কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সাভার শিল্প নগরীর ট্যানারিগুলোতে চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। এ খাতের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ চামড়াই সংগ্রহ করা হয় ঈদুল আজহায় কোরবানি করা পশুর চামড়া থেকে। ঈদ মৌসুমকে সামনে রেখে তাই অন্যান্য বছর সম্মুখীন হওয়া সমস্যাগুলো বিবেচনায় নিয়ে এ বছর সাভারের চামড়া শিল্প নগরী ও এর কম ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) কর্তৃপক্ষ নানা উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছে। সাভার শিল্প নগরী থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানিয়েছে, কঠিন বর্জ্য অপসারণে আগেই খনন করা হয়েছে দুটি পুকুর। এবার তা সংস্কার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও ঈদের দিন থেকে চামড়া সংগ্রহ ও তা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্নের কাজ চলছে। পাশাপাশি চলছে মৌসুমের অতিরিক্ত চাপ সামলানোর স্বার্থে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম। এছাড়াও শিল্প নগরী কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সারফেইস ড্রেনগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলমান রয়েছে।
জানা গেছে, এ বছরে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর মধ্যে ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ, ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়া এবং ৫ হাজার ৫১২টি অন্যান্য প্রজাতিসহ সর্বমোট ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি গবাদিপশুর প্রাপ্যতা আশা করা যাচ্ছে। এ বছর প্রায় ২০ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৫টি গবাদিপশুর উদ্বৃত্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। চামড়া শিল্প মালিকরা বলছেন, নানা কারণেই এবছর অন্যান্য বছরের তুলনায় পশু কোরবানি কম হবে। তারা আভাস দিয়েছেন, এবছর ৮০ থেকে ৯০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ করতে পারে।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং কোরবানির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াদির সুষ্ঠু ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় এ সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১৩ মে) কমিটি ‘কোরবানি সম্পর্কিত বিষয়াদির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ কমিটি’ পুনর্গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন- স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, শিল্প উপদেষ্টা, সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব, শিল্প সচিব, এনজিও প্রতিনিধি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও বেসরকারি প্রতিনিধি (সরকার মনোনীত)। কমিটিতে সদস্য সচিব থাকবেন বাণিজ্য সচিব।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কমিটি সঠিকভাবে চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং এজন্য পর্যাপ্ত লবণের সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া নির্ধারণ; চামড়ার উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করা এবং কোরবানির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াদির সুষ্ঠু ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবেন। এছাড়া চামড়া শিল্প নগরী, সাভারসহ সারাদেশে দ্রুত ও যথাযথভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে এ কমিটি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আগামী কোরবানি ঈদের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে যাতে এবছর কোরবানির গবাদিপশুর বাজার স্থিতিশীল থাকে। পশু যাতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তা নিয়ে খামারিদের সঙ্গে সব ধরণের যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।
জানা গেছে, সাভারের ট্যানারি শিল্প নগরীতে স্থাপিত ট্যানারিগুলোতে অন্যান্য বছরগুলোতে কোরবানির ঈদের মৌসুমে লোডশেডিংয়ের কারণে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে বেগ পেতে হয়েছে। এ সময় লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেশি হলে চামড়া নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এসব কারণে এ বছর সংশ্লিষ্ট পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ঈদ-পরবর্তী তিন মাস এখানকার শিল্প নগরীতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। সেভাবেই কাজ চলছে। কোরবানির পরদিন থেকে শিল্প নগরীতে আসা চামড়াবোঝাই ট্রাকের চলাচল, চামড়া আনলোডিং এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে এবছরও স্বেচ্ছাসেবক কাজ করবেন বলেও জানা গেছে। পাশাপাশি বাধাহীনভাবে শিল্প নগরীতে চামড়া প্রবেশে বিসিক জেলা প্রশাসনের সঙ্গেও কাজ করবে।
এদিকে কেমিক্যাল ডোজিং পাম্প সংস্কার করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্রকৌশলী দিয়ে সক্রিয় করা হয়েছে ফাইন স্ক্রিন। এতে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে অনেক টাকার কাজ চলছে। এর সবটাই হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ফান্ড থেকে। মৌসুমে সিইটিপির সক্ষমতার অতিরিক্ত চাপ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাভার ট্যানারি শিল্প নগরীতে যে কাজগুলো করা হয়েছে তাতে সিইটিপির সক্ষমতা আপনাআপনিই বাড়বে।
কোরবানির মৌসুমকে সামনে রেখে বিসিক লেদার ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের সিইটিপিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে পরিবেশ অধিদফতর বলছে, শিল্প নগরীতে অবস্থিত প্রতিটি ট্যানারিতেই প্রি-ট্রিটমেন্ট বাধ্যতামূলক হলেও শিল্প নগরীর অনেক ট্যানারিই সেটি করছে না। সম্প্রতি শর্তারোপ করে প্রতিটি ট্যানারিতে ক্রোম রিকভারি প্ল্যান্ট স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হলেও এর বাস্তবায়নে এখনও তেমন অগ্রগতি হয়নি। বর্তমানে, চামড়া শিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য শোধন করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু, কোরবানির ঈদে বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ঘনমিটারে। কারণ, ট্যানারি মালিকরা সারা বছর যে পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেন, তার অর্ধেকই আসে ঈদুল আজহায়। এর আগের বছর প্রায় এক কোটির বেশি পশু কোরবানি হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশেনে নেতা শাহিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে এবছর পশু কোরবানি কম হবে। সে বিবেচনায় এবছর সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ৯০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ হতে পারে। সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে অবস্থিত ট্যানারিগুলো সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তিনি জানান, বৈশ্বিকভাবেই চামড়ার চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে এবছর সরকারের পক্ষ থেকে কোরবানির সময় সংগ্রহ করা চামড়াগুলো লবণ দিয়ে তিন চার মাস সংরক্ষণের সুযোগ দেওয়া উচিৎ। যাতে তাড়াহুড়া না করে তিন চার মাস পরে ট্যানারি মালিকদের আস্তে আস্তে কেনার সুযোগ দিলে চামড়া সংশ্লিষ্টরা লাভবান হবে, নতুবা লোকসানের কবলে পড়তে পারেন ছোট ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে বাণিজ্য শেখ বশির উদ্দিন জানিয়েছেন, চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং কোরবানির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াদির সুষ্ঠু ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় এ সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। আশা করছি, এবছর চামড়া সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।