X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

মে দিবসেও ছুটি নেই শরীফাদের

এমরান হোসাইন শেখ
০১ মে ২০১৬, ১২:১৫আপডেট : ০১ মে ২০১৬, ১২:২৯

অন্যদিনের মতো মে দিবসেও কাজের অপেক্ষায় নারী শ্রমিকরা

অন্য দশটা দিনের মতোই মে দিবসের ভোরটা শুরু হয় শরীফা বেগমের। কাক ডাকা ভোরে উঠে রান্না করেছেন দুই ছেলে জন্য। খাবারের বেশিরভাগটা রেখে বাকিটা ছোট প্লাস্টিকের বক্সে ভরে প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা হেটে এসে বসলেন ফুটপাতে, যেখানে শরীফার মতো আরও নারী-পুরুষ রয়েছেন। এদের কেউ বসে আছেন, কেউবা রয়েছেন দাঁড়িয়ে। তাদের কারও কাছে রয়েছে  কোদাল ও ঝুড়ি, কারও কাছে রয়েছে শাবল, আবার কারও কাছে রয়েছে ইট ভাঙ্গার জন্য হাতুরি। কেউবা আবার রয়েছেন খালি হাতে।

মহান মে দিবসে সকাল ৭টায় আজিমপুর চৌরাস্তার অদূরে পশ্চিম পাশের ফুটপাতে গিয়ে এ চিত্র দেখা গেল। রাস্তার দুই ধাপের ফুটপাতে শ’দেড়েক নারী ও পুরুষ দাঁড়িয়ে ও বসে রয়েছেন আজকের দিনটার কাজের আশায়। হঠাৎ এদের একটি অংশে কিছুটা জটলা দেখা যায়। কাছে গিয়ে জানা গেল, এক আগন্তুকের সঙ্গে কে আগে কথা বলতে পারেন তার প্রতিযোগিতা চলছে। ওই আগন্তুক বাসা বদলের জন্য শ্রমিক খুঁজছেন। এ খবর জানতে পেরে নারী শ্রমিকরা কিছুটা হতাশ হয়ে পিছিয়ে এলেন। পরে ওই আগন্তুক পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে ৪ জনের সঙ্গে রফাদফা করলেন।

আরও পড়ুন:   মে দিবসেও ছুটি নেই শরীফাদের গৃহকর্মীদের সুরক্ষা কতদূর?

কয়েকজন শ্রমিক ও স্থানীয় চা দোকানদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, শুধু মে দিবস নয় বছরের ৩৬৫ দিনের সকালে তাদের এখানে দেখা যায়। এদের সুনির্দিষ্ট কোনও পেশা নেই। যখন যেটা সামনে পান তারা সেটাই করেন। এজন্য একাধিক কাজের যন্ত্রপাতি/ উপকরণ তাদের সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়। তবে, কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ সময়ই তাদের ইট ভাঙ্গা ও মাটিকাটাসহ গৃহ নির্মাণের কাজই করতে হয়। মাসের শুরু বা শেষ দিনে কিছু বাসা পরিবর্তনের কাজ পাওয়া যায়, একাজে কম সময় ও কম পরিশ্রমে তুলনামূলক কিছুটা বেশি পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন।

কথা হচ্ছিল শরীফা বেগমের সঙ্গে। বিয়ের ৬ বছরের মাথায় দুই সন্তান রেখে বছর ১৫ আগে মারা যান তার স্বামী। দরিদ্র পরিবারের শরিফা পরিচিতজনের মাধ্যমে গ্রাম থেকে এসে আশ্রয় নেন ঢাকার কামরাঙ্গী চরে। প্রথমে বাসায়-বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নিলেও সেখানে যেমনি ছিল আয় কম, তেমনি নানা ধরনের হয়রানিও কম ছিলো না। দেখতে সুন্দরী ও অল্প বয়সে বিধবা হওয়ার দুর্বলতার সুযোগও নিতে চেয়েছেন কিছু ‘ভদ্র’ পুরুষ। পরে বাধ্য হয়ে গৃহকর্মীর কাজ ছেড়ে দিয়ে ভাসমান শ্রমিক হিসেবে নিজেকে যুক্ত করেন। যদিও প্রতিদিনই তাকে কাজ খুঁজে নিতে হয়, তবু এই অনিশ্চিত পেশাটিই এখন তার ‘স্থায়ী’ পেশা। গত একযুগ ধরে এ কাজ করেই দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে বেঁচে আছেন শরীফা।  মেয়েকে ইতোমধ্যে বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলেও একটি স্কুল ভ্যানের চালক হিসেবে সম্প্রতি কাজ নিয়েছেন।

মে দিবসেও কাজের খোঁজে এসেছেন আজিমপুরের এই ভাসমান শ্রমিকরা

মে দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে শরীফা বলেন, তিনি শুনেছেন শ্রমিকদের জন্য একটি দিন আছে. যেদিনটি ছুটি থাকার কথা। তবে তার কথা, কাজ না করলে খাবেন কী?

‘মে দিবস কী তার পেটের ভাত যোগাবে’ কিছুটা আক্ষেপ করে বললেন তিনি। শরীফা জানালেন, ‘আজ (১ মে) তার মেয়ে  জামাইসহ বেড়াতে আসবে। তাদের জন্য কম করে এক হাজার টাকা খরচ করতে হবে। কাজ না করলে এই টাকাটা দেবে কে?

আরও পড়ুন: মে দিবসেও ছুটি নেই শরীফাদের  ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে চলে মালিক- শ্রমিক লুকোচুরি

মে দিবসে কাজের সন্ধানে আসা শাহজালাল (২৯) জানান, একটা দিন শ্রমিকদের জন্য আছে সেটা তিনি শুনেছেন। তবে সেটা আজ কী না তা তার জানা নেই। শাহজালাল বলেন, এ রকম একটি দিনের কথা তিনি জানেন কিন্তু সেটা বৈশাখ না জ্যৈষ্ঠ মাসে সেটা তিনি মনে করতে পারছেন না।

একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘মনে থাকলেওবা আমাদের কি করার ছিলো। স্ত্রীকে নিয়ে হাজারীবাগে ৩ হাজার টাকা ভাড়ার একটি বাসায় থাকেন। মাসের ৩০ দিন কাজ করেই টানাটানির মধ্যে চলতে হয়। এর মধ্যে একদিন কাজ কামাই দিলে চলবে কী করে।’

আজিমপুরে কাজের সন্ধানে আসা কুড়িগ্রামের মো. সালাম বলেন, ‘আমাদের আজকের দিন আর অন্যদিনের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। মাসের তিরিশটা দিনই তাদের খুঁজে খুঁজে কাজ করতে হয়। প্রত্যোক দিন তাদের চিন্তা করতে হয় পরদিন কাজ পাবেন কী না। আর স্থায়ী কোনও কাজে গেলে যে বেতন দেয় তাতে সংসার চালানো যায় না।’

হাতুড়িই আছিয়ার  ‘আপনজন’

আজিমপুর কবরস্থানের সামনের ফুটপাতে থাকেন আছিয়া বেগম (৪০)। একমাত্র মেয়েসহ তাকে রেখে স্বামী বছর কুড়ি হলো নিরুদ্দেশ। ‍বছর চারেক হলো মেয়েকেও বিয়ে দিয়ে একা হয়ে গেছেন। চৌরাস্তার ফুটপাতে প্রতিদিন ভোরে আসেন কাজের সন্ধানে। কাজের জন্য তার একমাত্র অস্ত্র ইটভাঙ্গার হাতুড়ি। বাম পায়ে সমস্যা থাকার কারণে হাটা চলার কাজ বেশি করতে পারেন না। এক জায়গায় বসে ইট ভাঙ্গার কাজে কিছুটা স্বস্তিবোধ করেন। নিত্যদিন করতে করতে এ কাজে অন্যদের চেয়ে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছেন বলেও  জানালেন অন্য শ্রমিকরা । কাজ পেলে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অন্ততঃ ৮/৯ ঘন্টা হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙেন।  মাঝে ‍কিছুটা বিরতিও পান। কখনও কাজ করেন দিন হিসাবে আবার কখনও বর্গফুট হিসাবে। এতে ৩ থেকে ৫’শ টাকা আয় হয় আছিয়ার। নিজের খরচ চালিয়ে মাঝে মধ্যে এর কিছুটা মেয়ের জন্যও পাঠাতে হয়।

আরও পড়ুন- মে দিবসেও ছুটি নেই শরীফাদের  মজুরি বৈষম্য: পুরুষের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে নারী শ্রমিকদের

আছিয়া বললেন, প্রতিদিন কাজ করতে করতে হাতুড়িটাই যেন এখন আপনজন হয়ে গেছে। রাখেনও যক্ষের ধনের মত আঁকড়ে। চুরির ভয়ে ঘুমানোর সময় বালিশের নিচে রেখে দেন বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে আছিয়া জানান, এই হাতুড়িই তার পেটের খাবার জোগায়, কাজেই একটু বাড়তি যত্ন করে তাকে রাখতে হয়। তার ভাষায় ‘আপনজনের’ মত এই হাতুড়ি মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে ‘বিমাতাসুলভ’ আচরণও করেছে কয়েকবার। অসাবধানতাবশত রক্তাক্ত করে দিয়েছে হাতের আঙ্গুলগুলো। তবে প্রথম প্রথম এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার বেশি হতে হলেও এখন খুব একটা তা আর হয় না।

সবাই যেন সকাল বেলার আপনজন

সকালে ভাসমান শ্রমিকদের কাজ খোঁজার এসব স্পটের লক্ষনীয় বিষয়, শ্রমিকরা একে অন্যের সঙ্গে খোশগল্প করেন। পরস্পরের কুশলাদি জানতে চান। আগের দিন কী কাজ করেছেন, কত পেয়েছেন, এ ধরনের বিষয়ও জানতে দেখা গেছে তাদের মধ্যে। বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা যেন একে অন্যের আপনজন।  কথা বলে জানা গেছে, তাদের মধ্যে কেউ কারও আত্মীয় নন। এখানে কাজ খুঁজতে এসেই তারা পরিচিত হয়েছেন। প্রতিদিন সকাল বেলা কিছুটা সময়ের জন্য হলেও এক সঙ্গে থাকতে থাকতে একে অন্যের ‘আপনজনে’ পরিণত হয়েছেন। এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই কেউবা পাশাপাশি বাসাও নিয়েছেন। দু’একজন আবার আত্মীয়তার বন্ধনেও আবদ্ধ হয়েছেন বলে কেউ কেউ জানান।

ইএইচএস/ এপিএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অকার্যকর মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের নিবন্ধন বাতিলের উদ্যোগ নেবে মন্ত্রণালয়
অকার্যকর মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের নিবন্ধন বাতিলের উদ্যোগ নেবে মন্ত্রণালয়
সাংবাদিকদের হুমকি স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধক
বিএফইউজে-ডিইউজের প্রতিবাদসাংবাদিকদের হুমকি স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধক
বরখাস্তের কয়েক ঘণ্টা পর পুতিনের সাবেক পরিবহনমন্ত্রীর ‘আত্মহত্যা’
বরখাস্তের কয়েক ঘণ্টা পর পুতিনের সাবেক পরিবহনমন্ত্রীর ‘আত্মহত্যা’
জুলাই পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠানমালা: যা হবে বৃহস্পতিবার
জুলাই পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠানমালা: যা হবে বৃহস্পতিবার
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশে নিজের অনেক ভক্ত জানার পর যা বললেন কেট উইন্সলেট
বাংলাদেশে নিজের অনেক ভক্ত জানার পর যা বললেন কেট উইন্সলেট
প্রসিকিউশন গণহত্যার দালিলিক প্রমাণ দিতে পারেনি: শেখ হাসিনার স্টেট ডিফেন্স
প্রসিকিউশন গণহত্যার দালিলিক প্রমাণ দিতে পারেনি: শেখ হাসিনার স্টেট ডিফেন্স
লোহিত সাগরে জাহাজে হামলায় আগুন, ডুবে যাওয়ার শঙ্কা
লোহিত সাগরে জাহাজে হামলায় আগুন, ডুবে যাওয়ার শঙ্কা
নদীতে ইলিশের দেখা মিলছে না কেন
নদীতে ইলিশের দেখা মিলছে না কেন
আসন্ন নির্বাচনে এগিয়ে বিএনপি, দ্বিতীয় জামায়াত: সানেমের জরিপ
আসন্ন নির্বাচনে এগিয়ে বিএনপি, দ্বিতীয় জামায়াত: সানেমের জরিপ