X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিজ্ঞাপনে বদলে গেছে একুশ!

উদিসা ইসলাম
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২:২৬আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২১:১৭

বিজ্ঞাপনে বদলে গেছে একুশ!

স্বাধীন বাংলার প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত একুশের দিন পত্রিকার পাতা ভরা থাকতো বর্ণমালায় দিয়ে সাজানো বিজ্ঞাপনে। ব্যাংক-বিমা থেকে শুরু করে ব্যাটারির বিজ্ঞাপন সাজিয়ে তোলা হতো বর্ণমালা দিয়ে। ধীরে ধীরে বদলে গেছে বিজ্ঞাপনে একুশের ভাষা। এখন সারা ফেব্রুয়ারি জুড়েই পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একুশের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। সেখানে নেই কোনও বর্ণমালার উপস্থিতি। এমনকি কোনও শোকের চিহ্নও নেই।

সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমাজের চাহিদা অনুযায়ী বিজ্ঞাপন তৈরি হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে আমুল পরিবর্তন হয়েছে তার ছাপ পড়েছে বিজ্ঞাপনে।

বিজ্ঞাপনে বদলে গেছে একুশ!

সত্তরের দশক থেকে শুরু করে পত্রিকার ২১ ও ২৩ ফেব্রুয়ারির পাতাজুড়ে থাকতো প্রভাত ফেরি, শহীদ মিনারের ছবি এবং বিশেষ পাতা বের হতো। শেষ পাতায় থাকতো একুশে শহীদ দিবস পালিত হওয়ার ছবি। আর বিজ্ঞাপন থাকতো অসংখ্য। প্রতিটি বিজ্ঞাপন বর্ণমালা দিয়ে সাজানোর একটা চেষ্টা অন্তত দেখা যেত।

কিন্তু এখন চিত্র ভিন্ন। পাল্টে গেছে বিজ্ঞাপনে ভাষা। জুঁই তেলের বিজ্ঞাপনের টেক্সটে বলা হয়েছে, ‘সময়টা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। মায়ের ভাষার জন্য লড়াই করতে গিয়ে বীর শহীদদের বুকে বিঁধেছিল বুলেট। প্রাণ দিয়েছিল প্রিয় বর্ণমালার জন্য। তবুও তারা পিছপা হয়নি। ভাষার দাবিতে ছাড় দেয়নি এক চুলও। তাদের এই আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রাণিত করে এক চুলও ছাড় না দিতে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সব ভাষা শহীদদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।’

জুই এর বিজ্ঞাপন

বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীণ ফোনও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবসকে সমানে রেখে নানাবিধ অফারের বিজ্ঞাপন দিয়েছে। তারা বাংলার অফার দেয় বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে। বিজ্ঞাপনটা এমন-‘মাই জিপি অ্যাপ’ এখন বাংলায়।

বিজ্ঞাপনে বদলে গেছে একুশ!

এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞাপন নির্মাতা গাউসুল আলম শাওন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা কাজ করেন, যাদের হয়তো আমরা চিনিও না, যারা আর্টের কাজ করেন, তারা কিন্তু বিজ্ঞাপনে একটা নতুন জায়গা দেখতে চাইছে। এই দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞাপন হয়, কিন্তু সেটা কতদূর পর্যন্ত করবো সেটার একটা ধারণা থাকতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখনকার সময়ে নতুন ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা দেখা যায়। সেটি করতে গিয়ে কখনও কখনও বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। কিন্তু ইন্টারেস্টিং কাজও হচ্ছে।’ বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ট কীভাবে ভাবছে সেটাকে বাদ দিয়ে আসলে কাজ করে লাভ হবে না ঠিকই কিন্তু সেটা করতে গিয়ে মূল জায়গা থেকে দূরে সরে যাওয়াও ঠিক হবে না। মূল বিষয় আমরা ধীরে ধীরে ৫২ থেকে যত দূরে যাচ্ছি, ব্যাখ্যা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হচ্ছে।’

বিজ্ঞাপনে বদলে গেছে একুশ!

বিজ্ঞাপনে ভাষার ব্যবহার নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘সব মিলিয়ে আমাদের কালচারাল এক্সপ্রেশন বদলে গেছে। একসময় যেটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ বলে প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা হতো, সমাজের মানুষ মনে করে সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সেটি উদযাপন করার সময় এখন। এতে করে ইতিহাস হারিয়ে যায় এ চিন্তা বিজ্ঞাপন নির্মাতারা মনে রাখবেন না, সমাজের মধ্যবিত্তকে মনে রাখতে হবে।’

বিজ্ঞাপনের এই পরিবর্তন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেকগুলো বিষয় এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন ধরেন, আগে আমরা জানতাম একুশ পালন করা হয়, এখন সেটি উদযাপন করা হয়। তাই এটাকে একটা উৎসবের দিবস হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর কারণ একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে ব্যবসা, কনসার্টের আয়োজন। ব্যবসার কারণে একুশে এখন ফ্যাশন, ইতিহাস বা শোকের দিন নয়।’

বিজ্ঞাপনে বদলে গেছে একুশ!

এ বিষয়ে সাংবাদিক ও সমাজবিজ্ঞানী আফসান চৌধুরী মনে করেন, ‘বতর্মান পরিস্থিতিতে এমনটাই হওয়ার কথা। বিজ্ঞাপন নিজে থেকে কিছু তৈরি করে না।’

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন যে ধরনের বিজ্ঞাপন দেখা যায় তার সবই লাইফস্টাইলজেড বিজ্ঞাপন। রাস্তায় রাস্তায় একুশেতে বাজছে ১৬ ডিসেম্বরের গান। তার মানে এসবই সংস্কৃতিগতভাবে মধ্যবিত্তের কাছে প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বিজ্ঞাপনে বদলে গেছে একুশ!

তিনি আরও বলেন, এসব উচ্চমধ্যবিত্তের বিজ্ঞাপন। নিম্ন মধ্যবিত্তের এর সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তদের মতো আর কোনও দেশে মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তের মুখাপেক্ষি নয়, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের লাইফস্টাইলটা খুব জরুরি। জুঁইয়ের ‘এক চুলও ছাড় না দেওয়া’ বিজ্ঞাপনের উল্লেখ করায় তিনি বলেন, ইতিহাস কিভাবে তুলে ধরছে সেটা ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু লক্ষণীয় হলো, অহংকারের প্রকাশ কিন্তু তারা করছে। কেবল প্রকাশের ধরনটা বদলে গেছে।

বিজ্ঞাপনে বদলে গেছে একুশ!

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রাজীব মীর মনে করেন ভাষা কোনও ব্যবসা নয়, ‘ভাষা হলো বিনিময়। ভাষার যেমন প্রাণ আছে তেমনি খুব বিশাল এক রাজনীতিও বটে। যে কারণে ভাষার জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ভিত্তি। এখন সমজদার বাংলা সংস্কৃতি বিবর্জিত সংস্কৃতির মহাজনরা পণ্য বিক্রয়ে বাংলার অপব্যবহার করছেন। বিদেশি সংস্কৃতির ডামাঢোলে ফেলে পণ্য বিক্রয়ে স্বদেশি সংস্কৃতি বিকিয়ে বহুজাতিকদের সঙ্গে আপোস করছেন। বিজ্ঞাপনে সৃজনশীলতা আনয়নের নাম করে বাংলা ভাষাকে হেয় করা হচ্ছে।’

বিজ্ঞাপনে বদলে গেছে একুশ!

এটি কোনও পরিবর্তন না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘পরিবর্তন তো প্রগতি। ব্যবসা যখন ভাষা বিকাশে, সংস্কৃতি বিকাশে অনুঘটক হবে, সেটাই বাংলাভাষার ঠিক অবস্থান, বাংলাদেশের সমৃদ্ধির চরিত্র। বিজ্ঞাপনে অযথা সৃজনশীল বিকৃতি মানুষের মনকে সাময়িক পণ্যায়িত করছে হয়তো। বাংলা ডুবে যাচ্ছে সাম্রাজ্যের গহ্বরে।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘এই পরিবর্তনগুলো যুগবদলের কারণে হয়েছে। কিন্তু কতটা যৌক্তিকভাবে হয়েছে, সেটা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সময়টা এখন পারফরমেটিভিটির ।’ তিনি  বলেন, ‘আরেকটা হলো ভোক্তাসংস্কৃতি আমাদের জীবনে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে গেছে। এই দুই বিষয় মিলে একুশ উপলক্ষে প্রকাশের  ধরন বদলে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘‘একুশের মূল চেতনা 'মাথা নত না করা'। মানুষ এখন একুশকে উদযাপন করে, কিন্তু আশপাশে কী ঘটে চলেছে, সেবিষয়ে তেমন রাজনৈতিক অভিব্যক্তি নেই তাদের।’

/এসটি/

 আরও পড়ুন: আজ একুশে ফেব্রুয়ারি: রাষ্ট্রভাষার অধিকারের দিন

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেসি অনভিজ্ঞ বলেই আপত্তি ছিল মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংকের
জেসি অনভিজ্ঞ বলেই আপত্তি ছিল মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংকের
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু