বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্টের ঘটনা।)
উপমহাদেশের মানবিক সমস্যার সমাধানের পথ সুগম করে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদল এদিন নয়াদিল্লিতে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর ফলে পাকিস্তানে আটকে পড়া কয়েক লাখ বাঙালি তাদের স্বাধীন স্বদেশভূমিতে ফিরে আসতে পারবে। বাংলাদেশের বহু ঘরে ফুটবে হাসি।
ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ১০মিনিটে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। জানানো হয়, তিন দেশে একইসঙ্গে চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ হবে। ভারত ও পাকিস্তান বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমঝোতার আগ্রহ, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার ফলে এবার দীর্ঘ ১১ দিনের আলোচনা সফল হয়েছে এবং চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব হয়েছে।
সেবছর ১৭ এপ্রিল ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত ঘোষণার ভিত্তিতে ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লিতে দুই দফা দীর্ঘ আলোচনার পর চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়। এপ্রিলের যুক্ত ঘোষণায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারযোগ্য ১৯৫ যুদ্ধাপরাধী ছাড়া সমস্ত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি, পাকিস্তানে আটক সমস্ত বাঙালি এবং বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানিদের যুগপৎ বিনিময় প্রস্তাব করা হয়েছিল। ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা হাকসার এবং পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের নেতা পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দফতরের প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
হাকসার চুক্তিটি স্বাক্ষর হওয়ার কথা আগে জানানোর সুযোগ পান। হাকসার ও আজিজ আহমেদ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা করেন। তারা বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি ও সমঝোতার আগ্রহ ছাড়া এ চুক্তি হতো না।
জানা গেছে, চুক্তিতে পাকিস্তান সেখানে আটক সমস্ত বাঙালিকে ফেরত দেওয়া ও বাংলাদেশে অবস্থানকারী বহু পাকিস্তানিকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে। অপরদিকে ১৯৫জন ছাড়া বাকি পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিরা পাকিস্তানে ফেরত যাবে বলেও জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত পি এন হাকসার।
প্রথম ঘোষণায় যা বলেন হাকসার
চুক্তি স্বাক্ষরের পরপর ভারতীয় দলের নেতা হাকসার সাংবাদিকদের বলেন, নয়াদিল্লি-ঢাকা-ইসলামাবাদে চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ হবে। তাদের ধারণা, কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা শুরুর আগে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানে আটক বাঙালি ও বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানের নিজ নিজ দেশে ফেরত নেওয়ার বিষয়টি এখন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি আলোচনার ব্যাপার।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাকিস্তান দলের নেতা আজিজ আহমেদ বলেছেন, আলোচনায় মাঝেমধ্যে বিরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের দূরদর্শিতা এবং শুভেচ্ছা এই চুক্তি স্বাক্ষরে আমাদের প্রেরণা যুগিয়েছে।
স্থায়ী শান্তিতে সহায়ক হবে চুক্তি
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, দিল্লিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে সহায়ক হবে। এদিন সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বিমানবন্দরে দিল্লি চুক্তিতে স্বাগত জানাতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের এ বক্তব্য দেন।
এসময় পাকিস্তানে আটকে পড়া সব বাঙালি দেশে ফিরে আসতে পারে বলে তিনি জানান। দিল্লিতে স্বাক্ষরিত চুক্তির পটভূমি ব্যাখ্যা করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই উপমহাদেশে যেসব মানবিক সমস্যা সমাধানের জন্য এতদিন বাংলাদেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বর্তমান চুক্তি তারই ফল।
এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ঘোষণার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন এবং বলেন, এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতেই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
ড. কামাল হোসেন বলেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর ধারণা করা হয়েছিল উপমহাদেশে কিছু জটিল মানবিক সমস্যার সৃষ্টি হবে। আমাদের লক্ষ্য ছিল সেসব সমস্যার সমাধান করা। বাংলাদেশ সরকারও ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে এসেছে।
এর আগে ওয়াকিবহাল মহল থেকে বারবারই বলা হচ্ছিল, এই বৈঠক থেকে কোনও চুক্তি হলে তা ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত ঘোষণার কাঠামো মধ্যে থাকবে। চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার দিনকয়েকের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে বলেও আগাম জানানো হচ্ছিল।