X
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ভবিষ্যৎ অন্ধকার কইরা গেলো কারখানার আগুনে!

জাকিয়া আহমেদ
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ০৭:৫২আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৬:১১

বোন ও স্ত্রীসহ রোকন ‘তার মতো মানুষ হয় না। কখনও কাউকে একটা ধমক দিয়ে পর্যন্ত কথা বলতেন না। ২০০৮ সালের আগস্টে আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমার মনে পড়ে না, গত ১২ বছরে কোনোদিন তিনি আমাকে ধমক দিয়ে কথা বলেছেন। আমার সব কিছু ছিল ‘পারফেক্ট’! সবকিছু ঠিক থাকার পরেও যদি সুখ কাইরা নেওয়া হয়, এ কষ্ট বোঝানো যায় না।’ টাম্পাকো ফয়েলস কারখানার দুর্ঘটনায় আহত স্বামী মীর শিপনের পাশে বসে কথাগুলো বলেন তার স্ত্রী আবিদা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘কারখানার আগুন আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিয়ে গেল।'

শুধু আবিদাই নন, অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন টাম্পাকো ফয়েলস কারাখানায় দুর্ঘটনায় আহত সব রোগীর স্বজনরা। কারাখানার মেশিন অপারেটর জাহাঙ্গীর মৃধা, মোহাম্মদ আনিমুল হক রিজু, লাইনম্যান আনোয়ার আলম, ইকবাল হোসেনসহ প্রত্যেকের স্বজনরাই বলছেন, কারখানার আগুন তাদের পরিবারগুলোকে এক অনিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের এভাবে আর কতোদিন হাসপাতালে থাকতে হবে, তাও জানেন না তারা। শুক্রবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে টাম্পাকো ট্র্যাজেডিতে আহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল। মীর শিপন কাজ করতেন টাম্পাকো ফয়েলস কারখানার প্রিন্টিং বিভাগে। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।


মীর শিপন আবিদা জানান, ঘটনার দিন সকালের শিফটে কাজ করার কথা ছিল শিপনের। দুর্ঘটনার পর অফিসের বাইরে থেকে কেউ একজন ফোন করে স্বামীর আহত হওয়ার কথা জানান তাকে।
আবিদা সুলতানা বলেন,‘এখনও শিপনের পুরোপুরি জ্ঞান ফেরেনি। মনে করতে পারছেন না সবকিছু। আমার তো টাকা-পয়সার দরকার নেই! মানুষটা সুস্থ থাকলে সারাজীবন আমাকে দেখতো। বাচ্চাটাকে দেখতো!’ তিনি বলেন, ‘সংসারে একমাত্র তিনিই উপার্জন করতেন। মানুষ আর কতো টাকা দেবে, সেই টাকায় কি আমরা তিনটা মানুষ সারাজীবন চলতে পারবো! আমাদের ভবিষ্যত এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে।’
আবিদা সুলতানা বলেন,‘স্বামী অল্প টাকা আয় করতো। তা দিয়েই ডালভাত খেয়ে ভালো ছিলাম, সুখে ছিলাম। ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছিলাম। আমি কারও সাহায্য চাই না। আমার স্বামী সুস্থ হোক, এইটুকুই চাই। আমি তো ভিখারি না। কারও সাহায্য নিয়ে চলতেও চাই না।’
‘এখানে যতদিন আছি, সরকার চিকিৎসা করাবে। কিন্তু এরপরে কী হবে? তাকে ভালো চিকিৎসা দিতে হবে। বড় ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ভালো খাবার খাওয়াতে হবে। ছেলেটার পড়াশোনা, সব কিছু মিলিয়ে কীভাবে সম্ভব হবে এসব। বলতে পারেন আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার অন্ধকার কইরা গেল কারখানার আগুনে।’ বলেন আবিদা সুলতানা।
স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে আবিদা সুলতানা বলেন, ‘স্বামী, সংসার আর সন্তান নিয়েই আমার সুখের পৃথিবী ছিল। স্বামী আমারে আগলে রেখেছিল এতদিন। কিন্তু আজ পরিস্থিতি আমাকে এমন জায়গায় দাঁড় করিয়েছে, যে আমি কোনোদিন ঘরের বাইরে পা রাখিনি, সেই আমি গত শনিবার থেকে ঘরের বাইরে। শ্বশুর বাড়ির সবাই নিজেদের মতো করে ভালো আছেন। কিন্তু তিন জনের একটা পরিবারকে চালানোর মতো সম্পদ কারও নেই। তাহলে কী হবে আমাদের। আমরা বেশ ভালোই ছিলাম। কোরবানির গরু কেনা হয়েছিল। রবিবারে বাড়ি যাবার কথা ছিল। কিন্তু বাড়ি না গিয়ে আমাদের ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের বিছানায়।’
তিনি বলেন, ‘একমাত্র ছেলে মীর তানভীর হাসানকে এতদিন বাবাকে দেখাইনি’ জানিয়ে আবিদা বলেন, ‘কাল ছেলেকে প্রথম এখানে নিয়ে এসেছিলাম। ওর বাবার এই চেহারা ছেলেকে দেখাতে চাইনি। ওর বাবার এই অবস্থা ছেলে সহ্য করতে পারবে না। গতকাল বাবাকে দেখে সে অসুস্থ হয়ে গেছে।’
টাম্পাকো কারখানায় আহতদের স্বজনদের সবারই ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় পড়েছে আবিদার মতো। শিপনের পাশের বেডে শুয়ে আছেন মো. রোকন। দুই ছেলের বাবা রোকন ওই কারখানায় ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করতেন। মাথায় আঘাত পেয়েছেন তিনি। ৪০টি সেলাই দেওয়া হয়েছে। বড় বোনের সঙ্গে টঙ্গীতেই থাকতেন রোকন। রোকনের বোন রুনা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘ওরে নিয়া যখন হাসপাতালে আসি, তখন খালিহাত দুইডা ধইরা কইছিল, ‘আফা, আমার ছেলে দুইডারে শুধু দেখবেন।’ এখন আমাদের কী হবে? ভাইয়ের সুস্থ হতে কতদিন সময় লাগবে জানি না। তারপর চাকরি দেবে কে? ওর ছেলেরা কী খাবে, সেটাই এখন বড় চিন্তা। আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার করে গেল কারখানার আগুনে।’’
একইভাবে নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন আমিনুল হকের বোন লিমা আক্তার। তিনি বলেন,‘কোম্পানিতে আগুন লাগার খবর শুনেই ভাইকে ফোন দেই।ফোন বন্ধ পেয়ে পাগলের মতো ছুটে আসি সিলেট থেকে ঢাকায়। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে এই ভাইটি আমাদের সব। কতোদিন হয়ে গেল, সামান্য একটু তাকান, কথা বলতে পারেন না। চিনতেও পারছেন না।আমাদের এখন কী হবে।’ কান্নায় ভেঙে পড়েন লিমা আক্তার।তিনি বলেন, ‘এ কেমন আগুন, আমাদের সব শেষ করে দিয়ে গেল।’
উল্লেখ্য,১০ সেপ্টেম্বর (শনিবার) ভোর ছয়টা পাঁচ মিনিটের দিকে গাজীপুরের টঙ্গীর টাম্পাকো প্যাকেজিং কারখানার পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে কারখানায় আগুন ধরে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। সেখানে শ্রমিকেরা রাতের শিফটে কাজ করছিলেন। বিস্ফোরণের পর ভবনটি আংশিক ধসে পড়ে। শনিবার পর্যন্ত এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ জন।
/জেএ/এবি/ এপিএইচ/

আরও পড়ুন
কাজ চান টাম্পাকোর শ্রমিকেরা

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তাপমাত্রা কমেছে ঢাকায়, সোমবার পর্যন্ত ঝড়-বৃষ্টি থাকতে পারে
তাপমাত্রা কমেছে ঢাকায়, সোমবার পর্যন্ত ঝড়-বৃষ্টি থাকতে পারে
সোমবার রাঙামাটিতে আধাবেলা অবরোধ
সোমবার রাঙামাটিতে আধাবেলা অবরোধ
ইতিহাস গড়ে বুন্দেসলিগা শেষ করলো ‘ইনভিন্সিবল’ লেভারকুসেন
ইতিহাস গড়ে বুন্দেসলিগা শেষ করলো ‘ইনভিন্সিবল’ লেভারকুসেন
জলবায়ু পরিবর্তন: ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে বাংলাদেশে
জলবায়ু পরিবর্তন: ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে বাংলাদেশে
সর্বাধিক পঠিত
মামুনুল হক ডিবিতে
মামুনুল হক ডিবিতে
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
যাত্রীর জামাকাপড় পুড়িয়ে পাওয়া গেলো সাড়ে চার কোটি টাকার স্বর্ণ
যাত্রীর জামাকাপড় পুড়িয়ে পাওয়া গেলো সাড়ে চার কোটি টাকার স্বর্ণ
সুপ্রিম কোর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্থান পরিদর্শন প্রধান বিচারপতির
সুপ্রিম কোর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্থান পরিদর্শন প্রধান বিচারপতির
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি