X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের ব্যয়ভার বহন করতে হবে বাংলাদেশকেই?

গোলাম মওলা
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৯:০৩আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৯:২৮

উখিয়ার বালুখালী এলাকায় রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী বসতি। ছবি: বাংলা ট্রিবিউন ‘দিন যত যাবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ তত কমবে’– এমন মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি অন্যদিকে চলে যাবে। কারণ, বিশ্বে প্রতিদিন নতুন নতুন ইস্যু সামনে আসছে। এ কারণে রোহিঙ্গাদের ব্যয়ভারের পুরো বোঝা বাংলাদেশকেই বহন করতে হতে পারে।’ 

সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক উল্লেখ করেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের খাদ্য সরবরাহে দাতাগোষ্ঠীগুলোর আগ্রহ কমতে শুরু করেছে। ফলে রোহিঙ্গাদের খাওয়া, পরা, থাকাসহ সব দায়িত্ব নিতে হবে বাংলাদেশকে। দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা কিংবা শিক্ষা অথবা সামাজিক নিরাপত্তা কমিয়ে তাদের পেছনে খরচ করতে হবে। অথবা উন্নয়ন ব্যয় করতে হবে কম।

ড. সেলিম রায়হান বলেছেন, ‘নির্বাচনি বছরে এমনিতেই বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে বাজেট থেকে রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় করতে গেলে চাপে পড়তে হতে পারে সীমিত সম্পদের বাংলাদেশকে।’ রোহিঙ্গা ক্যাম্প

এদিকে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সরবরাহে দাতাগোষ্ঠীর আগ্রহ কমতে শুরু করেছে বলে মন্তব্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলের। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ইতালির রাজধানী রোমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য খাবার সরবরাহের ব্যাপারে দাতা সংস্থার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। আমরা জাতিসংঘের ব্যবস্থার আওতায় দাতা সংস্থার মধ্যে এই আগ্রহটা ধরে রাখতে চেষ্টা করছি। কিন্তু এটি চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম জানিয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পেছনে বছরে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করতে হবে। এই বিপুল অর্থের জোগান দিতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকট তৈরি করবে।

সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘বাংলাদেশের যেসব স্থানে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে সেখানে বর্ষাকালে ভূমিধস হতে পারে। শরণার্থী শিবিরে আঘাত আনতে পারে সাইক্লোন। এ কারণে মানবিক বির্যয়ের শঙ্কা থাকছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের কারণে নিরাপত্তা সংকট তৈরি হলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কোনও বিদেশি বিনিয়োগকারী আসবে না।’

জানা গেছে, বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে খাওয়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। গত ছয় মাসে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৮ কোটি ডলার মূল্যের খাবার বিতরণ করেছে ডব্লিউএফপি। এই সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, প্রতি মাসে রোহিঙ্গাদের খাবার সরবরাহ করতে ২ কোটি থেকে আড়াই কোটি ডলার প্রয়োজন।

এদিকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি গবেষণা করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, নতুন-পুরনো মিলিয়ে সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার কারণে ভবিষ্যতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকে। তা হতে পারে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত। কক্সবাজারের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশকারী রোহিঙ্গারা (ফাইল ছবি)

মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এখন থেকে প্রতিদিন যদি ৩০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়, তাহলে সময় লাগবে সাত বছর। মূল্যস্ফীতি ও জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি বাদ দিয়ে বিদ্যমান রোহিঙ্গাদের পেছনে ২০২৫ সাল পর্যন্ত খরচ করতে হবে ৪৪৩ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩৫ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।

জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধিকে বাদ দিয়ে মূল্যস্ফীতি যোগ করে প্রতিদিন যদি ৩০০ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে পাঠানো হলে সময় লাগবে আট বছর। অর্থাৎ ২০২৬ সাল নাগাদ রোহিঙ্গাদের পেছনে খরচ করতে হবে ৫৯০ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৪৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধিকে বাদ দিয়ে মূল্যস্ফীতি যোগ করে প্রতিদিন যদি ২০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয় তাতে সময় লাগবে ১২ বছর। সেক্ষেত্রে ২০৩০ সাল নাগাদ তাদের পেছনে খরচ হবে ১ হাজার ৪৫ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৮৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

সিপিডির হিসাব অনুযায়ী, আগামী জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের পেছনে খরচ হবে ৮৮ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। সিপিডি বলছে, ২৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প তৈরির কারণে ৬ হাজার একর বনের জমি উজাড় হয়েছে। সিপিডির হিসাবে এর আর্থিক মূল্য ৭৪১ কোটি টাকা।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী সিপিডি হিসাব করে দেখেছে, এ বছরের জুন পর্যন্ত ৭ হাজার ১২৬ কোটি টাকা জরুরি। যা দেশের মোট জাতীয় বাজেটের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া এত বিপুল অর্থ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের দশমিক ০৩ শতাংশ ও মোট রাজস্বের ২ দশমিক ৫ শতাংশ।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জীবনযাপনে যে অর্থের প্রয়োজন পড়বে তার একটি অংশ বরাদ্দ দিতে হবে বাজেট থেকেই।’

আগের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে সিপিডির গবেষণা পরিচালক বলেন, ‘দুই লাখ ৩৩ হাজার রোহিঙ্গার দৈনন্দিন খরচের জন্য জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে বছরে ১ কোটি ৩৮ লাখ ডলার বরাদ্দ থাকে। কিন্তু ৪২ লাখ ডলারের বেশি পেতো না তারা। অর্থাৎ বরাদ্দেরও প্রায় ১ কোটি ডলারের কাছাকাছি ঘাটতি থাকতো। আর এখন তো রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়ছে।’

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন তাদের থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসাসহ সব ধরনের প্রয়োজন মেটাতে অর্থের জোগান দেওয়ার কথা আন্তর্জাতিক সংগঠনের। কিন্তু তারা যদি তা না দেয় তাহলে সরকারের বাজেট থেকেই সহায়তা করতে হবে।’

পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালকের মন্তব্য, ‘বাজেট থেকে ব্যয় করলে অর্থনীতিতে এর চাপ পড়বে কিছুটা। তবে এখন পর্যন্ত বাজেটে এ নিয়ে চাপ পড়েনি। এ কারণে বিদেশিরা সহায়তা বন্ধ না করা পর্যন্ত চিন্তার কোনও কারণ নেই। আর আমরা এই ইস্যুকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কতদিন জিইয়ে রাখতে পারি তাও দেখার বিষয়।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে এবারের বাজেটে চাপ না পড়লেও সামনের বাজেটে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংশোধিত বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য প্রকল্প কাটছাঁট করতে হবে।’

 

 

/জেএইচ/আপ-এফএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
অস্ত্র ও গুলিসহ ৫ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক
উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
সর্বশেষ খবর
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
‘গরমে’ শ্রেণিকক্ষে অজ্ঞান দুই শিক্ষার্থী
‘গরমে’ শ্রেণিকক্ষে অজ্ঞান দুই শিক্ষার্থী
গুলিস্তানে কমিউনিটি পুলিশ সদস্যের মৃত্যু, সন্দেহ ‘হিট স্ট্রোক’  
গুলিস্তানে কমিউনিটি পুলিশ সদস্যের মৃত্যু, সন্দেহ ‘হিট স্ট্রোক’  
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে