জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে ছয় জনের পরিচয় জানা গেছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ ভূঁইয়াসহ সংগঠনের চার জন রয়েছেন। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার এক সমন্বয়ক ও ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের এক শিক্ষার্থী জড়িত থাকার কথা জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, ছবি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। ছাত্রদলের অভিযুক্ত চার জন হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ভূঁইয়া, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫ ব্যাচের রাজু আহমেদ ও একই বিভাগের ৪৬ ব্যাচের মোহাম্মদ রাজন মিয়া (রাজু), ইংরেজি বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের হামিদুল্লাহ সালমান। রাজু, রাজন ও সালমান কোনও পদে না থাকলেও ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িত বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। অপর দুজন হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক আহসান লাবিব এবং ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আতিকুজ্জামান।
শামীম মোল্লা হত্যার ঘটনায় জড়িত অভিযোগে আট শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একই সঙ্গে ঘটনা তদন্তের জন্য ছয় সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এ বি এম আজিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
এরই মধ্যে মারধরের ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা ফটকের সামনে শামীমকে মারধরের একটি ৮ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, শামীম মাটিতে পড়ে আছেন। তার পিঠের দিকে কয়েকটা লাথি মারছেন ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আতিকুজ্জামান। একই সময়ে পায়ে লাঠি দিয়ে কয়েকটি বাড়ি দেন সমন্বয়ক আহসান লাবিব।
অপর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গত ১৫ জুলাই রাতে উপাচার্যের বাসভবনের ছাত্রলীগের হামলায় শামীম জড়িত ছিলেন কিনা, সেটা জিজ্ঞাসাবাদ করছেন আহসান লাবিব। তখন শামীম নিজে জড়িত ছিলেন না দাবি করে ছাত্রলীগের দুজন নেতা জড়িত ছিলেন বলে স্বীকারোক্তি দেন।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার কলাপসিবল গেটের মধ্যে শামীমকে মারধরের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, শামীম উল্টো হয়ে মেঝেতে পড়ে আছেন। রড দিয়ে বেধড়ক পেটাচ্ছেন সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী রাজু আহমেদ। তখন রাতুল নামের জার্সি পরিহিত একজনকেও লাঠি দিয়ে তাকে মারতে দেখা যায়। রাজু হাসান ও হামিদুল্লাহ সালামনও সেখানে শামীমকে মারধর করেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, প্রক্টর কার্যালয়ের সামনে শামীমকে কয়েক দফায় মারধর করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন আবু সাঈদ ভূঁইয়া। তিনি নিজেও মারধর করেন বলে নিরাপত্তা শাখার একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সুষ্ঠু তদন্ত শেষে বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
এ ব্যাপারে শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু সাইদ ভূঁইয়া জানান, জয় বাংলা ফটকে একজনকে মারধরা করা হচ্ছিল শুনে সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে উৎসুক জনতা হয়ে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি মারধর করেননি। শামীম মোল্লা এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ছিলেন এবং ১৫ জুলাই রাতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত ছিলেন। ছাত্রলীগের দোসররা তাকে মারধর করে থাকতে পারে।
রাজু আহমেদ বলেন, ‘আমি সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে শোনার পর সেখানে গেছিলাম। সেখানে গিয়ে আমি শামীমকে ধমক দিই, তাকে মারধর করিনি।’
হামিদুল্লাহ সালমান বলেন, ‘খবর পেয়ে বাকিদের মতো আমিও প্রক্টর অফিসে গিয়েছিলাম। তখন তাকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছিল। আমি মারধর বা তালা ভাঙার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত না।’
আতিকুজ্জামান বলেন, ‘আমি প্রান্তিক থেকে আসছিলাম। তখন দেখি একজনরে গণপিটুনি দিচ্ছে। সে নাকি চাঁদাবাজি করছিল আর ১৫ তারিখ ছাত্রলীগ যে হামলা করে, সেখানে ছিল। এটা শুনে আমি ক্ষোভ থেকে তিনটা লাথি মেরেছিলাম আর কিছু করিনি। আমি তাকে চিনতাম না।’
সমন্বয়ক আহসান লাবিব বলেন, ‘গত ১৫ জুলাই আমাদের ওপর যারা হামলা করেছিল তাদের মাস্টারমাইন্ড একজনকে জয় বাংলা ফটকে শিক্ষার্থীরা আটক করেছে, এমন খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। তারপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তখন শামীম দুজনের নাম স্বীকার করে। এরপর নিয়ম অনুযায়ী তাকে প্রশাসনের কাছে তুলে দিয়ে আমি চলে যাই।’
ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন অনেকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুর রশিদ বলেন, এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের সবার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেউ জড়িত থাকলে তাকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামাল হোসেন বলেন, শামীম মোল্লার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের সদস্যদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে মামলার বিষয়ে কেউ কিছু বলেননি স্বজনরা। কেউ অভিযোগ করলে অবশ্যই আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।