X
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কি এমএ রব?

ওমর ফারুক
১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ২২:৫৩আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:৩৫

মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বীর উত্তম এম এ রব লেখা নামফলক মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কে ছিলেন? দলিল-দস্তাবেজে এর স্পষ্ট উত্তর ‘জেনারেল এমএজি ওসমানী’। কিন্তু কেউ যদি হঠাৎই বলে বসেন, মুক্তিবাহিনীর ‘প্রথম প্রধান সেনাপতি’ ছিলেন জেনারেল এমএ রব, তাহলে কী হবে? উত্তরটা সবাইকে চমকে দেবে নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, রাজধানীর ধানমণ্ডির একটি সড়কে এমন বিভ্রান্তিকর তথ্যসংবলিত নামফলক স্থাপন করেছে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন। ফলক স্থাপনের পর কেটে গেছে দীর্ঘ আট বছর। অথচ আজও এই ভুল সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ঝিগাতলার কাছে বিজিবি (সাবেক বিডিআর) গেইটের সামনে সড়ক ডিভাইডারে ‘বীর উত্তম এমএ রব সড়ক’ লেখা পাথরের নামফলক স্থাপন করেছে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন। এই নামফলকে তারিখ লেখা হয়েছে ৮ চৈত্র ১৪১১/২২ মার্চ ২০০৫। নাম ফলকটিতে মেজর জেনারেল (অব.) এমএ রবকে মহান মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রধান সেনাপতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই নামফলকের পাশে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নামে উত্তরমুখী একটি ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। ম্যুরালের ওপরের দিকে এমএ রবের ছবি ও ছবির নিচে তার পরিচিতি লেখা। এই লেখার একাংশ হুবহু তুলে ধরা হলো: ‘১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে পাক সেনাবাহিনীর বাঙালি বিদ্রোহী সামরিক অফিসাররা এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে জেনারেল এমএ রবকে মুক্তিবাহিনীর সহ-সর্বাধিনায়ক মনোনীত করেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ভারতের মাটিতে প্রবাসী সরকার গঠিত হলে জেনারেল এমএ রবকে মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রূপরেখা প্রণীত হয়। ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই কলকাতায় বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দফতরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে জেনারেল এমএ রবকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ রব মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম প্রধান সেনাপতি। মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে বুলেটবিদ্ধ হয়ে তিনি পঙ্গুত্ব বরণ করেন। স্বাধীনতার পর এমএ রব জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৪ নভেম্বর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন।’

বিজিবির সদর দফতরের সামনে বীর উত্তম এমএ রব সড়ক

ম্যুরাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের সৌজন্যে ( অর্থায়নে) ম্যুরাল তৈরির সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিল ‘অ্যাড ল্যান্ড’ নামের একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ ২০০৮ সালের অক্টোবরে এই ম্যুরালের উদ্বোধন করেন। ম্যুরাল-শিল্পী ছিলেন হাফিজ উদ্দিন বাবু।

মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি নিয়ে এই বিভ্রান্তিকর তথ্য কিভাবে এলো? আর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহর মতো একজন মুক্তিযোদ্ধাই বা কী করে এই বিভ্রান্তিকর তথ্যসংবলিত ম্যুরাল উদ্বোধন করলেন? এ নিয়ে অনুসন্ধান করেন এ প্রতিবেদক।

মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ মঙ্গলবার সকালে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি ছিলেন জেনারেল ওসমানী। ম্যুরালে যদি এমএ রবকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে লেখা হয়, তাহলে ভুল হয়েছে। এই ভুল সংশোধন করা দরকার।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি উদ্বোধনের আগেই ম্যুরালটি তৈরি করা হয়েছিল। সিটি করপোরেশনের আমন্ত্রণে আমি শুধু উদ্বোধন করেছি। ব্যস্ত সড়কের অনুষ্ঠান, তাই পড়া হয়নি।’

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কর্মকর্তা ড. এম হাসান সোমবার সন্ধ্যায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এমএ রব কখনোই মুক্তিবাহিনীর প্রধান ছিলেন না। সিটি করপোরেশন ভুল লিখেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমএ রব আমাদের কাছে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল হিসেবে পরিচিত ছিলেন, জেনারেল হয়েছেন পরে।’ তিনি বলেন, ‘আমি একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন অস্ত্র ধরি, তখন ওনারা (এমএ রব) যুদ্ধে যোগ দেননি। যুদ্ধ করতে করতে আমরা সিলেটের হবিগঞ্জে যাই। এপ্রিল মাসের চার তারিখে সেখানে একটি মিটিং হয়। ওই মিটিংয়ে এমএ রব যোগ দেন এবং সেখানে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন এমএজি ওসমানী। পরে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে বিষয়টি এন্ডোর্স করা হয়। ওসমানীও তখন ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। পরে তিনিও জেনারেল হন। এমএ রব ছিলেন ওসমানীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ। ওসমানীর ক্যারিয়ার অনেক উজ্বল এবং তিনি সিনিয়রও। এমএ রব কখনও সেনাপ্রধান ছিলেন না।’

অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ নামে দ্বিখণ্ডিত করার পর ধানমণ্ডি এলাকাটি পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অধীনে। তাই এমএ রব সড়কের নামকরণ নিয়ে কথা হয় ডিএসসিসির নগরপরিকল্পনা শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে।

পরিকল্পনা শাখা থেকে জানা গেছে, সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার আমলে ২০০৬ সালের ২২ মার্চ (৮ চৈত্র ১৪১২) নগরভবনে অনুষ্ঠিত অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের অষ্টম সাধারণ সভায় ১২ নম্বর কার্যসূচি অনুযায়ী সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) গেট পর্যন্ত ধানমণ্ডি ২ নম্বর সড়ককে ‘বীরউত্তম এমএ রব সড়ক’ নামকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে এমএ রবের নাম সিটি করপোরেশন কিভাবে পেলো, জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নগরপরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম রবিবার দুপুরে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তখন এ শাখার দায়িত্বে আমি ছিলাম না। তবে এটুকু বলা যায়, সিটি করপোরেশন শুধু ধানমণ্ডির ওই সড়কটির নামকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ম্যুরাল ও নামফলক তৈরি করেছে একটি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান। তারা কিসের ভিত্তিতে এমএ রবকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে উল্লেখ করলো তা আমার জানা নেই। তবে ভুল হলে নিশ্চয়ই সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘অ্যাড ল্যান্ড নামের যে বিজ্ঞাপনী সংস্থাটি ম্যুরাল নির্মাণ করেছে তার পরিচয় তিনি জানেন না। তবে পাথরের নামফলকে লেখা তারিখটি ভুলবশত হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। কারণ সিটি করপোরেশন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই নামফলক ও ম্যুরাল স্থাপন করার কথা।’

বীর উত্তম এম এ রব সড়কের নাম ফলক

অ্যাড ল্যান্ডের পরিচয় জানতে রবিবার এ প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন বিজ্ঞাপন ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ বিলবোর্ড অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানের সঙ্গে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘অ্যাড ল্যান্ড নামের কোনও বিজ্ঞাপনী সংস্থার নাম আমি জানি না।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর ধরে সিটি করপোরেশনে ভুঁইফোড় বিজ্ঞাপন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য চলে। বিভিন্ন নামে তারা বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান খুলে সিটি করপোরেশন থেকে ফায়দা লুটে। ফায়দা লোটার পর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অ্যাড ল্যান্ড নামের প্রতিষ্ঠানটি তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান হতে পারে।’

উল্লেখ্য, জেনারেল এমএজি ওসমানী (মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী) সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওসমানী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। ১১ এপ্রিল (১৯৭১) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষণ দেন৷ ওই ভাষণে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবকাঠামো গঠনের কথা উল্লেখ করে এমএজি ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন৷ ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি ও সরকার গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার, ওসমানীকে করা হয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি।’

এমএ রবের জীবনীতে উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ‘২৭ মার্চ সিলেটের রশীদপুর চা-বাগান এলাকার শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, শেরপুর-সাদিপুর, সিলেটসহ আরও কয়েক স্থানে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে এমএ রব সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তার প্রত্যক্ষ পরামর্শ ও পরিচালনায়ই বেশির ভাগ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ সময় হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় প্রতিরোধ যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক দলনেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠক আয়োজনে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ক্রমে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে উঠতে থাকে। এরপর মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন এমএজি ওসমানী। তার অধীনে চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পান মোহাম্মদ আবদুর রব। তিনি পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার সদর দফতর ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়।’

/এমএনএইচ/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তাপমাত্রা কমেছে ঢাকায়, সোমবার পর্যন্ত ঝড়-বৃষ্টি থাকতে পারে
তাপমাত্রা কমেছে ঢাকায়, সোমবার পর্যন্ত ঝড়-বৃষ্টি থাকতে পারে
সোমবার রাঙামাটিতে আধাবেলা অবরোধ
সোমবার রাঙামাটিতে আধাবেলা অবরোধ
ইতিহাস গড়ে বুন্দেসলিগা শেষ করলো ‘ইনভিন্সিবল’ লেভারকুসেন
ইতিহাস গড়ে বুন্দেসলিগা শেষ করলো ‘ইনভিন্সিবল’ লেভারকুসেন
জলবায়ু পরিবর্তন: ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে বাংলাদেশে
জলবায়ু পরিবর্তন: ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে বাংলাদেশে
সর্বাধিক পঠিত
মামুনুল হক ডিবিতে
মামুনুল হক ডিবিতে
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
যাত্রীর জামাকাপড় পুড়িয়ে পাওয়া গেলো সাড়ে চার কোটি টাকার স্বর্ণ
যাত্রীর জামাকাপড় পুড়িয়ে পাওয়া গেলো সাড়ে চার কোটি টাকার স্বর্ণ
সুপ্রিম কোর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্থান পরিদর্শন প্রধান বিচারপতির
সুপ্রিম কোর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্থান পরিদর্শন প্রধান বিচারপতির
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি