সারাদেশে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে মাদক মামলা। এসব মামলা পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। দীর্ঘদিন মামলা চললেও এর বিচার হয় খুব কম। সাক্ষীর অভাব, আলামত নষ্ট, তদন্তে ধীর গতি ও আসামিদের ভুল তথ্য রেকর্ড করায় এসব মামলার বিচারকাজ শেষ হয় না। এমনকি অধিদফতরের অজান্তে অনেক আসামি মামলা থেকে অব্যাহতিও পায়। তবে অধিদফতরের দাবি, তাদের প্রসিকিউটর সংকটের কারণে অনেক মামলার খবর রাখা সম্ভব হয় না। এমনকি সরকারের নিযুক্ত আইনজীবীরা আসামিদের সঙ্গে আঁতাত করেন বলেও অভিযোগ করেছেন কর্মকর্তারা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মাদকদ্রব্য আইনে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬৪ হাজার ৮১৯টি। এর মধ্যে ২০১০ সালে ৮ হাজার ১৯টি, ২০১১ সালে ৮ হাজার ৭৪৯টি, ২০১২ সালে ১০ হাজার ১৪টি, ২০১৩ সালে ১০ হাজার ১১১টি, ২০১৪ সালে ১১ হাজার ৭২৩টি এবং ২০১৫ সালে মামলা হয়েছে ১২ হাজার ২৯৬টি। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত আরও সাড়ে ৩ হাজার মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার।
কোকেন, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, চোলাই মদ, গাঁজা ও বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশন উদ্ধারের ঘটনায় এসব মামলা হয়েছে। অস্ত্র মামলাও আছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের। একযুগ আগের মামলাও এই পরিসংখ্যানে আছে। অনেক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অবসরে গেছেন, তবুও মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই এমন মামলার চাপ রয়েছে। আঞ্চলিকভাবে অনেক বছরের পুরনো মামলা এখনও চলছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো (ডিএনসি) অঞ্চলেই গত বছর মামলা হয়েছে ১৭৯৭টি। বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৮ হাজার ২৯৬টি। ২০১৫ সালে কোকেন ও অস্ত্র মামলাও করেছে ডিএনসি। গত বছর ৯ ডিসেম্বর তিন কেজি কোকেনসহ এক স্প্যানিশ নাগরিককে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে ডিএনসি। এই ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি তদন্ত শেষ করে এ বছরের ৫ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. নিজাম উদ্দিন খান।
তবে এই ঘটনার সঙ্গে আর কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তদন্ত কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই স্প্যানিশ নাগরিক ব্রাজিল থেকে দুবাই হয়ে ঢাকায় এসেছেন। আমরা গোপন সংবাদে তাকে গ্রেফতার করেছি। তার মতিঝিলের একটি হোটেলে ওঠার কথা ছিল। আদালতে তিনি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তবে তার লাগেজে কোকেন ছিল কিনা, তা তিনি জানতেন না বলেও আদালতকে জানিয়েছেন। এই মামলায় ২৩ জন সাক্ষী রয়েছেন। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এখন তার বিচার শুরু হবে।’
তিন মাস হলো চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বদলি হয়ে এসেছেন এই পরিদর্শক। এই মূহূর্তে তার কাছে আরও তিনটি মামলা রয়েছে। পরিদর্শক মো. নিজাম উদ্দিন খান বলেন, ‘অভিযান পরিচালনা, মামলা তদন্তসহ বিভিন্ন কাজ করতে হচ্ছে। সব কাজে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হয়। এ কারণে মামলার তদন্ত কখনও কখনও ধীরে চলে।’
ডিএনসির উপপরিচালক (ডিডি) মুকুল জ্যোতি চাকমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদক মামলা নিষ্পত্তিতে সবচেয়ে বড় বাধা সাক্ষী জটিলতা। মামলার সাক্ষী হাজির করতে বেগ পেতে হয়। সাক্ষীরা ঠিক সময় হাজির হয় না। তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তারপরও তাদের হাজির করা যায় না। তাছাড়া আমাদের নিজস্ব সাক্ষী যারা তারাও অবসরে গেলে আর সাক্ষী দিতে চান না। এসব কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে ঝামেলা হয়। তাছাড়া আদালতেরও সংকট রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব প্রসিকিউটরও কম। ঢাকায় ৭০ থেকে ৭৭টি আদালতে আমাদের নিজস্ব প্রসিকিউটর মাত্র চারজন। বর্তমানে দুইজন সহকারী কাজ করছেন। আদালতের পিপি, এপিপি আমাদের হয়ে কাজ করার কথা, তবে তারাও পার্টির (আসামিদের) পক্ষে কাজ করেন। তাদের সঙ্গে আঁতাত করে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেন।’
মাদক নিয়ন্ত্রণের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আসামিরা অনেক সময় ভুল তথ্য দিয়ে থাকেন। পরবর্তী সময়ে তারা জামিন নিয়ে আর হাজির হন না। পলাতক থাকেন। তাদের আর হাজির করা যায় না। এ কারণেও মামলা নিষ্পত্তি হয় না।’
তিনি বলেন, ‘ডিএনসির যেসব কর্মকর্তা অবসরে যান, তারা এক একজন অন্তত ৫০০ মামলা নিষ্পত্তিহীন অবস্থায় রেখে যান। পরে ওইসব মামলার সাক্ষী দিতে তাদের আদালতে হাজির হতে বললে তারা আসেন না। কারণ, আদালত থেকে তাদের খোরাকি দেওয়ার বিধান থাকলেও তা দেওয়া হয় না। আবার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ডিএনসি থেকে যাতায়াত খরচ দেওয়ার নিয়ম নেই। ফলে ওই কর্মকর্তা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সাক্ষী দিতে আসতে চান না। আবার মামলার সময় যে সব সাধারণ মানুষকে সাক্ষী করা হয়, তারাও নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে সাক্ষী দিতে আসেন না।’
ঢাকা নিম্ন আদালতে থাকা ডিএনসির প্রসিকিউটর শাখা থেকে জানা গেছে, মাদক মামলায় ৮০ শতাংশ আসামি অব্যাহতি পায়। এর মূল কারণ ঢিলেঢালা তদন্ত এবং সাক্ষী না আসা। কোনও কোনও মামলার রায় হলেও তা জানে না মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।
এ বিষয়ে ডিডি মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, ‘সিআরপিসি অনুযায়ী কোনও মামলার রায় হলে আদালত তা আমাদের জানাতে বাধ্য নন। তাই আমরা এর অনুলিপি পাই না। তবে আমরা নিজেরা খোঁজ রাখি। আদালতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সবসময় তা সম্ভব হয় না।’
অসংখ্য মামলা নিষ্পতি না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যে কোনও বিষয়ে মামলা করি। অন্যান্য রাষ্ট্রে কিন্তু তা নয়। বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রে মাদক বাহককে আগে জিজ্ঞাসা করা হয়। মাদক কি কাজে তিনি বহন করছিলেন। যদি তাকে সেবনকারী মনে করে তাহলে মামলা না দিয়ে তাকে চিকিৎসার জন্য ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে এইরকম কোনও কিছু নেই। এক পুরিয়া গাঁজা পেলেও আমাদের মামলা দিতে হয়। এতে মামলার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।’
পুরো ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো উচিৎ বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন:
জঙ্গি অর্থায়নের কথা স্বীকার, সিঙ্গাপুরে দোষী সাব্যস্ত ৪ বাংলাদেশি
তামাক কোম্পানির পক্ষে প্রতিমন্ত্রীর ডিও লেটার!
হয়রানি বন্ধে চূড়ান্ত হচ্ছে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন
/এআরআর/এজে /আপ- এপিএইচ/