X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
ব্যর্থতা সংগঠনগুলোরই

ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস

উদিসা ইসলাম
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৭:২২আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৭:২৮

 স্বৈরাচার প্রতিরোধের দেয়াল লিখন‘১৪ ফেব্রুয়ারি আমরা শুধু জয়নালের লাশ পাই। দিপালী সাহার লাশ গুম করে ফেলে। তার লাশ আমরা পাইনি। ১৫ ফেব্রুয়ারি কাঞ্চন চট্টগ্রাম শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আরো অনেকে নিখোঁজ হন। তাদের জীবিত বা মৃত কোনও অবস্থায়ই পাওয়া যায়নি।
ভালোবাসা দিবসে এ রকম একটা হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল,তা এ প্রজন্মকে স্মরণ করাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এ দায় স্বীকার করে নিতে আমার আপত্তি নেই। ইতিহাসে অনেক ঘটনা আছে,পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে গেলেও তারও পরবর্তী প্রজন্ম আবার খুঁজে বের করে। ইতিহাস হারায় না,তাকে হারিয়ে ফেলার পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়।’ কথাগুলো বলছিলেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী ছাত্রনেতা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনিসহ ছাত্রসংগঠনের নেতারা মনে করেন,স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসকে নিয়ে যে ডক্যুমেন্টেশন হওয়া দরকার ছিল, এই দায়িত্ব সে সময়ের নেতারা,বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্বৈরাচার আন্দোলন থেকে ক্ষমতায় আসা দলগুলোও নেয়নি। আর এরই ধারাবাহিকতায় একধরনের অসাড়তার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রজন্মকে এবং এখন ভালবাসা দিবস স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের গুরুত্বকে ছাপিয়ে যেতে পেরেছে।
১৯৮২ সালের ১৪ ফেব্রয়ারি প্রতিরোধ সভায় হামলা
১৯৮২ সালের ২৪ শে মার্চ লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের পরপরই তাকে ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে। একইসাথে শুরু হয় ধরপাকড়। প্রথমদিনেই কলাভবনে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেফতার ও সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন ছাত্রনেতা শিবলি কাইয়ুম,হাবিবুর রহমান ও আব্দুল আলী। সে সময়ের আন্দোলন গড়ে তোলা নেতাকর্মীরা বলছেন,স্বৈরাচার প্রথম আঘাতেই টের পায় এ লড়াই তার জন্য ঠিক হবে না।
সে সময় সামরিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান ক্ষমতায় এসেই নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও রেজাল্ট খারাপ হলেও যারা ৫০% শিক্ষার ব্যয়ভার দিতে সমর্থ, তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয় এতে। এই নীতিতে দরিদ্ররা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে বলে ছাত্ররা এর প্রবল বিরোধিতা করে। ১৯৮২ সালের ১৭ ই সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে এই শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগঠনগুলো ঐকমত্যে পৌঁছে।
 স্বৈরাচার প্রতিরোধের পোস্টার
এরই ধারাবহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির জন্ম। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দি মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি ও গণমুখী, বৈজ্ঞানিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির দাবিতে ছাত্র জমায়েত ডাকে।
ছাত্রদের ওপর পুলিশি হামলায় সেদিন কতজন নিহত হয়েছিলেন তার কোন হিসেব নেই
হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলটি হাইকোর্টের গেটের সামনে ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়ে এবং ছাত্রনেতারা তারের ওপর উঠে বক্তৃতা শুরু করে। এসময় পুলিশ বিনা উস্কানিতে তারের একপাশ সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে দিয়ে রঙ্গিন গরম পানি ছিটাতে থাকে, বেধড়ক লাঠিচার্জ, ইট-পাটকেল ও বেপরোয়া গুলি ছুড়তে শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হয় জয়নাল। এরপর গুলিবিদ্ধ জয়নালকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়।
এসময় দিপালীও গুলিবিদ্ধ হন এবং পুলিশ তার লাশ গুম করে ফেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিহত ও আহতদের এ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে নিয়ে আসতে চাইলে ঘটনাস্থলে ঢুকতে দেয়নি খুনি বাহিনী। কিছু না ঘটা সত্ত্বেও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে, এমন অপপ্রচার চালিয়ে সামরিক সরকার উস্কে দেয় পুলিশকে। ঐদিন নিহত হয়েছিল জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালীসহ আরো অনেকে। সরকারী মতেই গ্রেফতার করা হয় ১,৩৩১ জন ছাত্র-জনতাকে, বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি ছিল। খোঁজ মেলেনি অনেকেরই।
 ১৯৮৩ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ জয়নালের ছবি
এই ঘটনার জোয়ার লাগে চট্টগ্রাম শহরেও। মেডিক্যাল ও অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীদের মিছিলে পুলিশ লাঠি চার্জ ও গুলি চালালে নিহত হয় কাঞ্চন। ছাত্রদের তিনটি মৌলিক দাবিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষানীতি স্থগিত হয়ে যায়।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পর এটাই ছিল ইতিহাসে লিখে রাখার মতো ছাত্রবিক্ষোভের এবং নিপীড়নের ঘটনা। তা সত্তেও ইতিহাসের পাতা থেকে হারাতে বসা এই দিবসটি নিয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও একসময়ের ছাত্রনেতা কাবেরী গায়েন বলেন,১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে যখন এই নৃশংস ঘটনা ঘটে, আমি তখন স্কুলে পড়ি। কিন্তু আমার বড় দুই ভাই এবং বড়বোন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন বলে ঘটনাটা আমার জানা। ১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি যখনবিশ্ববিদ্যালয়ে যাই তখন  জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দিপালী সাহাদের নামে শ্লোগান শোনা যেতো। তখনও বাম সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে যথেষ্ঠ শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ছিল।কিন্তু ততোদিনে অন্য এজেন্ডা ছাত্ররাজনীতিতে স্থান করে নিয়েছে। তিনি বলেন, হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে গ্রেফতার করার,মেরে ফেলার,গুম করার এই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা অবশ্য আমরা ক্যাম্পাসে থাকতে থাকতেই ফিঁকে হয়ে উঠছিলো। বিশেষ করে এরশাদের পতনের পরে যখন গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়লো, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক প্রতিরোধ ইতিহাসের ওপর করপোরেট ঔদাসীন্য একুশে ফেব্রুয়ারির পরে ছাত্র-শিক্ষকের এহেনো তাৎপর্যময় বিশাল আন্দোলনকে বিস্মৃতির অতলে ঢেকে দিলো।
 ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ সালে শিক্ষার্থীদের মিছিলের একাংশ 
ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের অংশ হিসেবে ১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এরশাদ তার সন্ত্রাসিবাহিনী দিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি করিয়ে হত্যা করায় রাউফুন বসুনিয়াকে। জাতীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক বসুনিয়া হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতরে। এরপর ঘটেছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা। ১৯৮৭ সালের ১০নভেম্বর নূর হোসেনকে হত্যা করে এরশাদের পুলিশ বাহিনী।আর ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর এরশাদের সন্ত্রাসীবাহিনী গুলি করে হত্যা করে ডা. মিলনকে। অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন হয় দখলবাজ স্বৈরাচার এরশাদের।
১৯৮৫ সালের এই দিনে স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় বসুনিয়া নিহত হন
কিভাবে ভালবাসা দিবস দিয়ে এই প্রতিরোধ দিবস ঢেকে দেওয়া গেল জানতে চাইলে ১৯৮৯ এর ডাকসু নেতা আব্দুল্লাহ আল ক্বাফী বলেন, নব্বইয়ের পর সোভিয়েত বিপর্যয়ের কারণে বাম সংগঠনগুলোতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ফলে যে কমিটমেন্ট থাকার কথা ছিল সেটার অভাব দেখা দিতে থাকে মূলত সাংগাঠনিক দুর্বলতার কারণেই। আবার প্রশাসনিক দিক থেকেও ছাত্র আন্দোলনকে সংকুচিত করার প্রবণতা তৈরি হয়।২৫ বছর ধরে ছাত্র ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়না। ফলে ছাত্র সংগঠনগুলোর যে প্রভাব হতে পারতো তা হয়ে ওঠেনি। আর পারেনি বলেই প্রধান যে দলগুলো তারা স্বৈরাচারের সাথে যখন যেভাবে পেরেছে আপোষ করেছে। এখনতো সে সময়ের আন্দোলনে অনেক নেতাই অনেক ভেবেচিন্তে বক্তৃতা করেন, যাতে স্বৈরাচার বিরক্ত না হন।
তিনি মনে করেন, এটা যে ভালবাসা দিবসের মতো একটি দিবস দিয়ে ঢেকে দেয়া গেছে সেই দায়সরকারের, সে দায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের, সে দায় সেই সংগ্রামের সাথে যারা যুক্ত ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে তাদের সবার। ৩০ বছর পার হয়ে গেছে। সে সময় যে শিশু জন্ম নিয়েছে সেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছে। এ সময়টাতে তার সামনে বেশি প্রভাব নিয়ে হাজির হয়েছে যা কিছু, সেটাকেই তো সে পালন করবে।
 /উআই/এপিএইচ/আপ-এআর/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হামাসকে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
হামাসকে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
প্রবীণ সাংবাদিক জিয়াউল হকের মৃত্যু
প্রবীণ সাংবাদিক জিয়াউল হকের মৃত্যু
‘লাকি সেভেন’ জার্সি ফিরে পেয়ে খুশি সানজিদা
‘লাকি সেভেন’ জার্সি ফিরে পেয়ে খুশি সানজিদা
সাবিনা, মারিয়া ও শামসুন্নাহারের হ্যাটট্রিকে ১৯ গোল
সাবিনা, মারিয়া ও শামসুন্নাহারের হ্যাটট্রিকে ১৯ গোল
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?