X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতীয় গবেষকদের রায়, উন্নয়নের প্রশ্নে বিএনপি আমল কোনও তুলনাতেই আসবে না

রঞ্জন বসু, দিল্লি প্রতিনিধি
০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ২৩:৫১আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ২৩:৫৯






বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালে বিগত এক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তথা সার্বিকভাবে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে তা নিয়ে দ্বিমত করার সুযোগ নেই বলে মনে করা হয়। তবে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় যে জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল, সেই আমলের তুলনায় এই অর্জন কতটা কম বা বেশি, প্রতিবেশী ভারতের অন্তত তিনজন নামী গবেষক ও পর্যবেক্ষক এমন প্রশ্নের জবাবে প্রায় একবাক্যে বলছেন, বিএনপি আমলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থনৈতিক অর্জন কোনও তুলনাতেই আসবে না। এমনকী তারা এ কথাও বলেছেন, প্রবৃদ্ধি ও আর্থিক স্থিতিশীলতা যদি উন্নয়নের প্রধান মাপকাঠি হয় তাহলে আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশের ভোটারদের আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প বেছে নেওয়ারও অবকাশ নেই।

ড. শ্রীরাধা দত্ত নিয়মিত বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহে নজর রাখা এই তিন পর্যবেক্ষকের মতে, সাম্প্রতিক অতীতে বহুবার শেখ হাসিনা সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’। গত নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তারা পর্যন্ত লিখেছে, ‘আওয়ামী লীগের শাসনে অর্থনীতির অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশের জিডিপি সম্প্রসারিত হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে, যা ভারত বা পাকিস্তানের চেয়েও অনেক বেশি।’
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ আরও লেখে, ‘জনমত জরিপগুলোও বলছে মানুষ সার্বিকভাবে সরকারের কাজকর্মে সন্তুষ্ট। সামরিক অভ্যুত্থানের কোনও আশঙ্কা নেই বললেই চলে। এবং তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতও প্রচ্ছন্নভাবে আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করছে।’
দ্য ইকোনমিস্টের এই পর্যবেক্ষণ থেকে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, ব্যাপক ও বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকারকে প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক এগিয়ে রেখেছে। কিন্তু বিএনপি জামানার চেয়ে সেই কাজের ধারা কোথায় আর কীভাবে আলাদা— এমন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন দিল্লির নানা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও থিংকট্যাঙ্কে যুক্ত তিনজন নামী নারী পর্যবেক্ষক।
বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো ড. শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘বহু বছর ধরে আমার বাংলাদেশে যাতায়াত, এখন যেন দেখছি অনেক অনেক দিন পর সে দেশে এক বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। গত দশ বছর ধরে প্রবৃদ্ধির হার সেখানে ৭ শতাংশের ওপর, এটা তো এক সাঙ্ঘাতিক অর্জন!’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি আমলে একটা বিরাট সমস্যা ছিল বিদ্যুতের সঙ্কট। সাধারণ মানুষ তো নাকাল ছিলেনই, বিদ্যুতের অভাবে ধুঁকছিল দেশের শিল্প, বিশেষত তৈরি পোশাক খাত। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই সেদিকে নজর দিয়েছিলেন, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনার চুক্তি করে এবং আরও নানা পদক্ষেপ নিয়ে সেই পরিস্থিতির অনেক উন্নতি ঘটিয়েছেন তিনি।’

ড. শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘আর দারুণ সব কাজকর্ম হচ্ছে সে দেশের অবকাঠামো খাতেও। শুধু পদ্মা সেতুই নয়, রাস্তাঘাট-রেল অবকাঠামো থেকে শুরু করে আরও নানা দিকে যেভাবে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, কিংবা ঢাকার মতো শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে, তাতে যেমন কর্মসংস্থান হবে, তেমনি তার সুফল পাবে সাধারণ মানুষও।’
এই গবেষক আরও বলেন, ‘বিএনপি আমলে এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনগুলোতে (ইপিজেড) নানা সমস্যা লেগেই ছিল। এখন কিন্তু শিল্প পরিস্থিতি অনেক ভালো, অনেক নিয়ন্ত্রণে। শেখ হাসিনা সরকার চীন ও ভারতের জন্য আলাদা জায়গা নির্দিষ্ট করে ইপিজেড তৈরির কাজও শুরু করে দিয়েছেন।’
সব মিলিয়ে শ্রীরাধা দত্ত বিশ্বাস করেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ একটা কৃষিনির্ভর (অ্যাগ্রেভিয়ান) অর্থনীতির দেশ থেকে অনেক ‘আপগ্রেডেড’ (উন্নীত) হয়েছে, আর সেই কৃতিত্ব শেখ হাসিনার সরকারকে না দিয়ে কোনও উপায় নেই!

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনসের (ইকরিয়ের) অধ্যাপক ড. অর্পিতা মুখার্জি বলেন, ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যে একটা দেশের অর্থনীতির উন্নয়নকে কতটা সাহায্য করে আমি বলবো, বাংলাদেশে গত দশ বছরের আওয়ামী লীগ শাসন তার একটা ক্লাসিক দৃষ্টান্ত। যে দেশটা হরতাল-বন্ধ-রাজনৈতিক সংঘাতের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল মাত্র এক দশক আগেও, সেখানে এখন অর্থনীতির চাকা এগোচ্ছে জোর কদমে।’
তিনি বলেন, ‘আমি সে দেশের তৈরি পোশাক খাতকে খুব কাছ থেকে দেখি এবং আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই, তারা সেখানে ভারতের চেয়েও অনেক ভালো করছে। বহু বছর ধরে একটা জায়গায় আটকে থাকার পর তারা এখন জোর দিয়েছে গুণগত মান বৃদ্ধির ওপর, আর সেখানে সরকার ওই শিল্পকে ভীষণভাবে সাহায্য করছে।’
ড. অর্পিতা মুখার্জি ড. অর্পিতা মুখার্জি বলেন, ‘বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, ডিএফআইডি-র মতো দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা যখন বাংলাদেশ ঘুরে ভারতে আসেন, তারা আমাদের জিজ্ঞেস করেন— বাংলাদেশ অনুদানের টাকা এত ভালোভাবে খরচ করতে পারলে বা ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ে (সামর্থ নির্মাণ) কাজে লাগাতে পারলে ভারত কেন সেটা পারছে না? তখন সত্যিই কী উত্তর দেবো আমরা বুঝে পাই না!’
তিনি আরও বলেন, ‘আর একটা জিনিস না বললেই নয়, বর্তমান বাংলাদেশ সরকার যেভাবে সেখানে জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করতে শুরু করেছে সেটাও কিন্তু অর্থনীতির গতিকে অনেক আশ্বস্ত করেছে।’
ইকরিয়েরের এই অধ্যাপক বলেন, ‘হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার আগে-পরে তারা যেভাবে মৌলবাদের মোকাবিলা করেছে, সেটা সত্যিই শেখার মতো। অথচ এই বাংলাদেশেই আমরা একযুগ আগে দেখেছিলাম বাংলাভাই বা জেএমবি কীভাবে প্রচ্ছন্ন সরকারি মদতে অবাধে তাদের তৎপরতা চালিয়ে গিয়েছিল।’
ড মুখার্জিও আসলে এই মতেরই শরিক যে গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা গুণগত উত্তরণ হয়েছে, তারা অনেক ‘অ্যাকাডেমিক’ হয়ে উঠেছে। ‘যেমন ধরুন, বাংলাদেশ এখন আর শুধু দুবাই-কুয়েতে লো-স্কিলড লেবার পাঠানোর কথাই ভাবে না; দলে দলে পেশাদারদেরও (প্রোফেশনাল) তারা বিদেশে কাজ করতে পাঠাচ্ছে’, যেটা তার মতে, সার্বিক উন্নতির একটা বড় লক্ষণ।
ড. অর্পিতা মুখার্জি ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের গবেষক ও ফেলো ড. পুষ্পিতা দাস বলেন, ‘প্রথমেই মনে করিয়ে দেবো, এই সরকারের আমলেই কিন্তু বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। মাত্র বছর ১৫ আগেও যে দেশটি বৈদেশিক সাহায্যের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল কিংবা প্যারিসের দাতা সম্মেলনের ভরসায় যাদের তাকিয়ে থাকতে হতো, তাদের জন্য এটা কত বড় অর্জন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আর এটার জন্য সে দেশের রাজনৈতিক সরকারকে (পলিটিক্যাল গভর্নমেন্ট) কৃতিত্ব তো দিতেই হবে। শেখ হাসিনা সরকার প্রমাণ করে দিয়েছেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে তারা একটি সঠিক ফোকাস নিয়ে এগোচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘দেশের ভেতরে বা বাইরে থেকে যা-ই সংকট আসুক (যেমন জঙ্গিবাদ বা রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল) তারা সেই ফোকাস থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। আর সে কারণেই অর্থনীতির চাকাও এগিয়েছে মসৃণ গতিতে। আর পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নের প্রায় সব সূচকেই তারা প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও অনেক এগিয়ে। কাজেই এটাকে ‘ট্রিমেন্ডাস জব’ না-বলে উপায় কী!’
ড. পুষ্পিতা দাস আরও বলেন, ‘আসলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনীতির উদারীকরণ ও সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সেই নব্বইয়ের দশকের আশেপাশেই। ভারতে যেমন, থাইল্যান্ডেও তেমন। তবে এই অঞ্চলের নানা দেশে সেই প্রক্রিয়া কোথাও একটু আগে, কোথাও একটু পরে ‘পিক’ করেছে (তুঙ্গে উঠেছে)। বাংলাদেশ এই শতাব্দীর প্রথম দশকে (অর্থাৎ যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল) যে সুযোগ হারিয়েছিল, সেটাই তারা পুষিয়ে নিয়েছে পরের দশকে, এই সরকারের আমলে!’
পুষ্পিতা দাসও বিশ্বাস করেন, অর্থনীতিই যে একটা দেশের চেহারা বদলে দিতে পারে, সেই দূরদৃষ্টি শেখ হাসিনার মধ্যে আগাগোড়া ছিল বলেই এই অর্জনটা সম্ভব হয়েছে। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নানা সমস্যা তার পূর্বসূরির মতো শেখ হাসিনার সামনেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে, কিন্তু তিনি সেটাকে অ্যাড্রেস করেছেন সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।
আগামী ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বাংলাদেশের ভোটাররা এই অর্থনৈতিক জয়যাত্রাকে কতটা গুরুত্ব দেন, এখন দেখার বিষয় সেটাই।

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিতে আগ্রহী অস্ট্রিয়া
বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিতে আগ্রহী অস্ট্রিয়া
ভোটারবিহীন নির্বাচন চুন ছাড়া পানের মতো: ইসি রাশেদা
ভোটারবিহীন নির্বাচন চুন ছাড়া পানের মতো: ইসি রাশেদা
সিরি আ’য় এবারই প্রথম এক ম্যাচে সব নারী রেফারি
সিরি আ’য় এবারই প্রথম এক ম্যাচে সব নারী রেফারি
ফেরিঘাটে টেম্পুর ধাক্কায় কলেজশিক্ষার্থী নিহত
ফেরিঘাটে টেম্পুর ধাক্কায় কলেজশিক্ষার্থী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ