X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

একমুঠো ভাতের জন্য আদালতে মা

আমানুর রহমান রনি
০৮ মে ২০১৬, ০৭:৫৬আপডেট : ০৮ মে ২০১৬, ০৮:০৮

সন্তানকে পরম স্নেহে এক মা জীবনে যা আয় করেছিলেন তার সবটুকু সন্তানদের পেছনে ব্যয় করেছেন মা-বাবা। সন্তানদের মুখে হাসি ফুটাতে সব বাবা-মা তাই করেন। শাহেদা বেগম এবং তার স্বামী হযরত আলীও সেটাই করেছিলেন। তাদের জীবনের ক্ষুদ্র সঞ্চয় তিন ছেলের জন্য ব্যয় করেছেন। ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এরপরই যার যার মতো করে আলাদা হয়ে চলে গেছেন। আর খোঁজ নেন না মা-বাবার। অসহায় মা-বাবা কোথায় থাকবেন? কি খাবেন? সেই খোঁজ আর রাখেন না তিন সন্তান। বাধ্য হয়ে ঢাকার নিম্ন আদালতে ভরণপোষণের দাবি জানিয়ে পৃথক দুটি মামলা করেন এই দম্পতি। তবে তাতেও মেলেনি ভাত। মামলা চলছে দেড় বছর ধরে; কিন্তু ভরণপোষণ তারা পাচ্ছেন না।
এটি শুধু একটি ঘটনা। ২০১৩ সালে বাবা-মায়ের ভরণ পোষণের আইন পাস হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন আদালতে এরকম অনেক  মা-বাবা মামলা করেছেন। আমরা খোঁজার চেষ্টা করেছি ওইসব মামলার কয়েকটির সর্বশেষ অবস্থা। তবে কোনও মামলারই অবস্থা সুখকর না। মামলা করেও বাবা-মা নিয়মিত পাচ্ছে না ভরণপোষণ। তাদের জীবন আরও অনিশ্চয়তায় কাটছে।
আরও পড়তে পারেন: বিশ্ব মা দিবস আজ
সাহেদা বেগম ও হযরত আলী দম্পতির তিন ছেলে। হযরত আলী এমএলএসএস পদে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন। সাত-আট বছর আগে অবসরে গেছেন তিনি। অবসরে যা পেয়েছিলেন তা সব তিন ছেলের পেছনে ব্যয় করেছেন। ছেলেদের ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগ করেছেন। বড় ছেলে মো. সেলিম একটি বীমা কোম্পানিতে চাকরি করেন। মেজ ছেলে মো. শামীম বাসচালক। ছোট ছেলে মো. শাহীন ব্যবসা করেন। কেউই বাবা-মায়ের খোঁজ রাখেন না।
উপায় না পেয়ে ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর হযরত আলী ও তার স্ত্রী সাহেদা বেগম ঢাকা মহানগর হাকিমের আদালতে তিন ছেলেকে বিবাদী করে একটি ভরণপোষণের মামলা দায়ের করেন। সি. আর. মামলা নম্বর ৪৪১ ও ৪৪২; তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৪।
সাহেদা বেগম শনিবার সন্ধ্যায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘সন্তানদের বিশ্বাস করে সবকিছু দিয়েছি। কিন্তু সন্তানরাই এখন জিগায় না। আমি কেমন সন্তানের মা। মানুষের কাছে বলতেও পারি না। উপায় না দেখে মামলা করেছি। আমাদের যদি একটু উপায় থাকতো তাহলে মামলাও করতাম না। তারা আমাদের নিঃস্ব করে সব নিয়ে গেল। এখন কোনও খবর নেয় না।’

হযরত আলী দীর্ঘ এক সপ্তাহ বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পাড়া-প্রতিবেশী ও সচ্ছল স্বজনরা তাকে সহায়তা করে চিকিৎসা করিয়েছেন। শনিবার তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি ২০১৪ সালে মামলা করি। এরপর আদালত তিন ছেলেকে আমাকে দুই হাজার করে টাকা দিতে বলে। বড় এবং মেজ ছেলে কয়েকমাস দুই হাজার করে পেশকারের কাছে টাকা দিত। আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম। কিন্তু নতুন বিচারক আসায় গত মাসে কিছুদিন পর তারা বুদ্ধি করে কি যেন করল। এরপর নতুন বিচারক বড় ছেলেকে ১৫ হাজার টাকা ও মেজ ছেলেকে দশ হাজার টাকা জরিমানা করল। এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা জমা দেওয়ার জন্য আদেশ দেয় আদালত। টাকা জমা না দিলে বড় ছেলের দুই মাস এবং মেজ ছেলের দেড়মাস কারাদণ্ড হবে। ছোট ছেলেরতো কোনও খোঁজ নেই। আমি আদেশ শুনে চুপ হয়ে চলে আসি। আমি এই টাকা দিয়ে কি করব? আমি আমার উকিলকে বলছি আইনে তিন মাসের জেল ও একলাখ টাকা জরিমানার কথা বলা আছে। আমি এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করব। নকল উঠানোর জন্য আবেদন করেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমি বর্তমানে ২১শ’ টাকায় ডেমরার কোনাপাড়া এলাকায় একটি কক্ষে ভাড়া থাকি। আমি এখন মামলাও চালাতে পারছি না। আমি একজন রোগী, চলতে পারি না। আমার কি হবে? এটা কেমন বিচার?’

আরও পড়তে পারেন: যেভাবেই হোক একটা পরিচয় মা’দের দাঁড় করাতে হবে
অপরদিকে ২০১৪ সালের ১৮ নভেম্বর কৌশলে ভিটেবাড়ি নিজেদের নামে রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার পর চার ছেলেকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন বাবা হাসেম আলী (৭০)। তিনি সাভার থানার ভাটপাড়া এলাকায় থাকেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত সন্তানদের হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করেছেন।

মামলার বিবরণে জানা যায়, সাভার থানার ভাটপাড়া এলাকায় হাসেম আলী (৭০) বসবাস করেন। ২০০৮ সালে তার স্ত্রী মারা যান। পরে সেখানে তিনি ৬ শতাংশ বাড়িতে তিন ছেলে আমজাদ হোসেন, আবুল হোসেন, আলমগীর হোসেন ও একমাত্র মেয়ে রাশিদা আক্তারকে নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। কিন্তু সন্তানেরা সুকৌশলে তার সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করে নেন। বাড়ি রেজিস্ট্রির পর সন্তানেরা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাকে এ বাড়ি থেকে বের করে দেন। ফলে, বৃদ্ধ বয়সে অসহায় হয়ে তিনি গ্রাম্য সালিসের আয়োজন করেন। সেখানেও সন্তানেরা জানিয়ে দেন তারা বাবার ভরণপোষণ দিতে পারবেন না। বর্তমান সরকার ভরণপোষণ আইন প্রণয়ন করায় তিনি এ আইনে সন্তানদের আসামি করে মামলাটি করেন। মামলা করে আশ্রয় পেলেও তার ভরণপোষণ মেলেনি।

একই বছর এপ্রিলে চাঁদপুরের আদালতে পুত্র ও পুত্রবধূর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। শাহরাস্তির আলীপুর গ্রামের বৃদ্ধ মিন্নত আলী মামলায় অভিযোগ করেন, তিনি এবং তার স্ত্রী শামছুন্নাহার দম্পতি প্রায় ৫০ বছর ধরে ভিক্ষাবৃত্তি ও ফেরি করে ১ ছেলে ও ৪ মেয়েকে লালন-পালন করে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ছেলে নুরুল আমীন প্রতিষ্ঠিত হয়ে উল্টো তাদেরই ভিটেমাটি ছাড়া করেছেন। এরপর মিন্নত আলী আদালতে মামলা করেন।

সন্তানদের এমন অমানবিক আচরণের সুষ্ঠ বিচার আদালতেও পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তোভোগীরা। মামলা পরিচালনা করার মত সামর্থ্য নেই এসব মানুষের। তারা এসব মামলার দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন।

আরও পড়তে পারেন: পোশাক শ্রমিক মা
এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রকাশ বিশ্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাবা-মাকে ভরণ পোষণ না শুধু; তাদের সব প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে সন্তান নৈতিক, সামাজিক ও আইনগতভাবে বাধ্য। কেউ কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে অমানবিক আচারণ করেন। তা রাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে বিধায় পিতা-মাতার জন্য ভরণপোষণের আইন করা হয়েছে। আইনের বাস্তবায়ন বা প্রয়োগে সবার সদিচ্ছা থাকতে হবে। সন্তানদের বিরুদ্ধে বাবা-মা কখন মামলা করতে আসেন? এটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। তাই বৃদ্ধ বয়সকে কোনও বাবা-মা যেন বিচারের নামে হয়রানির শিকার না হয় তার জন্য সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।’

পিতা-মাতারভরণ-পোষণআইন

মা-বাবার ভরণপোষণ নিশ্চিত করা এবং তাদের সঙ্গে সন্তানের বসবাস বাধ্যতামূলক করার বিধান করে সরকার ২০১৩ সালে এ আইন পাস করে। আইনের ৩ নং ধারায় বলা হয়, প্রত্যেক সন্তানকে তার মা-বাবার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো মা-বাবার একাধিক সন্তান থাকলে সেক্ষেত্রে সন্তানরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ভরণপোষণ নিশ্চিত করবে। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবেন না। তা ছাড়া সন্তান তার মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখবেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবেন।

মা-বাবাকে ভরণপোষণ না দিলে জেল-জরিমানার বিধান রেখে ২০১৩ সালে সরকার এ আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের বিরুদ্ধে ১ লাখ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

/এআরআর/এমপি/এমএসএম/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জুলাই গণহত্যা: শেখ হাসিনাসহ তিন জনের পক্ষে শুনানি ৭ জুলাই
জুলাই গণহত্যা: শেখ হাসিনাসহ তিন জনের পক্ষে শুনানি ৭ জুলাই
যশোরে নির্মাণাধীন ভবনের বারান্দা ভেঙে দুই প্রকৌশলীসহ ৩ জনের মৃত্যু
যশোরে নির্মাণাধীন ভবনের বারান্দা ভেঙে দুই প্রকৌশলীসহ ৩ জনের মৃত্যু
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট থেকে বেরিয়ে গেলো ছাত্র ফেডারেশন
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট থেকে বেরিয়ে গেলো ছাত্র ফেডারেশন
জলবায়ু অভিযোজনে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে ইউনিসেফের সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ
জলবায়ু অভিযোজনে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে ইউনিসেফের সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ
সর্বাধিক পঠিত
সঞ্চয়পত্রে কমলো মুনাফার হার, কার্যকর ১ জুলাই থেকে
সঞ্চয়পত্রে কমলো মুনাফার হার, কার্যকর ১ জুলাই থেকে
তিন বিমানবন্দরে ১৬ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে
তিন বিমানবন্দরে ১৬ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে
ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ
ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ
রূপপুর প্রকল্পের ১৮ প্রকৌশলী অপসারণ: হাইকোর্টের রুল
রূপপুর প্রকল্পের ১৮ প্রকৌশলী অপসারণ: হাইকোর্টের রুল
অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা মুখোমুখি
প্রশাসনে থামছে না আন্দোলনঅন্তর্বর্তী সরকার ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা মুখোমুখি