X
শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫
১৯ বৈশাখ ১৪৩২
ঈদসংখ্যা ২০২৫

জোমো কেনিয়াতার ‘জঙ্গলের ভদ্রলোক’

অনুবাদ: অরিত্র সান্যাল
২৭ মার্চ ২০২৫, ১৩:১২আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৫, ১৩:১২

জোমো কেনিয়াতা (১৮৯১-১৯৭৮) কেনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং স্বাধীন কেনিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি। তিনি কিকুয়ু জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব নিয়ে ‘Facing Mount Kenya’ (১৯৩৮) নামে একটি গবেষণাধর্মী বই লেখেন।

একবার একটি হাতি একজন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিল। একদিন প্রচণ্ড ঝড়জল হচ্ছে। হাতি এলো বন্ধুর কাছে। বনের প্রান্তে ছোট্ট কুঁড়ে। হাতি এসে বলে: ‘ও গো প্রিয় সুজন! বাইরে তো উথালপাথাল বৃষ্টি, আমার শুঁড়টা একটু রাখতে দেবে গো তোমার ঘরে?’ বন্ধুর অবস্থা দেখে মানুষটি বলে: ‘ওগো হাতি! আমার ঘর তো বড্ড ছোট, তবু তোমার শুঁড়ের জন্য জায়গা আছে। রাখ আলতো করে তবে’। হাতি বন্ধুকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল: ‘আহা বড় উপকার করলে গো; একদিন এর প্রতিদান দেব’। কিন্তু হলো কী তারপর? হাতি যেই মাত্র শুঁড় কুঁড়েঘরের ভেতরে ঢোকাল, সঙ্গে সঙ্গে ঢুকিয়ে দিল মাথাটাও। শেষমেশ লোকটিই বৃষ্টির মধ্যে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ল, আর হাতি বন্ধুগৃহে আরামসে শুয়ে পড়ল, বলল: ‘বন্ধুবর, তোমার ত্বক আমার ত্বকের চেয়ে শক্ত, এবং যেহেতু এখানে আমাদের দুজনের জন্য জায়গা যথেষ্ট নেই, তুমি বৃষ্টির মধ্যে থাকতে পার, ততক্ষণ আমি আমার কোমল ত্বক শিলাবৃষ্টি থেকে বাঁচাই’।

মানুষটি সব দেখেশুনে অসন্তোষে গজগজ করতে শুরু করে; আশেপাশে থাকা বনের প্রাণীরা শব্দ শুনতে পায়, দেখতে আসে কাণ্ডটা। হাতি আর মানুষের তর্ক সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছে। এবার এলেন সিংহ। গর্জন করে বললেন: ‘জানো না, জঙ্গলের রাজা আমি! কেউ আমার রাজ্যের শান্তি ভঙ্গ করার ধৃষ্টতা করে কীভাবে?’ হাতি আসলে ছিল যে বন রাজ্যের একজন উচ্চপদস্থ মন্ত্রী; মোলায়েম করে উত্তর দিল: ‘হুজুর, রাজ্যের শান্তি নষ্ট করার কোনও সুযোগ নেই। হুজুর, আমাকে যে ছোট্ট কুঁড়েঘরটি দখল করতে দেখেছেন, তার মালিকানা নিয়ে আমার বন্ধুর সঙ্গে সামান্য আলোচনা চলছে’। রাজ্যে শান্তি রক্ষা করতে আগ্রহী সিংহ ভদ্রস্বরে উত্তর দেন: ‘মন্ত্রীদের এই বিষয়টির পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করার জন্য, এবং সেই অনুযায়ী রিপোর্ট দেওয়ার জন্য একটি তদন্ত কমিশন নিয়োগ করার নির্দেশ দিচ্ছি’। তারপর মানুষটির দিকে ফিরে সিংহ বললেন: ‘তুমি আমার লোকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে ভালো করেছ, বিশেষ করে হাতির সঙ্গে, ও আমার রাষ্ট্রমন্ত্রী। আর বকাঝকা কর না, তোমার কুঁড়েঘর তোমার থেকে হারায়নি। আমার ইম্পেরিয়াল কমিশনের বৈঠক পর্যন্ত অপেক্ষা কর, সেখানে তোমাকে তোমার মামলা বলার জন্য প্রচুর সুযোগ দেওয়া হবে। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, কমিশনের ফলাফলে তুমি খুশি হবে’। জঙ্গলের রাজার এই মিষ্টি কথা শুনে মানুষটি তো খুব খুশি। তারপর শুরু হল মামলার সুযোগের অপেক্ষা, অবলার মতো এই বিশ্বাস নিয়ে যে স্বাভাবিকভাবেই কুঁড়েঘরটি সে ফেরত পাবে।

হাতি হুজুরের আদেশ মান্য করে, তদন্ত কমিশন নিয়োগের জন্য অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। জঙ্গলের প্রবীণদের কমিশনে বসতে নিযুক্ত করা হয়েছিল: (১) গন্ডার সাহেব; (২) মহিষ মহাশয়; (৩) শ্রীযুক্ত কুম্ভীর; (৪) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য মাননীয় শৃগাল; এবং (৫) শ্রীমান চিতাকে কমিশনের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কর্মীদের দেখে মানুষটি হেঁকে ওঠে। এই কমিশনে তার পক্ষ থেকে একজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা কি প্রয়োজন নয়?—এই ছিল দাবি। কিন্তু তাকে বলা হলো তা সম্ভব নয়, কারণ তার পক্ষের কেউই জঙ্গল আইনের জটিলতা বোঝার মতো যথেষ্ট শিক্ষিত নন। তাছাড়া, ভয়ের কিছু নেই, কমিশনের সদস্যরা সকলেই ন্যায়বিচারে নিরপেক্ষতার জন্য খ্যাত। আর যেহেতু তারা ঈশ্বর কর্তৃক মনোনীত ভদ্রলোক, সবার দাঁত ও নখ কম, নিশ্চিত থাকাই যায় যে তারা সর্বোচ্চ যত্ন সহকারে বিষয়টির তদন্ত করবেন। নিরপেক্ষ রিপোর্ট দেবেন।

কমিশন সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য বসে। প্রথমে মাননীয় হাতিকে তলব করা হলো। সে এসে নিজের গিন্নির দেওয়া একটি চারাগাছ দিয়ে দাঁত ঘষে কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠে বলে: ‘জঙ্গলের ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা সবাই বোঝেন এমন একটি গপ্প ফেঁদে আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি সবসময় আমার বন্ধুদের স্বার্থ রক্ষা করাকে আমার কর্তব্য বলে মনে করে এসেছি, এবং এর ফলে আমার এবং আমার বন্ধুর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়। তিনি আমাকে তার কুঁড়েঘরটিকে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে বাঁচাতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যেহেতু কুঁড়েঘর খালি থাকায় ঝড়ের দাপটে পড়েছিল, আমি আমার বন্ধুর স্বার্থে, নিজে বসে অব্যবহৃত জায়গাটিকে আরও মেপেঝুপে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা জরুরি বলে মনে করেছি; এ কর্তব্য আপনারা যে কেউ নিঃসন্দেহে এই পরিস্থিতিতে সমানভাবে পালন করতেন’।

মাননীয় হাতির চূড়ান্ত বক্তব্য শোনার পর, কমিশন শ্রীমান হায়েনা এবং জঙ্গলের অন্যান্য প্রবীণদের ডেকে পাঠায়। সকলেই হাতিকে সমর্থন করে। এবার কমিশন আহ্বান জানায় মানুষকে। বিরোধীপক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে তার বিবরণ শুরু হতে না হতেই কমিশন মানুষটিকে বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করতে বলে: ‘সুজনেষু, দয়া করে প্রাসঙ্গিক বিষয়েই কথা বলুন। আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন নিরপেক্ষ সূত্র থেকে পরিস্থিতি শুনেছি; আমরা আপনাকে কেবল আমাদের বলতে চাই যে আপনার নড়বড়ে ঘরের জায়গাটি কি মাননীয় হাতি আসার আগে অন্য কেউ দখল করেছিল?’ মানুষটি বলে: ‘না, কিন্তু’, আর তৎক্ষণাৎ কমিশন ঘোষণা করে যে তারা উভয় পক্ষের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বয়ান নিয়েছে। এবং সিদ্ধান্ত বিবেচনা করার জন্য তাদের একটি বিরতি চাই। মাননীয় হাতির খরচায় চমৎকার আহারাদি সেরে কমিশন জানায় তারা তাদের রায়ে পৌঁছেছে, অতঃপর মানুষটিকে ডেকে ঘোষণা করে: ‘আমাদের মতামত এই বিরোধ একটি দুঃখজনক ভুল-বোঝাবুঝির কারণে উদ্ভূত, আর তার জন্য দায়ী আপনার পিছিয়ে-থাকা ধ্যানধারণা। আমরা বিবেচনা করে দেখলাম যে, মাননীয় হাতি আপনার স্বার্থ রক্ষার জন্য নিজের পবিত্র কর্তব্য পালন করেছেন। জায়গাটি সবচেয়ে সাশ্রয়ীভাবে ব্যবহার করা উচিত—এটাই আপনার জন্য ভালো, যেহেতু আপনি নিজে ঘর বাড়ানোর অবস্থায় পৌঁছাননি, তাই আমরা উভয় পক্ষের জন্য একটি আপস ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করি। মাননীয় হাতি আপনার কুঁড়েঘরের উপর তার অধিকার কায়েম রাখবেন, তবে আমরা আপনাকে এমন একটি জায়গা খুঁজতে অনুমতি দিচ্ছি যেখানে আপনি আপনার প্রয়োজনের জন্য আরও উপযুক্ত আরেকটি কুঁড়েঘর তৈরি করতে পারেন, এবং আমরা আপনাকে সুরক্ষিত রাখব’।

আর কোনও বিকল্প ছিল না মানুষটির কাছে। এর খেলাপ কমিশনের সদস্যদের দাঁত এবং নখরগুলির মুখোমুখি করতে পারে এই আশঙ্কায় সে সব মেনে নেয়। কিন্তু তিনি আরেকটি কুঁড়েঘর তৈরি করা মাত্রই মাননীয় গন্ডার তার শিং নিচু করে লোকটিকে ঘর ছাড়বার নির্দেশ দেন। বিষয়টি তদন্ত করার জন্য আবার একটি রয়েল কমিশন নিযুক্ত করা হয় এবং একই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। মহিষ মহাশয়, শ্রী চিতাবাঘ, শ্রীযুক্ত হায়েনা এবং বাকিদের নতুন কুঁড়েঘর দিয়ে স্থান না দেওয়া পর্যন্ত এই পদ্ধতিটি পুনরাবৃত্তি করা হয়েছিল। তারপর মানুষটি সিদ্ধান্ত নিল যে তাকে সুরক্ষার একটি কার্যকর পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, কারণ তদন্ত কমিশন তার কোনও কাজে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। সে বসে বলে, ‘Ng'enda thi ndagaga motegi,’ যার আক্ষরিক অর্থ ‘পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যাকে ফাঁদে ফেলা যায় না’, অথবা অন্য কথায়, আপনি কিছু সময়ের জন্য মানুষকে বোকা বানাতে পারেন, কিন্তু চিরকালের জন্য নয়।

একদিন ভোরে, যখন জঙ্গলের শাসকদের দখলে থাকা কুঁড়েঘরগুলো ক্ষয়ে আসছে আর একে একে ভেঙে পড়ছে, তখন মানুষটি বেরিয়ে একটু দূরে একটি বড় এবং ভালো কুঁড়েঘর তৈরি করে। মাননীয় গন্ডার দেখতে পেয়েই হাজির। তাড়াহুড়ো করে ভেতরে ঢুকে দেখে যে মাননীয় হাতি ইতোমধ্যেই ভেতরে নিদ্রা যাচ্ছে। শ্রী চিতাবাঘ এরপর জানালার কাছে আসে, রাজা সিংহ, শ্রীমান শৃগাল এবং মহিষ মহাশয় দরজা দিয়ে প্রবেশ করে। শ্রীযুক্ত হায়েনা ছায়ায় জায়গা পাওয়ার জন্য চিৎকার করে। শ্রীমান কুম্ভীর ছাদে বসে থাকে। ইতোমধ্যে তারা সকলেই তাদের প্রবেশাধিকারের অধিকার নিয়ে তর্ক শুরু করে, এবং তর্ক গড়ায় লড়াইয়ে। যখন সবাই একসাথে জড়িয়ে আছে, মানুষটি কুঁড়েঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। তারপর সে বাড়ি ফিরে আসে, বলে: ‘শান্তি ব্যয়সাপেক্ষ, কিন্তু পয়সা উশুল হয় বটে’। তারপর সে সুখে বসবাস করতে থাকে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ফিলিপাইনে বাস দুর্ঘটনায় নিহত ১০, আহত ৩০ 
ফিলিপাইনে বাস দুর্ঘটনায় নিহত ১০, আহত ৩০ 
মানুষের টিকে থাকার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ জরুরি: ফরিদা আখতার
মানুষের টিকে থাকার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ জরুরি: ফরিদা আখতার
মোহাম্মদপুরে পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার ২৪
মোহাম্মদপুরে পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার ২৪
‘জিমি থাকলেও ওমানকে হারানো যেতো না, ট্যাকটিক্যালি আমরা পিছিয়ে পড়েছি’
‘জিমি থাকলেও ওমানকে হারানো যেতো না, ট্যাকটিক্যালি আমরা পিছিয়ে পড়েছি’
সর্বাধিক পঠিত
টেকনাফে সরকারি বরাদ্দের মালামাল মিয়ানমারে পাচার
টেকনাফে সরকারি বরাদ্দের মালামাল মিয়ানমারে পাচার
সাপের কারণে জাপানে বুলেট ট্রেন চলাচল বন্ধ
সাপের কারণে জাপানে বুলেট ট্রেন চলাচল বন্ধ
চিন্ময়ের জামিন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, ইন্টেরিম সাবধান: হাসনাত আব্দুল্লাহ
চিন্ময়ের জামিন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, ইন্টেরিম সাবধান: হাসনাত আব্দুল্লাহ
কূটনীতিক সুফিউর রহমানের নিয়োগ নিয়ে হচ্ছে কী
কূটনীতিক সুফিউর রহমানের নিয়োগ নিয়ে হচ্ছে কী
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন