গণপরিবহনে সিটিং-গেটলক সার্ভিস ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে রবিবার সকাল থেকে অভিযানে নেমেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান এড়াতে সড়কে বাস চালানো বন্ধ রেখেছেন অনেক বাস মালিক। এ কারণে সকাল থেকে রাজধানীতে গণপরিবহন সংকট দেখা দেয়। আর এতে বিপাকে পড়েছেন কর্মজীবীরা। তবে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন কর্মজীবী নারীরা। তারা বলছেন, গণপরিবহনে সেবার মান বাড়ানোর উদ্যোগ না নিয়ে হঠাৎ করে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়ায় এই জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারের ঘোষণায় রাজধানীতে রবিবার থেকে বন্ধ করা হয়েছে গণপরিবহনে সিটিং ও গেটলক সার্ভিস। বিষয়টি গাড়িচালক ও মালিকরা ঠিকমতো মানছেন কিনা, গাড়ির ফিটনেস আছে কিনা, তা দেখতে নগরীর পাঁচটি জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে।
রাজধানীর মিরপুর ১ থেকে বাসে চড়ে নিয়মিত অফিসে যাতায়াত করেন সায়মা রহমান। নিউভিশন নামের মতিঝিলগামী বাসে চড়ে বাংলামোটরে নেমে অফিসে যান তিনি। সায়মা রহমান বলেন, ‘আজ এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোনও বাসে উঠতে পারিনি। অথচ প্রতিদিন নির্দিষ্ট লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে ওঠানোর নিশ্চয়তা ছিল। বাসে উঠে ভিড়ে ঠেলাঠেলির যন্ত্রণা ছিল না। কিন্তু আজ বাসে ওঠার জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে।’
সায়মা রহমান বলেন, ‘নিউভিশন নামের মতিঝিলগামী বাসগুলো মিরপুর থেকে কাওরানবাজার, এরপর কাওরানবাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রত্যেকবার নতুন করে পর্যন্ত নির্দিষ্ট ভাড়া রাখে। বাংলামোটর নামলেও কাওরানবাজার থেকে মতিঝিলের ভাড়া দিতে হয়। তবু একটা শান্তি ছিল যে, নির্দিষ্ট লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে ওঠার নিশ্চয়তা ছিল। বাসে সিট পাওয়া যেত, ভিড়ের যন্ত্রণা ছিল না।’
অতিরিক্তি ভাড়া প্রসঙ্গে মো. রিপন বলেন, ‘যাত্রীরা একটু স্বাচ্ছন্দ্যে যাওয়ার জন্য সিএনজিতেও ওঠেন। ঠিক একই রকমভাবে বাসেও ওঠেন, যাত্রীদের সিটিং সার্ভিস নিয়ে কোনও অভিযোগ আমরা পাইনি। খুব বেশি যে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হয় তা কিন্তু নয়, কয়েকটি স্টপিজে হয়ত দুই থেকে তিন টাকা বেশি থাকতে পারে।’
জিনিয়া আহমেদ বাসে চড়ে নিয়মিত মালিবাগ-সাভার রুটে আসা-যাওয়া করেন। তিনি বলেন, ‘সিটিং সার্ভিসের মান বাড়োনোর জরুরি, বন্ধ করা নয়। অনেক সিটিং বাসের সিট ভালো নয়, সেদিকে নজর না দিয়ে বন্ধ করে সমাধান হতে পারে না।’
কাওরানবাজারে কথা হয় বাসযাত্রী আফরোজা খানমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সব ধরনের বাস সার্ভিস থাকা উচিত। যে যেমন সুবিধা দেবে, সেটা বিবেচনা করে যাত্রীরা চড়বে। বাসের ধরন হওয়া উচিত পয়েন্ট টু পয়েন্ট, স্টপেজ ভিত্তিক। কিন্তু যে ধরনের হোক না কেন, সিটির অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া উচিত নয়, সিটিং সার্ভিস অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বস্তি দেয়। গণপরিবহনকে মানসম্মত করতে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘কর্মজীবীদের জন্য অফিস সময়ে সরাসরি বাস সার্ভিস দরকার। যানজটের এই শহরে অফিসে সময়ে সব স্টপেজে বাস থেমে থেমে গেলে কতটা সময় নষ্ট হবে, সেটা বিবেচনা জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘আমার পরিচিত অনেক নারী আছেন যারা গাজিপুর থেকে বাসে চড়েও অফিস করেন। এখন সব স্টপেজে থেমে থেমে বাস চললে কী অবস্থা হবে?’
অভিযান প্রসঙ্গে বিআরটিএ-এর ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম জানান, ‘সকাল ৮টা থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু হয়েছে। মামলার বেশিরভাগই সিটিং সার্ভিস ও গেটলক সংক্রান্ত। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ এর ৩৯ ও ৪০ ধারা অনুযায়ী অতিরিক্ত ভাড়া গ্রহণ করায় মামলা করা হচ্ছে। মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী ঢাকায় কোনও সিটিং সার্ভিস অথবা গেটলক বা বিরতিহীন বলতে কিছু থাকবে না।’
ঠিকানা এক্সপ্রেস নামের একটি বাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রিপন বলেন, ‘আমাদের ঠিকানা নামের বাসটি সাভারেরর কালামপুর থেকে গাবতলী, নিউমাকের্ট হয়ে সাইনবোর্ড পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করে। কয়েকটি নির্দিষ্ট স্টপিজে থেকে যাত্রী উঠানো হতো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিআরটিএ-এর নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী ভাড়া নেওয়া হয়। তবে সিটিং সাভির্স থাকায় নির্দিষ্ট স্টপিজের মধ্যে ভাড়া একই রকম ছিল। যেমন গাবতলী থেকে আসাদ গেট পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট ভাড়া এর মধ্যে যেখানেই যাত্রী নামুক না কেন একই ভাড়া। দ্রুত ও ভিড় ছাড়া একটু স্বাচ্ছন্দ্যে যাওয়ার জন্য যাত্রীদেরও তেমন কোনও আপত্তি নেই।’
রাজধানীর তেজগাঁওস্থ সাতরাস্তার মোড়ে অভিযান পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এই সময় ‘সিটিং’ সার্ভিস বন্ধের ফলে যাত্রী হয়রানির আশঙ্কা আছে কিনা’—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সবাই নিয়মের মধ্যে এলে কোনও সমস্যাই হবে না। যাত্রীদের ভোগান্তি রোধেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। মানুষের ভোগান্তি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাজ করব।’
ছবি: নাসিরুল ইসলাম
/এমএনএইচ/