X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ও ভারতের বিচার বিভাগে সংকট: মিল কোথায়

রঞ্জন বসু, দিল্লি
১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ১৭:২৫আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ২০:০৮

বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও ভারতের বর্তমান প্রধান বিচারপতি  দীপক মিশ্র ভারতে সুপ্রিম কোর্টের চার জন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি গত ১২ জানুয়ারি দুপুরে একযোগে ও প্রকাশ্যে দেশের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র’র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এরপর থেকে বলা হচ্ছে, দেশটির বিচার বিভাগ কখনও এত বড় সংকটের মুখোমুখি হয়নি।

কাকতালীয়ভাবে কিছুদিন আগে বাংলাদেশেও  প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগকে কেন্দ্র করে নাটকীয়তা দেখা গেছে। তখনও অনেকটা একইরকম কথা বলা হয়েছিল। দুই প্রতিবেশী দেশের গণতন্ত্রে বিচার বিভাগ নিয়ে বিতর্ক ও সংকটে অদ্ভুত কিছু সাদৃশ্য আছে। একইসঙ্গে রয়েছে বেশকিছু ফারাক। এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো সেসব মিল-অমিল।

প্রথম মিল হলো, দুই দেশেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রধান বিচারপতি স্বয়ং। অভিযোগের আঙুলও সরাসরি তাদের দিকেই। ভারতের ক্ষেত্রে বিচারপতি দীপক মিশ্র। আর বাংলাদেশে ছিলেন বিচারপতি এস কে সিনহা।

সতীর্থ বিচারপতিরা অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন স্পর্শকাতর মামলার শুনানিতে বেঞ্চ গঠনের সময় রীতিমতো স্বেচ্ছাচারিতা করছেন দীপক মিশ্র। সিনিয়র জাজদের উপেক্ষা করে তিনি দায়িত্ব দিচ্ছেন অনেক জুনিয়রকেও। এর মধ্যে এমন একটি মামলা (মেডিক্যাল কলেজ রেজিস্ট্রেশন মামলা) রয়েছে, যেখানে তার নিজের ভূমিকা পর্যন্ত প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সেখানে ঘুষের লেনদেন হয়েছে বলেও সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর বিরুদ্ধে মামলা শুনছিলেন, এমন এক বিচারকের মৃত্যুর ঘটনার সংবেদনশীল মামলাও নিজের পছন্দের বিচারপতিদের এজলাসে পাঠিয়ে দেন দীপক মিশ্র। তখনই ওই চার বিচারপতি সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগগুলো তোলেন।

এস কে সিনহার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছিল, সেগুলোও ছিল প্রধানত আর্থিক। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তাদের দেওয়া বিবৃতিতে জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে মোট ১১ দফা অভিযোগ ছিল– দুর্নীতি, বিদেশে অবৈধভাবে অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম ও ‘নৈতিক স্খলনে’র। যদিও এসব অভিযোগের বিবরণ পাওয়া যায়নি। তবে বিচারপতি সিনহা যে এর কোনোটিরই সদুত্তর দিতে পারেননি সেটি জানানো হয়েছে।

দ্বিতীয় মিল– উভয় ক্ষেত্রেই সতীর্থ বিচারপতিদের একাংশ প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথে হেঁটেছেন। ভারতে চার জন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি চেলমেশ্বরের বাড়ির লনে নজিরবিহীনভাবে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের অভিযোগের কথা জানান। একইভাবে বাংলাদেশেও অন্তত পাঁচ জন বিচারপতি জানিয়ে দিয়েছিলেন, তারা প্রধান বিচারপতি সিনহার সঙ্গে একই বেঞ্চে বসতে পারবেন না।

তৃতীয় বা সবচেয়ে বড় মিল হলো, দুই দেশেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বা নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এই সংকটের কারণে। পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও প্রধান বিচারপতিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে অস্বীকার করার উপায় নেই– শীর্ষ আদালতের কার্যক্রমের ওপর দুই দেশের মানুষের আস্থা টলে গেছে।

ভারতের সাবেক অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘গণতন্ত্রে বিচার বিভাগ হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা মানুষের শেষ ভরসা। বিচার পাওয়ার জন্য তারা সেদিকেই তাকিয়ে থাকেন। সেই বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ ব্যক্তিকে নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে কিংবা তাকে টাকা দিয়ে কেনা যায় কিনা এমন সন্দেহ তৈরি হয়, তখন সেই আস্থা চুরমার হয়ে যায়। আমার ধারণা, বাংলাদেশে কিছুদিন আগে সেটাই ঘটেছে, আর এখন ভারতেও ঘটছে।’

আর অমিলের কথায় যদি আসি, তাহলে দুই সংকটের মধ্যে প্রধান ফারাক হলো, ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার স্পষ্টভাবে অভিযুক্ত প্রধান বিচারপতির পাশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ দীপক মিশ্র এই সংকটে নরেন্দ্র মোদি সরকারকে পাশে পেয়েছেন। কিন্তু বিতর্কের গোড়া থেকেই এস কে সিনহা বাংলাদেশ সরকারের কারও সমর্থন পাননি। অথচ তারাই একদিন ওই পদে এনেছিলেন তাকে।

ভারতে চার বিচারপতির বিদ্রোহের কিছুক্ষণ পরেই প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করতে যান প্রধানমন্ত্রী মোদির ব্যক্তিগত সচিব ও বিশেষ আস্থাভাজন নৃপেন্দ্র মিশ্র। বাংলাদেশেও যখন সংকট চরমে, তখন প্রধান বিচারপতি সিনহার সঙ্গে সরকারের দূত হিসেবে দফায় দফায় কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তবে দীপকের ব্যাপারটা ছিল বিপদ মোকাবিলার লক্ষ্যে। অন্যদিকে বাংলাদেশে খোঁজা হয়েছে এস কে সিনহার সম্মানজনক বিদায়ের রাস্তা।

আর একটি বিষয়ে শেষ পর্যন্ত দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে মিল নাকি অমিল থাকবে সেই উত্তর শুধু সময়ই দিতে পারবে। বাংলাদেশে ওই সংকটের জের ধরে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত বিতর্কিত পটভূমিতে এস কে সিনহাকে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। এটা সবারই জানা। কিন্তু ভারতে এই বিতর্কের দায় নিয়ে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রকে শেষ পর্যন্ত ‘ইমপিচমেন্ট’ বা অভিশংসনের মুখে পড়তে হবে কিনা তা আপাতত বলা যাচ্ছে না। বিদ্রোহী চার বিচারপতি শুধু বলেছেন, ‘জাতিই এর উত্তর স্থির করবে।’

বছরদেড়েক আগে ভারত সফরে এসে এক একান্ত আলাপচারিতায় বাংলাদেশের তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘ভারতের বিচার বিভাগীয় মডেলের বেশকিছু জিনিস আমার খুব প্রিয়। আমার কার্যকালেই তার মধ্যে বেশ কয়েকটি বাংলাদেশেও চালু করতে চাই। সেই লক্ষ্যে কাজও শুরু করেছি।’

বিচারপতি সিনহা তখন নিশ্চয়ই ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি, বাংলাদেশে বিচার বিভাগীয় সংকটের একটা অবিকল ‘রেপ্লিকা’ ভারতও  অল্প সময়ে নিজেদের বিচার বিভাগেও প্রয়োগ করে ফেলবে!

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ