গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় সরকার একটি নীতিমালা করে দিয়েছে। আর সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ১৬ জুনকে ‘আন্তর্জাতিক গৃহশ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালনও করা হচ্ছে। প্রতি বছর মে দিবস এলে গৃহকর্মীসহ সব শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠছে পুরো জাতি। কিন্তু নির্যাতন কমছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় সরকার নীতিমালা করে দিলেও তা বাস্তবায়নে তেমন কোনও আগ্রহ কারও মধ্যে নেই। বরং সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, খেলোয়াড়, অভিনেতা, ব্যবসায়ী এমনকি সমাজের গণমান্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও গৃহকর্মীদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ উঠছে।
শনিবার বেসরকারি সংস্থা ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ'-বিলস থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে সারাদেশে অন্তত ১৮২ জন নির্যাতিত গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ১৪৩ জন। বছরওয়ারি হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭৮ জন গৃহকর্মী।তাদের মধ্যে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ৩৯ জন। ২০১৪ সালে নির্যাতনের শিকার হন ৫৫ জন। তাদের মধ্যে মারা যান ২৭ জন ও আহত হয় ২৮ জন। ২০১৩ সালে নির্যাতনের শিকার ৫৬ জন গৃহকর্মীর মধ্যে মারা যান ৩২ জন ও আহত হন ২৪ জন। ২০১২ সালে নির্যাতিত ৭৮ গৃহকর্মীর মধ্যে ৪৬ জন নিহত ও ৩২ জন আহত হয়। ২০১১ সালে নির্যাতনের শিকার হন ৫৮ জন। তাদের মধ্যে মারা যায় ৩৮ জন ও আহত হন ২০ জন।
আরও পড়ুন: ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে চলে মালিক- শ্রমিক লুকোচুরি
মূলত দারিদ্র্যের কারণে বাবা-মা তাদের সন্তানদের গৃহশ্রমিক হিসেবে বাসাবাড়িতে পাঠান। অনেক দরিদ্র বাবা-মা আছেন, যারা তাদের এই শিশুদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা পারিবারিক কাজের জন্য শিশু গৃহকর্মীদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু গৃহকর্মী নিয়োগে কেউ কোনও নীতি মানেন না। দরিদ্র এসব শিশুকে দিয়ে বেশি কাজ করানো হলেও তাদের মজুরি দেওয়া হয় অনেক কম। শুধু তাই নয়, সামান্য ভুল-ত্রুটি হলেই তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন।
জানা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলা হয় না। কারণ দরিদ্র পরিবার মামলা করলেও চালাতে পারে না। এ ছাড়া নির্যাতনকারী পরিবারের ভয়ভীতি তো আছেই। অন্যদিকে কোনওভাবে নির্যাতনের মামলা হলেও পরে মীমাংসা হয়ে যায়। এই মীমাংসার নেপথ্যে থাকে নগদ অর্থ।
বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান এখনও হয়নি। তবে বিলস কর্মকর্তাদের মতে, এই সংখ্যা পাঁচ লাখের ওপর। গৃহকর্মীদের মধ্যে নারী ও কন্যা শিশু বেশি৷ তাদের বেশির ভাগেরই বয়স দশ থেকে বার বছর। গৃহকর্মী নির্যাতনকে বিলস সামাজিক ক্ষত হিসেবে আখ্যায়িত করে অবিলম্বে নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করেছে।
আরও পড়ুন: টাঙ্গাইলে দর্জিকে কুপিয়ে হত্যা, আইএসের ‘দায় স্বীকার’
জানা গেছে, দীর্ঘদিন অবহেলার পর বাসাবাড়ির কাজকে শ্রমের মর্যাদা দিয়ে গত ২১ ডিসেম্বর একটি নীতিমালার খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে অনুমোদন পাওয়া নীতিমালাটি ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’ নামে অভিহিত।
এদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. শফিউল আলম সাংবাদিকদের জানান, কারা গৃহর্কমী হিসেবে বিবেচিত হবে, তাদের প্রতি আচরণ কেমন হবে ইত্যাদি বিষয় এই নীতিমালায় বলে দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, নীতিমালা হলেও গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন ও হয়রানির বিচারের বিধান প্রচলিত আইনে রয়েছে।তিনি জানান, গৃহকর্মীদের কল্যাণে ‘শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ করা হবে। এই ফাউন্ডেশন গৃহকর্মীদের বিষয়টি তদারকি করবেন।
মন্ত্রিসভায় নীতিমালার খসড়াটির অনুমোদন পাওয়ার পর বর্তমানে কী অবস্থায় আছে, এটা জানার জন্য শনিবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নুকে পাওয়া যায়নি। তবে, মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার উপসচিব মো. আমিনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মে মাসের মধ্যেই একটা মনিটরিং সেল গঠন করা হবে। মালিক, শ্রমিক, বিভিন্ন সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এতে থাকবেন। এই সেল হবে গৃহশ্রমিক সুরক্ষা নীতিমালা বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ ফোরাম।
গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষায় দীর্ঘদিন কাজ করছেন বিলস কর্মকর্তা সৈয়দ সুলতানউদ্দিন আহমেদ। বর্তমানে তিনি ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের’ সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ গৃহকর্মীদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গৃহকর্মীদের অবস্থা খুব একটা ভালো নেই। নির্যাতন বাড়ছে। মামলা হলেও আপসের নামে হারিয়ে যাচ্ছে। নির্যাতনকারীদের বিচার হচ্ছে না। গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালার বাস্তবায়ন করে আমাদের দ্রুত এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা দরকার।
/এমএনএইচ/আপ- এপিএইচ/