জানালার পর্দাগুলোয় ময়লা জমে বুড়ো হয়ে গেছে, হাড়গোড় ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে— বারান্দায় ছবি আঁকার ফাঁকে পিঠটাকে শান্ত করতে জিরিয়ে নিতে নিতে সে ভাবছে। মিলির আজ আঁকার দিন, আঁকতে আঁকতে ক্যানভাসটা যতক্ষণ না মনের দৃশ্যটা ছাড়িয়ে যেতে পারছে, ততক্ষণ সে আঁকতে থাকবে। কফির কাপের ভিত্তিহীন নীরবতা কাজ করে, ঘনকালো ঘূর্ণায়মান নীরবতা। নীরবতা স্মৃতির দরজামাত্র, মিলি প্রবেশ করেছে সেখানে, তার ঠোঁটের কাছে আরো উষ্ণ-স্মৃতি হাজির হয়।
সেদিন, হয়ত শুক্রবার, লিলি বাসায় এসে তাকে তার ক্যানভাসে স্বাগত জানায়। বারান্দায় স্পষ্ট আলো দেখার মতো সকালও তখন হয়নি। মিলি সমস্ত কিছু ভেবে নিতে চাচ্ছে, যদি পর্দাগুলোর হাড় ভেঙে থাকে, অথবা ক্ষয়ে গিয়ে স্পষ্ট হতে থাকে, কেউ কী সেখানে নজর দিয়ে ‘আমাদের সাঁতরানো দেখবে?’— মিলি এই প্রশ্নের পর লিলি আরো রং ছড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখে। হামাগুড়ি দিয়ে মেদে মেদ ঘেঁষতে থাকে। কফির ঘ্রাণ তাকে কাবু করে ফেলে। হয়ত দুপুর তখন সাড়ে বারোটা, আজান পরপর, রাস্তা দিয়ে টুপি-পাঞ্জাবি-মসলা নিয়ে পুরুষগুলো যাচ্ছে। রোদ বেশ। ‘বাবাও নামাজ শেষে এভাবে জিলাপি হাতে ফিরতো, আমাদের বড়বাড়ির মসজিদ থেকে’— লিলির সাথে হয়ত সেদিন এইটুকুই সে বলতে চেয়েছিল।
‘লিলি, তুই পদ্ম কেন আঁকতে চাইলি?’— মিলির প্রশ্ন। লিলির উত্তর— ‘পিঠে এরচেয়ে ভালো কিছু মানাচ্ছিল না, নাভিতে আঁকতে চেয়েছিলাম, সে দিল না’, মিলির ক্রোধ ‘কেন?’, ‘সে দেয়নি, তাছাড়া আমার সেভ করা ছিল না ঐদিন’, ‘পরে করতি?’। ‘লিলি মানে পদ্ম, হিন্দু পুরাণে ‘পদ্ম’ অনেক বড় বিষয় জানিস’— মিলি বিড়বিড় করে। হয়ত এ কথোপকথন রবিবারের ‘সন্ধ্যাকথন রেস্তোরাঁয়’। মিলির নামের অর্থ কী? ‘মেহেরুন্নেসা মরিয়ম’— নিজের নাম উচ্চারণ করে মিলি নিজেই হাসে। ট্যাটু সে করতেই পারে, তার পরে যাওয়ার সময় আছে, সেভ করাই থাকে আজকাল।
সাবলীল ভাবে বইছে তুরাগের একপাশ, কাশফুল, মিলির পাশে তার নারী-প্রেমিকটি বসে রয়েছে। মিলি চাচ্ছে তার ভেতরের কোমল-সুগন্ধি নারীটি আজ বর্ণময় হোক। বর্ণনা শুনুক নারী-প্রেমিকটির। সে আর্জি করে বলুক, ‘আমি একটা ট্যাটু করতে চাই, নাভি থেকে তোমার উত্তাল-বাসস্থান পর্যন্ত’। নারী-প্রেমিকটি তাকিয়ে রয়েছে। রাগ-গুল্ম-লতা তার চোখ থেকে বেরিয়ে মিলির গলায় পেঁচিয়ে যাচ্ছে, মিলি মিষ্টি ঠোঁটে তা কেটে দিচ্ছে। তুরাগ তার স্বভাবে বয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে।
কফি হয়ত শেষ, পিঠটাও জিরিয়ে নিয়েছে। একাংশ যা এঁকেছে, তার মর্ম এই, মাথার ভেতর নদীগুলো বইছে, পরিচিত তিতাস, মেঘনা ব্রিজের ছায়া। বাকিটুকুতে সে একটা কাহিনি বুনতে চায়— শুরুটা এমন, আজ সে সবকিছু সেভ করে বের হয়েছে, বুকিং আগেই দেওয়া ছিল তাই সোজাসুজি ভেতরে ঢুকে গেল, তারপর ট্যাটু ডিজাইন পছন্দ করল, পিঠে একটা নদী খোদাই করে নিল, তারপর স্তনজোড়ার মধ্যখানের ব্যাপ্তিতে ‘অর্ধেক-মাথা-কাটা রুই মাছ’ খোদাই করল। সে কী করবে ভাবছে। নাভি বাকি আছে তাই আপাতত সেটার ডিজাইন নিয়ে ভাবছে। খোদাইকারের পরামর্শ পছন্দ হচ্ছে না তার। হচ্ছেই না। শেষে খোদাইকারের নির্লিপ্ত ‘একজোড়া চোখ ভ্রূ কুচাকানো সহ’ খোদাই করে নিল। সে অনেকগুলো প্রেমিক-পুরুষকে পালিয়ে যেতে দেখল, কেউ কেউ নদী ধরে রুই পর্যন্ত এসে পালিয়ে গেল, কেউ চোখে চোখ পড়তেই দৌড় দিল। তারপর সবাই।