X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ যাত্রায় ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চই ভরসা

শাহেদ শফিক
১৭ জুন ২০১৭, ২৩:১২আপডেট : ১৮ জুন ২০১৭, ১৪:০৪

ঈদ উপলক্ষে লক্কর-ঝক্কর লঞ্চ মেরামত করা হচ্ছে, ছবি নাসিরুল ইসলঅম ঈদের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এরই মধ্যে কর্মস্থল ছাড়তে করতে শুরু করেছে রাজধানীর কর্মজীবী মানুষ। ভিড় বাড়ছে টার্মিনালগুলোতে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন পরিবহন মালিকরা। তবে প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণারও আশ্রয় নিচ্ছেন কেউ কেউ। লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহনগুলো রঙ-কালি করে প্রস্তুত রেখেছেন অনেকেই। সব মিলিয়ে এ বছরও নৌপথে ভরসা ত্রুটি ও ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৩৫ শতাংশ যাত্রী চলাচলের অন্যতম মাধ্যম নৌপথ। কিন্তু এ পথে নিরাপদ ও পর্যাপ্ত বাহনের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে ঘরমুখো মানুষের ভিড় থাকে কয়েকগুণ। এ সুযোগে কাজে লাগিয়ে মালিকরা তাদের পুরানো ও ঝুঁকিপুর্ণ লঞ্চগুলো নৌপথে নামিয়ে দেন। তাছাড়া ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি যাত্রী পরিবহন করে। আর এতেই ঘটে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা।

নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের ৩৫ হাজার নৌযানের মধ্যে বর্তমানে নিবন্ধিত নৌযান প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার। এরমধ্যে যাত্রীবাহী নৌযান দুই হাজার ২২৫টি। শুধু বুড়িগঙ্গা নদীতেই রয়েছে সাড়ে চার হাজার বিভিন্ন ধরনের লঞ্চ। এরমধ্যে ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র সাত হাজার ৮২টির। এসব লঞ্চের অর্ধেকেরই রেজিস্ট্রেশন নেই। যে কারণে গত ৩০ বছরে নৌ-দুর্ঘটনায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সবচেয়ে বড় হতাশার বিষয় হচ্ছে বিশাল এ নৌযানগুলোতে লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা মাত্র ১৫০ জন।

তবে বিআইডাব্লিউটিএর নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ জানিয়েছে, গত ৬৬ বছরে দেশে দুই হাজার ১২২টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ছয় হাজারের মতো যাত্রী নিহত হয়েছেন। মামলা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৪১টি মামলা। বাকি মামলাগুলো ঝুলে রয়েছে। কিছু মামলার কোনও হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোলোতে অপরাধীদের উল্লেখযোগ্য কোনও শাস্তি হয়নি।

সম্প্রতি দেশের নৌযানগুলোর উপর গবেষণা করেছে বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট। এতে দেখা গেছে, কারিগরি ও অবকাঠামোগত ত্রুটি, চালকের অদক্ষতা, কার্যকর তদারকি না থাকা এবং অতিরিক্ত যাত্রীর করণে দেশে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া যেসব লঞ্চ পুরোনো নকশায় নির্মিত সেগুলোও বর্তমান সময়ে বেশি দুর্ঘটনায় পড়ছে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর এপ্রিল থেকে মে মাসেই বেশি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। এ দুই মাস নৌ চলাচলের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া জুন মাসও এর আওতায় থাকলেও তাতে কাযর্কর কোনও ব্যবস্থা নেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। অনেক সময় বৈরি আবহাওয়া লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মালিকরা তা মানছেন না। সর্বশেষ গত ১৩ জুন নৌ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও একটি যাত্রীবাহী ট্রলার ডুবে যায়। অন্যদিকে, এ পর্যন্ত দেশে যেসব নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় ৭০ ভাগই ত্রুটিপূর্ণ নকশার কারণে হয়েছে বলে নিরাপদ নৌ-পথ বাস্তবায়ন জোটের এক গবেষণায় দেখা গেছে। বর্তমান সময়ের দুর্ঘটনাগুলোও একই কারণে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লঞ্চের দৈর্ঘ, প্রস্থ, ড্রাফট ও উচ্চ এ চারটি বিষয় বৈজ্ঞানিক ও আনুপাতিকভাবে একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু যাত্রী ধারণ ক্ষমতাতে মালিকরা খেয়াল খুশিমতো লঞ্চের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা বাড়ান, তখনই লঞ্চটি ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটছে ২০০৩ সালে। ওই বছর তিনটি নৌ-দুর্ঘটনায় মারা গেছে এক হাজার ১৫ জন যাত্রী। এছাড়া ১৯৯৯ সালে ১০৪ জন, ২০০০ সালে ১০৪ জন, ২০০১ সালে ৪০ জন, ২০০২ সালে ৬০, ২০০৭ সালে ৫০৩ জন, ২০০৮ সালে ১১২ জন, ২০০৯ সালে ২৩২ জন, ২০১৩ সালে ৩৯ জন এবং ২০১২ সালে ১৫০ জন মারা যান।

নৌপরিবহন সংক্রান্ত ১৯৭৬ সালের আইনে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটলে মালিক, চালক ও জরিপকারীসহ অনেকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও নকশাকারী বা নির্মাণকারীর বিষয়ে কিছুই বলা নেই এ আইনে। এ জন্যই লঞ্চগুলোর নকশা নির্মাণ ও অনুমোদনে সংশ্লিষ্টরা দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যায়।

লঞ্চ নির্মাণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী কোনও লঞ্চ দুর্যোগের কবলে পড়ে ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত কাত হলেও এতে পানি ঢুকবে না। দেশের দেশের লঞ্চগুলো মাত্র ১০ থেকে ১৪ ডিগ্রি পর্যন্ত কাত হলেই তাতে পানি ঢুকে পড়ে।

ঈদ উপলক্ষে লক্কর-ঝক্কর লঞ্চ মেরামত করা হচ্ছে, ছবি- নাসিরুল ইসলঅম জানা গেছে, প্রতিবছর যাত্রীবাহী নৌযানগুলোর মধ্যে মাত্র ৯০০টির মতো লঞ্চের সার্ভে করা হয়। আবার অধিকাংশ লঞ্চকে সার্ভের জন্য চিঠি দেওয়া হলেও তারা কোনও উত্তর দেয় না। রাজনৈতিক কারণে অনেক লঞ্চ কর্তৃপক্ষের এসব নিয়ম ও অইন মানছে না।

শুধু নকশা, কারিগরি কিংবা কাঠামোগত ত্রুটি নয় চালকের অদক্ষতার কারণেও বাড়ছে নৌ-দুর্ঘটনা। কোস্ট ট্রাস্টের ওই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ‘চালকের গাফিলতি, অদক্ষতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। মাস্টার ও চুকানিদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও তা কেউ মানছে না।

এ বিষয়ে কোস্ট ট্রাস্টের সহকারী পরিচালক মো. মুজিবুল হক মনির বলেন, ‘সম্প্রতি কোকো দুর্ঘটনা মামলায় রায় হয়েছে। রায়টা হতাশা জনক। আশার বিষয় হচ্ছে কয়েক জন কর্মকর্তার শস্তি হয়েছে। কিন্তু মালিক পক্ষের কারও শাস্তি হয়নি। প্রত্যেক দুর্ঘটনার পর একটা করে তদন্ত কমিটি হয়। এ পর্যন্ত ৫০০ কমিটি হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র তিন-চারটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। প্রতিবেদনগুলোতে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তার ৮০ ভাগ বাস্তবায়ন হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বলে আসছি সার্ভেয়ার বাড়ানো হোক। পর্যাপ্ত লাইফ বয়া নেই। লঞ্চ ছাড়ার আগে যাত্রীদের সংখ্যাসহ তালিকা করা হোক। তাহলে দুর্ঘটনায় পড়লে অন্তত একটা হিসাব থাকবে।’

এ জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোনও ঝুঁকিপূর্ণ ও ফিটনেস বিহীন লঞ্চ নদীতে নামতে দেওয়া হবে না। ঈদের পাঁচ দিন আগেই বেশ কয়েকটি মোবাইল কোর্ট থাকবে। র‌্যাব, পুলিশ, আনসারসহ পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাপ) সংস্থার সিনিয়র সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সদরঘাটে যাত্রীবাহী দুই শতাধিক লঞ্চ রয়েছে। এগুলোর কাগজপত্রে কোনও ত্রুটি নেই। বাকিগুলোর থাকতে পারে। ঈদের আগে প্রতিটি জাহাজের ফিটনেস চেক করা হয়। ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে সেগুলো সারিয়ে নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন-
ঈদ যাত্রায় লক্কড়-ঝক্কড় লঞ্চে চলছে রঙ-কালি

/এসএমএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাজধানীতে মাদক কারবারির ছুরিকাঘাতে যুবকের মৃত্যু
রাজধানীতে মাদক কারবারির ছুরিকাঘাতে যুবকের মৃত্যু
টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে জাতীয় লজিস্টিক্স নীতি প্রণয়ন
টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে জাতীয় লজিস্টিক্স নীতি প্রণয়ন
গ্রিনপিন সেবা চালু করলো এনসিসি ব্যাংক
গ্রিনপিন সেবা চালু করলো এনসিসি ব্যাংক
রাজনৈতিক সংশয়ের মুখোমুখি নেতানিয়াহু
গাজায় যুদ্ধবিরতি নাকি রাফাহতে হামলারাজনৈতিক সংশয়ের মুখোমুখি নেতানিয়াহু
সর্বাধিক পঠিত
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?