ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশের ডাস্টবিন থেকে মেডিক্যাল বর্জ্য অপসারণের কাজ করতেন মহসিন। এক সময় দেখা গেল, তার হাত, পা ও পেটের চামড়া কুঁচকে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও ফেটে যাচ্ছে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে জানলেন, দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের ডাস্টবিনে কাজ করতে-করতে তিনি এই মারাত্মক চর্মরোগে ভুগছেন। চিকিৎসার খরচ চালাতে না পেরে এবং ঢাকায় কোনও কাজ না পেয়ে তিনি ফিরে যান গ্রামে।
শনিবার মোবাইলফোনে কথা হয় তার সঙ্গে। বললেন, ‘মেডিক্যালের ফেলনা জিনিস থেকেই আমার এই রোগ হয়েছে বলেই ডাক্তার জানিয়েছেন। দিন যত যাচ্ছে হাত ও পায়ের অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে। কোনও কাজও করতে পারি না এখন, হাত দিয়ে কিছু ধরতেও পারি না।’
উল্লেখ্য, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ২০০৮ সালে আইন পাস হলেও বাস্তবে আইনটির বাস্তবায়ন হচ্ছে না, আইনটি রয়েছে কেবল কাগজে কলমেই। ফলে বিভিন্ন হাসপাতালের বর্জ্য এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য এক বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, ২০০৩ সালে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একটি উচ্চ পর্যায়ে কমিটি গঠিত হয়। ২০০৪ সালে একটি বেসরকারি সংস্থা ঢাকার হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনিস্টক সেন্টারগুলোর বর্জ্য অপসারণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়। অবশেষে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা হয় ২০০৮ সালে। কিন্তু এতবছর পরে সেই আইনটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের বেশিরভাগ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মেডিক্যাল বর্জ্য পরিশোধনের যেমন ব্যবস্থা নেই, তেমনি এসব বর্জ্য পরিশোধনের জন্যও নেই আধুনিক প্রযুক্তি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ অধিদফতরের নির্দেশনা থাকলেও প্রতিষ্ঠানগুলোয় সেগুলো মানা হচ্ছে না। তবে, পরিবেশ অধিদফতর থেকে জানা গেল, পরিবেশ অধিদফতর এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ায় হাসপাতালগুলোর টনক নড়েছে, তারা অধিদফতরের চাহিদা পূরণে যথাযথ চেষ্টা করছে। যদিও এর আগেও এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর ও সিটি করপোরেশন থেকে একাধিকবার তাদের নোটিশ চিঠি দিলেও কোনও কার্যকর ব্যবস্থা এখনও কারও বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের মোট ৯২ শতাংশ বর্জ্য রাজধানীর চারপাশের নদীসহ হাসপাতালগুলোর সামনের খোলা ডাস্টবিন কিংবা নর্দমায় ফেলা হয়। এসব বর্জ্যের ভেতর রয়েছে, সিরিঞ্জ, সূচ, রক্ত, পুঁজযুক্ত তুলা, টিউমার, ব্যান্ডেজ-গজ, হ্যান্ডগ্লাভস, ওষুধ ও ওষুধের বোতল-শিশি, ব্লাড ব্যাগ, স্যালাইন ব্যাগসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য। আর এভাবে খোলা জায়গায় এসব বর্জ্য ফেলায় যক্ষা, চর্মরোগসহ নানা সংক্রামক রোগে ভুগ্যেছ মানুষ। পাশাপাশি ডিপথেরিয়া, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইসিস সি এবং এইডসের ঝুঁকিতেও পড়ছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ঢাকা মেট্রো অফিসের তদন্ত কর্মকর্তা সাইফুল আশ্রাব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঢাকা মেডিক্যালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি খারাপ। তার ভাষায়, ‘ঢাকা মেডিক্যালের কিছুই নেই। না আছে তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার, না আছে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। অথচ, সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনও প্রতিষ্ঠানে যদি দৈনিক ৫০০ মানুষ যাতায়াত করে, তাহলে তার পয়ঃবর্জ্য ট্রিটমেন্ট থাকতে হবে। ওটা সেফটি ট্যাংকে হবে না। অথচ আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী ঢাকা মেডিক্যালে প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ছয়শত মানুষ সেবা নিচ্ছে আউটডোর (বহির্বিভাগ) থেকে। সেখানে যদি এক লিটার করে করে পয়ঃবর্জ্য হয়, তাহলে সেটি হয় ২ হাজার ছয়শত লিটার। কিন্তু কোনও ধরনের ট্রিটমেন্ট ছাড়াই এ বর্জ্যটা চলে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ অথবা অন্য কোনও নদীতে। নদী দূষণের এটাও একটা কারণ বলে উল্লেখ করেন সাইফুল আশ্রাব।
রাজধানী ঢাকার এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন রকিবউদ্দীন এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, হাসপাতাল বর্জ্য অপসারণ আমাদের কাজ নয়। তবে, ঢাকা শহরের যত হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে, সেগুলোর বর্জ্য সিটি করপোরেশন উত্তর দক্ষিণ দুই-ভাগই একটি এনজিওর (প্রিজম) সহায়তায় অপসারণের কাজ করে। ঢাকার অদূরের মাতুয়াইলে এগুলোর ডাম্পিং করা হয়। তবে, তিনি এক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন, যতটুকু বর্জ্য প্রিজমকে দেওয়া হয়, সেগুলোর সঠিক ব্যবস্থপনা করা হয় এটা নিশ্চিত। তবে অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতাল থেকে পুরো বর্জ্য আসে না, সেগুলোর ব্যবস্থাপনা না হওয়ায় ওই সব বর্জ্য থেকে জীবাণু উৎপাদিত। জনস্বাস্থ্যের জন্য সেটা অবশ্যই হুমকিস্বরূপ। হাসপাতালগুলো যদি আরেকটু দায়িত্বশীল হয়, ওয়েস্টগুলো প্রিজমের কাছে ঠিকমতো দেয়, তবে সমস্যাগুলো আরেকটু কম হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি আইন থাকলেও সেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না। ঢাকা শহরের বেশকিছু হাসপাতালে মানা হলেও অনেক হাসপাতালে মানা হচ্ছে না। সিটি করপোরেশন এবং প্রিজমের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি থাকলেও চুক্তির বাইরে হাসপাতালগুলোয় এই অব্যবস্থাপনাটা বেশি রয়েছে। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো এ সম্পর্কে কিছুই ভাবে না।
লেলিন চৌধুরী বলেন, প্রতিটি মহানগরে এবং জেলা ও উপজেলায় যেখানে হাসপাতাল রয়েছে, সেগুলোকে একটি স্থায়ী ব্যবস্থাপনার ভেতরে নিয়ে আসতে হবে। কারণ, প্রতিটি উপজেলাতেই হেল্থ কমপ্লেক্স ও হাসপাতালের বর্জ্যগুলোকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ডিসপোজ করার জন্য প্রাইভেট-পাবলিকের সম্বন্বয়ে একটি ব্যবস্থাপনা গেড়ে তোলা দরকার। এমনও হতে পারে সরকার প্রতিটি জেলা উপজেলা এবং মহানগরে এমন একটি ব্যবস্থা করবে, যেটি হাসপাতালগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করতে হবে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য সবদিক দিয়েই হুমকিস্বরূপ। এই বর্জ্যগুলো থেকে একদিকে বিপজ্জনক রোগের জীবাণু ছড়ায়, অন্যদিকে সিরিঞ্জ ও আরও কিছু সরঞ্জাম আছে, যেগুলো অসাবধানতাবশত দ্বিতীয়বার ব্যবহৃত হলে এর মধ্য দিয়েও রোগ ছড়াতে পারে। মেডিক্যাল বর্জ্য ও ওষুধের যে সব কেমিক্যাল থাকে, সেগুলো ধীরে ধীরে মাটির সঙ্গে মিশে পানিতে প্রবাহিত হয়। অর্থ্যাৎ ক্রমাগতভাবে এটি জৈবখাদ্য চক্রের মাধ্যমে মানুষের দেহে ফিরে আসে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বর্জ্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আবদুল গফুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের সঙ্গে প্রিজমের একটি চুক্তি রয়েছে মেডিক্যাল বর্জ্য নিয়ে। ওরা নিয়মিত সকালে এসে তাদের কাভার্ড ভ্যানে করে বর্জ্য নিয়ে যায়। আর জেনারেল বর্জ্য (রোগীদের ব্যবহার্য জিনিস, খাবার জিনিস, খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ, বিস্কিট, ফল) বাইরে ফেলে আসে, ওগুলো সিটি করপোরেশন নিয়ে যায়।
প্রতিদিন ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে ২০০ থেকে ৩০০ কেজি বর্জ্য হয় বলে জানান তিনি। ‘মাঝে মাঝে কিছু এদিক সেদিক চলে যায়। আমার লোকজন সবাই প্রশিক্ষিত না, যার কারণে মেডিক্যাল বর্জ্য কিছু তারা নিয়ে চলে যায়, সেটা আমরা রোধ করার চেষ্টা করেছি, অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মেডিক্যাল বর্জ্য আগের তুলনায় দিনে দিনে বাড়ছে।’
ছবি: নাসিরুল ইসলাম।
/এমএনএইচ/আপ-এফএস/