পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করছেন আনসার সদস্যরা। ব্যাটালিয়ন আনসার এ বাহিনীর মূল ফোর্স হলেও আনসার বলতে মানুষ বোঝে সাধারণ আনসারদেরই। নির্বাচনে শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রথমেই ডাক পড়ে এই সাধারণ আনসারদেরই। এছাড়া পুলিশের সঙ্গে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্বও পালন করছেন তারা। আর এই সাধারণ আনসার সদস্যদের অভিযোগ, বাহিনীতে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। তাদের বেতন-ভাতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এই বেতনে জীবিকা নির্বাহ করা অনেক কঠিন। এরপরও জীবন-জীবিকার তাগিদে কাজ করে যেতে হচ্ছে বছরের পর বছর।
সাধারণ আনসারদের চাকরির ধরন
অঙ্গীভূত সাধারণ আনসারদের তিন বছর বাধ্যতামূলকভাবে ছয়মাসের জন্য বিরতিতে যেতে হয়। ছয়মাস পর নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আনসার সদস্যের কাছে সদর দফতর থেকে একটি অফার ম্যাসেজ যাবে। সেই ম্যাসেজে বলা হয়, তিনি কোন জায়গায় পুনরায় কাজে যোগ দেবেন। কিন্তু ছয়মাস পর সেই মেসেজ পেতে লেগে যায় আর আরও তিন থেকে চার মাস। বিরতির পর মেসেজ পাওয়া সম্পর্কে আনসার বাহিনীর ওয়েব সাইটে বলা হয়েছে, ‘স্মার্ট কার্ডধারী আনসারদের অঙ্গীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি একটি অটোমেটেড সিস্টেমে পরিচালিত হয়ে থাকে। আনসারদের নির্ধারিত বিরতিকালের পরেও অফার পাওয়ার জন্য ৩ থেকে ৪ মাস অপেক্ষা করতে হতো। বর্তমানে প্যানেলে আসার পর এ বিরতিকাল তিন-চার মাস থেকে কমে ১৫ দিনে এসে দাঁড়িয়েছে। এইচআরএম সিস্টেমে সম্প্রতি কিছু উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেওয়াসহ অফার-প্রত্যাশী আনসারদের ক্রমাগত সচেতন করায় অফার-প্রাপ্তিতে এ কাঙ্ক্ষিত ফলটি অর্জিত হয়েছে বলে আনসার সদর দফতরের দাবি। কিন্তু আনসার সদস্যদের অভিযোগ, বাস্তবতা ভিন্ন। তারা বলছেন, ছয় মাস বিরতির পর যে মেসেজ যাওয়ার কথা, সেটি পেতে অনেক ক্ষেত্রে আরও অতিরিক্ত ছয় মাস পার হয়ে যায়। আর এ সময়টি তারা সম্পূর্ণ বেকার থাকেন। কেউ খোঁজও নেয় না।
নিরাপত্তায় অতন্দ্র প্রহরী হচ্ছে অঙ্গীভূত সাধারণ আনসার
অঙ্গীভূত সাধারণ আনসার সদস্যরা দেশের সরকারি-বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান, সম্পত্তি, মার্কেট, হাটবাজার, যানবাহন, ব্যাংক, অর্থ-লগ্নিকারি প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সরকারঘোষিত বিশেষায়িত এলাকার যে কোনও সরকারি-বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও এলাকার নিরাপত্তা ও পাহারায় তারা দায়িত্ব পালন করছেন। আনসার সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চার হাজার ১০টি সংস্থায় ৪৮ হাজারেরও বেশি অঙ্গীভূত আনসার সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
পুলিশ ও বিজিবিতে সাধারণ আনসারদের দায়িত্ব পালন
ঢাকা মহানগর পুলিশে প্রায় দুই হাজার ৪০০ অঙ্গীভূত সাধারণ আনসার সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। এসব আনসার সদস্য পুলিশের সঙ্গে ট্রাফিকের দায়িত্ব ও বিভিন্ন থানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে পুলিশের সঙ্গে প্রায় আড়াই হাজার ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্য ও দুই হাজারের বেশি সাধারণ আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। বিজিবির সঙ্গে আপাতত কোনও আনসার সদস্য কাজ করছেন না বলে জানিয়েছেন বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খন্দকার ফরিদ হাসান।
বিমান বন্দর, সমুদ্র বন্দর ও স্থলবন্দরের নিরাপত্তা
বিমান বন্দর, সমুদ্র বন্দর ও স্থল বন্দরের নিরাপত্তায়ও দায়িত্ব পালন করছেন এসব অঙ্গীভূত সাধারণ আনসার সদস্যরা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই দুই হাজার ৪০০ অঙ্গীভূত সাধারণ আনসার ও ৪০ জন ব্যাটালিয়ন আনসার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বলে আনসার সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়া চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, রাজশাহী, সৈয়দপুর ও বরিশাল বিমানবন্দরে অঙ্গীভূত সাধারণ আনসাররা দায়িত্ব পালন করছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর ও দেশের স্থলবন্দরগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার কাজেও অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা কর্মরত রয়েছেন। যে কোনও নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাধারণ আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ৫ জন অঙ্গীভূত আনসার সদস্য মারা গেছেন। ২০১৩-১৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় রেলপথ ও সড়কপথের নিরাপত্তায় সাধারণ আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্ব এজতেমা, দুর্গাপূজাসহ বিভিন্ন উৎসবগুলোর সময় সাধারণ আনসার সদস্যরাই দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
সাধারণ আনসারদের বক্তব্য
ঢাকা মহানগরীর একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন সাধারণ আনসার সদস্য শাহীন। প্রতিষ্ঠানটির বাউন্ডারির ভেতরেই ক্যাম্প। ওই ক্যাম্পে থাকে ২৫ সদস্যের এক প্লাটুন। শাহীন বলেন, মাত্র ১৩ হাজার টাকা বেতন। ক্যাম্প না থাকলে তো আর চাকরির টাকা বাড়িতে পাঠানো যাবে না। এতে অন্তত বাসা ভাড়াটা লাগে না। গাদাগাদি করে থাকি। কিন্তু খাওয়া খরচ বাদ দিয়ে সামান্য কিছু টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারেন। যা দিয়ে কিছুই হয় না। ট্রাফিকে যারা কাজ করেন, তারা তো এক বেডে দু’জন করে থাকেন। বিভিন্ন স্থানে তাঁবু টানিয়ে থাকি আমরা। রেশন হিসেবে পান চাল, গম ও তেল। অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের যেভাবে রেশন দেওয়া হয়, সেভাবে দেওয়া হয় না। তিনি বলেন, তিন বছর পর যে ছয় মাসের বিরতিতে পাঠানো হয়, তখন তো বাহিনীর কেউ আমাদের চেনেও না।
একই ক্যাম্পের সহকারী প্লাটুন কমান্ডার মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দুঃখ-কষ্ট কেউ বুঝবে না। কাউকে বোঝাতে পারব না। তাই মাফ চাই। এ বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না। সরকারের বরাদ্দ যা দেয়, তাই পাই। চাকরি শেষে কী পাব, না পাব তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। প্রতি মাসে ৫শ’ টাকা করে আনসার ভিডিপি ব্যাংকের জন্য কেটে নেওয়া হয়। সেটা দু’বছর কাটবে। চাকরি থেকে যাওয়ার সময় সেটা দিয়ে দেওয়া বলে বলা হয়েছে।’ বিরতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একসময় দুই বছরেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হতো। এখন সেই বিরতি ছয়মাস করেছে।
আরও পড়ুন:
বিশেষ ও হিল আনসারদের চাকরি কবে স্থায়ী হবে?