ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত অন্যতম প্রধান অভিন্ন নদী তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা (ম্যানেজমেন্ট) ও পানি সংরক্ষণের (কনজারভেশন) প্রকল্পে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হওয়ার কথা ঘোষণা করেছে ভারত। তবে এর সঙ্গে যে দীর্ঘদিন ধরে নিষ্পত্তি না হওয়া তিস্তার পানি ভাগাভাগি চুক্তির কোনও সম্পর্ক নেই, সে কথাও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
ভারত এটিকে ‘তিস্তা রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ বলে বর্ণনা করলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশ তাদের অংশে তিস্তা নদীর ভাটিতে যেটিকে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বলে এতদিন বর্ণনা করে এসেছে, সেই দুটি আসলে একই!
শনিবার (২২ জুন) দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যৌথ সাংবাদিক বৈঠকেও জানানো হয়েছে, তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে একটি টেকনিক্যাল টিম (কারিগরি দল) গঠন করা হয়েছে। এই টিম অচিরেই তিস্তা অববাহিকা অঞ্চল সফর করবে বলেও জানা যাচ্ছে।
এরপর বিকালে দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াটরা তার সাংবাদিক ব্রিফিংয়ে জানান, ‘তিস্তা নদীর পানির কনজারভেশন ও ম্যানেজমেন্টের কাজ আমরা (ভারত) করবো এবং এখানে ভারতের উপযুক্ত সহায়তা থাকবে।’
সহায়তা বলতে কারিগরি সহায়তার কথা তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করলেও আর্থিক সহায়তার কথা অবশ্য কিছু বলেননি। তবে গত মাসেই ঢাকাতে মি. কোয়াটরার সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছিলেন, ভারত তিস্তা মহাপরিকল্পনায় অর্থায়ন করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এ দিন মি. কোয়াটরা আরও বলেন, ‘তিস্তার অভিন্ন জলসম্পদের ব্যবস্থাপনা আমাদের দুই দেশের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল একটি বিষয়।’ সেই বাস্তবতা থেকেই যে ভারত তিস্তার বাংলাদেশ অংশেও পানির সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় আগ্রহ দেখিয়েছে, তার কথায় সেই আভাস স্পষ্ট ছিল।
আসলে তিস্তার ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হলো, বর্ষার মাসগুলোতে প্রচুর পরিমাণ পানি এই নদী দিয়ে বয়ে গেলেও তা শুষ্ক সময়ের জন্য ধরে রাখার কোনও ব্যবস্থা নেই!
যেমন এই মুহূর্তে ঘোর বর্ষায় ভারত ও বাংলাদেশে তিস্তা পাড়ের বাসিন্দারা নদী ভাঙনে নিজেদের ঘরবাড়ি হারাচ্ছেন বা বন্যার আশঙ্কায় রাত কাটাচ্ছেন- অথচ শুষ্ক মৌসুমে তাদেরই আবার পানির জন্য হাহাকার করতে হয়। তাদের চাষের ক্ষেত পানির অভাবে শুকিয়ে যায়!
এই সমস্যার প্রতিকারে একদল নদী বিশেষজ্ঞ বহুদিন ধরেই বলে আসছেন, বর্ষার সময় বয়ে আসা পানিকে জলাধারে ধারণ করে বা খাল কেটে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যদি অপচয় রোধ করা যায় এবং শীত ও গ্রীষ্মের শুষ্ক মাসগুলোতে কাজে লাগানো যায়, তাহলে কৃষিকাজের জন্য পানির চাহিদা হয়তো অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব। তাছাড়া বাঁধ বা জলাধারের পানি থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনও সম্ভব। যা বিদ্যুতের চাহিদাও মেটাতে সাহায্য করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’র মূল লক্ষ্য ছিল এটিই। ভারত এখন ‘তিস্তা রেস্টোরেশন প্রজেক্টে’র মাধ্যমে একই লক্ষ্য পূরণে প্রতিবেশী দেশকে সাহায্য করার কথা বলছে।
প্রসঙ্গত, মাস কয়েক আগেই চীন তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ বাস্তবায়নে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছিল প্রকাশ্যেই। ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত তখন তিস্তা অববাহিকায় সরেজমিন সফরও করেছিলেন। কিন্তু সীমান্তের এত কাছে চীনের এই ধরনের সক্রিয়তায় ভারতের আপত্তি ছিল যথারীতি। যেকোনও কারণেই হোক বাংলাদেশের নির্বাচনের পর ওই পদক্ষেপ নিয়ে চীনকে আর বিশেষ এগোতে দেখা যায়নি।
এখন পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে চীনের আগ্রহ দেখানোর কারণেই ভারত তড়িঘড়ি নিজে থেকে এই প্রকল্পে যুক্ত হতে চেয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার বৈঠকেও প্রসঙ্গটির অবতারণা ও তারপর ভারতের সদর্থক ঘোষণা সম্ভবত তারই প্রতিফলন।
কিন্তু ভারত যদি এই প্রজেক্টে অংশীদারও হয়, তিস্তা চুক্তির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব কিন্তু আজ (শনিবার) স্পষ্ট করে দিয়েছেন- এই দুটি বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। বিনয় মোহন কোয়াটরা বলেছেন, ‘অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয বিষয় এবং তিস্তাও এই নদীগুলোর অন্যতম। তবে এটা মূলত দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের (জয়েন্ট রিভার কমিশন) আলোচনার বিষয়। যদিও দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকেও তার প্রতিফলন থাকে অবশ্যই।’
‘তবে আমরা তিস্তা প্রকল্পে যে ওয়াটার ম্যানেজমেন্টের (পানি ব্যবস্থাপনা) কথা বলছি, এটা প্রধানত টেকনিক্যাল (কারিগরি) বিষয়। এর সঙ্গে পানি ভাগাভাগির সম্পর্ক কম’, জানিয়েছেন তিনি।