X
বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪
২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে: ইসি অখুশি নয়, কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ

এমরান হোসাইন শেখ
১১ অক্টোবর ২০২২, ২২:২৭আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২২, ২২:৪৭

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া ‍শুরু হয় প্রায় দুই বছর আগে। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের রুলস অব বিজনেসে প্রয়োজনীয় সংশোধনসহ নানা প্রক্রিয়া শেষ করেছে সরকার। এখন চলছে চূড়ান্ত প্রক্রিয়া। এর অংশ হিসেবে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০২২’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন হয়েছে। আইনটি সংসদে পাসের পর শেষ হবে সব প্রক্রিয়া। সরকারের এই প্রক্রিয়ায় নিশ্চুপ কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সরকারের এই পদক্ষেপে তাদের করণীয় নেই বলেও ইতোমধ্যে জানিয়েছে। তবে, এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।  

জানা গেছে, ২০২১ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বে থাকা সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের কথা বলা হয়। এর প্রেক্ষাপটে কয়েক দফা চিঠি চালাচালির পর ওই বছরের ২০ জুন সরকার জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম আইনানুগভাবে নির্বাচন কমিশন থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ইসিকে চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দেয়। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গত দেড় বছরে আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। তবে শুরু থেকেই নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এর বিরোধিতা করে আসছে। সংবাদ সম্মেলন ডেকে গণমাধ্যমকে তাদের অবস্থান জানানো ছাড়াও ইসিকে একাধিকবার স্মারকলিপি দিয়ে এর প্রতিবাদ করেছেন। বিদায়ী কে এম নূরুল হুদা কমিশনের সময়কার ওই ঘটনায় কয়েকজন কমিশনারও সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তা পুনর্বিবেচনার দাবি করেন। বিভিন্ন সময়ে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও এর বিরোধিতা করা হয়েছে।

এদিকে সোমবার মন্ত্রিসভায় জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইনের খসড়া অনুমোদনের পর মঙ্গলবার (১১ অক্টোবর) বিকালে জুম মিটিংয়ে বসেন ইসির কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা হতাশা প্রকাশের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে মন্ত্রিসভা আইন অনুমোদনের পর মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ও সোমবার রাশেদা সুলতানার প্রক্রিয়ায় হতাশ হয়েছেন ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা।

ইসির খুলনা বিভাগের জেলা পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশের জনগণ এখন ভোটের চেয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রকেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। জাতীয় পরিচয়পত্র সেবার কারণেই দেশের মানুষ নির্বাচন কমিশনকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তারাও (ইসি) জনগণকে বিনা ভোগান্তিতে সেবা দিয়ে থাকেন। এনআইডি সেবা তাদের কাছ থেকে চলে গেছে, ফলে তাদের পরিচয় দেওয়ার মতো কিছু থাকবে না।

প্রসঙ্গত, আইন অনুমোদনের পর মঙ্গলবার সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়ায় সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘এনআইডি চলে গেলে তো আমাদের ব্যাপার নয়। এটা রাষ্ট্র, সরকার এবং পার্লামেন্টের বিষয়। এখানে আমরা কী করবো? কাজেই এটা নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনার কোনও কারণ নেই। এটা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাবো না। আমরা নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দেবো। আমাদের কাছে স্বচ্ছ ভোটার তালিকা থাকবে। আমরা ভোটার তালিকা দিয়ে নির্বাচন করবো।’

ভোটার তালিকার সঙ্গে এনআইডির সংযোগের কোনও প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে সিইসি বলেন, ‘আমাদের ভোটার তালিকার বাই প্রোডাক্ট হচ্ছে এনআইডি। এনআইডির বাই প্রোডাক্ট কিন্তু ভোটার তালিকা নয়। আমি নিউজে পড়ালাম, যে শিশুটির জন্ম হবে সেও এনআইডি পাবে। এখন সরকার যদি একটা উদ্যোগ নিয়ে থাকে, সেখানে আমাদের প্রশংসা করা দরকার।’

এর আগের দিন সোমবার নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অনুবিভাগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কিছু করার নেই। বিষয়টি বর্তমান ইসির সময়ে ঘটেনি, যা কিছু ঘটার আগেই ঘটে গেছে।’

এনআইডি যেন ইসির অধীনে থাকে—সেটা চান নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোশিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি মনে করি, এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত। আমরা বিশ্বাস করি, আমরা কথা বলার সুযোগ পেলে তাদের বুঝাতে সক্ষম হবো। আমরা সরকারের বাইরে কেউ নই। আমরা সরকারের কাজ করছি। সরকার চাইলে তো নিতেই পারে। তবে, স্বল্প খরচে স্বল্প সময়ে আমরা নাগরিকদের সেবা দিয়ে আসছি। আমরা যদি ফেল না করি তাহলে এটা পরিবর্তনের কেন প্রয়োজন হবে। আরও ভালো করতে চাইলে আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে পারে।’

সিইসি ও কমিশনার রাশেদা সুলতানার প্রতিক্রিয়ার জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্তৃপক্ষ যেটা বলেছেন, সেই বিষয়ে আমাদের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। তবে আমাদের স্মারকলিপির বক্তব্যগুলো যদি ‍উনারা রিভাইস দেন তাহলে ক্লিয়ার হবে। আর আমরা তো আমাদের সমস্যা নিয়ে কোনও কথা বলছি না। এনআইডির সঙ্গে ভোটার তালিকার একটি সম্পর্ক আছে। ইভিএমে ভোটের একটি বিষয় আছে। এটা চলে গেলে এগুলো কীভাবে হবে, সেই প্রশ্ন আসবে। ভোটার তালিকা নিয়েও প্রশ্ন আসতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের হতাশা বা ক্ষোভের বিষয় নয়। এনআইডি আমাদেরই সন্তান। এর ভালোমন্দটা আমরাই দেখতে চাই। আর আমরা তো ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্য এটা যাচ্ছি না। আমরা সরকার ও জনগণকে সেবা করতে চাচ্ছি। আমরা এই বিষয়টি আবারও সরকার ও আমাদের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনতে চাই। আর আমরাও আমাদের জায়গা থেকে তাদের বুঝাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। যতটা সম্ভব করণীয় যা আছে, তা করবো।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের কাছে সরকারের উদ্দেশ্যটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমেই তো আমাদের ভোটার তালিকা প্রণয়ন হয়। ফলে এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলে আমাদের ভোটার তালিকা হুমকির মধ্যে পড়বে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকারের যদি এ ধরনের ইচ্ছে থাকে, তাহলে নতুন করে নিজেরাই একটি ন্যাশনাল আইডি তৈরি করে দিতে পারে।’

সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এনআইডি সরকারের হাতে যাওয়ার কার্যক্রম আমাদের সময় হয়েছে, এটা সত্য। তবে আমরা এটা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি। আমাদের নজরে আসার পর আমরা এর প্রতিবাদ করি এবং আমাদের চার কমিশনারের চাপে সিইসি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এর বিরোধিতা করে চিঠি দিয়েছিলেন। আমি নিজেই ওই চিঠিটি ড্রাফট করে দেই। প্রথমে কিন্তু তখনকার সচিব ও সিইসি এই চিঠি দিতে চাননি।’

বর্তমান নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর ও তাদের সময়কালের সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে দায়ী করে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের মনে হয়েছে বিষয়টি আগে থেকে সিইসি কে এম হুদা ও তৎকালীন ইসি সচিব বর্তমান কমিশনার মো. আলমগীরের গোচরেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারা দুজনই সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে। পরে আমাদের মিটিংয়ে জানান। এছাড়া কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব থাকার সময় আলমগীর সাহেব এ সংক্রান্ত কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি একান্তভাবে এনআইডি সরকারের কাছে দিয়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘সরকার যদি এটা নিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আসলেই নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই। কিন্তু এটা হলে প্রায় দেড় দশক ধরে ইসির যে দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী গড়ে উঠেছে, সেটা নতুন কারও হাতে গেলে সম্ভব হবে না। তাদের আবারও নতুন করে শুরু করতে হবে। দক্ষ জনবল, যন্ত্রপাতি ও টেকনোলজির প্রয়োজন হবে। কাজেই আমি মনে করি,  প্রধানমন্ত্রী যেখানে সবকিছুতে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছেন, সেখানে এই সময়ে এই ধরনের সিদ্ধান্ত না নেওয়াটাই উচিত ছিল। এটা হলে প্রাথমিক পর্যায়ে জনগণ সেবা বঞ্চিত হবেন। তাদের ভোগান্তির শিকার হতে হবে। কোনও বিবেচনায় এটা ওয়াইজ ডিসিশন হচ্ছে না। তারপরও সরকার চাচ্ছে করবে।’

এনআইডি ইস্যুতে বর্তমান কমিশনের অবস্থান প্রশ্নে সাবেক এই কমিশনার বলেন, ‘এটা তো ওনারশিপের ব্যাপার। ওনারশিপ না থাকলে এটাই তারা করবেন। তাছাড়া সরকার নিতে চাচ্ছে, এই সময় বিরোধিতা করে সরকারকে রুষ্ট করতে চান কিনা? সরকারের উইলের অ্যাগেইনস্টে গিয়ে তারা এটা করতে চায় কী, সেটা বুঝতে হবে।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল, প্রকাশ্যে ভোটের জন্য এমপির ‘দুঃখ প্রকাশ’
নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পরিবেশ সৃষ্টি করছে নির্বাচন কমিশন: রাশেদা সুলতানা
ভুয়া এনআইডি তৈরি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তারা
সর্বশেষ খবর
সিকিউরিটি ফিচারে ‘বড়’ পরিবর্তন, জানা যাবে ফোন খোয়া যাওয়ার সময়ও 
অ্যান্ড্রয়েডের নতুন ভার্সনসিকিউরিটি ফিচারে ‘বড়’ পরিবর্তন, জানা যাবে ফোন খোয়া যাওয়ার সময়ও 
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাচনে ৭ দিনের স্থিতাবস্থা
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাচনে ৭ দিনের স্থিতাবস্থা
ব্রুনোকে রেখে দিতে চায় ম্যানইউ
ব্রুনোকে রেখে দিতে চায় ম্যানইউ
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের গবেষণা টিমের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের গবেষণা টিমের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
সর্বাধিক পঠিত
১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলির ফল প্রকাশ
১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলির ফল প্রকাশ
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে খান এই ৫ খাবার
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে খান এই ৫ খাবার
রাজধানীর ফিটনেসবিহীন গাড়ি স্ক্র্যাপ করার সিদ্ধান্ত
রাজধানীর ফিটনেসবিহীন গাড়ি স্ক্র্যাপ করার সিদ্ধান্ত
রণক্ষেত্রে রুশ অগ্রগতি পাল্টে দিতে পারে ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথ
উদ্বিগ্ন হোয়াইট হাউজরণক্ষেত্রে রুশ অগ্রগতি পাল্টে দিতে পারে ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথ
শিক্ষার্থী ভর্তির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ
শিক্ষার্থী ভর্তির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ