যামলীর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। এমন একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বে সুকান্ত ভাবতেও পারেননি। এখানেই শেষ নয়, ওই রাতে ডোডো কিছুই খায়নি। এরপর থেকে সবাই সতর্ক থাকার চেষ্টা করে, তবু কখনো কখনো বিরক্তি প্রকাশ করলে সে কীভাবে যেন বুঝে যায়, মন খারাপ করে থাকে।

বারো
দীপু আবার ডায়রি লেখা শুরু করেছে। সে ডায়রি লেখে তার মা ভাইর দেয়া সুন্দর মলাটের সাদা খাতায়। খাতাগুলো এতটাই সুন্দর যে, হাতে নিলেই মনে হয় কিছু লিখি। এতো সুন্দর খাতায় লিখতে হলে হাতের লেখা সুন্দর হওয়া জরুরি। দীপুর হাতের লেখা এমনিতেই সুন্দর কিন্তু দীর্ঘ দিনের অনভ্যাসে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। তাই কয়েক দিন হাতের লেখা প্র্যাক্টিস করে নেয়; কেননা ডায়রিটা সে নানা ভাইকে পড়তে দেবে।

সে লিখছে ডোডোকে নিয়ে: ডোডোরা আমাদের মতো কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। তবে তারা অনেক কিছু বোঝে, মনের ভাবও প্রকাশ করে। আমরা চাইলে তাদের মনের অনেক কথা বুঝতে পারি। আমি যেমন ডোডোর অনেক কথা বুঝতে পারি। রুপু আমার চাইতে আরো বেশি বুঝতে পারে, সে ডোডোর প্রতিটা এক্সপ্রেশনের একটা অর্থ খুঁজে বের করে।

ডোডো কেবল ‘ভুক ভুক’, ‘ভু...য়ু’ আর ‘কুঁই কুঁই’ এই কয়টা শব্দ করতে পারে, কিন্তু এই কয়টা শব্দ দিয়েই মনের সব ভাব প্রকাশ করতে পারে। এরা হাসতে পারে আবার কান্নাও করতে পারে।

আর ডোডোদের আছে লেজ, এই লেজ দিয়েও তারা মনের অনেক ভাব প্রকাশ করে। আমরা বলি লেজ গুটিয়ে থাকা, বা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়া; আসলে এরা ভয় পেলে লেজ গুটিয়ে রাখে।

আবার খুশিতে তারা লেজ নাড়তে থাকে, কেউ যদি ভালোবেসে কিছু খাবার দেয় তখন কৃতজ্ঞতায় তারা যে লেজ নাড়ে তা দেখার মতো। আর তারা যখন রেগে যায় তখন এরা লেজ একেবারে খাড়া করে ফেলে। অনেকে বলেন, কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না, আসলে দরকার হলে সোজাও করে।

বাবা যখন বাসার বাইরে থাকে তখন ডোডো বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে রাস্তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আর ঘরময় পায়চারি করে। মাঝে মাঝে, বিশেষ করে সন্ধ্যার পর গলাটা বাড়িয়ে অত্যন্ত করুণ একটা স্বরে ‘ভু... য়ু… ভু...’ করে ডাকতে থাকে। বাবা যখন টানা কয়েক দিন বাইরে থাকেন তখন ডোডো রাত হলে দরজার সামনে বসে থাকে, আর কুঁইকুঁই শব্দে কান্না করে। কোনো কারণে ক্ষেপে গেলে গলার রগ ফুলিয়ে ভু...য়ু...শব্দে চিৎকার করে।

মা বাইরে থেকে এলে ডোডো লাফ দিয়ে উঠে মার ব্যাগ দেখবে কিছু এনেছে কি না তার জন্য, এরপর মায়ের হাতের তালুতে হাত রেখে অদ্ভুত একটা শব্দ করবে আর গরুর বাছুরের মতো মাথা দিয়ে ঢুস মারবে; এর মানে হচ্ছে কী এনেছ তাড়াতাড়ি দাও। খাওয়ার পর খুশিতে ল্যাজ নাড়তে থাকে।

খেলার বল, পুতুল যা পায় তাই দিয়ে সে খেলতে চায়, রুপুর সবগুলো টেডি-বিয়ার সে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে, এটা তার খেলা। এছাড়া বল নিয়েও সে খেলে। তার খেলনাগুলো কেড়ে নিলেই সে ক্ষেপে যায়, এই সময় গলার রগ ফুলিয়ে ভো ভো শব্দ করে গোলগোল ঘুরতে থাকে।

মা তখন বলেন, ‘পাগল ক্ষেপেছে’; মা দিদি আমাদের কারো কথা সে শোনে না, বাবা-ই কেবল তাকে শান্ত করতে পারে।

বাবা গলার আওয়াজ চড়া করে যখন বলেন ‘ডোডো এসব কী হচ্ছে?’ তখন আবার অ্যা অ্যা শব্দ করতে করতে বাবার সামনে শুয়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে।

এর কিছুদিন পর বাবা-মা দুই জনের জ্বর, তারা একরুমে আমরা আরেক রুমে। আমাদের কোভিড শুনে কাজের মেয়েটা কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এমন একটা সময় আত্মীয়-স্বজন কাউকে কাছে ডাকা যায় না।

আমরা দুই বোন আর ডোডোকে নিয়ে বাবা-মা দুজনেই চিন্তিত। ডোডোকে যতটা সম্ভব আমাদের কাছে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু সে কিছু সময় পরপর বাবা মাকে গিয়ে দেখে আসে। বাবার জ্বর বেশি না হলেও খুব কাশি, মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্ট। একদিন বাবা বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন, মা আছেন পাশের সোফায়। বাবা ভীষণ কাশছেন, হঠাৎ দেখি ডোডো দৌড়ে গিয়ে বাবার বুকের ওপর দুই পা দিয়ে চেপে ধরে আছে, আর অ্যা অ্যা অদ্ভুত শব্দ করছে। বুক চেপে ধরার কারণ বুঝতে পারি কিন্তু অ্যা অ্যা শব্দের কী কারণ বুঝতে পারি না।

তার এই কাণ্ড দেখে আমরা সবাই অবাক। কিছুক্ষণ পরে মা ইচ্ছা করে কাশতে থাকেন ডোডো কী করে দেখার জন্য। কাশির শব্দ শুনে ডোডো ঠিকই দৌড়ে এলো, তবে মাকে ভ্রূ কুঁচকে দেখে নিয়ে ধমকের সুরে ভুক ভুক শব্দ করে দৌড়ে চলে যায়। এর মানে হচ্ছে, তুমি মিথ্যামিথ্যি কাশছ কেন?

ডোডো আমাদের দু'বোনের মারামারি ঝগড়াঝাঁটি একেবারে পছন্দ করে না। কোনো কারণে ঝাগড়া বা মারামারি লাগলে সে প্রথমে মার সামনে গিয়ে গলা ফুলিয়ে ভুগ ভুগ করে আর কাপড় কামড়ে টেনে টেনে আমাদের কাছে নেয়ার চেষ্টা করে। এতে মা কোনো সাড়া না দিলে দৌড়ে একবার মায়ের সামনে আসে আর একবার আমাদের কাছে আসে, শেষে মাকে ধমকের সুরে ভুকতে থাকে। এর মাধ্যমে সে মাকে বোঝাতে চায় বোনেরা ঝগড়া করছে তুমি কিছু বলছ না কেন?

তারপর মা যখন বলেন, ‘দেখতো ডোডো বোনেরা ঝগড়া করছে কেন?’ সে দৌড়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে কে আসল দোষী, মানে কে মার দিচ্ছে। যে মার দিচ্ছে তাকে গিয়ে কামড়ে ধরে। কোনো কোনো সময় বুঝতে পরে না কে দোষী, তখন সে আমাদের দুজনকেই সমানে কামড়াতে থাকে।

সবচেয়ে মজার কাণ্ডটা করে বাবার সঙ্গে। বাবা তাকে বকাবকি করলে সে চুপ করে শুনে, একটা সময় পর সে জোরে জোরে ভুকে, ভুকতে ভুকতে দৌড়ে এসে বাবার ঘাড়ে কামড়ে ধরে, যতক্ষণ না বাবা মেঝেতে শুইয়ে পড়ে ততক্ষণ কামড়ে ধরে। তার এই আচরণের মানে হচ্ছে তুমি আমাকে বকা দিচ্ছ কেন?

সত্যি সত্যি তার ওপর বাবা কখনো রাগ করলে সে সেটা বুঝতে পারে এবং খাটের নিচে বা সোফার নিচে লুকিয়ে যায়, পিটপিট চোখে বাবার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করত। বাবার রাগ কমলে পর বেরিয়ে আসে।

বাবা দেশি কৈ মাছ পছন্দ করেন। বাসায় একদিন দেশি কৈ মাছ রান্না হয়, কৈ মাছ ভাজি হচ্ছে লাল লাল করে, লাউ দিয়ে কৈ মাছ। কৈ মাছ ভাজার পর ডাডো মার পিছ ছাড়ে না। তাকে দুধ দিয়ে ভাত দেয়া হয়, সে না খেয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে মুখ তুলে গন্ধ শোঁকে।

মা বাবাকে বলেন, ‘দেখ না, কৈ মাছ ভাজার পর থেকে আমার পিছ ছাড়ছে না, দুধ ভাতও খায়নি।’

‘ও কৈ মাছ খাবে, ওকে মাছ দিয়ে একটু ভাত মেখে দাও।’

বাবা বলেন, ‘ডোডোকে কৈ মাছ দিয়ে ভাত মেখে দিতে পারি এক শর্তে তোমার বরাদ্দের মাছ দিতে পারবে না, তার জন্য একটা ভাজতে হবে।’

কৈ মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে ডোডো মার পায়ের কাছে শুয়ে থাকে।

ডোডোর একটা সুন্দর পানির পাত্র আছে, ওটাতেই সে পানি খায়। এই পানি সরবরাহের দায়িত্ব রুপুর। পানির দরকার হলে সে রুপুর কাছেই চায়। পানির খালি পাত্রটা মুখে নিয়ে দৌড়ে রুপুর কাছে চলে যায়, অন্য কেউ পানি দিতে গেলে সে তেড়ে আসে।

তেরো
‘মা, শুনেছি নানা ভাইয়ের লেখা একটা কবিতার খাতা আছে। নানা ভাই কবিতাগুলো কখন লিখেছেন?’

‘তোর নানা ভাই কলেজে পড়ানোর সময় লিখেছেন, বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে, কলেজ ছাড়ার পর আর লেখেননি।’

‘নানা ভাই কি কবি?’

‘এই কথা তোর নানা ভাইকে জিজ্ঞেস করিস।’

‘নানা ভাই তো ডাক্তার দেখাতে আসবেন। তুমি নানা ভাইকে বলে দাও না কবিতার খাতাটা নিয়ে আসতে।’

‘আমি বললে নাও শুনতে পারে, তুই চিঠি লিখে বল, তা হলে কাজ হবে।’

দীপু তার নানা ভাইয়ের কাছে চিঠি লেখে।

নানা ভাই
নমস্কার

কয়েক দিন আগে আমরা রাত জেগে একটা ছবি দেখেছি, জাপানি ছবি, ছবিটার নাম হাসিকো। আমি রুপু মা ডোডো সবাই দেখি। ডোডো অবশ্য কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ে। ছবিটা দেখে খুব মজা পেয়েছি। তুমি এলে তোমাকে ছবিটা দেখাব। ছবির স্টোরি আগে থেকে বলে দিলে ছবির মজা থাকে না। এই ছবির স্টোরি বললেও মজা পাবে।

রুপুর তোমাকে চিঠি লেখার কথা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে লিখতে হচ্ছে। কেন লেখেনি সেটা আমি জানি, ওর প্রচুর বানান ভুল হয় সেজন্য লেখেনি। তুমি এলে ওকে আচ্ছামতো বেইজ্জত করবা। তুমি তো বেইজ্জত করার ওস্তাদ।

ডোডো আমাদের চারজনের বাইরে কাউকে গ্রহণ করতে পারে না। অবশ্য করোনার কারণে কেউ বাসায় আসেও না।

এই প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা বলি, কয়েকটা আঙ্কেল পুজার চাঁদা নিতে বাসায় এসেছিল, ডেডো এমন ভুকতে লাগলো, আংকেলরা ভয় পেয়ে দৌড়ে চলে যায়, চাঁদার জন্য আর আসেনি।

ডোডো তোমার সঙ্গে কী আচরণ করে এই নিয়ে মা বাবা চিন্তিত, আমার ধারণা তোমার সঙ্গে ভালো আচরণ করবে।

ভালো কথা, মা বলেছে তোমার নাকি একটা কবিতার খাতা আছে, যক্ষের ধনের মতো সেটি আগলে রেখেছ। মনে করে কবিতার খাতাটা নিয়ে আসবা। বাবাকে বলে তোমার কবিতার বই ছাপানোর ব্যবস্থা করে দেব।

পুনশ্চ: নানির সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি কি আগের মতোই করছে, নাকি ছেড়ে দিয়েছ?

ইতি
দীপু।

চৌদ্দ
দীপু রুপুর নানা ভাই বাইপাসের রোগী, ডোডো তার সঙ্গে কী আচরণ করে এই নিয়ে চিন্তিত শ্যামলী। ডোডো চারজনের বাইরে কাউকে অ্যালাউ করে না।

একবাটি পায়েস খেয়ে ডোডো খুশিতে লেজ নাড়ে। শ্যামলী এই সময় ডোডোর মাথায় হাত রেখে বলে, ‘তোমার নানা আসছেন কাল, নানার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো না, তুমি ভদ্র বাচ্চা না, নানা ডাক্তার দেখিয়ে চলে যাবেন।’

ডোডো মাথা নাড়ে, আর চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে। তার এই অভিব্যক্তির মানে হচ্ছে চিন্তার কিছু নেই।

রুপু তখন বলে, ‘মা, কেবল তুমি বললে হবে না, শয়তানটা এখন বাবার ভক্ত, বাবাকে দিয়ে বলাতে হবে।’

‘তুই ঠিকই বলেছিস, তোর বাবা আসুক রাতে তোর বাবাকে দিয়ে বুঝিয়ে বলাতে হবে।’

দীপু রুপুর নানা ভাই বাথরুমে গেলে সে বাথরুমের বাইরে বসে থাকে। ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলে পায়ের কাছে বসে থাকে, রাতে ঘুমানোর সময় মাথার কাছে মেঝেতে শুয়ে থাকে, রাতে যতবার বাথরুমে যায় ততোবার সে পিছে পিছে যায়।

তাদের নানা ভাই ডোডোকে ডাকে ‘ভাই আমার’ বলে, ‘তুই আমার পিছে পিছে থাকিস না ভাই।’

শ্যামলীকে ডেকে বলে, ‘দেখছিস মা, তোরা তো ভয় পাইছিস, ডোডো আমার সঙ্গে কত ভালো ব্যবহার করছে।’

‘সত্যি, আমরা ভাবতেও পারিনি যে সে এতটাই ভালো ব্যবহার করবে।’

‘তবে সমস্যা হচ্ছে বেশি ভালো ব্যবহার করছে।’

এক সন্ধ্যায় নাস্তা করার পর দীপু রুপুর নানা ভাই সোফায় বসে টিভি দেখে, ডোডো পায়ের কাছে বসে আছে। দুজনেরই কোনো সাড়াশব্দ নেই। শ্যামলী উঁকি দিয়ে দেখে ডোডো কুট কুট শব্দ করে কী যেন খাচ্ছে।

‘বাবা, ডোডো কী খাচ্ছে?’

‘ভাই আমার সুপারি খাচ্ছে।’

‘তুমি ছেলেটাকে সুপারি দিলে কেন?’

‘ও খাইতে চাইল, দিলাম। দেখ না ভাই আমার কী সুন্দর করে খাচ্ছে।’

‘খাইতে চাইল, আর তুমি দিলা, কয়দিন পর কী পান বিড়ি খাওয়াবে?’

‘হা হা হা, খেতে চাইলে খাওয়াব।’

‘রুপু ভাই তুমি নাকি বানান ভুল করো, তোমার কি যুক্তবর্ণে সমস্যা? যুক্তবর্ণে সমস্যা কোনো সমস্যাই না। ’

‘তোমাকে কে বলেছে, ওই শাকচুন্নি বলেছে, ও যে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে তুমি সেটা জানো না?’

‘একেবারে তোমার নানির মতো তাই না ভাই?’

‘এরমধ্যে নানিকে টেনে আনছ কেন? শোনো, যুক্ত বর্ণ যুগ্ম বর্ণে আমার ভুল হয় না, তুমি পরীক্ষা করে দেখতে পারো। আমি বাংলা বই এনে দিচ্ছি, তোমার যে পৃষ্ঠা থেকে ইচ্ছা ধরতে পার।’

যুক্তবর্ণ যুগ্ম বর্ণের পরীক্ষায় রুপু পাস।

‘এবার তুমি ওই শাকচুন্নিকে ডেকে আচ্চা মতো বেইজ্জত করো।’

এই সময় দীপু দৌড়ে এসে বলে, ‘দেখছো নানা ভাই একটা বানানও পারে না। ’

‘তুই কী বলিস, রুপু ভাই তো সব কয়টা বানানই পেরেছে।’

‘এটা কী করে হলো, নিশ্চয় তোমার চোখ ফাঁকি দিয়ে টুকলি করেছে।’

‘এটা কী বলিস, রুপু ভাই কি টুকলি করার মেয়ে?’

‘তা হলে কী করে পারলো?’

রুপু দৌড়ে এসে বলে, ‘ম্যাজিক, একে বলে ম্যাজিক। নানা ভাই, দেখেছ ও কতটা বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে!’

শ্যামলী এসে বলে, ‘রুপু যে, ভোরে উঠে গত একসপ্তাহ দুই ঘণ্টা পড়েছে তুই তা দেখবি কী করে, তুই তো ঘুমে বিভোর থাকিস’

পনেরো
সোফায় পাশাপাশি দুই বোন রুখসানা, রুমানা; সামনের সোফায় শ্যামলী, সাল্লু বসেছে একটু দূরে ফ্লোরে। রুখসানা রুমানার পরিবারের অর্ধেক সদস্য থাকে আমেরিকা। তারা দুই বোনও যাওয়ার চেষ্টায় আছে। হঠাৎ বাড়িওয়ালিদের জরুরি তলবের কারণ কী হতে পারে, তিন মাসের ভাড়া বকেয় আছে, এই বিষয়ে তো কথা ফাইনাল হয়ে আছে। এখন থেকে মাসের ভাড়া মাসে দেয়া হবে, পুরানো বকেয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দেখা যাবে।

‘দিদি, একটা জরুরি কথা বলার জন্য আপনাকে ডেকেছি, কথাটা বলতে খারাপ লাগছে, তবু বলতে হচ্ছে।’

‘বলেন, অসুবিধা কী।’

‘বলছি, ছাদ থেকে সবগুলো গাছ সরিয়ে নিতে হবে। আমরা ছাদে কোনো গাছ রাখতে দেবো না, ছাদে গাছ রাখলে বিল্ডিংয়ের ক্ষতি হয়।’

শ্যামলী যেন আকাশ থেকে পড়ে। ‘আপনারা কী বলছেন বুঝতে পারছি না।’

রুখসানার কথা কেড়ে নিয়ে রুমানা বলে, ‘না বুঝার কিছু নাই, ছাদ থেকে সবগুলো গাছ সরিয়ে নিতে হবে। আমাদের ক্ষতি করে তো আপনার শখ পূরণ করতে দিতে পারি না।’

পাশ থেকে দাঁত সব বের করে সাল্লু বলে, ‘বিল্ডিংয়ের অনেক ক্ষতি। ড্যাম হয়ে যায়।’

শ্যামলী কিছু সময় কোনো কথা বলতে পারে না।

‘এইসব কী বলছেন আপনারা! রুখসানা আপা, আপনি নিজেই তো আমাকে গাছ লাগাতে অনুমতি দিয়েছেন, দেননি, সত্যি করে বলেন দেননি?’

রুমানা রুখসানার দিকে তাকিয়ে চোখে কী যেন ইশারা করে।

‘তখন বলেছি গাছ লাগাতে, এখন বলছি সরিয়ে নিতে, ব্যস সরিয়ে নেবেন। এত কথার তো দরকার নাই। এ সপ্তাহের মধ্যে ছাদ খালি করে দেবেন। আর বাসার মধ্যে কুকুর পালতে পারবেন না। কুকুর খেদানোর জন্যও এক সপ্তাহ সময় দেয়া হলো, না হলে তিনমাসের বকেয়া ভাড়া দিয়ে বাসা ছেড়ে দেন।’

‘তিন মাসের ভাড়া বকেয়া আছে সেই বিষয়ে তো আপনাদের সঙ্গে আমার হাসব্যান্ড কথা বলে সেটেল করেছে, আর কুকুরের বাচ্চার বিষয়েও কথা বলেছে, বাচ্চাটাকে কয়েক দিনের মধ্যে একজন নিয়ে যাবে।’

‘বাসাভাড়া নিয়ে তো কিছু বলছি না, আর কুকুরের বাচ্চাও সরিয়ে দেবে আপনার হাজবেন্ড বলেছেন, সমস্যা হচ্ছে গাছ নিয়ে, ছাদে কোনো গাছ রাখা যাবে না, কেবল তাই না, ছাদে কেউ উঠতেও পারবে না।’

‘ঢাকা শহরে সবাই ছাদে গাছ লাগাচ্ছে, আর আপনি আমার লাগানো গাছ সরিয়ে ফেলতে বলছেন, এট কেমন কথা? আর এতগুলো গাছ হঠাৎ করে কে নেবে?’

‘ছাদে গাছ থাকবে না এটাই ফাইনাল, আর অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে লাভ নাই। আমাদের বিল্ডিং আমরা কী করবো সেটা আমাদের বিষয়।’

সাল্লু এ সময় বলে, ‘নার্সারিকে দিয়ে দেন, এটাই ভালো হবে।’

শ্যামলী সাল্লুর দিকে তাকালে রুখসানা বলে, ‘সাল্লু তুমি থামো। ওনারা গাছ নার্সারিকে দেবেন না কাকে দেবেন সেটা ওনাদের ব্যাপার। তাহলে এটাই ফাইনাল।’

‘এই সাল্লু, একটা নতুন তালা কিনে আনবা। এক সপ্তাহ পর ছাদে নতুন তালা লাগিয়ে দেবে, মনে থাকবে?’

সাল্লু এমনভাবে হাসে যেন দাঁতগুলো এক্ষুনি খুলে পড়ে যাবে।

‘মনে থাকবে আপা, তালা আমি আগেই কিনে এনেছি।’

ষোলো
বিকেল হতেই ডোডো ছাদে যাওয়ার জন্য ছটফট করে। কিন্তু ছাদে যাওয়া বন্ধ। সারাক্ষণ ঘরে থেকে থেকে ডোডো বিরক্ত, বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে গলা লম্বা করে কেবল ভুকতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ডোডোকে কোথাও রেখে আসার কোনো বিকল্প নেই।

ডোডোকে রাখার একজনই আছে, তার আল-আমিন মামা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্যামলী জানতে পারে তার পরিবারের সবাই অসুস্থ, করোনা হতে পারে। তবু সে বলেছে তারা সুস্থ হয়ে ডোডোকে নিয়ে যাবে।

শ্যামলী সুকান্তকে বলে, ‘তুমি একটা কাজ করো, রাজার বাগের দিকে তোমার চেনাজানা কারো কাছে কিছু দিনের জন্য ডোডোকে রাখা যায় কিনা দেখ। কয়দিন পরতো বাসা পাল্টে ফেলব, তখন নিয়ে আসব।’

কয়েকদিন থেকে শ্যামলীর চেহারা বিমর্ষ, খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো করে না।

‘তোমাকে একটা কাজ দিয়েছি, তুমি কাজটা করছ না।’                           

‘ডোডোর ব্যবস্থা হয়ে গেছে, রাজারবাগের মাটিকাটা রোডে আমার এক বন্ধুর বাড়ি আছে। সেখানে বন্ধুর এক খালা থাকেন, রিজিয়া খালা- উনি বাসায় বেড়াল পোষেন। রিজিয়া খালার কাছে ডোডোকে কিছুদিন রাখা যাবে। কাল তোমাকে ওনার কাছে নিয়ে যাব।’

রিজিয়া খালার কাছে ডোডোকে দিয়ে এসে সুকান্ত আবার খামারে চলে যায়। দুই তিন দিন পর শ্যামলী দীপু রুপুকে নিয়ে ডোডোকে দেখতে যায়, গিয়ে দেখে ওই মহিলার ঘরের সামনে এক কোণে ডোডো শুয়ে আছে, সারা শরীরে ময়লা, এখানে ওখানে আঘাতের চিহ্ন।

ওই মহিলা বলে, ‘তোমরা যে খাইয়ে গেলে তার পর ডোডো আর কিছুই খায়নি, কত চেষ্টা করলাম সে কিছুতেই খাবে না। আর এখান থেকে বের হতেও পারেনি, যাতো বারই বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে ততোবার বাইরের কুকুরগুলো তার ওপর হামলে পড়েছে।’

দীপু রুপুকে সঙ্গে নিয়ে একদিন পরপর শ্যামলী ডোডোকে খাবার দিয়ে আসে। প্রতিবারই ডোডো আসার জন্য বায়না ধরে। কোনো কোনো দিন রিকশায় উঠে বসে থাকে, কোনো কোনো দিন তাদের আগে আগে হাঁটতে থাকে।

রিজিয়া খালা একদিন শ্যামলীকে ডেকে বলে, ‘শোনো মা, আমার কাছে আছে থাক, কিন্তু আজ হোক কাল হোক তোমরা ডোডোকে তোমাদের কাছে নিয়ে যেও, ও তোমাদের ছাড়া বাঁচতে পারবে না।’

রিজিয়া খালার বিল্ডিংয়ের সামনে একটু খালি জায়গা, সেখানে বিকেল হলে কয়েকটা ছেলে ক্রিকেট খেলে। ডোডোকে খাইয়ে শ্যামলী দাঁড়িয়ে ছেলেগুলোর খেলা দেখে, তাদের মধ্যে বড় ছেলেটাকে ডাকে। ব্যাট ফেলে দৌড়ে এসে ছেলেটা বলে, ‘আন্টি আমাকে ডেকেছেন?’

‘তোমাকে ডেকেছি বাবা, তোমার নাম কী, তোমার বাসা থোকায়?’

‘আমার নাম সবুজ, ওই যে টিনের ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে সেখানে আমাদের বাসা।’

‘এই বিল্ডিংয়ের নিচে একটা সাদা কুকুর দেখেছ, ওটা আমার কুকুর। ওর নাম ডোডো। কয়েক দিনের জন্য রেখেছি, পরে নিয়ে যাব, তুমি বাবা ওকে দেখেছ?’

‘ওটা আপনার কুকুর আন্টি, কুকুরটা খুব সুন্দর। কিন্তু ও তো বের হতে পারে না। এখানকার কুকুরগুলো বের হলেই মারে। দুইটা কুকুর আছে ডেঞ্জারাস।’

শ্যামলী ব্যাগ থেকে বিস্কুট বের করে সবুজের হাতে দিয়ে বলে, ‘তুমি খাও আর তোমার বন্ধুদের দাও। তুমি বাবা ডোডোকে দেখে রেখ, আমি একদিন পরপর আসি, তখন তোমার সঙ্গে দেখা হবে।’

সবুজ তার বন্ধুদের ডাকে।

‘শোনো, ওই যে সাদা কুকুরটা দেখছস, ওটা আন্টির কুকুর। ওটাকে কেউ যেন না মারে। আন্টি, আপনি চিন্তা কইরেন না, আমরা দেখে রাখবো।’

মাটিকাটা রোড হয়ে ব্যাংক কলোনিতে আসতেই হাতের ডানে একটা পুকুর পড়ে, তার উলটো দিকে সদ্য ওঠা চারতলা বিল্ডিং। ডোডোকে খাইয়ে ফেরার পথে শ্যামলী দেখে বিল্ডিংয়ের নিচে গ্যারেজে একটা ছেলে তিনটা কুকুর ছানাকে খাওয়াচ্ছে। শ্যামলী থামে, ছেলেটাকে কাছে ডাকে, ‘তোমার নাম কী?’

‘শরীফ, আন্টি।’

‘তুমি কোন ক্লাসে পড়ো? সবুজকে চিনো?’

‘ক্লাস এইটে। সবুজ আমার সঙ্গে পড়ে। ওরা গরিব, ওই টিনের ঘরে থাকে।’

‘তুমি দেখছি কুকুর ভালোবাসো। মাটিকাটা রোডে গোলাপি রঙের দ্বোতলা বিল্ডিংটা আছে না, তার নিচে আমার একটা কুকুর থাকে, ওর নাম ডোডো। ওকে দেখেছ বাবা?’

‘সাদা করে কুকুরটা, নতুন এসেছে, ওটা আপনার কুকুর! ঠিক আছে আন্টি আমি দেখে রাখব। এই পাড়ায় কানকাটা আর লেজকাটা দুইটা কুকুর আছে, ভয়ংকর। ওরা অন্য সব কুকুরকে মারে।’

কয়েক দিন পর শ্যামলী ডোডোকে খাওয়ানোর পর সবুজকে খোঁজে, হঠাৎ মাটিকাটা রোড থেকে সবুজ হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে আসে, তার সঙ্গে রোগা লিকলিকে আর একটা ছেলে। শ্যামলীর হাত ধরে টানতে টানতে তাদের বাসার সামনে নিয়ে গিয়ে বলে, ‘আন্টি একটা কথা আছে, একটা কথা আছ।’

‘তুমি বাবা আগে শান্ত হও।’

‘ওই বাড়িওয়ালার ছেলে শরীফকে বলেছেন ডোডোকে দেখে রাখতে, শরীফ একটা খারাপ ছেলে।’

‘ও না বাবা স্কুলে পড়ে!’

‘স্কুলে পড়লে কী হবে, ও কতটা খারাপ আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।’

‘সে কী খারাপ কাজ করেছে।’

‘বিভিন্ন জায়গা থেকে কুকুরের বাচ্চা ধরে এনে কিছুদিন রাখে, তারপর কোনোটার লেজ কেটে দেয়, কোনোটার কান কেটে দেয়, কোনোটাকে ল্যাংড়া করে দেয়- এটাই তার নেশা। তার সঙ্গে আরো কয়েকটা চেলাবেলা আছে।’

‘সবুজ, তুই কি বলিস এসব? এ তো কিশোর অপরাধী, ওর বাপ মা কিছু বলে না?’

তাদের কথা শুনে কয়েকজন মহিলা এগিয়ে আসে, এদের মধ্যে সবুজের মাও আছে।

‘এরা ডোডোর লেজ কেটে দেয়ার পরিকল্পনা করেছে, যে কোনো দিন ডোডোর লেজ কেটে দেবে।’

‘তুই কী করে জানলি?’

‘আমার বন্ধু ঝন্টু বলেছে, কী রে ঝন্টু আন্টিকে ঘটনা বল।’

‘সত্য আন্টি, শরীফ বলেছে একদিন ডোডোর লেজ কেটে দেবে।’

‘তোরা চিন্তা করিস না বাবা, তোদের আঙ্কেলকে দিয়ে ওর বাপ-মাকে বলাব, তাতে কাজ না হলে পুলিশকে জানাব, তখন বুঝবে ঠেলা।’

‘ডোডোর যদি লেজ কেটে দেয়!’

‘ডোডোর লেজ কেটে দেয়া অত সহজ না, তার আগেই দেখিস ওর হাত ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে।’

মহিলারা হেসে ওঠে, সবুজের মা এগিয়ে এসে বলে, ‘সত্যি দিদি শরীফ ছেলেটা খুব খারাপ। বাপে ছোট চাকরি করে, দেখেন না ঘুষ খেয়ে চার তলা বাড়ি করেছে, তার ছেলে আর কত ভালো হবে।’

দুই দিন পর বিকেল বেলা, দীপু, রুপুকে নিয়ে শ্যামলী ডোডোর জন্য খাবার নিয়ে যায়, ডোডোকে খাইয়ে ফিরে আসবে এমন সময় সবুজ চিৎকার দিয়ে ডাকে ‘আন্টি আন্টি, দাঁড়ান, দাঁড়ান। সবুজের সঙ্গে সঙ্গে তার মা খালা এবং আশপাশের কয়েকজন মহিলাও এগিয়ে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগে সবুজ শ্যামলীকে জড়িয়ে ধরে, ‘আন্টি আপনার মধ্যে কিছু একটা আছে। আপনি মানুষ না।’

শ্যামলী সবুজকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘দেখেন তো সবুজ কি পাগল হয়ে গেছে? ও কী বলে এসব?’

মহিলারা মুখ টিপে হাসে। সবুজের আম্মা বলে, ‘দিদি, আপনি বলেছেন না ডাডোর লেজ কাটতে গেলে শরীফের হাত ভেঙে যাবে, ঘটনা ঘটছেও তাই। ডোডোকে খাবারের লোভ দেখিয়ে চারতলার ছাদে নিয়ে যায় লেজ কাটার জন্য, তারপর কী নিয়ে চেলাগুলোর সঙ্গে ঝগড়া লাগে, এক চেলা স্টাম্প দিয়ে হাতে এমন জোরে বাড়ি দেয় শরীফের ডান হাত ভেঙে দুই ভাগ হয়ে যায়।’

‘ওই ছেলে এখন কই?’

‘পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি আছে।’

‘আমার ছেলেটা আপনাকে খুব ভালোবাসে, আপনি যে লাল জামাটা দিয়েছেন সেটাই সারাদিন পরে থাকে। আপনি ছেলেটার জন্য দোয়া করবেন।’

‘ঝন্টুকে দেখি না কেন বাবা, ঝন্টু কই?’

‘ঝন্টু আজ সকালে নানার বাড়ি গেছে আন্টি।’

সতেরো
সকাল সকাল যে এত ভালো খবর পাবে ভাবতে পরেনি শ্যামলী। বিছানা ছেড়ে উঠবে উঠবে এমন সময় কল। শ্যামলী স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে আল-আমিনের কল। কোনো ভূমিকা ছাড়াই আল-আমিন বলে, ‘আপা কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি।’

‘বলেন ভাই।’

‘আমরা সবাই এখন সুস্থ, ডোডোকে যদি নিয়ে আসতে চাই দেবেন?’

‘দেবো না কেন, ডোডো আপনার কাছে থাকলে ভালো থাকবে।’

‘আপনি নিয়ে যাবেন, নাকি আমরা নিয়ে আসব?’

‘আমি নিজেই নিয়ে আসতে পারি, কিন্তু ডোডোর ছুতায় আপনি যদি এই গরিব ভাইয়ের বাড়িতে একবেলা ডাল-ভাত খান খুব খুশি হব, আমার স্ত্রীও খুশি হবে, আমার মেয়ে দুইটাকেও দেখে গেলেন।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে আমরা নিয়ে আসব, আপনার ভাই ঢাকা এলে আমরা আসব।’

শরীরে ঘাম দিয়ে জ্বর ছুটে গেলে যেমন হালকা অনুভূত হয়, ঠিক সেরকমই হালকা অনুভব হয় শ্যামলীর। ডোডোকে নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় ছিল সে। প্রতিদিন এতো দূর গিয়ে খাবার দিয়ে আসা সম্ভব নয়, আর ওখানে তার থাকাও নিরাপদ নয়, কুকুরগুলো কোনোভাবেই তাকে মেনে নিতে পারছে না। এই প্রথম বুঝতে পারে প্রতিটা এরিয়া একদল কুকুরের দখলে থাকে, নতুন করে অন্য কুকুরের ওই এলাকায় প্রবেশ কঠিন। এর মধ্যে বাসা বদল করাও সম্ভব হয়নি। মেঘ না চাইতে জল, আপাতত ডোডোর একটা হিল্লে হলো।

সকাল ছয়টায় রওয়ানা হলেও সিএনজি করে অলিগলি হয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় আল-আমিনের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে এগারোটা হয়ে গেছে। পুরো সময় ডোডো শুয়ে শুয়ে বাইরের দৃশ্য দেখেছে, কোনো সমস্যা করেনি।

আল-আমিনের বাড়িটা সুন্দর, টিনশেটের ঘরের পিছনে কুকুর, সামনে উঠান, নানা গাছপালায় ভরা পুরো বাড়ি। আল-আমিন দেখতে পোলাপান মানুষ, তার বউকে আরো পোলাপান দেখায়। আল-আমিন ফুটফুটে দুই মেয়ে, পিঠাপিঠি বয়স, একটার নাম আসমা, অন্যটা আমিনা। ডোডো সিএনজি থেকে নেমে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর দৌড়ে গিয়ে আল-আমিনকে শুঁকে, এরপর লেজ নাড়াতে নাড়োতে আসমা-আমিনার সঙ্গে খেলতে থাকে।

শ্যামলী বলে, ‘দেখো দেখো কত সুন্দরভাবে খেলছে, মনে হয় কত দিনের চেনা। বাচ্চা বাচ্চার সঙ্গে খেলবে এটাই স্বাভাবিক, এর সৌন্দর্যই আলাদা।’

সবাই পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখে, গাছের গুঁড়ির তৈরি পুকুরের ঘাটের একপাশে চালতা গাছ এমনভাবে নুয়ে আছে যেন একবুক তৃষ্ণা নিয়ে পানির দিকে সবগুলো পাতা তাকিয়ে আছে। ঘাটের অপর পাশে গোলাপি জবা ফুটে আছে। তার পরে আছে ডুমুর গাছ। দীপু পানিতে পা ডুবিয়ে গাছের গুঁড়িতে বসে থাকে, রুপু আসমা আমেনা আর ডোডোকে নিয়ে ব্যস্ত।

‘আল-আমিন পুকুর পাড়ে কয়েকটা হিজল গাছ লাগাবে, পানির কাছে ঘেঁষে লাগালেও হবে, হিজল গাছ বুক পরিমাণ পানিতে দিব্যি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। হিজলের ফুল যখন পানিতে পড়ে তখন ঘুরতে থাকে, সেই এক সৌন্দর্য’

সুকান্তের কথা শেষ হতেই শ্যামলী বলে, ‘হিজল গাছে কোনো আয় ইনকাম আছে? নাই, তুমি আল-আমিনকে এমন বুদ্ধি দাও যাতে তার কয়টা টাকা আয় হয়।’

‘কেবল টাকা পায়সা হলেই হবে, সৌন্দর্যর দরকার আছে, কী বলো আল-আমিন?’

‘জি, সৌন্দর্যরও দরকার আছে।’

পিছনে দাঁড়ান শিরিনও বলে ওঠে, ‘ভাইজান ঠিকই বলেছেন, সৌন্দর্যরও দরকার আছে।’

‘ওরে বাবা, সবাই দেখছি ভাইয়ের পেয়াদা হয়ে বসে আছে।’

‘দীপু বলোত জবাফুলের গাছের পরে ওটা কী গাছ?’

‘কেন বাবা, ওটা ডুমুর গাছ।’

‘তুমি যে এই গাছের নাম জানবে আমি ভাবিনি।’

‘ডুমুরের ফুল কেন বলে এটাও জানি, আসলে ডুমুরের ফুল হয়, ওই ফুল ফলের মধ্যে থাকে বলে দেখা যায় না।’

দুপুরে খাবার টেবিলে এলাহি কাণ্ড; ছোট মাছের চচ্চরি, শুঁটকি ভর্তা, কাতল মাছ, দেশি মোরগ- আরো কত কী।

‘শিরিন, তুমি এত রান্না করতে গেলে কেন?’

‘ভাইজান ছোটো মাছ আর শুঁটকি পছন্দ করেন...’

‘ভাইজান ছোটো মাছ আর শুঁটকি ভর্তা পছন্দ করে তোমাকে এই কথা কে বলেছে?’ ‘কেউ বলেনি দিদি, আপনার ভাই ফেসবুকে আপনার সঙ্গে আছে। আপনি কোনো একটা পোস্টে আপনাদের পছন্দের খাবারের কথা লিখেছেন। সেটা দেখে আপনার ভাই জেনেছে; আপনি যে কাতল মাছ পছন্দ করেন তাও আমরা জেনেছি।’

‘এখন সময় খারাপ, সামনে কী অপেক্ষা করছে জানি না, এতগুলো টাকা খরচা করা তোমাদের ঠিক হয়নি।’

আল-আমিনের বাসায় খেয়ে সোনারগাঁও জাদুঘর ঘুরে, শীতলক্ষ্যা নদীতে ভ্রমণ করে ঢাকায় ফেরে সবাই। আসার সময় শিরিন শ্যামলীর কাছে এসে বলে, ‘দিদি দোয়া কইরেন, আমাদের যেন একটা ছেলে সন্তান হয়।’

‘ছেলে হবে, তুমি চিন্তা করো না, ওই যে একটা ছেলে দিয়ে গেলাম, দেখবা দেখতে দেখতে ছেলে এসে যাবে।’

দীপু আর রুপু মন খারাপ করে আছে, রুপু মাঝেমাঝে চোখ মোছে। তাদের স্বাভাবিক করার জন্য সুকান্ত বলে, ‘ডোডোকে ছাড়া থাকতে আমাদের কষ্ট হলেও সে অন্তত ভালো জায়গায় আছে, নিরাপদে আছে। সবচেয়ে বড় কথা তার মামার বাড়ি আছে।’

এরমধ্যে দেখতে দেখতে একমাস চলে যায়, শ্যামলী ডোডোকে দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। কয়েকবার পিছানোর পর সবাই আবার আল-আমিনের বাড়ি যায়। ডোডোর জন্য শ্যামলী কৈ মাছ ভাজি করে, ফালুদা বানায়। ডোডো সবাইকে একসঙ্গে পেয়ে মহাখুশি। সবই ঠিকঠাক ছিল, বিপত্তিটা বাধে সবাই যখন রওয়ানা দেবে ঠিক সে সময়। ডোডো কিছুতেই দীপু রুপুকে ছাড়ে না, সে দৌড়ে সিএনজিতে উঠে বসে থাকে, অনেক চেষ্টা করেও তাকে নামানো যায় না। তার এই অবস্থা দেখে দীপু চুপিচুপি রুপুকে বলে সে যেন তাদের বাবাকে কনভিন্স করে ডোডোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রুপু যথারীতি মেঝেতে পা মেলে বসে কান্না শুরু করে, ডোডোকে ছাড়া সে বাসায় যাবে না।

সুকান্ত চরম বিরক্তি নিয়ে শ্যামলীর দিকে তাকায়, মনে হচ্ছে শ্যামলী গুরুতর অপরাধ করে ফেলেছে।

‘তুমি অমন কটমট করে আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন, মনে হয় মেয়েকে আমি শিখিয়ে দিয়েছি।’

শ্যামলী বলে, ‘আমাদের এখন বড় বাসা, বাসার নিচে গ্যারেজে ডোডো থাকতে পারবে।’

অগত্যা ডোডোকে নিয়ে আসতে সম্মত হয় সুকান্ত।

আঠারো
অনেক অনেক দিন পর দীপু রুপুর স্কুল খুলতে যাচ্ছে। আহা কী আনন্দ, কত কতদিন পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে। কত গল্প জমা হয়ে আছে। দীপু রুপু এই খুশিতে যেন বাতাসে উড়ছে। একসময় স্কুলের কথা শুনলে রুপু মুখ গোমড়া করে রাখত, আজ সেই বেশি উৎফুল্ল।

নতুন করে সুকান্ত আবার খামার চালু করে। সপ্তাহে একবার বাসায় আসে সে, পুরো সময়টা ডোডো মন খারাপ করে থাকে, বাইরে যাওয়ার জন্য ছটফট করে। বিকেল থেকে রাত অব্দি বারান্দায় বসে রাস্তার দিকে মনমরা হয়ে তাকিয়ে থাকে সুকান্তের পথ চেয়ে, খাওয়া দাওয়াও ঠিকমতো করে না। রাস্তায় সুকান্তের মতো কাউকে দেখলে ভুকতে থাকে।

এক সন্ধ্যায় সবাই চা খায়। সুকান্ত কী যেন একটা বই পড়ে।

‘তুমি না থাকলে ডোডো অস্থির করে, ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করে না, আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে বলে, আমি সামলাতে পারবো না। তার বোনদেরও খুব বিরক্ত করে। স্কুল খুলে যাচ্ছে, স্কুল খুলে গেলে একদিনের জন্যও নড়া যাবে না। ওদের পড়ালেখায় মন দিতে হবে, তুমি ওকে খামারে নিয়ে যাও।’

‘ওদের কাজ ওরা করবে, ডোডোর কাজ ডোডো করবে।’

‘করোনা করোনা করে লেখাপড়া একেবারে গোল্লায় গেছে...।’

সুকান্ত বইটা সরিয়ে একটু আয়েশ করে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘লেখাপড়ায় ডোডোর যে অবস্থা তোমার মেয়েদেরও একই অবস্থা। কী বলিস ডোডো?’

‘তোমাকে একটা সিরিয়াস কথা বললাম, আর তুমি সেটাকে হালকা করে দিচ্ছ।’

‘কী সিরিয়াস কথা?’

‘বলছি তুমি ওকে খামারে নিয়ে যাও, খামার পাহারা দেবে, তোমাকেও দেখে রাখবে।’

সুকান্ত ডোডোকে সামনে বসিয়ে তার ঝুলে পড়া কান দুটো ধরে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডোডো তুই খামারে যাবি?’

বরাবরের মতো ডোডো মাথাটা একবার ডানদিকে আর একবার বাম দিকে কাত করে।

রুপু চিৎকার করে বলে, ‘বাবা ডোডো যেতে রাজি হয়েছে।’

এর পর পরই ডোডো দৌড়ে গিয়ে সুকান্তের দুই গাল চেটে দেয়।

সবাই মিলে খামারে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে, এরমধ্যে এক দুপুরে আল-আমিন আসে সবার জন্য মিষ্টি নিয়ে। শ্যামলীকে বলে, ‘আপা আপনাকে আর ডোডোকে দেখতে এসেছি।’

আল-আমিনকে দেখে ডোডো মহাখুশি, বারাবার তাকে জড়িয়ে ধরে। সন্ধ্যায় সুকান্তকে মিষ্টি দিয়ে শ্যামলী বলে, ‘আল-আমিন এসেছে দুপুরে, আমাদের দেখতে। ওদের এলাকার মিষ্টি, খেয়ে দেখ অনেক সফট।’

সুকান্ত মিষ্টি খেতে খেতে বলে, ‘ভালো, অনেক ভালো; ডোডোর কারণে তুমি একটা ভাই পেয়েছ।’

শ্যামলী হেসে বলে, ‘পেয়েছি তো।’

‘মিষ্টি কী আল-আমিন এমনি এমনি এনেছে! তোমার আইকিউ দেখছি দিনে দিনে জিরোতে নেমে যাচ্ছে, আমি ভেবেছি তুমি ধরতে পারবে। আল-আমিনের ছেলে হবে।’

‘তুমি তো দেখছি বুজুর্গ হয়ে গেছ, যেটা যেটা বলছ সেট সেটা ফলে যাচ্ছে।’

শ্যামলী লজ্জা পেয়ে বলে, ‘দূর, কিছু একটা বলতে হয়, বলেছি। ঝড়ে বক মরে গেছে আরকি!’

‘সবাই মিলে যে খামারে যাবে বলতেছ, তোমার মেয়েরা স্কুলের ব্যাগ বই খাতা ঝেরে-মুছে ঠিক করেছে?’

‘তুমি সেটা মেয়েদের জিজ্ঞাসা করো, বাপ হিসেবে তোমার কোনো কর্তব্য নেই? কত আর আমার ওপর চাপ দিবা।’

সুকান্ত দীপু রুপুকে ডেকে বলে, ‘তোমাদের স্কুল খুলে যাচ্ছে, তোমরা কি বই-পত্র খুঁজে বের করেছ? খামার থেকে এসে সময় পাওয়া যাবে না।’

দীপু বলে, ‘তুমি আমাদের কী মনে করো বাবা, আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন।’

রুপু বলে, ‘তুমি জানো না, আমরা ডোডোর বোন, আমাদের সব কিছু টনটনে।’

সুকান্ত এক বন্ধুর পুরানো একটা গাড়ি ম্যানেজ করে। পরদিন সকালে সবাই ডোডোকে নিয়ে রওনা হয় খামারের উদ্দেশে। সুকান্তের পায়ের কাছে ডোডো প্রথমে শুয়ে থাকে। পরে সিটে উঠে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে। ঘর থেকে বের হতে পেরে সে খুব খুশি।

এক সময় মনের আনন্দে গলাটা লম্বা করে ডোডো চিৎকার করে ওঠে ভু ভু, ভু ভু, ভু ভু…।

সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে ভুভু...

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের তদন্ত শুরু
রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের তদন্ত শুরু
পরীর মনে ‘সুপ্তি’র মায়া
পরীর মনে ‘সুপ্তি’র মায়া
রাজধানীতে চাঁদা আদায়ের সময় গ্রেফতার ১৩  
রাজধানীতে চাঁদা আদায়ের সময় গ্রেফতার ১৩  
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি
সর্বাধিক পঠিত
ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, জানালেন ওবায়দুল কাদেরঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে
ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নিহত হলেন যারা
ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নিহত হলেন যারা
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
পাউবোর দুই প্রকৌশলীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
পাউবোর দুই প্রকৌশলীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
‘বাংলাদেশ দলে খেলতে না পারলে আমি মরে যাবো না’
‘বাংলাদেশ দলে খেলতে না পারলে আমি মরে যাবো না’